পুজোপাঠ সাধনভজন না করেই সংসারে শান্তিতে থাকা ও ঈশ্বর লাভের উপায় জানালেন সাধুবাবা
আমি নিশ্চিত জানি, সূর্যের মতো দেখতে পাচ্ছি আমার কথাগুলো একদিন প্রকাশিত হবে অক্ষরে, তখন আমি দেহে থাকবনা। আমার আশির্বাদ অবিশ্রান্ত ধারায় তোর উপরে বর্ষিত হবে ভারতীয় সাধুদের অপ্রকাশিত কথা লোকসমক্ষে তুলে ধরার জন্য।
সাধুবাবা বললেন তাঁর গুরুজির করুণাধারায় স্নাত হয়ে ধন্য হয়েছেন। ধন্য তো হয়েছেনই, তাঁর চাইতেও অনেক বেশি ধন্য হলাম আমি, ধন্য হল আমার জীবন মন, ভিখারির বেশে লোকচক্ষুর আড়ালে বসে থাকা গুহ্যেশ্বরী মন্দিরের সামনে উচ্চকোটি এই মহাপুরুষের সঙ্গ, স্পর্শ ও দর্শন করে। আবেগে কণ্ঠ আমার রুদ্ধ হয়ে এল। চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুধারা। বারবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লাগলাম। বৃদ্ধ সমানে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন মাথায়।
সাধুবাবার এই জীবনকথা যে কত সত্য অর্থাৎ গুরু মহারাজের দেহরক্ষার পর শিষ্য বা একান্ত ভক্তের প্রয়োজনে গুরুজি রক্ত মাংসের দেহে স্বয়ং যে আবির্ভূত হন তা দেখা গিয়েছে ভারতবরেণ্য মহাপুরুষ ব্রজবিদেহী মহন্ত শ্রীশ্রীসন্তদাস বাবাজি মহারাজের জীবনে।
শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়াবাবাজি মহারাজের অনুগত শিষ্য ও একান্ত আপনজন ছিলেন স্বামী সন্তদাস বাবাজি মহারাজ। কোনও কার্য ও কারণে রামদাস কাঠিয়াবাবার আদেশক্রমে শ্রদ্ধেয় সন্তদাসকে যেতে হয়েছিল দ্বারকায়। এবার ভাষা ও বানান অবিকৃত রেখে স্বামী সন্তদাসের কথায় —
‘গুরুদেব আমাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া বলিলেন, তুমি দ্বারকা দর্শন করিয়া আইস, রাস্তায় তোমার কোন কষ্ট হইবে না। তোমার সমস্ত আবশ্যকীয় বস্তু তোমার বিনা চেষ্টায় তোমার নিকট উপস্থিত হইবে। আমি দ্বারকাভিমুখে প্রস্থিত হইলে রাস্তায় বাস্তবিক আমার কোন প্রকার অভাব বা অসুবিধা ঘটিল না। যেখানে গিয়া মধ্যাহ্নে অথবা সায়াহ্নে আসন স্থাপন করিতাম, সেখানেই লোকজন আসিয়া আমাদের খাদ্য সামগ্রী ও গাঁজা চরস প্রভৃতি সব দিয়া যাইত। রাজ-পুতানার মরুভূমি পার হইতে বস্তির লোক আপন হইতে শকট গাড়ী জুটাইয়া দিত। এইরূপে দ্বারকায় উপস্থিত হইয়া দ্বারকানাথের দর্শন করিলাম এবং তথা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া গুরুদেব যে স্থানে ছিলেন সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম সেইস্থানে আমার জ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা সকলে উপস্থিত আছেন সকলেরই বদন বিষণ্ণ, এবং গুরুদেব সে স্থানে নাই। আমি গুরুদেবের কথা জ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা সকলকে জিজ্ঞাসা করিলাম। তখন অতি কষ্টের সহিত তাঁহারা বলিলেন যে গুরুদেব দেহরক্ষা করিয়াছেন, তিন দিবস হইল দেহরক্ষা করিয়াছেন। এই নিদারুণ সংবাদ শুনিবামাত্র আমার মস্তক ঘূর্ণিত হইতে লাগিল। আমি জানতাম তিনি ভগবান, ব্রহ্মর্ষি, জরামৃত্যু রহিত সুতরাং গুরুভ্রাতাদিগের প্রদত্ত সংবাদে আমি আস্থা স্থাপন করিতে পারিলাম না। আমি কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া তাঁহাদিগকে বলিলাম, গুরুদেব সর্বশক্তিসম্পন্ন ভগবান ছিলেন, তাঁহার কিরূপে মৃত্যু হইতে পারে ? আপনারা আমাকে ছলনা করিতেছেন। তাঁহারা বলিলেন, তাঁহাদের সাক্ষাতেই তিনি দেহরক্ষা করিয়াছেন এবং তাঁহারা তাঁহার দেহের সৎকার করিয়াছেন। আমি এই সকল বাক্য শুনিয়া একেবারে মর্মাহত হইলাম, বলিলাম, হায় এই জন্যই কি তিনি আমাকে স্থানান্তরে পাঠাইয়াছিলেন ? তিনি ভগবান, তাঁহার মৃত্যু কিরূপে সম্ভব হয় ? আমি তাঁহার দর্শন না পাইলে এ জীবন রাখিব না। আমি শোকে ক্রমে এতই অভিভূত হইলাম যে স্বহস্তে আমার মস্তকের দীর্ঘ জটা সকল উৎপাটিত করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। গুরুভ্রাতা সকল দয়ার্দ্র হইয়া আমাকে মুণ্ডিত করাইয়া দিলেন, কিন্তু আমি শোকে অভিভূত হইয়া ভূমির উপর লুণ্ঠিত হইতে হইতে অনশনে কালযাপন করিতে লাগিলাম। কাহারও প্রবোধবাক্য আমার অন্তরে স্থান পাইল না, অবিশ্রান্ত ক্রন্দন করিতে করিতে আমার কাল অতীত হইতে লাগিল। অবশেষে সপ্তম দিবসে গুরুদেব প্রসন্ন হইয়া আমাকে দর্শন দিলেন এবং আমাকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন, “বৎস! তুমি আর শোক করিও না, উত্থিত হও, তোমার মঙ্গল হইবে, আমার মৃত্যু হয় নাই, তুমি শান্ত হও! আমার মৃত্যু নাই ইহা সত্য, কিন্তু প্রয়োজন বশতঃ আমি আত্মগোপন করিয়াছি, মৃত্যুর ব্যাপার যে ইহাদিগকে প্রদর্শন করিয়াছি ইহা লীলামাত্র। সময় সময় আমি তোমাকে দর্শন দিব। আমি অপরের অলক্ষিতভাবে এখন হইতে নর্মদা তীরে বাস করিতেছি ও করিব। তুমি আর শোক করিও না, উত্থিত হইয়া সাধুমার্গে বিচরণ কর, তোমার সমস্ত কামনা সফল হইবে।” আমাকে এরূপে প্রবোধিত করিয়া গুরুদেব অন্তর্হিত হইলেন। তাঁহার দর্শনলাভে এবং প্রবোধবাক্যে আমার চিত্ত শান্ত হইল, আমি উত্থিত হইলাম এবং স্নান আহার করিলাম। জ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা সকল যথাবিধানে গুরুদেবের ভাণ্ডারা করিয়া আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। গুরুদেব সময় সময় আবির্ভূত হইয়া আমাকে দর্শনদান দ্বারা তাঁহার বাক্য সত্য করিতে লাগিলেন।’
পড়ুন : দৃষ্টিদোষের অশুভ প্রভাব এড়ানো ও মুক্তি পাওয়ার পথ দিলেন সাধুবাবা
সন্তদাস বাবাজি মহারাজ অনেকগুলি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে। তার মধ্যে থেকে আর একটির কথা তাঁর কলমে —
‘অধিকন্ত্ত শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজ (রামদাস কাঠিয়াবাবা) মানবলীলা সম্বরণ করিবার পরেও আমাদিগকে সময় সময় পূর্বোক্ত প্রকারে দর্শন দিয়া উৎসাহিত করিতে এবং তাঁহার স্মৃতি সর্বদা জাগরূক রাখিতে ত্রুটি করিতেছেন না।
এই শ্রেণীর ঘটনা আর অধিক বর্ণনা করিয়া এই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করা অনাবশ্যক। এই স্থলে অধিকন্ত্ত এই মাত্র বলিতেছি যে কেবল তাঁহার শিষ্য আমাদিগকে যে শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজ এইরূপ দর্শন দিতেন তাহা নহে। আমাদের বন্ধুবর্গের মধ্যেও কেহ কেহ এইরূপে তাহার দর্শন লাভ করিয়াছেন। একটি মাত্র ঘটনা এইস্থলে উল্লেখ করিয়া এই অধ্যায় বিভাগ শেষ করা যাইতেছে।
আমি কলিকাতায় কম্বলীয়াটোলায় থাকা কালে বৈঠকখানা ঘরে যে স্থানে আমি সর্বদা বসিতাম তাহার উপরে দেওয়ালের গায় শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজের একখানি ছবি টাঙ্গাইয়া রাখিয়াছিলাম। শ্রীযুক্ত বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় নামে আমার একজন ধর্মবন্ধু ছিলেন। তিনি ধর্মসম্বন্ধে অতি নিষ্ঠাসম্পন্ন সাত্ত্বিক স্বভাবের ভক্তিমান লোক ছিলে। তাঁহার স্বাস্থ্য অতিশয় খারাপ হওয়াতে তিনি সাঁওতাল পরগণার একস্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গমন করিয়া তলায় কিয়দ্দিবস বাস করেন। তৎপরই কলিকাতা আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ঐ কম্বলীয়াটোলার বাটিতে আসেন। তিনি বৈঠকখানা ঘরে প্রবিষ্ট হইয়াই শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজের ঐ ছবিটি দর্শন করিয়া আমাকে একটু বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এই মহাপুরুষের দর্শন কোথায় পাইলেন ?” আমি বলিলাম, ‘এই খানা আমার গুরুদেবের ছবি।’ তিনি বলিলেন, ‘আমি ইহাকে সাঁওতাল পরগণায় যে স্থানে ছিলাম, সেইস্থানে দর্শন করিয়া আসিয়াছি। আমি যে বাড়ীতে ছিলাম তাহার নিকট একটি অশ্বত্থ গাছতলায় তিনি তিনদিবস আসন স্থাপন করিয়াছিলেন। আমি প্রতিদিন তাঁহার নিকট যাইয়া বসিতাম। তিনি আমাকে বড় স্নেহ ও আদর করিতেন।’ বাস্তবিক তৎকালে শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজ শ্রীবৃন্দাবন বাস করিতেছিলেন। সুতরাং আমি বলিলাম যে, “আমার শ্রীগুরুদেব ত এক্ষণে শ্রীবৃন্দাবনে বাস করিতেছেন। তিনি সাঁওতাল পরগণায় এক্ষণে যাইবার ত কোন সম্ভাবনা নাই। আপনি তথায় কিরূপে তাঁহার দর্শন পাইলেন বুঝিতেছি না।” তিনি বলিলেন, “আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি যে ইহাকেই আমি সাঁওতাল পরগণায় সম্প্রতি তিন দিবস ক্রমান্বয়ে দর্শন করিয়াছি। এই বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই”। আমি তাঁহার এই কথা শুনিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলাম। পরে শ্রীবৃন্দাবনে আসিয়া আমি শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজকে এই বিষয় জিজ্ঞাসা করাতে তিনি হাসিয়া বলিলেন, “বাবা। কখনও কখনও অন্য স্থানে অন্য লোকেও আমার দর্শন সময় সময় লাভ করিয়া থাকে, ইহার রহস্য এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, পরে বুঝিবে।”
এরপর বৃদ্ধ তিরানব্বই বললেন,
— বেটা, জগতে যা কিছু হচ্ছে, যা কিছু হবে, যা কিছু হয়েছে তা জানবি কোনওটাই কল্পনাপ্রসূত নয়। সবই সত্য, সত্য, সত্য। সংসারে যারা আছে তারা সবাই আছে সাধারণ বুদ্ধিতে স্থিত হয়ে। তারা অধিকাংশই মজে আছে বিষয়বুদ্ধিতে সুতরাং এসব বিষয়গুলো তাদের এতটুকুও বোধে আসবে না। আমি নিশ্চিত জানি, সূর্যের মতো দেখতে পাচ্ছি আমার কথাগুলো একদিন প্রকাশিত হবে অক্ষরে, তখন আমি দেহে থাকবনা। আমার আশির্বাদ অবিশ্রান্ত ধারায় তোর উপরে বর্ষিত হবে ভারতীয় সাধুদের অপ্রকাশিত কথা লোকসমক্ষে তুলে ধরার জন্য।
একটু থামলেন। কেমন যেন একটা ঘোরে মধ্যে কথাগুলো বললেন। আজ লিখতে বসে বারবার মনে পড়ছে সেই অতিবৃদ্ধ সাধুবাবার কথা। জীবনে কোনওদিন কল্পনাও করিনি ভারতীয় সাধুদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ জীবনকথা লেখা হবে। যাইহোক, প্রসঙ্গের মোড় ঘোরাতে বললাম,
— বাবা, আমি তো সংসারে আছি সুতরাং মনের ধান্দাটাও সেই রকমের। প্রচুর টাকা চাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই, সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, নাম যশ খ্যাতি চাই। জগতে যা কিছু চাওয়ার মতো আছে তা তো সবই চেয়ে থাকি অন্তরে কোনও মন্দিরে গেলে, সাধুসন্ন্যাসীদের প্রণাম করলে। বাবা, আমার অন্তরের কথাগুলো অকপটে জানালাম আপনাকে। এবার আপনি আমাকে বলুন আপনার মতো, আমিও সব সময় থাকব আনন্দে, আর না চাইতে আপনার মতো সবকিছুই ‘আপসে আ যায়গা’ – কি করলে সংসারী হয়েও আমি তা পেতে পারি।
কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলেন। শুনতে শুনতে মাথাটা দোলাচ্ছিলেন সাধুবাবা। মনে হল বৃদ্ধ যেন আগেকার দিনের চিকিৎসক। নাড়ি ধরেই বুঝতে পারলেন রোগটা কি, গলদটা কোথায়? আর এখনকার দিনের চিকিৎসক? বৃদ্ধ বললেন,
— বেটা, আমার গুরুজি মহারাজ আমাকে যা বলেছিলেন, দীক্ষার পর থেকে আজ পর্যন্ত যা করে এসেছি, যা করব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সেই উপদেশই তোর জিজ্ঞাসার উত্তরে বলছি। মেনে চলবি কিনা সেটা তোর ব্যাপার। দীক্ষা নেওয়া থাকলে ভালো, না নেওয়া থাকলেও কোই বাত নেহি। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার সময় বাসী বিছানায় বসে তোর যে দেবতার উপর বিশ্বাস ভক্তি শ্রদ্ধা তাঁর কিংবা গুরুজি মহারাজের উদ্দেশ্যে একমাত্র প্রার্থনা শুধু এটাই হবে, হে গুরুজি মহারাজ, আমার কিছু করার নেই, কিছু ভাবার নেই, কিছু বোঝার নেই, কিছু বলার নেই। আমি যা করলে তুমি আমার প্রতি সদা সর্বদা প্রসন্ন থাকবে আমাকে দিয়ে তাই তুমি করিয়ে নাও।
এই প্রার্থনা যদি তুই প্রতিদিন সকালে করতে পারিস, তাহলে তুই নিশ্চিত আনন্দময় জীবন লাভ করতে পারবি, যে জীবনে উত্তরণ ছাড়া অবতরণ বলে কোনও কথা নেই। এই প্রার্থনায় জীবনে এমন একটা সময় আসবে যখন কাম ক্রোধ লোভ থেকে শুরু করে কোনও রিপুই তোর দেহমনকে স্পর্শ করতে পারবে না। রোগ শোক দুঃখ ব্যথা বেদনা এতটুকুও টলাতে পারবে না, কোনও কিছুতেই কাতর করে তুলতে পারবে না মনকে। তবে প্রার্থনাটা যেন দায়সারা গোছের না হয়ে আন্তরিক হয়। আমার দীক্ষালাভের দিন মন্ত্রগ্রহণ করে বলেছিলাম, ‘মহারাজ, গুরুজির কাছে আমার কি প্রার্থনা করা উচিত?’ তিনি আমাকে এই কথাগুলোই বলেছিলেন। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই প্রার্থনায় একটা দিনও আমার ভুল হয়নি। (উচ্চস্বরে একবার জয় গুরু মহারাজ কি জয় বললেন) বেটা, ম্যায় গুরুজি মহারাজ কি কৃপা সে সদা আনন্দ মে হুঁ, সদা পরমানন্দ মে হুঁ, সদা ব্রহ্মানন্দ্মে হুঁ। তুইও থাকবি, করে দেখ।
সাধুবাবার কথাটা শুনে হৃদয় মন আনন্দে উথলে উঠল। কারণ, যখন আমার দীক্ষা হয়েছিল তখন এসব ব্যাপারে কিছুই বুঝিনা, তবুও জিজ্ঞাসার উত্তরে আমার কুমারী সন্ন্যাসিনী গুরুমা এই কথাগুলোই বলেছিলেন। পরবর্তীকালে পথচলতি সাধুসঙ্গ করাকালীন ঠিকই একই কথা বলেছিলেন আর একজন সাধুবাবা। সারা জীবন সাধুসঙ্গের সময় এই একই প্রশ্ন করেছিলাম অধিকাংশ সাধুসন্ন্যাসীকে। ভাষা ও ভাবের পার্থক্য থাকলেও আজ দেখলাম সব শিয়ালের এক ‘রা’। এবার একটা চক্কর এল মাথায়। সাধুবাবা যখন নাথ সম্প্রদায়ের উচ্চমার্গের ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর শিষ্য তখন এই বৃদ্ধ হেলে বা জলঢোঁড়া নয়, নিশ্চিত কেউটে। বললাম,
— বাবা, আপনার গুরুজি মহারাজ উচ্চকোটি সাধক মহাত্মাদের মধ্যে যে একজন তা বুঝতে আমার আর বাকি নেই। আপনি তাঁর চেলা। আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া বিস্ময়কর যেসব ঘটনা, তা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেছি। সাধুমুখনিঃসৃত এইসব কথা ও কাহিনি আর কারও ভাগ্যে শোনা সম্ভব হবে কিনা তা আমার জানা নেই। দুটো পায়ে ধরেছি, আপনার গুরুজির মতো এই মুহুর্তে অসাধারণ যোগশ্বৈর্যের ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছেন ভিখারিবেশে, দয়া করে এমন কিছু করে দেখান যা মরার দিন পর্যন্ত আপনি যেন হৃদয়মনজুড়ে থাকেন।
পড়ুন : লোভের হাত থেকে মুক্তির পথ দিলেন বৃদ্ধ সাধুবাবা
সাধুবাবার মুখখানা একটু গম্ভীর হয়ে এল আমার কথা শুনে। বললেন,
— না বেটা, আমার কোনও যোগৈশ্বর্য কিছু নেই। আমি চলি আমার জীবন মরণের পরমধন গুরুজিকে আশ্রয় করে। তাঁর কৃপাতেই দুবেলা দুটো সবজি রুটি মিলে যায়। তাঁর অপার অনন্ত করুণায় সর্বদা আছি আনন্দে। ওই সব যোগবিভূতির প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ নেই। গুরুজি দেহে থাকাকালীন, দেহরক্ষার পরও দেখেছি তাঁর বিস্ময়কর যোগৈশ্বর্যের প্রকাশ। আমার কোনও শক্তি নেই। তোদের মতো যারা, তাদের দেওয়া ভিক্ষায় আমার পেটটা চলে। বয়েস তো অনেক হল! বাকি দিনগুলো এইভাবেই কেটে যাবে।
বৃদ্ধের এসব কথাগুলো শুনে বুঝে গেলাম এড়িয়ে যাওয়ার ধান্দা। শক্তিমান সাধুসন্ন্যাসীদের এই ধরণের কথাবার্তা এর আগে আমি বহু শুনেছি। মনে মনে বললাম, ‘ওসব কথা বলে বাবা কিছু লাভ হবে না।’ ছোটবেলা থেকেই সম্মানজ্ঞান বা বোধটা আমার ছিলনা, আজও নেই। কে কি করল তা নিয়ে ভাববার সময় নেই। আমার সম্পর্কে কে কি বলল তা নিয়ে এতটুকুও মাথাব্যথা নেই। এইভাবে চলে এলাম জীবনের এতগুলো বছর। এই মুহুর্তে আর কোনও কিছু বললাম না। প্রকাশ্য দিবালোকে, নেপালবাসী ও বিদেশি অগণিত লোক চলাচলের পথে ঝপ্করে সাধুবাবার পা-দুটো ধরে একেবারে শুয়ে পড়লাম রাস্তার উপরে। পরে বুঝেছিলাম, বৃদ্ধ বুঝতে পারেননি এমনটা আমি করতে পারি। এখন সাধুবাবা একটা অপ্রস্তুত অবস্থায়। তিনি বারবার আমার মাথা আর হাতদুটো ধরে ওঠানোর চেষ্টা করতে করতে আবেগমথিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
— ওঠ ওঠ বেটা, মেরা বাচ্চা ওঠ, লোকেরা দেখলে কি ভাববে বলতো? এরকম ভাবে রাস্তার ধারে তুই পায়ে হাত দিয়ে পড়ে থাকলে লোকেদের মনে একটা কৌতূহল সৃষ্টি হবে। এখানে এসে নানা প্রশ্ন করবে। মেরা বাচ্চা, ওঠ ওঠ। তেরা বাত ম্যায় শোচুঙ্গা।
তিরানব্বই-এর এই বৃদ্ধ সাধুবাবার কথা উপেক্ষা করলাম না, তা করলে অপমান করা হয়। উঠে বসলাম। আমার চোখে জল দেখে বললেন,
— বেটা তুই কাঁদছিস? নেহি বেটা, রোনা মত্। চোখের জল ফেলে তুই অন্তরের কোনও দুঃখমোচন করতে পারবি না। শ্রীগুরুর চরণে যদি একফোঁটা জলও অন্তর থেকে ফেলতে পারিস, জানবি সমস্ত কষ্টের অবসান তোর হবেই হবে।
এই পর্যন্ত বলে আমার মুখের দিকে তাকালেন। বুঝলাম, সাধুবাবার ধান্দা আমি যা চেয়েছি তা এড়িয়ে যাওয়া। কিছু বললাম না। বৃদ্ধবাবা বললেন,
— বেটা, সংসারে কোনও মানুষেরই আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। আকাঙ্ক্ষার তৃষ্ণা যত বাড়বে, সংসারজীবনে তার রোগ ভোগ দুঃখ তত বাড়বে। সংসারে আছিস, ভালো কথা। মন থেকে চাওয়াটাকে মুছে ফেলে দে। আকাঙ্ক্ষা থেকে চাওয়ার সৃষ্টি হয়। তোর কপালে যেটা ভগবান লিখে দিয়েছেন, সেটা তাঁর নির্দিষ্ট সময়ে চেষ্টা করলেও পাবি, চেষ্টা না করলেও পাবি এবং সেটা তাঁর বিচারে তোর আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হতে পারে, নাও হতে পারে। এটাই অনাদি অনন্তকালের সত্য। এর বাইরে জীবজগতের কোনও মানুষ কখনও যেতে পারবে না। এই কথাটা সারাজীবন মনে রাখবি, দেখবি মানসিক কোনও কষ্ট থাকবে না, মন সদা সর্বদা থাকবে আনন্দে।
আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পড়লাম, সে পথে না গিয়ে সাধুবাবা অন্য পথে ড্রাইভ করে চলেছেন। কিছু বললাম না। দেখি না কি করেন! বললেন,
— বেটা, সারা পৃথিবীতে কোনও মানুষেরই এতটুকু কর্তৃত্ব নেই তার নিজের চুলের উপর। যখন সে ধীরে ধীরে সাদা হতে থাকে তখন তাকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। একটা সাদা চুলকে কোনও শক্তিবলেই কালো করতে পারে না। মানুষ কত অসহায় অথচ যে কোনওভাবে সে চায় অন্যের উপর কর্তৃত্ব করতে। একটু ভেবে দেখ, মানুষ কত বোকা, তাই না? বেটা, সংসারে যখন আছিস তখন ভগবানের কর্তৃত্ব মেনে নিবি, জীবনের কোনও আশাই তোর অপূরণ থাকবে না। এই দেখ না, ভারতের সমস্ত সাধক সম্প্রদায় তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন বলেই তো তাঁরা সব পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন অসাধারণ শক্তির অধিকারী। আমার নেংটিসম্বল গুরুজির কথাই একবার ভেবে দেখ না?
আমি কিন্তু কথাগুলো শুনছি মন দিয়ে। নোট করছি প্রয়োজন মতো। মনে মনে ভাবছি, দেখি না বুড়োবাবা কতক্ষণ প্যাঁচাল পারে। যোগৈশ্বর্যের প্রকাশ দেখতে চাওয়াতে এখন নানান কথা শুরু করেছেন বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ধৈর্য ধরে বসে আছি। দার্শনিক এমেরসন বলেছেন, ‘ধৈর্য তিক্ত হলেও তার ফল মিষ্ট’। তবে ধৈর্য এতটাই তিতো যে, উচ্ছে করলা ছেলেমানুষ, নিমপাতা কালমেঘও হার মেনে যায়। সাধুসঙ্গের সময় আমার কখনও কোনও তাড়াহুড়ো থাকে না। এসময় কোনও আত্মীয় বন্ধুকে সঙ্গে রাখি না। যখন যেখানে কেউ না কেউ সঙ্গে থেকেছে, তাদের সম্পর্কে ধারণা আমার এতটাই খারাপ যে তা অক্ষরে প্রকাশের নয়। যাইহোক, সাধুবাবা বললেন,
— বেটা, সব সময় সৎ মানুষের সঙ্গ করবি। এতে ভিতরের অসৎ প্রবৃত্তি (তমো ও রজোগুণ) নষ্ট হবে। মন নির্মল হলেই হয় জ্ঞানের বিকাশ। তারপর এক মন হয় বিশ্বমনে পরিণত। সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে চট্করে মনের নির্মলতা আসে না। মেরা বাচ্চা শিউশঙ্কর, দধিমন্থন (সাধু ও সৎসঙ্গ) করলে তার সারবস্তু ননী (আবিলতা মুক্ত মন) পাওয়া যায়। আর জলমন্থন করলে শুধু জলই পাওয়া যায়।
একটু থামলেন। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন এদিক ওদিক। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক্স-রে করে নিলেন একনজরে। বললেন,
— বেটা, অনুরাগ বা প্রেমই হল সাধনভজনশীল মানুষ আর সাধকের একমাত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। গুরু বা আরাধ্য দেবতার উপর প্রেম জন্মালে পার্থিবজগতে আর কাউকেই সাধকের ভালো লাগে না। এই ভালো না লাগাটাই তাকে পরম পথের সন্ধান দেবে।
সাধুবাবা আর কোনও কথা বললেন না। এতক্ষণ একভাবে বসেছিলেন তাই একটু নড়েচড়ে হাত পা-টা ছাড়িয়ে নিলেন। মনে মনে আমি বেশ অধৈর্যই হয়ে উঠলাম। কোনও কথা বললাম না। বৃদ্ধবাবা বললেন,
— বেটা তোকে যে প্রেমের কথা বলছিলাম, এই প্রেমের দ্বারা বিষ্ণুর যে উপাসনা, ভারতে তাকে বলে গোপীধর্ম। ভগবান বিষ্ণু যে স্বয়ং প্রেমের দেবতা তাই তাঁর আর এক নাম গোপী। নারায়ণের আর এক নাম যে গোপী তা প্রায় কেউই জানে না। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তথা নারায়ণের প্রতি এই প্রেমকে বলে গোপীধর্ম।
সাধুবাবা গোপীধর্মের বিষয়ে যা বললেন তার একটা অক্ষরও আমার জানা ছিল না। মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। কোনও কথা বলছি না। মাথায় যে চক্করটা চলছে সেটা বৃদ্ধের চমৎকারি কিছু দেখা। উনি সে পথেই হাঁটছেন না। মনে মনে আরও অধৈর্য হয়ে পড়লাম তবে কথায় প্রকাশ করলাম না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম,
— বাবা, মহাত্মারা বলেন ভগবানের নামগান করলে তবেই মানুষ শান্তি পাবে। আপনার রামজি বলুন আর গুরুজিই বলুন, এঁদের কাউকে স্মরণ না করে, পুজোপাঠ সাধনভজন না করে সংসারজীবনে শান্তিতে থাকতে পারব, এমন পথ কি আপনার জানা আছে?
কথাটা শোনামাত্র বৃদ্ধ তিরানব্বই-এর মাধুর্যেভরা মুখখানা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কেমন যেন একটা অপার্থিবভাবে ছেয়ে গেল সারা মুখমণ্ডল। মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন,
— হাঁ হাঁ বেটা জানা আছে। সারাটা জীবন, যতদিন বেঁচে থাকবি, ভুল করেও ভগবানকে তোর ডাকার দরকার নেই। প্রয়োজন নেই কোনও দেবদেবীর পুজোপাঠ সাধনভজন করার। শুধু একটা কাজ করলে আমৃত্যু শান্তি তো তুই পাবিই, মৃত্যুর পরও পরলোকে থাকবি পরমানন্দে। লেগে পড় বেটা, যতদিন বাঁচবি ততদিন শুধু নিজের দোষ খুঁজবি, গুণ খুঁজবি অন্যের। ব্যস, বেটা ইসিমে তেরা সব কুছ মিল যায়গা, ভগবান্কো ভি।
পড়ুন : কলুষিত কামনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পথ দিলেন সাধুবাবা
কথাটা শোনামাত্র মনে পড়ে গেল, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথা, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কঠিন কাজটা হল নিজের ভুল বা দোষ স্বীকার করা।’ প্রণাম করলাম অতি বৃদ্ধের পায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে। খুবই খারাপ লাগছে এখন বেলা প্রায় ৯টা হতে চলল। না সাধুবাবার, না আমার পেটে একটা দানাপানি পড়েছে। চোখের সামনে একটা দোকান নেই যে একছুটে গিয়ে কিছু নিয়ে আসব। আর এখন এমন একটা মানসিক অবস্থায় আছি যে উঠে গিয়ে খাবার আনতে কম করেও মিনিট কুড়ি লাগবে। এই মুহুর্তে সেই সময়টা ছাড়তে রাজি নই না খেয়ে থাকলেও। আমরা যেখানে বসে আছি, মাঝে রাস্তার বিপরীতে ঝাউ ফার বা পাইন জাতীয় ছোট একটা গাছ দেখিয়ে হঠাৎ সাধুবাবা বললেন,
— বেটা, ওই গাছটার গোড়ায় দুটো জঙ্গলি পাতায় তোর আর আমার খাবার দেখলাম গুরুজি রেখে দিয়ে আমাকে ইশারায় বললেন খেয়ে নিতে। একটু আগে তুই আমাকে খাওয়ানোর কথা ভাবছিলি অথচ দেখ, আমার গুরুজি তোর না খেয়ে থাকার কথা ভাবছে। বেটা, আমি ভাবতেও পারছি না, তোর উপরে আমার গুরুজির কি অপার করুণা!
কথাটা শেষ হওয়ামাত্র একছুটে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে গাছতলায় দেখছি এক ধরণের বেশ বড় বুনোপাতায় কিছু ফল মিষ্টি আর ভুরভুর করে ধোঁয়া উঠছে গরম গরম পুরি সবজি থেকে। খাবার বেশ অনেকটা তাই একবারে দুটো পাতা আনতে পারলাম না। আনলাম দুবার গিয়ে। আমার কিছু বলার নেই, ভাবারও নেই কিছু। যে কৌতূহল হয়েছিল সাধুবাবার বলা নর্মদা পরিক্রমাকালীন খাবার নিয়ে, আজ সেই ঘটনাটাই ভগবান পশুপতিনাথ আর মা গুহ্যেশ্বরী দেখিয়ে দিলেন চোখের সামনে। মনে মনে ভাবলাম, জগতে যা কিছু ঘটে, যা কিছু ঘটবে আর যা কিছু ঘটেছে তা সব সত্য সত্য আর সত্য। এই মুহুর্তে এটুকু ছাড়া আর কিছুই ভাবলাম না।
(সমাপ্ত)