Mythology

ট্যারা, ভাঙা গাল, কুৎসিত এক দুঃখী সাধুর জীবনকথা

তাকানো মাত্রই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হতাশ হয়ে গেলাম। ট্যারা। ভাঙা গাল। রঙ একেবারেই ময়লা বেশ কালো। মুখখানায় এতটুকু আকর্ষণ নেই। কুৎসিত দেখতে।

বেশ কিছুটা পথ চলতে হয় বালির উপর দিয়ে সাবিত্রী পাহাড়ে যেতে। এখনও বেলা তেমন বাড়েনি। বাড়লে বালিও গরম হয়, পথ চলতেও বেশ কষ্ট হয়। তাই ধর্মশালা থেকে বেরিয়েছি সকাল সকাল। পথ চলেছি একাই। আমার মতো চলছে অনেকে যে যার ভাবে। আছে সব বয়েসের, তবে বেশি বয়েসের যারা, তাদের অনেকে চলছেন ডান্ডিতে। বলা যায় কাঁধে চড়ে। উপায় কি। সারাজীবন সংসারের ঘানি ঠেলে এরা সময় পায়নি তাই শেষ বয়েসে কাঁধে চড়ে তীর্থ করা। চেহারা দেখে মনে হয় এদের পয়সা আছে, রোগ আছে, বয়েস নেই।

ঘাটে যাওয়ার আগে ঘাটের পাথেয় সংগ্রহ করতে যারা আসেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি বহু তীর্থে, যখন সেখানে সুযোগ হয়েছে। কর্ম ও সংসারজীবনে অবসর প্রাপ্ত বিপত্নীক আর বৃদ্ধ ‘ব্যাচেলার’ অনেকেই আসেন তীর্থ ভ্রমণে। একা একা আর ভাল লাগে না। নাতি নাতনি কিংবা ভাইপো ভাইঝিদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার ডিউটিতে ধরেছে অরুচি। প্রায়ই ছেলে বউ নিয়ে, ভাই তার বউকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। বাচ্চা সামলাতে হচ্ছে বুড়োকে। ওরা ফুর্তি করবে, আমি ঘরে বসে থাকব পাহারাদার হয়ে, তার চেয়ে বরং বেরিয়ে পড়ি। পরপারের কাজ তো কিছু হবে। এদের ভ্রমণে সঙ্গী বউ নয়, সঙ্গী থাকে হার্ট প্রেশার আর ডায়াবেটিসের প্যাকেট।

এদের মধ্যে আবার এমন কেউ আছে, সারাজীবন খেটেখুটে ছেলেদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন ভাল ঘরে। অভাব নেই। সারাজীবন সময়ও পাননি। অফিস বউ ছেলেমেয়েদের পিছনেই গেছে যৌবনটা। এখন অবসর জীবন। পাড়ার বুড়োদের সঙ্গে পাঁচবাড়ির পাঁচালিও আর ভাললাগে না। তাই দিনকয়েকের জন্যে রুচি পাল্টাতে বেরিয়ে পড়া। এখন এদেরও হয়ত কেউ চলেছেন সাবিত্রী তীর্থপথে।

অনেক বিধবা বুড়িও চলেছেন এ পথে, চলেছেন এখন এমন অনেক তীর্থযাত্রী সারা ভারতের কোনও না কোনও তীর্থপথে। এদের অনেককেই আফসোস করে বলতে শুনেছি, বাবা, শাস্ত্রের কথাই ঠিক। এত বছর ধরে সংসার করলাম। দেখলাম কেউ কারও নয়। এসেছি একা, যেতেও হবে একা। আমি মনে মনে বলি, কথাটা ঠিক নয় ঠাকুমা। একা এসেছেন ঠিকই। কেউ কারও নয় বেঠিক কথা। একাও যেতে হবে না। স্বামী নেই বলে দুঃখের কিছু নেই। পরপারে যাওয়ার সময় সঙ্গে যাবে আপনার বাত হাঁটু আর কোমর ব্যথা। মনের ব্যথার চেয়েও এ ব্যথা বড় বেশি ব্যথা। এ ব্যথা নেই এমন কোনও বৃদ্ধা মহিলা আমার অন্তত দেখা নেই। সঙ্গীকে নিয়ে এ পথে চলেছেন অনেক বৃদ্ধা।

Pushkar

অনেক জ্বালায় এদের অনেকের তীর্থে আসা। শেষ বয়েসে ভাবনা আসে পরপারের। হিন্দুর সমস্ত সম্প্রদায়ের নারীপুরুষ নির্বিশেষে। বিধবাদের অনেকে আসে, ভাবে তীর্থ করলেই ঝুলি ভরে যাবে। তাই বেরিয়ে পড়া। এ ভাবনা আসে পরোক্ষে। প্রত্যক্ষে সংসার আর বিষয়ভাবনা এদের পিছু ছাড়ে না। ছেলের বউ–এর সঙ্গে মন মতের মিল নেই। কেউ দেখতে পারে না কাউকে। তাই দুদিনের জন্যে বেরিয়ে পড়া। দুটো দিনই শান্তি। ছেলেমেয়েরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেও এটা পারেনি। তার চিন্তা নিয়েই পথে বেরনো। দ্বারকাধীশ যদি একটা ব্যবস্থা করে দেয়। কারও চিন্তা হল মেয়েটা পার হয়নি। ঠাকুর মেয়েটার একটা গতি করে দিও। এমন হাজার হাজার ভাবনা। ভ্রমণে পা চলে, মন আর সংসার পিছেপিছে। এদিকে ঘরে বউমা ভাবে, বাঁচলাম বাবা, যে কদিন বাইরে থাকে বুড়ি, সে কদিনই শান্তি। বাড়িতে এলে তো টিকতে দেবে না। এমনটাই দেখেছি অধিকাংশ বিধবা বুড়িদের কথায়, হাবভাবে। এদের বেশিরভাগের ঈশ্বর চিন্তায় নয়, সাংসারিক তাড়নায় বেরিয়ে পড়া।

এবার বলি এদের পথে বেরোনোর আগের কথা। পাড়া বেপাড়া শহর শহরতলি আর আত্মীয় পরিজন দের কারও জানতে বাকি থাকে না, ‘অ-দিদি, এবার দ্বারকায় চললুম। অনেকে দিনের ইচ্ছা কৃষ্ণকে দর্শন করি। আর কটা দিনই বা আছি। অনেককালই তো সংসার করলুম। তাঁর কৃপাতেই দর্শন হবে এবার।’ যে বউমার সঙ্গে মনের মিল নেই তাকে উদ্দেশ্য করে, ‘বউমাই আমার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’ বউমাও ভাবে, ‘হাড়ে বাতাস লাগবে কটা দিন।’ এইসব সধবা বা বিধবা বুড়িদের অনেকে তার যাওয়ার ব্যাপারে একই কথা বলতে থাকে পরিচিতি যাকে দেখে তাকে।

আর্থিক অসুবিধে যাদের আছে তাদেরও অনেকে সাবিত্রীতীর্থে চলেছেন বালির উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে। কষ্ট হলেও যেতে হবে। আর আর্থিক সামর্থ্য যাদের আছে, চলার শক্তি কম অথচ উঠতে হবে পাহাড়ে তাদের অনেকে চলেছেন ডান্ডিতে। অনেকের ভাবনা, তীর্থ করতে বেরিয়েছি তো লোকের ঘাড়ে চড়ব কেন?

এদের কাউকে ডাঁয়ে, কাউকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চলেছি সাবিত্রী পাহাড়ের দিকে। এ পথের যাত্রী অনেক। আমি চলেছি আমার মতো। হাঁটু কোমরব্যথা আর ছেলেপুলে কোনটাই আমার নেই। তাই ওদের চাইতে গতি আমার এখন অনেক বেশি। গতি বাড়িয়ে দিয়েছি আরও দূর থেকে গেরুয়াবসন পরা এক সাধুবাবার পিছনটা দেখে। তিনিও চলেছেন সাবিত্রীতীর্থে। সাধু বলে মনে হয়েছে বসনের জন্যে নইলে তীর্থযাত্রী বা ভ্রমণকারী বলেই মনে হত। দূরত্ব অনেকটা। বালির উপর দিয়ে বেশি জোরেও চলা যাচ্ছে না। হাঁপিয়ে উঠছি তবুও যতটা পারলাম চললাম। এগোলাম আনন্দেই, সাধু সঙ্গ হবে।

একসময় এসে গেলাম একেবারে সাধুবাবার পিছনে। কোনওদিকে তাঁর দৃষ্টি নেই, সামনে। এতক্ষণ আমার দৃষ্টি ছিল সাধুবাবার পিছনে। এবার এসে গেলাম পাশাপাশি। পিছন থেকে ডাকলে অনেকে অসন্তুষ্ট হয় তাই ডাকি না কাউকে। সাধুবাবাকেও ডাকলাম না।

এখন সামনে এসে আড়চোখে তাকালাম মুখের দিকে। তাকানো মাত্রই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হতাশ হয়ে গেলাম। ট্যারা। ভাঙা গাল। রঙ একেবারেই ময়লা বেশ কালো। মুখখানায় এতটুকু আকর্ষণ নেই। কুৎসিত দেখতে। দেহে সৌন্দর্যের কোনও চিহ্নই নেই। এমন রূপ, যার সঙ্গে কোনও কিছু দিয়ে তুলনা করা চলে না। সাধুদের সাধারণ সৌন্দর্য যেটুকু থাকে তার বিন্দুমাত্রও নেই। যেমন অনেক মেয়ের দেহের গঠন ও পোশাকে পিছনটা এমন সুন্দর, দারুণভাবে আকর্ষণ করে পুরুষদের। পরে অনেকসময় হতাশ হয় আমার মতো, যারা ‘ওভারটেক’ করে সামনে এসে দেখে। প্রথম দর্শনে আমি কিছু পেলাম না সাধুবাবার কাছ থেকে, না তাঁর রূপ, না সুন্দর দেহ। মানুষকে প্রথমদর্শন ব্যাপারটা যে মনের উপর কতটা ক্রিয়া করে তা প্রত্যক্ষভাবে গভীর উপলব্ধি হল এই প্রথম। সেইজন্য হয়ত রুক্ষমেজাজ দোকানদারের কণ্ঠেও মধু ঝরে সুন্দরী ক্রেতা দেখলে। মানুষের জন্যে মানুষ, স্বার্থসিদ্ধির সময়টুকু ছাড়া আর কখনও মনে হয় না।

সাধুবাবার চেহারাটা একটু খোলাখুলি বলি। ট্যারা, একেবারে মোক্ষম ট্যারা। আমার দিকে তাকালেন না পাহাড়ের দিকে, তা কিছু বোঝা গেল না। হাতুড়িমারা থ্যাবড়ানো গাল। চামড়া অথচ চ্যাপ্টা কপাল। সারা গালে নয়, থুতনিতে একগুচ্ছ দাড়ি। মাথায় সামান্য চুলে ছোটছোট কয়েকটা জটা ঝুলে আছে কাঁধ পর্যন্ত। আধুনিককালের চুলে ছাঁট দেয়ার পর মাপ যতটুকু দাঁড়ায় ততটাই। বিবর্ণ ফ্যাকাসে গেরুয়া বসন। কনুইয়ের হাড় বেরানো। মাংসের বড় অভাব। এমন অভাব সারা দেহে। কাঁধে ছোট্ট একটা ঝোলা। হাতে লম্বা লাঠি একটা। বেশ বয়েস হয়েছে। আন্দাজ ৭০/৭৫ এর কাছাকাছি।

এমনটা দেখার পর একটা কথা বলতেও প্রবৃত্তি হল না। যেমন প্রবৃত্তি হয় না সুন্দরীদের, রূপ নেই এমনদের সঙ্গে কথা বলতে। তার উপরে গায়ে যদি দারিদ্রের ছাপ থাকে তো কথাই নেই।

সাধুবাবাকে দেখলাম। এবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় কয়েক পা বাড়াতেই তিনি বললেন,

– কিরে বেটা, আমাকে পছন্দ হল না বুঝি?

এইভাবে জীবনে অপমানিত হইনি। এর চেয়ে সরাসরি যদি জুতো মারত তাহলে বোধ হয় মনে লাগত কম, অপমানিতও হতাম না। দাঁড়িয়ে গেলাম। এক পা-ও আর এগোল না। মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রইল না লজ্জায়। দাঁড়ালেন সাধুবাবাও। অভ্যাসবশত প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিলেন। মুখ থেকেও কোনও কথা সরল না। সাধুবাবাই বললেন,

– বেটা, মানুষের মনের ছবি তোলা যায় না। তা যদি যেত, তাহলে কেউ কাউকে কোনওদিন মুখ দেখাতে পারত না সংসারে। আমার রূপ নেই তাই তোর প্রণামে আন্তরিকতাও নেই। বুঝলাম প্রণাম করলি নিয়ম রক্ষার্থে। একমাত্র আশীর্বাদই হল প্রণামের বিনিময়। তাই-ই তোকে বলি, বেটা তুই পরমানন্দে থাক।

জীবনে সাধুসঙ্গের সময় অনেক সাধুর গালাগাল খেয়েছি অনেক। মুখে আনা যায় না এমন গালিও দিয়েছে অনেকে। তবে কারও কাছে কথায় এমনভাবে অপমানিত হইনি। কি বলব, কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। লজ্জায় মাথাটা আমার আরও নত হয়ে এল। মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তিও যেন হারিয়ে গেল। সাধুবাবা বললেন,

– তোর কোনও দোষ নেই বেটা। আমার রূপ নেই বলে সংসারই যখন আমাকে গ্রহণ করেনি তখন তুই-ই বা করবি কেমন করে। আমাকে দেখে এড়িয়ে যেতে চাইছিলি, এতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি আমি দুঃখিতও নই।

এ কথায় মানসিক অপরাধবোধ জেগে উঠল আমার। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সাধুবাবার পা-দুটো ধরে বসলাম,

– আমার নিচ মনের এই অপরাধের জন্যে ক্ষমা করে দিন আমাকে। আশীর্বাদ করুন, কারও রূপ গুণ কিছু না থাকলেও তাকে অবজ্ঞা করার মনটা যেন কখনও না হয়।

আমার দু-বাহু ধরে টেনে তুলতে তুলতে বললেন,

– ওঠ ওঠ বেটা, লোকে দেখলে অন্য কিছু ভাববে। কিছু মনে করিনি আমি। ওঠ ওঠ।

Pushkar

উঠে দাঁড়ালাম। একটু স্মৃতি এল মনে। এতক্ষণ পর তাকালাম সাধুবাবার মুখের দিকে। দেখলাম হাসিতে ভরা মুখখানা। এবার কুৎসিত রূপ আর চোখে পড়ছে না। মুহুর্তে কোথায় যেন সব মিলিয়ে গেছে। উজ্জ্বল প্রসন্ন হাসি। আনন্দময় হাসি। এ হাসি বোধ হয় সাধুরাই হাসতে পারে। এখন আর রূপ কাজ করছে না আমার মনে। হাসির ছটায় চোখ মুখে ভেসে যাচ্ছে সৌন্দর্যে। কোনও শিশুর মুখ কিংবা ফুলের সঙ্গে এখন এ মুখের তুলনা করা যায়। অভাবের সংসারে পিতৃহীন মা খাবার জোগাড় করেছেন অতিকষ্টে। নিজে না খেয়ে শিশুকে খাওয়ানোর পর যে তৃপ্তিতে আনন্দময় এক রূপ ফুটে ওঠে মায়ের মুখে, এখন সেই রূপসৌন্দর্য্যে ভরে উঠেছে সাধুবাবার মুখখানা। একেবারে মোহিত হয়ে গেলাম। কয়েক মিনিটের জন্যে চিন্তাশূন্য হয়ে গেল মনটা। সাধুবাবার কথায় মনটা আবার ফিরে এল মনে। বললেন,

– বেটা সাবিত্রী মায়ের দর্শনে যাবি, এখানে বোকার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? চল চল, এখন পথ হাঁটতে হবে অনেকটা। জীবনের পথও অনেক লম্বা। দাঁড়িয়ে থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছবি কেমন করে? যে দাঁড়িয়ে থাকে, সে দাঁড়িয়েই থাকে। তোকে আমাকে সকলকেই এগোতে হবে। দেরি করলে চলবে কেন?

সাধুবাবা আর আমি এগিয়ে চলি দুজনে। মুখ থেকে এখনও আমার কথা সরছে না। পথ চলছি নিঃশব্দে। বালির উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি চলা যায় না, তাই চলছি ধীরে ধীরে। কোনও কথা বলছি না দেখে বললেন,

– তোকে অপমান বা আঘাত করব বলে কথাটা বলিনি। তোর মনের কথা আমার মনে হয়েছে বলেই বলেছি। এতে তোর মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিস আমাকে।

এ কথার উত্তরে কোনও কথা বললাম না। সাধুবাবা বললেন,

– কোথায় থাকিস? এখানে কি বেড়াতে এসেছিস?

আমার আসার কারণ ও উদ্দেশ্যের কথা জানালাম। আমরা এসেও গেলাম সাবিত্রী পাহাড়ের পাদদেশে। হাওয়া বইছে হু-হু করে। চলার সময় বেশ গরম লাগছিল। এবার দুজনে উঠতে লাগলাম পাহাড়ি পথ ধরে। উঠছে আমদের মতো আরও অনেক তীর্থযাত্রী, দর্শনার্থীরা। এতক্ষণ পর এই প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আপনার বাড়ি কোথায় ছিল, বর্তমানে ডেরাই বা কোথায়?

মানসিক প্রসন্নতার সুর ফুটে উঠল সাধুবাবার কণ্ঠে। বললেন,

– বিহারের এক অজগাঁয়ে। নাম বললে তুই চিনতে পারবি না। ও নাম তুই শুনিস নিও। আমার ডেরা নেই কোথাও। একমাত্র পথই আমার পরম আশ্রয়।

পাহাড়ি পথের দুপাশে, কখনও বা এক পাশে ছোটবড় নানা ধরনের গাছ। পাহাড় কেটে তৈরি সিঁড়ির মতো রাস্তা। ধীরে ধীরে উঠছি দুজনে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে বিশ্রাম নিচ্ছেন বয়স্করা। বসে আছেন পাথরের চাঁই-এ পথের ধারে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, ঘর ছেড়েছেন কত বছর?

এতটুকু না ভাবেই বললেন,

– তখন আমার বয়েস বছর ত্রিশ-বত্রিশেক হবে।

– এখন বয়েস কত?

উত্তর দিলেন একটু ভেবে,

– সত্তরের উপর হবে, তার কম নয়।

এবার আর দ্বিধা না করে বললাম,

– ঘর ছাড়লেন কেন?

ইশারায় একটা পাথর দেখালেন। বসতে বললেন। বসলাম দুজনে। এতক্ষণ চলার মধ্যে একটুও বিশ্রাম করিনি তাই বসলাম। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা সংসারে কিছু পুরুষ আছে যারা রোগগ্রস্ত। এরা স্ত্রীকে ভোগ করতে পারেনা, ত্যাগ করতেও পারে না। আমি রোগগ্রস্ত নই, রুগীর মানসিকতারও নই। ভোগই যখন করতে পারব না তখন ভোগের আশায় সংসারে পড়ে থেকে লাভ কি? তাই সব ছেড়ে, মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় বান্ধব সবাইকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে। এমনিতেই সংসারে থাকার সময় মৃত্যু হয়েছে সংসারের। বেঁচে ছিল মনটা। থাকলে মনটারও মৃত্যু হত। বেটা একেবারেই অকালে মৃত্যু হত।

কথার সুরে পেলাম ব্যথিত জীবনের ইঙ্গিত। জানতে চাইলাম,

– আপনার কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। একটু খোলাখুলি বলবেন বাবা।

মলিনতার ছাপ ফুটে উঠল সারা মুখখানায়। বললেন,

– ওসব কথায় কাজ নেই। চল বেটা এগোই।

কথাটা বলেই উঠতে যাচ্ছিলেন। বাঁপাশে বসে ছিলাম। আমার ডানহাত দিয়ে সাধুবাবার বাঁহাতটা টেনে ধরে বসিয়ে বললাম,

– যেতে তো হবেই। একটু বসুন না, দয়া করে বলুন না বাবা কেন ঘর ছাড়লেন আপনি?

চুপ করে বসে রইলেন মিনিট পাঁচেক। লক্ষ্য করলাম, ধীরে ধীরে সাধুবাবা যত অতীতে চলে যাচ্ছেন মনে মনে, ততই বেড়ে যাচ্ছে মুখের মলিনতা। এইভাবে কাটল আরও কিছুক্ষণ। পরে বললেন,

– বেটা, জীবনের প্রথম ৩০/৩২টা বছর সংসারে কেটেছে আমার অকর্মণ্য অপদার্থতার অবস্থায়। এর একমাত্র কারণ আমার রূপ, নেই দেহে বিন্দুমাত্র সৌন্দর্য। ছোটবেলায় পড়াশুনো করিনি। তখন কোনও স্কুল ছিল না আমদের গাঁয়ে। পড়াশুনোর পাটও ছিল না ঘরে ঘরে। আমার কোন বন্ধু নেই ছোটবেলা থেকে, আজও। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে এড়িয়ে চলত। প্রথম প্রথম যখন বয়েস কম ছিল তখন বুঝতাম না। যখন জ্ঞান হল তখন বুঝলাম আমার একমাত্র অপরাধ আমি দেখতে কুৎসিত। কষ্ট হত মনে। ছোটবেলায় মাকে এসে বলতাম, ‘মা সবাই খেলা করে, আমকে কেউ খেলায় নেয় না। তাড়িয়ে দেয়। আমি কি কোনও অপরাধ করেছি?’ মা আমার একথার কোনও উত্তর দিত না। তবে দেখতাম মায়ের মুখখানা অন্ধকার হয়ে যেত। একমাত্র মা ছাড়া সংসারে আমার বাবা ভাই বোন প্রতিবেশী কেউই আমাকে ভালবাসেনি, আদর করে ডাকেনি। আন্তরিকতা তো দূরে থাক, ভালভাবে কথা পর্যন্ত কেউ বলেনি। এমন মনকষ্ট নিয়েই বড় হতে লাগলাম। জমিতে জনমজুরের কাজ করব, তাও আমার মেলেনি। একদিন কিছু সবজি নিয়ে বসেছিলাম গাঁয়ের হাটে। দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বসেই রইলাম। দু-পয়সার খদ্দের জুটল মাত্র একটা। আমাকে দেখে, কিন্তু কেনে না। একই জিনিস অন্যে নিয়ে বসেছে, তার কাছ দিয়ে কিনছে সবাই। আমি শুধু বসে বসে দেখলাম। সন্ধ্যের সময় সব নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। তারপর আর কখনও হাটে যাইনি। পাঁচজনের হাঁড়িতে একজনের দু-মুঠো যেমন জোটে তেমন জুটত আমারও। ঠিক এইভাবে, একই নিয়ম, অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কাটল আমার জীবনের প্রথম ৩০/৩২টা বছর।

একটানা বলে সাধুবাবা থামলেন। অসহ্য বেদনা আর বাল্যব্যথার ছাপ ফুটে উঠল মুখখানায়। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। চুপ করে রইলেন মিনিটখানেক। লক্ষ্য করতে লাগলেন যাত্রীদের যাওয়া আসা। কথা না বলে শোনার অপেক্ষায় রইলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– বেটা, আমার জীবনের তুই একমাত্র ব্যক্তি, যার সঙ্গে এই প্রথম কথা হল এতক্ষণ, যে ধৈর্য ধরে শুনছে আমার কথা। আজ তোকে পেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে মনে। জয় হোক তোর, সারাজীবন তোর জয়জয়কার হোক।

বলে হাতদুটো মাথায় বুলিয়ে দিলেন স্নেহভরে। কোনও কথা বেরল না মুখ থেকে। অভিভূত হয়ে পরলাম আমি। সাধুবাবা বললেন হতাশার সুরে,

– বেটা, সংসারে থেকেও আমার কাছে মরে গেল সংসারটা। হতভাগ্য বোধ হয় একেই বলে, তাই না বেটা? জীবনে কোনও অপরাধ করিনি আমি অথচ এমন চরম দণ্ড দিলেন ভগবান, এ কোন পাপে বলতে পারিস?

চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। মাথাটা নিচু করে মনে মনে বললাম, বাবা এর উত্তর আমার জানা নেই। ভাবলাম, সংসারে তো কত কুৎসিত রূপের নারী পুরুষ দেখা যায়, তাদের জীবনে কি কখনও এমন হয়েছে? সাধুবাবারই বা এমন হবে কেন? চিন্তাগুলো মাথায় কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। কিছুই আর ভাবতে পারছি না। সাধুবাবা বললেন,

– এমন এক যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করতে করতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। একদিন না পেরে মাকে বললাম আমার মনের কথা। আমি বুঝতাম, মা বুঝতেন আমার অন্তরের দুঃখের কথা। কি-ই বা করার ছিল মায়ের! বেটা, এমন কোনও বাক্যের সৃষ্টি করেনি বিধাতা, যে বাক্যে আমার এই পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দেবেন তিনি। অথচ দেখ, সংসারে সব যন্ত্রণা উপশমের জন্যে বিধাতা সব ধরণের বাক্য সৃষ্টি করেছেন, যে বাক্যে রোগে শোকে দারিদ্রে ব্যথা বেদনায় সান্ত্বনা পেতে পারে মানুষ।

এই পর্যন্ত বলে চুপ করে রইলেন। ফোঁটাফোঁটা জল ঝরতে লাগল চোখ থেকে। কি বলব আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম মুখের দিকে। খানিক পরে ভাবটা একটু সম্বরণ হতে বললেন,

– বেটা, একদিন গোপনে মাকে বললাম, ‘মা যে সংসারে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কেউই গ্রহণ করল না আমাকে, সে সংসারে থেকে লাভ কি?’ কথাটা শুনে মা আমার অঝোরে কাঁদলেন। একদিন সকলের অলক্ষ্যে উঠলাম ভোররাতে। ডেকে তুললাম মাকে। প্রণাম করলাম। অনুমতি দিলেন না, তবে বাধাও নয়। বেরিয়ে পড়লাম মানুষের রূপ নয়, ঈশ্বরের রূপ জানতে, যিনি আমার এমন রূপ স্রষ্টা, যাঁর জন্যে সংসারে পেলাম না কিছু।

এবার উঠে দাঁড়ালেন সাধুবাবা। উঠে দাঁড়ালাম আমিও। চলতে শুরু করলাম পাশাপাশি। লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে চলতে বললেন,

– বেটা, বড় দেরি হয়ে গেছে। আরও অনেক আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল আমার। কোনও অপরাধ তো করিনি আমি, তাই আশা আর অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু হল না।

হঠাৎ খপ করে সাধুবাবা বাঁহাত দিয়ে আমার ডানহাত ধরে দাঁড়ালেন। বললেন আবেগের সুরে,

– বেটা, এই সংসারে যা কিছু দুঃখ, যা কিছু মানসিক কষ্ট, তার মূলই হল একমাত্র আশা। মানুষের দুঃখ শোক আর মানসিক কষ্ট উৎপন্ন করে আশা। এটা ত্যাগ করতে না পারলে পৃথিবীর কোনও মানুষ, কোনওদিন মুক্ত হতে পারবে না মানসিক কষ্ট থেকে। বেটা, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আশা ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে, সে বাঁচায় আছে এক অদ্ভুত আনন্দ, পরমানন্দ। আশামুক্ত জীবনটাই একটা আলাদা জীবন। যেখানে প্রবেশ করা বড় কঠিন। সে পথও সাধনার পথ। বেটা, যতদিন বেঁচে থাকবি সংসারে, আশা ছাড়াই চলতে চেষ্টা করবি। দেখবি একসময় মনটা তৈরি হয়ে গেছে। চাওয়া পাওয়ার বাসনা থেকে একেবারেই মুক্ত হয়েছে মন। পরে দেখতে পাবি, আশা করে মানসিক কষ্টের মধ্যে থেকে যা পেতিস, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছিস আশা না করে।

হাতটা ছেড়ে দিলাম। নিঃশব্দে চলতে শুরু করলাম দুজনে। প্রায় মিনিটদশেক পথ চললাম কোনও কথা না বলে। ভাবতে লাগলাম সাধুবাবার কথা। প্রথমে অন্তর থেকে গ্রহণ করিনি আমি, তিনিই আমাকে আপন করে নিয়ে এমন আন্তরিকভাবে কথা বলেছেন দেখে অন্তরে আমার এক অদ্ভুত আনন্দের সঞ্চার হল। ভেসে গেল মনটা।

Show More

One Comment

  1. আপনি সারাজীবন অনেক ঘটনারই তো সাক্ষী , অনেক সাধনার
    ফল আপনার আয়ত্ত্বে , তাই আমাদের কিছু দান করুন, যদিও নব‍্য
    যুবক যুবতীরা এসবকে মানে না , কিন্তু একদিন অবশ্যই টের পাবে । আপনাকে অনেক অনেক প্রনাম জানাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *