Mythology

মা গঙ্গারও মাসিক হয় একমাস ব্যবহার করা যায় না গঙ্গাজল

গঙ্গাজল তখন সাধারণ জলেরই মতো। তবে এই মাসের গঙ্গাজলে দেবদেবীর পুজো নিষিদ্ধ।

১৯৮০ সালের কথা। আগ্রা থেকে রাজস্থান হয়ে যাব দ্বারকা সোমনাথ। এখনও ট্রেনের সময় হয়নি। আগ্রাফোর্ট স্টেশন। সময় কাটাতে লম্বা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে গিয়ে নজর পড়ল এক সাধুবাবার উপর। বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছেন পরম নিশ্চিন্তে। লম্বা একখানা লাঠি রয়েছে দু-হাঁটুর ফাঁকে। পাশেই জবুথবু করে গায়ের সঙ্গে লাগানো আছে ছোট ঝুলিটা। আর কিছু নেই।

সাধুবাবার পরনে গেরুয়া নয়, সাদা একখানা কাপড়। ময়লা হতে হতে সাদা ভাবটা আর নেই। ময়লা রঙটা সৃষ্টি করেছে আর একটা রঙের। গায়ে ফতুয়া একটা, তার দশাও ওই কাপড়ের মতো। গাল ভর্তি পাকা দাড়ি। মাথাটা বেঞ্চে হেলান দেয়া তাই মুখখানা হয়ে আছে উপরমুখো। ভাঙা গালের জন্য নাকটাও বেশ উঁচিয়ে আছে উপর দিকে। বেঞ্চের মাঝে নয়, এক কোণে বসে আছেন সাধুবাবা। বয়েসে বৃদ্ধ। ৭০-৭৫-এর কম হবে বলে মনে হল না। চওড়া কপাল। সামনের দিকটার চুল বেশ কিছুটা উঠে যাওয়ায় কপালটা যেন আরও চওড়া হয়ে গেছে। মাথায় জটা-টটা কিছু নেই, আছে মাঝারি লম্বা চুল। দীর্ঘকাল তেল না পড়লে চুলের রঙটা যেমন হয়, তেমনই খয়েরি সাদাটে ভাব। কপালে গোপীচন্দনের তিলক। বৈষ্ণবসাধু বলেই মনে হল। আবার গলায় দেখছি রুদ্রাক্ষের মালা। ঘুমচ্ছেন বিভোর হয়ে।

একেবারে কাছে দাঁড়িয়েই এসব দেখছি। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু কাশলাম। ঘুম ভাঙল সাধুবাবার। দাঁড়িয়ে না থেকে পাশেই বসলাম। এবার সরাসরি পায়ে হাত দিতেই একটু চমকে উঠলেন। ঘুম ভেঙে গেল। দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন। বসলেন সোজা হয়ে। কথা শুরু করলাম আমি। অনেক অ-নে-ক কথা হল। কথা প্রসঙ্গে এক সময় জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এখনকার কথা বলছি না, বলছি অনেক আগের কথা, গৃহত্যাগের পরের কথা, যখন এলেন এ পথে তখনকার কথা। প্রথম প্রথম জীবনের বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত মা বাবার কথা তো নিশ্চয়ই মনে পড়তো। তখন মন খারাপ হলে কি করতেন? কেমন করে কাটাতেন তাৎক্ষণিক মন খারাপের সময়টুকু, অনুগ্রহ করে বলবেন বাবা!

কথাটা শোনামাত্র ‘ছ্যাঁত করে’ কেমন যেন হয়ে গেল হিন্দিভাষী সাধুবাবার মুখখানা। ‘কেমন যেন’ ভাবটা দেখলাম মুহুর্তমাত্র। পরেই ফিরে এলেন আগের ভাবে। বললেন,

– হাঁ বেটা, তখন তো আমি ছেলেমানুষ। প্রথম অবস্থায় মন খারাপ তো হতোই তবে তা স্থায়ী হতো না। গৃহত্যাগ করলেও মা বাবার স্পর্শ আমি খুব সহজে অনুভব করতাম। আনন্দে মনটা ভরে উঠত। মুহুর্তে দূর হত মনের কষ্ট। কেমন করে জানিস?

এই মুহুর্তে দেখছি চোখ দুটো জলে ভরে উঠল সাধুবাবার। আমার চোখে চোখ না রেখে নামিয়ে নিলেন। একটু সামলে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, মন খারাপ হলে কাঁদতাম। মনের দরজা খুলেই কাঁদতাম। চোখ থেকে বেরনো অশ্রুধারা মিশিয়ে দিতাম গঙ্গার জলধারায়।

আমি গঙ্গাজল স্পর্শমাত্র স্পর্শ পেতাম বাবা মায়ের। কারণ তাঁরা তো এই জল দিয়েই নিত্য পুজো করতেন। সুতরাং তাঁরাও আমার স্পর্শ পেতেন আমারই মতো, যেমন আমি পেতাম। আমরা উভয়ে একে অপরকে ছেড়ে বহুদূরে থাকলেও আমাদের যোগাযোগটা অটুট ছিল ওই ‘গঙ্গামাঈ’-এর দৌলতে। অতএব বেটা বলতে পারিস আমি সংসার ছাড়লেও আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকিনি কখনও।

এবার ভাবাবেগে ডুকরে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ সাধুবাবা। আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, গঙ্গা – এ এমনই এক আশ্চর্য নদী, প্রিয়জনের মৃত্যুতেও কোনওদিন বিচ্ছেদ হতে দেয় না প্রিয়জনের সঙ্গে। মৃত্যুর পর ভস্ম নাভি সবই তো গচ্ছিত রাখি ‘গঙ্গামাঈ’-এর কাছে। গঙ্গা স্পর্শ করলে তো প্রিয়জনেরই স্পর্শ পাওয়া যায়। বেটা যে দেশে গঙ্গা বয়ে চলেছে, সে দেশের মানুষের কিসের শোক, দুঃখই বা কিসের? বেটা, আট বছর বয়েসে গৃহত্যাগের পর মায়ের জন্য মন খারাপ হলে গঙ্গামাঈই মনটা ভরিয়ে দিত এক জাগতিক আনন্দে। সাধু হতে পারি, মাকে কি কখনও ভোলা যায়?

সাধুবাবা এমন এক অপূর্ব দৃষ্টিকোণ থেকে গঙ্গাকে দেখেছেন যা ভুল করেও ভাবিনি কখনও। অন্তরের অবস্থানটা কোন পর্যায় পৌঁছলে তবেই এমন এক অনুভূতি শক্তির সৃষ্টি হয়, এই ভেবে বিস্মিত হয়ে গেলাম। একটা কথাও সরলো না মুখ থেকে। সাধুবাবার কথায় বুঝলাম, এর নাম গঙ্গা। আনন্দে প্রণাম করলাম দু-পায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে। তাঁর ঝরে পড়া চোখের জল মুছে হাতটা মাথায় ঠেকালেন সাধুবাবা।

পুরাণের কথায় গঙ্গার সংক্ষিপ্ত জীবনকথা। গঙ্গার জন্ম হয় বিষ্ণুর দেহ থেকে। তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী। বিষ্ণুর তিন স্ত্রী যথাক্রমে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা। একসময় গঙ্গার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন বিষ্ণু। এতে লক্ষ্মী বিষ্ণুকে ক্ষমা করলেও সহ্য করতে অক্ষম হন সরস্বতী। ফলে বিরোধ ও কলহের সৃষ্টি হয় গঙ্গা ও সরস্বতীর মধ্যে। তখন সরস্বতী অভিশাপ দিলেন গঙ্গাকে, ‘তুমি নদীরূপে পরিণত হও।’ শাপগ্রস্ত গঙ্গাও ওই একই অভিশাপ দিলেন সরস্বতীকে। বিষ্ণুর দুই স্ত্রী নদীরূপে পরিণত হয়ে প্রবাহিত হলেন মর্তলোকে।

Ganga Mahatmya
ফাইল : প্রয়াগের সঙ্গমে পুণ্যস্নান, নিজস্ব চিত্র

একবার গঙ্গা প্রেমাভিলাষিণী হন শ্রীকৃষ্ণের। শ্রীকৃষ্ণ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন গঙ্গার প্রেমে। এ ঘটনা নজর এড়াল না রাধারানীর। রেগে ফায়ার হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তিরস্কার তো করলেনই, গণ্ডূষে পান করতে উদ্যত হলেন গঙ্গাকে। প্রেমের ব্যাপারটা চাউর হতেই গঙ্গা আশ্রয় নিলেন শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে। এতে সারা পৃথিবী জলশূন্য হবার উপক্রম হল। দেবতারা শরণাপন্ন হলেন কৃষ্ণের। তখন কৃষ্ণ তাঁর নখাগ্র থেকে নিষ্ক্রান্ত করে দিলেন গঙ্গাকে। সেই থেকে গঙ্গার নাম হল বিষ্ণুপদী। পরে ব্রহ্মার অনুরোধে প্রেমিকা রাধাকে সাইডে গ্যারেজ করে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন গঙ্গাকে। এ সব কথা ও কাহিনী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের।

একবার গঙ্গা হ্লাদিনী, পাবনী, নলিনী, সুচক্ষু, সীতা, সিন্ধু ও রাজা ভগীরথের পিছনে একটি স্রোত, এই সাতটি স্রোত ধারায় প্রবাহিত হতে থাকেন। গঙ্গার গতিপথে পড়ল জহ্নুমুনির আশ্রম। আশ্রম ও যজ্ঞের সমস্ত উপকরণাদি ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন গঙ্গা। এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ জহ্নু গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেললেন। তখন দেবতারা তপস্যা করে সন্তুষ্ট করলেন মুনিবরকে। প্রীত জহ্নু কন্যারূপে কান থেকে মুক্ত করলেন গঙ্গাকে। সেই থেকে গঙ্গা ত্রিলোকে খ্যাত হলেন জহ্নুমুনির কন্যা জাহ্নবী নামে।

স্বর্গ মর্ত ও পাতাল, এই তিন পথে প্রবাহিত বলে গঙ্গার অপর নাম ত্রিপথগা। ব্রহ্মার বরে রাজা ভগীরথের জ্যেষ্ঠা দুহিতা গঙ্গা। তাই গঙ্গার আর এক নাম ভাগীরথী।

গঙ্গা কুরুরাজ শান্তনুর স্ত্রী। দেবব্রত ভীষ্মের মাতা। একবার মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে ভব ধ্রুব সোম বিষ্ণু অনিল অনল প্রত্যুষ ও প্রভব, গঙ্গা থেকে উৎপন্ন এই অষ্টবসু তথা আট গণদেবতার পক্ষে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে উঠল। তখন তাঁরা জন্ম ও মুক্তির জন্য প্রার্থনা করলেন গঙ্গার শরণাপন্ন হয়ে।

অষ্টবসুর এই প্রার্থনা পূরণ করবার জন্য গঙ্গা এক অপরূপা নারীমূর্তি ধারণ করে আকৃষ্ট করলেন রাজা শান্তনুকে। তাঁর অনুনয়ে এক শর্তাধীনে গঙ্গা পতিত্বে বরণ করলেন শান্তনুকে। শর্ত ছিল, গঙ্গার কোনও কাজে রাজা বাধা দিলে সেই মুহুর্তে গঙ্গা বিদায় নেবেন তাঁর কাছ থেকে।

এই শর্তে গঙ্গা শান্তনুর স্ত্রী হয়ে সাতপুত্রের জননী হন। জন্মমাত্রই প্রত্যেকটি সন্তানকে নিক্ষেপ করেন নদীগর্ভে। এই পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটি নির্বিকার চিত্তে মেনে নিলেন রাজা। এবার অষ্টম পুত্র প্রসব হতেই পুত্রের প্রাণবধে বাধা দিলেন শান্তনু। বশিষ্ঠমুনির শাপে অষ্টম পুত্ররূপে অবতীর্ণ হন অষ্টবসুর অন্যতম প্রভব।

রাজার শর্তভঙ্গের অপরাধে বিদায় নিলেন গঙ্গা। বিদায়কালে গঙ্গা তাঁর আত্মপরিচয় ও কর্মের কারণ (অষ্টবসুর শাপমুক্তি) জানালেন রাজাকে। যাওয়ার সময় রাজ-আজ্ঞায় সঙ্গে নিয়ে গেলেন নবজাত শিশুকে। কয়েক বছর পরে রাজোচিত শিক্ষা দিয়ে পুত্রকে শান্তনুর হাতে অর্পণ করলেন গঙ্গা। গঙ্গার এই পুত্রই জগতে অসাধারণ খ্যাতিলাভ করেন দেবব্রত ভীষ্ম নামে। এ কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে।

মহাভারতে বিভিন্ন তীর্থের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে রাজা যুধিষ্ঠিরকে মুনিশ্রেষ্ঠ দেবর্ষি নারদ বলেছিলেন,

“রাজা! মনোযোগী হইয়া শ্রবণ-যেমন বুদ্ধিমান ভীষ্ম পুলস্ত্যের নিকট এই সকল শ্রবণ করিয়াছিলেন।”

“মহারাজ! পূর্ব্বে ধার্ম্মিকশ্রেষ্ঠ ও মহাবীর ভীষ্ম গঙ্গাতীরে দেব, দেবর্ষি ও গন্ধর্ব্বগণসেবিত পবিত্র এবং উৎপাতশূন্য গঙ্গাদ্বারে পিতৃলোকের সেবায় ব্যাপৃত হইয়া মুনিগণের সহিত বাস করিয়াছিলেন।”

Ganga
হরিদ্বার শহরে গঙ্গানদী, নিজস্ব চিত্র

মহাভারতীয় যুগের গঙ্গাদ্বার তথা আধুনিক ভারতের হরিদ্বারের গঙ্গীতীরে ঋষিশ্রেষ্ঠ পুলস্ত্যকে মহামতি ভীষ্ম বলেছিলেন,
“ভগবান! তীর্থধর্ম্ম বিষয়ে আমার কোন কোন সন্দেহ আছে, আপনি তাহার পৃথক পৃথকভাবে সমাধান করুন, আমি তাহা শুনিতে ইচ্ছা করি….

গঙ্গার মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে নিষ্পাপ কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে পুলস্ত্য বলেছিলেন,

“মহাবাহু! ….মানুষ ব্রহ্মচারী ও একাগ্রচিত্ত হইয়া গঙ্গায় স্নান করিয়া পাপশূন্য হয় ও বাজপেয়যজ্ঞের ফললাভ করে।…

কুরুনন্দন! যেখানে সেখানে অবগাহন করা হউক না কেন, সর্বত্রই গঙ্গা কুরুক্ষেত্রের তুল্য; কিন্তু সে গঙ্গা কনখলে বিশেষতীর্থ এবং প্রয়াগ অতিমহাতীর্থ।।

মানুষ শত পাপ করিয়াও যদি গঙ্গাস্নান করে, তবে অগ্নি যেমন কাষ্ঠ দগ্ধ করে, তেমন গঙ্গাজলও তাহার সেই সমস্ত পাপ দগ্ধ করে।।

সত্যযুগে সকল তীর্থই পুণ্যজনক, ত্রেতাযুগে পুষ্কর তীর্থ পুণ্যজনক, দ্বাপরে কুরুক্ষেত্রতীর্থ পুণ্যজনক, আর কলিযুগে গঙ্গাতীর্থ পুণ্যজনক।।

পুষ্কর, কুরুক্ষেত্র, গঙ্গা এবং প্রয়াগাদি মধ্যবর্তী তীর্থে স্নান করিয়া মানুষ ঊর্ধ্বে সাত পুরুষ এবং নিম্নে সাত পুরুষকে উদ্ধার করে।।

গঙ্গার নাম করিলে তিনি পাপনাশ করেন, দেখিলে মঙ্গল প্রদান করেন এবং স্নান ও পান করিলে সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত পবিত্র করেন।।

রাজা! মানুষের যে পরিমাণ অস্থি গঙ্গাজল স্পর্শ করে, সে মানুষ ততকাল স্বর্গলোকে সম্মানিত হয়।।

স্বয়ং ব্রহ্মা এইরূপ বলেন, যে গঙ্গার সমান তীর্থ নাই, নারায়ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতা নাই এবং ব্রাহ্মণ অপেক্ষা উত্তম বর্ণ নাই।।

মহারাজ! যেখানে গঙ্গা আছেন, সেইটাই দেশ, সেইটাই তপোবন এবং গঙ্গাতীরস্থ সেই ক্ষেত্রটাকেই সিদ্ধক্ষেত্র বলিয়া জানিবে।।” (মহাভারত, বনপর্ব, সপ্ততিতমোহধ্যায়ঃ, পৃষ্ঠা ৭৯৮-৮০০)

Haridwar

মহাভারতে বিভিন্ন তীর্থকীর্তনের সময় কুলপুরোহিত নিষ্পাপ পান্ডুনন্দনকে বলেছিলেন,

‘রাজা যুধিষ্ঠির! গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও অষ্মরাগণ কর্তৃক সেবিত এবং কিরাত ও কিন্নরগণের বাসভূমি পর্ব্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয়কে বেগে ভেদ করিয়া গঙ্গা নির্গত হইয়াছেন, সেইজন্যই ব্রহ্মর্ষিগণসেবিত সেই স্থানটিকে ‘গঙ্গাদ্বার’ বলে।।

কুরুনন্দন! সনৎকুমার মুনি কনখলকেও গঙ্গাদ্বারের তুল্যই পুণ্যজনক বলেন।’…

পুরাণের কালে গঙ্গাদ্বার তথা হরিদ্বারে পিতৃতর্পণকালে মহর্ষি দত্তাত্রেয়ের হাতের কুশ ভেসে যায় গঙ্গাস্রোতে। তখন মুনিবর যোগবলে গঙ্গার ধারাকে আবর্তন করিয়ে কুশ পুনারনয়ন করান। তদবধি ঘাটটির নাম হয়েছে কুশাবর্ত।

শিবপুরাণের মতে, মহর্ষি গৌতম গঙ্গাদেবীর আদেশক্রমে গঙ্গাদ্বারের নিম্নভাগে রচনা করেন কুশাবর্ত তীর্থ। জ্ঞানসংহিতায় উল্লেখ আছে, ‘এই অনুত্তম তীর্থে স্নান করিলে মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয়।’

পদ্মপুরাণের উত্তরাখণ্ডে, মহাভারতের অনুশাসন পর্বের কথায়, ‘গঙ্গাদ্বারে, কুশাবর্তে, বিল্বকে, নীলপর্বতে ও কনখল তীর্থে গঙ্গায় স্নান করলে স্নাতা নিষ্পাপ হয়ে সুরলোকে গমন করে।’

গঙ্গার মাহাত্ম্যে অশেষ বিশ্বাস যে মহাভারতীয় যুগেও ছিল অভ্রান্ত প্রমাণ মহাভারত। খাণ্ডব বনে অগ্নিদাহের ফলে ধৃতরাষ্ট্র; কুন্তী ও গান্ধারীর মৃত্যু হলে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন গঙ্গাদ্বারে। তাঁদের ভস্ম ও অস্থি বিসর্জন দেন গঙ্গাজলে। (আশ্রমিক পর্ব, ৩৯ অধ্যায়, শ্লোক ১৪-২২।)

মহাতেজা শান্তনুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহাবলী ভীষ্ম তাঁর ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করে গঙ্গাদ্বারে। (অনুশাসন পর্ব, ৮৪ অধ্যায়, শ্লোক-১১)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে গঙ্গোপাখ্যান, ৮ম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সত্যযুগে গঙ্গার জল দুধের রং, ত্রেতায় জ্যোৎস্না রং, দ্বাপরে চন্দন ও কলিতে গঙ্গাজলের রং জলের মতো। তবে গঙ্গার জলের মতো রং পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।

গরুড় পুরাণে পূর্বখণ্ডে বহুতীর্থের মাহাত্ম্য নামে একাশিটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যত তীর্থ আছে তার মধ্যে গঙ্গাই সব তীর্থের প্রধান।’

১৯৭৮ সালের মে মাসের কথা। যমুনোত্রী হয়ে চলেছি গঙ্গোত্রীর পথে। এখন তো ভৈরবঘাটি চটিতে লোহার পুল হয়েছে। বাস যাচ্ছে ফুস করে। তখন খাড়া চড়াই বেয়ে উঠতে হত ৪ কিমি।

এই চটিতে যাওয়ার পথে পথ চলছি লক্ষ্য রেখে যদি কোনও সাধুর দেখা পাওয়া যায়। তাই এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে চলছিলাম। কপালটা ভালো। এবার আর সাধু খুঁজতে হলনা। দেখলাম এক সাধুবাবাকে। আমাদের আগে আগেই চলেছেন। কাঁধে একটা বোঝা। বয়েসের ভার আর হিমালয়ের চড়াই বেশ নুইয়ে দিয়েছে তাঁকে। পরনে গেরুয়া বসন, যা বহুবার ধোয়ায় অনেকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। লালচে চুলগুলো পিঠ সব ছড়ানো তবে মেয়েদের মতো পিঠ ছাড়িয়ে নয়।

পরে দেখেছিলাম টিকালো নাক। চোখদুটো বয়েসের ধাক্কায় একবারে কোণ ঠাসা হয়ে গেছে তবে উজ্জ্বল। উচ্চতায় প্রায় আমারই মতো পৌনে ছ-ফুট। হাতের তাঁর বহু ব্যবহৃত লাঠি। গালে বড় বড় দাড়ি দেখে মনে হল কেউ এক কৌটো সাদা বার্ণিশ ঢেলে দিয়েছে। পেটের একটু উপর পর্যন্ত। পথ চলছে ধীরে ধীরে। জোরে চলার কোনও উপায়ই নেই। হিমালয়ই বটে।

Haridwar

সাধুবাবার খুব কাছাকাছি এসে ডাকলাম,

– সাধুবাবা?

একটু পিছন থেকে ডাকায় ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন। পরে বললেন,

– কহো বেটা।

এইভাবে কথা শুরু হল গিরি সম্প্রদায়ের প্রায় ৬৫ বছর বয়েসের বৃদ্ধ সাধুবাবার সঙ্গে। পথ চলতে চলতেই কথা হচ্ছে। অনেক অ-নে-ক কথা হল সাধুবাবার জীবনপ্রসঙ্গে। একসময় তাঁর গেরুয়া বসন দেখে কৌতূহল হল। দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– সাধুসন্ন্যাসীরা গেরুয়া বসন পরেন কেন? অন্য রঙের বসনও তো পরতে পারেন?

Varanasi

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝলক তাকালেন আমার দিকে। কি ভাবলেন জানি না। কথারও কোনও উত্তর দিলেন না। বেশ কিছুটা চলার পর পথের ধারে একটা বড় পাথরের চাঁই-এর উপর বসলাম। এবার বিশ্রাম নিতে নয়। প্রশ্নের উত্তর দিতে বসে সাধুবাবা বললেন,

-বাচ্চা, আমি মূর্খ মানুষ। লেখাপড়া কিছুই জানি না। তোর মতো এপ্রশ্ন আমিও একদিন করেছিলাম আমার গুরুমহারাজের কাছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন,

-‘বেটা, মোক্ষ বা মুক্তির প্রতীক হল গেরুয়া। এর মধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত অধ্যাত্মরহস্য। পাতঞ্জল যোগদর্শনে বলা হয়েছে, ‘ভুবনজ্ঞানম্ সূর্যে সংযমাত’। যোগীগণ সূর্যে সংযমন দ্বারা ভুবনজ্ঞান লাভ করেন। ভুবনজ্ঞানের প্রথম কথাই হলো সৃষ্টির জ্ঞান। সৃষ্টির জ্ঞান বলতে-সৃষ্টি কোথা থেকে হল, কিভাবে ধারণ ও লয় হবে, এসব রহস্যের সমাধান যোগীগণ সূর্য সংযমন দ্বারা লাভ করেছেন।

সূর্যোদয়ের মুহুর্তে যে রক্তাভরশ্মি সেটা চরাচর সৃষ্টি করে। অস্তাচলাগত সূর্যরশ্মি লয় করে সৃষ্টিকে। সূর্যরশ্মি বিশ্লেষণ করে যোগীগণ যোগনেত্রে দেখেছেন অস্তায়মান সূর্যরশ্মির রঙ গেরুয়া। সেইজন্যই তো বেটা, সংসারে প্রকৃত বীতরাগ সাধুসন্ন্যাসীরা গেরুয়া রঙের বস্ত্র পরিধান করেন। তাদের ভাবনা মুক্তির-সৃষ্টির নয়। ভববন্ধনের লয় চাই। গৈরিক-সৃষ্টি চাই না, এই শাশ্বত বাণী ও ভাবনার প্রতীক। গেরুয়া বস্ত্র সাধুসন্ন্যাসীগণের ভাবনাকে সৃষ্টিলয়ের ধ্যানধারণায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। বেটা, গঙ্গাজলের রঙও গৈরিক মিশ্রিত। তাই এই জলে স্নান করলে মোক্ষের প্রতীক গৈরিক দিয়ে সমস্ত দেহ অনুলিপ্ত করা হয়। যারজন্যই তো গঙ্গা মুক্তিদায়িনী এবং স্নানে ভববন্ধন লয়ের সহায়ক হয়।’

কথাপ্রসঙ্গে সেদিন সাধুবাবা আরও বলেছিলেন, মা বসুন্ধরা অর্থাৎ পৃথিবী রজঃস্বলা হন আষাঢ়মাসে অম্বুবাচী তিথিতে, গঙ্গামাঈয়া রজঃস্বলা হন ভাদ্রমাসে। ওই মাসের গঙ্গাজল তার মাহাত্ম্য বহন করেনা, তবে পুজো দিলে কোনও দোষ নেই। গঙ্গাজল তখন সাধারণ জলেরই মতো। তবে ওই মাসের গঙ্গাজলে দেবদেবীর পুজো নিষিদ্ধ। একইসঙ্গে তার মাহাত্ম্য বহন করেনা গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের জল। কেন, তার কোনও কারণ কিছু সাধুবাবা বলেননি। তখন বয়েস কম ছিল, অত কৌতূহল ছিল না অন্তরে। পরবর্তীকালে দেখেছি, সারা ভারতের অধিকাংশই প্রসিদ্ধ দেবদেবীর মন্দিরগুলি স্থাপিত গঙ্গার পূর্বপাড়ে।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া এক সাধুবাবার মুখে গঙ্গার জল আর গেরুয়া বসনের অন্তর্নিহিত অধ্যাত্মরহস্যের কথা শুনে আনন্দিত তো হলামই, বিস্ময়ের অবধি রইল না। মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম সাধুবাবাকে। কথাটা শেষ হতে শুরু করলাম হাঁটা। কিছুক্ষণ পরেই এলাম ভৈরবঘাটি। গঙ্গোত্রীর পথে এটা একটা ছোট্ট চটি। এখান থেকে আবার বাস। অপেক্ষা না করে আমরা সকলে গিয়ে বসলাম অপেক্ষমাণ বাসে সঙ্গে সাধুবাবাও। বসলাম পাশাপাশি। বাস ছাড়লে যথাসময়ে। দুজনে কথা হতে থাকল সমানে।

Varanasi

বিশেষ তিথিতে গঙ্গাস্নান মাহাত্ম্য

গঙ্গায় স্নান মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র ও একাধিক অন্যান্য পুরাণ। তন্ত্রশাস্ত্রে গঙ্গার মাহাত্ম্য কথা শিব বলেছেন পার্বতীকে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এখানে গঙ্গাস্নানের যে বিশেষ বিশেষ যোগগুলির কথা লেখা হল, সেগুলি কিন্তু প্রতিবছর হয় না। যে বছর তিথি নক্ষত্র ও বারে যোগগুলি সংগঠিত হয়, সেই বছর পঞ্জিকাতে সেই মাসে উল্লেখ থাকে।

দশহরা স্নান ফল – জ্যৈষ্ঠমাসে মঙ্গলবারে শুক্লাদশমী তিথিতে হস্তানক্ষত্র যুক্ত হইলে দশজন্মার্জিত দশবিধ পাপক্ষয় ও অযুত অশ্বমেধ যজ্ঞের শতগুণ ফল লাভ হইয়া থাকে। উক্ত যোগ ভগীরথ-দশহরা নামে প্রসিদ্ধ।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে দশবিধ পাপক্ষয় হয়ে থাকে। এজন্য উক্ত তিথিকে দশহরা বলা হয়।

বারুণী স্নান – স্কন্দপুরাণের কথায়, চৈত্রমাসে কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে শতভিষানক্ষত্র যোগ হলে সেই তিথি বারুণী নামে অভিহিত হয়। ওই তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে বহুশত সূর্যগ্রহণের জন্য গঙ্গাস্নানের ফলসম ফল লাভ হয়ে থাকে।

মহাবারুণী স্নান – উক্ত পুরাণে আরও কলা হয়েছে, চৈত্রমাসে কৃষ্ণত্রয়োদশী তিথিতে যদি শতভিষানক্ষত্র ও শনিবার যুক্ত হয় তবে মহাবারুণী হয়ে থাকে উক্ত যোগে গঙ্গাস্নান করলে কোটি সূর্যগ্রহণের জন্য ফলসম ফল প্রাপ্তি হয়ে থাকে।

চূড়ামণি যোগে স্নান – রবিবারে সূর্যগ্রহণ এবং সোমবারে চন্দ্রগ্রহণ হলে চূড়ামণি যোগ হয়। উক্ত যোগে গঙ্গাস্নান করলে অনন্ত গঙ্গাস্নানসম ফললাভ হয়ে থাকে।

গ্রহণ স্নান – গ্রহণ চলাকালীন যে স্নান, তার নাম গ্রহণস্নান। গ্রহণ শেষ হলে অর্থাৎ মোক্ষকালের স্নানকে বলে মুক্তিস্নান।

গ্রহণে স্নানফল – চন্দ্রগ্রহণস্নানে লক্ষগুণ ও সূর্যগ্রহণস্নানে দশলক্ষগুণ এবং গঙ্গাদি তীর্থস্নানে কোটিগুণ ফললাভ হয়।

মৎস্যপুরাণের কথায়, গঙ্গাসাগর-সঙ্গম-স্নানে দশ জন্মার্জিত পাপ বিনষ্ট হয়। সূর্যগ্রহণকালে সঙ্গমে স্নান করলে সহস্রজন্মকৃত পাপসমুদয় নষ্ট হয়ে থাকে।

উক্ত পুরাণ আরও জানিয়েছে, সূর্যগ্রহণকালে কনখলে (হরিদ্বার) গঙ্গা যেমন পুণ্যদায়িনী, তেমনই প্রয়াগ, পুষ্কর, গয়া এবং কুরুক্ষেত্রও পুণ্যপ্রদ।

বিশালবুদ্ধি ব্যাসদেব বলেছেন, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণে গঙ্গায় অবগাহন স্নান করলে সমস্ত তীর্থে স্নানতুল্য ফল লাভ হয়।

গোবিন্দ দ্বাদশী স্নানফল – ফাল্গুন মাসে শুক্লপক্ষের পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত যে দ্বাদশী, সেটি গোবিন্দদ্বাদশী নামে অভিহিত। এই দ্বাদশী মহাপাপ নাশিনী। উক্ত তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে মহাপাপও স্নানমাত্র বিনষ্ট হয়।

ব্রহ্মপুত্র স্নানফল – পুনর্বসুনক্ষত্র ও বৃষলগ্ন যদি চৈত্রমাসের শুক্লাষ্টমীতে যোগ হয়, তা হলে ওই যোগে ব্রহ্মপুত্রনদ স্নানে মানুষ সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সমস্ত তীর্থস্নানের ফললাভ করে থাকে। গঙ্গার মতোই পবিত্র নদ ব্রহ্মপুত্র।

নারায়ণীযোগ স্নানফল – পৌষমাসে অমাবস্যাতিথি মূলানক্ষত্রযুক্ত হলে নারায়ণীযোগ হয়। নারায়ণীযোগে করতোয়াতে স্নান করলে তিন কোটি কুল পর্যন্ত উদ্ধার হয়ে থাকে।

গঙ্গামন্ত্রোচ্চারণ ফল – শিব পার্বতীকে বলেছেন, হে সুন্দরী, যে পাপাত্মা গঙ্গাক্ষেত্রে ও গঙ্গানদীতে গঙ্গামন্ত্র উচ্চারণ করে স্নান করে, সে সমস্তরকম পাপ থেকে মুক্তিলাভ করে।

গঙ্গাক্ষেত্র মাহাত্ম্য – হে দেবী, যে ক্ষেত্রে গঙ্গানদী প্রবাহিত, সেই ক্ষেত্র থেকে এক যোজন পর্যন্ত স্থান গঙ্গাক্ষেত্র বলে অভিহিত, এতে কোনও সন্দেহ নেই। গঙ্গাসম পুণ্য আমার জ্ঞানে কিছুই নেই।

গঙ্গানাম মাহাত্ম্য – যোগিনীতন্ত্রের পূর্বখণ্ডে অষ্টাদশ পটলের কথায়, ‘হে সুরেশ্বরী, যাঁর নাম স্মরণমাত্রই পাপীরা মুক্তিভাগী হয়, সেই গঙ্গার মাহাত্ম্য আর আমি কি বলব? যে সব পাপীরা ‘গঙ্গা গঙ্গা’ এই শব্দ (নাম) উচ্চারণ করে, তাদের সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়। তারা বৈকুণ্ঠে গমন করে।

গঙ্গাজল সমাযোগে মৃত্যু ফল – গঙ্গাজল সঙ্গে আছে, এরকম অবস্থায় যে স্থানেই মৃত্যু হোক না কেন, সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে বাস হয়ে থাকে।

গঙ্গায় তর্পণ ফল – যে পুণ্যবান গঙ্গায় তর্পণ করে, তার পিতৃগণ, ঋষিগণ ও দেবগণ সত্যই শতবর্ষ পর্যন্ত মহাতৃপ্তি লাভ করে থাকেন।

শিবকে পার্বতী বলেছেন, দিবা অথবা রাত্রিকালে, সন্ধ্যা অথবা মহানিশিতে, গঙ্গায় স্নান, দান, হোম, তর্পণ ও পুজো, এসকল কাজ করবে, কালভেদ বিচার করবে না।

গঙ্গাযাত্রীর পথিমৃত্যু ফল – পাপী ব্যক্তিও গঙ্গার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে পথমধ্যে প্রাণত্যাগ করলে, বিষ্ণুলোকে গমন করে থাকে।

গঙ্গাতীরে মৃত্যু ফল – গঙ্গাতীরের ন্যায় অথবা অন্যায়পূর্বক প্রাণত্যাগকারী ব্যক্তি সর্বসম্ভারসংযুক্ত স্বর্গলোক প্রাপ্ত হয়।

গঙ্গায় মৃতাস্থিনিক্ষেপ ফল – মৃতব্যক্তির যত সংখ্যক অস্থি গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হয়, তত সংখ্যক সহস্রবর্ষ তার স্বর্গলোকে বাস হয়ে থাকে।

গঙ্গার চতুর্হস্তমধ্যে পিণ্ডদান ফল – যে ব্যক্তি সংযতচিত্তে গঙ্গাতীরে গঙ্গার চারহাতের মধ্যে পিণ্ডদান করে, সে ব্যক্তি পিতৃগণকে মুক্ত করে নিজে বিষ্ণুলোকে বাস করে থাকে।

গঙ্গার স্তোত্রকথা

হিমালয়ের বুক বেয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে আপনভাবে, আপন খেয়ালে, আপন মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করে। হিমালয় সুন্দর-চির সুন্দর, আরও সুন্দর করে তুলেছে এই অমৃতবাহী গঙ্গা। গঙ্গা এখানে আর বাংলার বুড়ি নয়। পূর্ণ যুবতী। কামিনী উন্মাদিনী। উত্তাল তরঙ্গায়িত যৌবনের গঙ্গা যেন নিজেকে হারাতে চায় বিশালে, সাগরে।

গিরিরাজের বুকে বেগবতী গঙ্গা বড় চঞ্চলা। তারপর গঙ্গা মাতৃরূপিনী। স্তন্যদুগ্ধে বাঁচিয়ে রেখেছে কোটি কোটি সন্তানের প্রাণ। তাই তো কবির কথায়, ‘জাহ্নবী যমুনা বিগলিত করুণা, পুণ্য পীযূষ স্তন্যদায়িনী।’

পৌরাণিক মতে, সুরনদী গঙ্গা মহাদেবের জটাজাল ভেদ করে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিলেন পৃথিবীতে। বেগ সংহত করেছেন গঙ্গা হিমবাহের আকার ধারণ করে। ক্রমে একই গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিলেন তিন ধারায়। গঙ্গার এক ধারা ভাগীরথী গঙ্গা। অন্য দুটি ধারা মন্দাকিনী গঙ্গা এবং অলকানন্দা গঙ্গা। ভাগবত মতে, বহু কোটি বছর কোন নাম ছিল না এই জলধারার। পরে নাম হয় গঙ্গা। ভাগীরথী, জাহ্নবী নাম আসে আরও অনেক পরে।

পৌরাণিক কাহিনীতে সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে। কপিলমুনির শাপে তাঁরা ভস্ম হয়ে গেলে, সগর রাজার ছেলে অংশুমান শাপমুক্তির জন্য শেষ জীবনে তপস্যা করেন গঙ্গাকে মর্ত্যে আনবার জন্য। তারপর তাঁর ছেলে দিলীপ তপস্যা করেন। তিনিও কৃতকার্য হননি। রাজা দিলীপের ছেলে ভগীরথ কৃতকার্য হন। তিনিই গঙ্গাকে সাগরে আনেন পথ দেখিয়ে। তিন পুরুষের চেষ্টায় সফলতা লাভ। ভারতে ইংরাজ শাসনকালে তদানীন্তন পূর্তবিভাগের একজন ইংরাজ ইঞ্জিনিয়ারের মতে, গঙ্গা প্রযুক্তিবিদ্যার এক অভূতপূর্ব সাফল্য। জলের উৎস কখনও শুকোবে না, হিমালয় থেকে সাগর পর্যন্ত চিরদিন অফুরন্ত জলপ্রবাহ বজায় থাকবে, এমন এক উৎস মুখ বের করে দুস্তর দুর্গম গিরির পাথর কেটে হাজার হাজার মাইল খাল কেটে নিয়ে এসে সাগরে মিশানো, সে এক অলৌকিক কারিগরি।

প্রবাদ আছে, জল না পেয়ে মরলে মানুষ প্রেত হয়। সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে প্রেত হয়েছিল। গঙ্গার স্পর্শে তাদের মুক্তি হল। সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে এখানে রূপক। আসলে সেকালে প্রজারাই ছিল রাজার সন্তান। ষাট হাজার ছেলে মানেই সগরের অসংখ্য প্রজা। হাজার হাজার মানুষ জলের অভাবে মারা যাওয়ায় চিরন্তন জলধারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গঙ্গার প্রবাহ না থাকলে উত্তরপ্রদেশ বিহার আর বাংলা হয়ে যেত মরুভূমি।

তিন পুরুষের তপস্যায় গঙ্গা মর্ত্যে এলেন। পুরাণের এই কাহিনীকে আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলতে পারি, ৭৫ থেকে ৯০ বছর লেগেছিল এই বিরাট খাল কেটে আনতে। ইতিহাসে এক পুরুষ সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরা হয়। মানুষের কাটা কাল বেয়ে তখন ওই জলধারা নিজের গতিতেই পথ করে নিয়েছে। ভগীরথ শঙ্খ বাজিয়ে আগে আগে পথ দেখিয়ে এনেছেন গঙ্গাকে। এই কাহিনীর মূলেও আছে নির্দেশিত খালের বাইরে যাতে জলধারা না যায়।

মোটের উপর পুরাণের গঙ্গার অস্তিত্বে বিশ্বাস, সাহেব ইঞ্জিনিয়ারের কথায় আস্থা স্থাপন করি বা না করি, গঙ্গা যে এক অতি আশ্চর্য নদী তা স্বীকার করতে হবে সকলকেই। তাই তো হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ভক্তিপ্লুত ও কৃতজ্ঞচিত্তে প্রশস্তি গেয়ে চলেছেন গঙ্গার। প্রাণদায়িনী দেবীরূপে পবিত্র গঙ্গা পুজোও পেয়ে আসছেন আজও।

Ganga
গঙ্গোত্রীতে গঙ্গা নদী, ছবি – সৌজন্যে – উইকিপিডিয়া

আনুমানিক ১২৮৬ বছর আগে মাত্র বারো বছর বয়সে দুর্গম তীর্থ বদরিকাশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে প্রয়াগ হরিদ্বার হয়ে গঙ্গোত্রীতে কিছুদিন বাসের পর যখন উত্তরকাশীতে আচার্য শঙ্কর আসেন তখন তিনি ষোলো বছর বয়েসে পদার্পণ করেছিলেন। হিমালয়ে বিভিন্ন তীর্থ পরিক্রমাকালীন আচার্য গঙ্গোত্রী মতান্তরে ত্রিযুগীনারায়ণে রচনা করেছিলেন গঙ্গাস্তোত্র। আচার্য ছাড়াও মহর্ষি বাল্মীকি, মহাত্মা দরাপ খাঁ, মহাকবি কালিদাস ও ভগীরথের গঙ্গার প্রশস্তি সুললিত ছন্দের ঝংকার আর ভক্তিরসাত্মক ব্যঞ্জনা বহন করে আনে এক অতীন্দ্রিয়লোকের বাণী। শতসহস্র বছর আগে আচার্য শঙ্করের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে –

শ্রীগঙ্গায়ৈ নম।
দেবী সুরেশ্বরী ভগবতি গঙ্গে,
ত্রিভুবনতারিণি তরলতরঙ্গে।
শঙ্কর মৌলিবিহারিণি বিমলে,
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।।…..

দেবি গঙ্গে! তুমি অমরবৃন্দেরও ঈশ্বরী, ভগবতী! তুমি ত্রিভুবন পরিত্রাণ কর, তুমি তরলতরঙ্গময়ী এবং মহেশ্বরের মস্তকে বিহার করিতেছ, তোমাতে কোনরূপ মলসম্পর্ক নাই। জননী! তোমার পাদপদ্মে আমার চিত্ত নিরত থাকুক।। ১ ।।

দেবি! ভগীরথ তোমাকে ব্রহ্মধাম হইতে ভূলোকে আনিয়াছিলেন, তুমি সর্ব্বপ্রাণীকে সুখ প্রদান করিয়া থাক। মাতঃ! তোমার মাহাত্ম্য নিগমেও পঠিত আছে, আমি তোমার মহিমা কিছু জানি না, তুমি ও অজ্ঞানকে পরিত্রাণ কর।। ২ ।।

গঙ্গে! তুমি শ্রীহরির পাদপদ্মে তরঙ্গরূপে বিদ্যমান ছিলে, দেবি! তোমার তরঙ্গ সকল হিমরাশি, চন্দ্র ও মুক্তার ন্যায় শ্বেতবর্ণ। কৃপাময়ী তুমি আমার পাপরাশি দূরীকৃত করিয়া আমাকে সংসার সাগরের পারে উত্তীর্ণ কর।। ৩ ।।

দেবি! যে ব্যক্তি তোমার জল পান করিয়াছে, সে পরম পদ পাইয়াছে। গঙ্গে! যে মনুষ্য তোমাকে ভক্তি করিয়া থাকে, কদাচ শমন তাহাকে দর্শন করিতে পারে না অর্থাৎ তোমার ভক্তগণ যমপুরে না যাইয়া বৈকুণ্ঠে যাইয়া থাকে।। ৪ ।।

দেবি গঙ্গে! তুমি পতিত জনকে পরিত্রাণ কর, তুমি পর্ব্বত-গতি হিমালয়কে খণ্ডন করিয়াছ, তোমার ভঙ্গি অতি সুশোভিত, তুমি ভীষ্মের জননী এবং জহ্নুমুনির কন্যা, ত্রিভুবনে তোমাপেক্ষা পাতক-হারিণী আর নাই।। ৫ ।।

দেবি! তুমি কল্পতরুর ন্যায় ফল প্রদান কর, অর্থাৎ ভক্তবৃন্দ তোমার নিকট যাহা কামনা করে, তুমি তাহাই প্রদান করিয়া থাক। যে তোমাকে প্রণাম করে, সে কদাচ শোকে পতিত হয় না। দেবি! তুমি সমুদ্রের সহিত বিহার কর, তোমার ভক্তগণ কদাচ নারীগণের চঞ্চলকটাক্ষে বিমুগ্ধ হয় না।। ৬ ।।

গঙ্গে! যে ব্যক্তি তোমার জলে স্নান করিয়াছে, সে পুনরায় জননী জঠরে প্রবেশ করে না। হে জাহ্নবী! তুমি ভক্তগণের নরক নিবারণ কর এবং পাপরাশিও বিনষ্ট করিয়া থাক। কেহই তোমার মাহাত্ম্য জানিতে পারে না।। ৭ ।।

দেবি! তোমার জন্মান্তরমুক্ত দেহ নাই, তোমার তরঙ্গসকল অতি পুণ্য প্রদান করে; জাহ্নবী! তোমার দর্শন কৃপাপূর্ণ, তোমাহইতে কাহারও উৎকর্ষ নাই। মাতঃ! তোমার চরণ দেবরাজ ইন্দ্রের মুকুটমণির দ্বারা সমুজ্জ্বল হইয়াছে। তুমি সকলকে সুখ ও শুভ প্রদান কর এবং যে তোমার সেবক হয়, তুমি তাহাকেই আশ্রয় প্রদান করিয়া থাক।। ৮ ।।

হে ভগবতী! তুমি ভক্তগণের শোক, রোগ, তাপ ও কুমতি হরণ কর। তুমি ত্রিলোকের সারভূতা ও অবনীর হারস্বরূপে বিদ্যমান আছ। দেবি! এই সংসারে একমাত্র তুমিই আমার গতি অর্থাৎ আমি কেবল তোমাকেই আশ্রয় করিলাম।। ৯ ।।

দেবি! তুমি অলকানন্দা এবং তুমি পরমানন্দস্বরূপা; আমি কাতর হইয়া তোমাকে বন্দনা করিতেছি, তুমি আমাকে কৃপা কর। মাতঃ! যে ব্যক্তি তোমার তটসন্নিধানে অবস্থিতি করে, অন্তকালে তাহার বৈকুণ্ঠে বাস হয়।। ১০ ।।

দেবি! তোমার জলে কচ্ছপ ও মীন হইয়া থাকি; তোমার তীরে ক্ষীণতর ক্বকলাস হইয়া বাস করি অথবা ক্রোশদ্বয় মধ্যে অতি দীন চণ্ডালকুলে জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাকিতে বাসনা করি, তথাপি দূরদেশে কুলীন নরপতি হইয়া থাকিতে বাসনা করি না।। ১১ ।।

দেবি! ত্রিভুবনের ঈশ্বরী, তুমি পুণ্যস্বরূপা, তোমাহইতে কাহারও প্রাধান্য নাই। তুমি জলময়ী ও মুনিবরের নন্দিনী! যে মনুষ্য প্রত্যহ এই গঙ্গাস্তর পাঠ করে, সে নিশ্চয়ই সকল বিষয়েই জয় লাভ করিতে পারে।। ১২ ।।

যাহার মনে অচলা গঙ্গাভক্তি আছে, সে নিয়ত সুখ ভোগ করিয়া থাকে। অতি মধুর ও কোমল পজ্‌ঝটকা ছন্দে বিরচিত এই স্তব পরমানন্দপ্রদ ও অতি সুললিত।। ১৩ ।।

এই অসার সংসার মধ্যে উক্ত গঙ্গাস্তবই সারবান্ পদার্থ, ইহা ভক্তবৃন্দের অভিলাষিত ফল প্রদান করে। মহেশ্বরসেবক শঙ্করাচার্য্যকৃত এই স্তব সমাপ্ত হইল।। ১৪ ।।

ইতি শঙ্করাচার্য্যকৃত গঙ্গাস্তোত্র সমাপ্ত।।

দরাফ্ খাঁ কৃত গঙ্গাস্তোত্র

১। জননীগণ যে দেহ (মৃতদেহ) পরিত্যাগ করেন, বন্ধু ও (পিতৃমাতৃসম্বন্ধিমাতুলাদি) বান্ধবগণ যাহা স্পর্শ করেন না; এবং পথিকগণ যাহাতে দৃষ্টি পতিত হইলে শ্রীহরি স্মরণ করিয়া থাকেন, এরূপ দেহ তুমি স্বীয়ক্রোড়ে স্থাপন করিয়া আনন্দিত হও। অতএব হে ভাগীরথী! তুমি সর্ব্বপ্রধান করুণাপরায়ণা মাতা হইবে।

২। হে বিষ্ণুপাদপদ্ম সমুদ্ভূতে তরঙ্গিণি এবং চন্দ্রশেখর অর্থাৎ শিবশিরের মালতীমালা স্বরূপে! আমি যখন তোমাতে দেহত্যাগ করিব, তখন তুমি আমাকে শিবত্ব দিও, বিষ্ণুত্ব প্রাপ্ত হইলে, তুমি শঙ্করমৌলি-বিহারিণীরূপে মস্তকে থাকিবে, কিন্তু বিষ্ণুপাদপদ্ম সমুদ্ভুতা তুমি, আমি বিষ্ণুত্ব লাভ হইলে, তুমি চরণস্পর্শ করিবে, ইহা অসহনীয়।

৩। হে মাতর্গঙ্গে! যেকাল হইতে এই পৃথিবীতে তোমার জলস্রোত প্রবাহিত হইতেছে, সেই কাল হইতে শমন নগরী (যমপুরী) শূন্য হইয়াছে, রৌরবাদি নরক নীরব হইয়াছে, বিমান (দেবযান বা রথ) সকল প্রতিদিন স্বর্গে যাতায়াত করিয়া ভগ্ন হইয়াছে এবং (তোমার জলে তনুত্যাগকারী ব্যক্তির সম্মানার্থ সম্মানার্থ) স্বর্গে (অণিবাদি গুণযুক্ত) সিদ্ধগণের সহিত দেবগণ প্রত্যেকেই এক একটী অর্ঘ্যপাত্র হস্তে লইয়া অবস্থান করিতেছেন।

৪। তোমার এই গঙ্গাজলে যদি তনুত্যাগ ঘটে, তবে আর পুনরায় দেহধারণ অর্থাৎ জন্মপরিগ্রহণ করিতে হয় না, অথবা যদিও পুনরায় দেহলাভ ঘটে, তবে হস্তে রথাঙ্গ (চক্র), শয়নে ভুজঙ্গ (অনন্তসর্প), যানে বিহঙ্গ (পক্ষী গরুড়) এবং চরণে গঙ্গাজল, এইরূপ দেহ প্রাপ্তি অর্থাৎ বিষ্ণুদেহ লাভ হয়।

৫। হে ত্রিভুবন জননি! তোমার বারিপূরিত গর্ভে কত চক্ষু, কত গজগণ্ড, কত নরকপাল, এবং কত কত হস্তী ও ব্যাঘ্রচর্ম্ম আছে এবং কত কত অমৃতাধার পাত্র আছে, কত বিষ আছে। যে তোমার জলে মগ্ন হইয়া জীব দেহত্যাগান্তে প্রত্যেকে এই সকল বস্তুর এক একটী করিয়া লইয়া উঠিতেছে অর্থাৎ তোমার নীরে দেহত্যাগান্তে শিবত্ব প্রাপ্ত হইতেছে, সুতরাং অসংখ্য শিববিভূতি তোমার বারি পূরিতগর্ভে নিহিত রহিয়াছে।

৬। হে গঙ্গে! যদি তোমার তরঙ্গ নয়নপথ গোচর হয়, তবে, অবীচি প্রভৃতি নরক কোথায় থাকে? তুমি প্রীত হইলে (পানকারীকে) পীতাম্বর পুরে অর্থাৎ বৈকুণ্ঠে বাস প্রদান কর। হে মাতঃ! আর দেহধারীগণের দেহ যদি তোমার ক্রোড়ে পতিত হয়, তাহা হইলে ইন্দ্রত্ব পদ লাভও তাহার পক্ষে অতি তুচ্ছ।

৭। তুমি জল হইয়াও লোক সকলের (মানবগণের) পাপসমূহ দগ্ধ করিতেছ। জলের দাহিকাশক্তি না থাকিলেও, তবজলের পাপ দহন ক্ষমতা অতি বিচিত্র। তুমি স্বয়ং নিম্নগা হইয়াও, প্রণতগণকে সর্ব্বোচ্চ স্থানে প্রেরণ কর। তুমি বিষ্ণু হইতে জাতা হইয়াও, শত শত বিষ্ণু উৎপাদন কর। হে মাতর্গঙ্গে! তোমার কি এই অদ্ভুত চরিত্র জগতে বিজয়লাভ করিতেছে।

৮। হে সুরধুনী (দেবনদী)! হে মুনিকন্যে! তুমি পুণ্যবানকেই ত্রাণ করিয়া থাক, কিন্তু মাতঃ! পুণ্যবান্ স্বীয় পুণ্যবলেই পরিত্রাণ লাভ করিয়া থাকে, তাহাতে তোমার মহত্ত্ব কি আছে? যদি গতিহীন পাতকী আমি, আমাকে ত্রাণ করিতে পার, তবে তোমার মহত্ত্ব প্রকাশিত হইবে, এবং সেই মহত্ত্বই প্রকৃত মহত্ত্ব।

দরাফ্ খাঁ কৃত গঙ্গাস্তোত্র সমাপ্ত।

সম্রাট আকবর অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন ও মর্যাদা দিতেন হরিদ্বারের ব্রহ্মকুণ্ডকে। বাদশার প্রধান সেনাপতি মানসিংহের অস্থি বিসর্জন দেয়া হয়েছিল ব্রহ্মকুণ্ডের জলে। গঙ্গাজলের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ছিল বাদশার। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট জলাশয়ে সঞ্চিত বৃষ্টির জলের সঙ্গে গঙ্গাজল মিশিয়ে সেই জল দিয়ে রান্না করা হত সম্রাটের। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল আরও জানিয়েছেন, ‘রাজদরবার পাঞ্জাবে অবস্থানকালে পানীয় জল সকল সময়ে হরিদ্বার হইতেই সরবরাহ হইত।’

সুরনদী গঙ্গার কথা শেষ করি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের কথা দিয়ে-

‘গঙ্গার মহিমা যত এক মুখে কব কত
বিস্তারিত অনেক পুরাণে।’

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : মহাভারতম্-হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য (অনুবাদক), হিন্দুর নিত্যকর্ম্ম পদ্ধতি-শ্রী সুরেন্দ্ৰনাথ ভট্টাচার্য্য (১৯৩৫), শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় জ্ঞানদাপ্রসাদ চৌধুরী। আচার্য শঙ্কর ও দরাফ খাঁ-এর গঙ্গাস্তোত্র দুটির মূল সংস্কৃত থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য।

(প্রয়াগের সঙ্গমে পুণ্যস্নানের ছবি – শিবশংকর ভারতী)

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *