লোভের হাত থেকে মুক্তির পথ দিলেন বৃদ্ধ সাধুবাবা
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ তিরানব্বই। প্রাণের দুয়ারখোলা হাসি। এ হাসি যেন মন্দাকিনীর স্ফটিকধারা। এ হাসি একমাত্র সাধুরাই পারে হাসতে।
এই পর্যন্ত বলে সাধুবাবা হুট্করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন আমি কি করি? এমন মধুর কণ্ঠস্বরে কেমন করে যেন অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে গেল। সেই স্বর আর ভাবটা এখন এমন যেন আমি ডাকাতি খুন খারাপি করি। যাইহোক, যেহেতু সাধুবাবা বলেছিলেন তাঁর গুরুজি তাঁকে শাস্ত্র ও যোগশিক্ষা দিয়েছেন, সেই কারণে সোজাসাপটা কি করি তা না বলে ঘুরিয়ে বললাম,
– বাবা, মহাভারতীয় যুগে মহাপ্রস্থানের পথে পঞ্চপাণ্ডবদের একের পর দেহের পতন হতে লাগল। আনুমানিক ৪৪৫০ বছর আগে নগ্নপদে, নগ্নগাত্রে, যোগ সমাহিতচিত্তে, নিরুদ্ধ ইন্দ্রিয় প্রায় ৯০ বৎসর বয়স্ক রাজা যুধিষ্ঠির চলেছেন অবিচলিত পদক্ষেপে। প্রথম দেহের পতন হল দ্রৌপদীর। তিনি জানতে চাইলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, কোন অপরাধে তাঁর দেহের পতন ঘটল?
রাজা যুধিষ্ঠির জানালেন, দ্রৌপদী, তোমার পাঁচ পাঁচটা স্বামী। তাঁরা সকলেই তোমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতো কিন্তু তুমি সকলকে ভালবাসলেও বেশি ভালোবাসা ছিল তোমার অর্জুনের উপর। এই পক্ষপাতদুষ্ট ভালোবাসার কারণে তুমি সশরীরে স্বর্গে যেতে পারলে না। সেইজন্যই তোমার দেহের পতন ঘটল।
এইভাবে একের পর এক ভাইদের দেহপতনের কারণ বর্ণনা করতে করতে চলেছেন রাজা যুধিষ্ঠির। একসময় দেহের পতন ঘটল সহদেবের। তিনি জানতে চাইলেন,
– দাদা, কি ও কোন অপরাধে আমার এ দেহের পতন হল যে তোমার সঙ্গে স্বর্গে যেতে পারলাম না।
রাজা যুধিষ্ঠির বললেন,
– ভাই সহদেব, তুমি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, রূপবান। এটা তুমি জানতে আর সেই কারণে তোমার অহঙ্কার ছিল। এছাড়া একটা বিশেষ বিদ্যালাভ করেছিলে, যে বিদ্যা নিজে জানলেও তার ফলাফল অন্যকে জানানোর অধিকার তোমার নেই কিন্তু সেই কাজটা তুমি করেছিলে। রূপের অহঙ্কার আর বিধাতার বিধি লঙ্ঘনের জন্য তোমার দেহের পতন হল।
এরপর রাজা যুধিষ্ঠির এগিয়ে চললেন মহাপ্রস্থানের পথে আর সাধুবাবা তাকালেন আমার মুখের দিকে। আমার কর্মজীবন কি তা বৃদ্ধ বুঝতে পেরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বসা অবস্থায় আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,
– বহুত বড়িয়া বেটা, বহুত বড়িয়া। এই জন্যই তো তোর সঙ্গে বসে দুটো কথা বলছি। যারা আসে, কথা বলে, তারা সব সংসারের দুঃখের কথাই বলে। আসলে কষ্টে আছে বলেই তো বলে। এবার তোকে আসল কথাটা বলি। আমি জানতে চাইছিলাম তুই এমন কোনও কাজ করিস কিনা যাতে ঘুষ কিংবা সুদ খেতে হয়। দেখলাম নাহ্, ও পথে তুই নেই। বেটা বড় দুঃখের সঙ্গে বলছি, যারা ঘুষ কিংবা জিনিস বন্ধক রেখে সুদ খায় (সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে তার মাধ্যমে পাওয়া সুদের অর্থ নয়)। তাদের জন্য আমার কষ্ট হয়। এরকম কোনও সুযোগ এলে সব সময় এড়িয়ে যাবি। যারা ঘুষ কিংবা সুদ খায় তার পরপর তিন প্রজন্ম ভুগতে থাকবে ওই অর্থ ভোগ করার জন্য।
বলে একটু থামলেন। ব্যাপারটা খোলসা করে বলার জন্য অনুরোধ করলাম।
সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, যারা ঘুষ কিংবা সুদ খাচ্ছে, তাদের জাগতিক ভোগটা ভালো হবে তবে শান্তি নষ্ট হবে সংসারজীবনের। সবসময় কোনও না কোনও ভাবে মানসিক উদ্বেগ ও অশান্তিতে ভুগবে। সংসারে কারও না কারও রোগভোগের জন্য অর্থব্যয় হবে জলের মতো। অর্থক্ষতি হবে যেকোনও ভাবে। মোটের উপর স্ত্রী সন্তানসহ নানান অশান্তি রোগভোগ ও দৈবদুর্বিপাকে পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হবে সারাজীবন। শত সুখেও শান্তিহীন জীবন হয় এদের।
এরপর সন্তানের প্রজন্ম ভুগবে ওই একইভাবে। সে তার স্ত্রী বা স্বামী সন্তান নিয়ে ভুগতে থাকবে যে কথাগুলো তোকে বললাম। এবার এদের সন্তানদের যে প্রজন্ম তাদেরও এক ছিটেফোঁটা রেহাই নেই। মোট তিনটে প্রজন্ম ঘুষ ও সুদরূপ পাপরাশি গ্রহণ করে অমানুষিক কষ্ট ভোগ করবে। গুরুজি বলেছিলেন, বেটা তোদের তো জ্ঞাননেত্র খোলেনি তাই দেখতে পাস না। মৃত্যুর পর ঘুষ ও সুদখোরদের পাপকর্ম ক্ষয় করতে হয় কুকুরযোনিতে জন্মগ্রহণ করে।
আরও পড়ুন : দৃষ্টিদোষের অশুভ প্রভাব এড়ানো ও মুক্তি পাওয়ার পথ দিলেন সাধুবাবা
সাধুবাবার একথা শোনার পর সারাটা দেহ আমার শিউরে উঠল ভয়ে। এর আগে অন্য ক্ষেত্রে একটি সাধুসঙ্গের সময় এক সাধুবাবা কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘বেটা, ঘুষ আর সুদ খাবি না কখনও।’ তবে ভয়াবহ পরিণতির কথা তিনি কিছু বলেননি। আজ নেপালে দেবী গুহ্যেশ্বরীর মন্দিরক্ষেত্রে বসে এসব কথা শুনে চমকে উঠলাম। তিরানব্বই-এর বৃদ্ধের মুখে ‘কুকুর যোনিতে জন্মগ্রহণ’ কথাটা শুনে মনে পড়ে গেল সুদূর অতীতের একটি ঘটনার কথা ও কাহিনি।
আমার শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় জ্ঞানদাপ্রসাদ চৌধুরীর মুখে ঘটনাটির কথা শুনেছিলাম ১৯৭৯ সালে। তিনি শুনেছিলেন তাঁর শ্বশুরমশাই-এর কাছ থেকে। শ্বশুরমশাই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ঢাকা কোর্টের আইনজীবী। একসময় তিনি (নামটা আজ আর মনে নেই) বিখ্যাত ভাওয়ালের (সন্ন্যাসী) রাজার পক্ষ নিয়ে ঢাকা কোর্টে মামলা লড়ে জয়লাভ করেছিলেন। এঁদের সেই কথা ও কাহিনি আমার ভাষায়।
সমগ্র মহাভারত মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহামহোপাধ্যায় ভারতাচার্য মহাকবি পদ্মভূষণ শ্রীমদ্হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য (২২.১০.১৮৭৬ — ২৬.১২.১৯৬১)। (মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত মূল সংস্কৃত) ১৯২৯-এ নীলকণ্ঠের টীকাসহ বাংলায় মহাভারত রচনার কাজ শুরু করে দীর্ঘ ২৯ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর মহাভারত সম্পাদনার কাজ শেষ করেন ১৯৫৮ সালে। সৌভাগ্যক্রমে সেই মহাভারত আমার সংগ্রহে আছে।
হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের বয়স তখন অনেক। ভরাশীতকালে একদিন স্নানের আগে বাড়ির সামনে একটি কালোজাম গাছের গোড়ায় বসে গায়ে তেল মাখছিলেন। হঠাৎ কানে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে তাকিয়ে দেখলেন স্থানীয় এক জমিদারের সঙ্গে অন্য এক জমিদারের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। এরপর এক জমিদার উত্তেজিত হয়ে গুলি করে মেরে দিলেন অন্য জমিদারকে। মৃত জমিদার পরিবার থেকে খুনের মামলা দায়ের করা হল ঢাকা কোর্টে।
এই মামলায় প্রতিপক্ষ অর্থাৎ হত্যাকারী জমিদারের হয়ে আইনি লড়াইতে জমিদারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। অভিযোগকারীর তরফ থেকে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসাবে সিদ্ধান্তবাগীশকে তলব করা হল কোর্টে।
বৃদ্ধের পরনে সাদা ধবধবে ধুতি। গায়ে জড়ানো উত্তরীয়। তাঁরই নিচের অংশ থেকে বেরিয়ে আছে দুধরঙা পৈতে। পায়ে মুণ্ডিদেওয়া কাঠের খড়ম। যথারীতি কাঠগড়ায় উঠলেন সিদ্ধান্তবাগীশ। প্রশ্ন শুরু করলেন চিত্তরঞ্জন,
– কি নাম আপনার?
– হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য।
– কি জাত আপনার?
– জাতিতে ব্রাহ্মণ।
– বিশ্বাস হয় না আপনি ব্রাহ্মণ। পৈতে থাকলেই কি ব্রাহ্মণ হওয়া যায়?
এবার একটু উত্তেজিত হয়ে সিদ্ধান্তবাগীশ,
– চিত্তরঞ্জন, বাজে কথা বোলো না। প্রতিদিন তিন সন্ধ্যা আহ্নিক আর নারায়ণের চরণে তুলসী না দিয়ে আমি জল গ্রহণ করি না।
অনেক কথার পর চিত্তরঞ্জন ধমকের সুরে চিৎকার করে বললেন,
– এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আপনি যা বলেছেন তা একটাও সত্য নয়। যখন গোলাগুলি চলে তখন আপনি কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন?
হরিদাস জানালেন,
– স্নানে যাওয়ার আগে কালোজাম গাছের গোড়ায় বসে গায়ে তেল মাখছিলাম। এখন শীতকাল তাই গায়ে তেল মেখে স্নান করলে শীতটা কম লাগে।
চিত্তরঞ্জন বললেন,
– আপনি সমানে মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি ওখানে ছিলেন না। আমার মক্কেল জমিদার অন্য জমিদারকে গুলি করে মেরেছে, এটাও আপনি ঠিক দেখেননি। এসবই আপনি মিথ্যা বলছেন।
এবার আরও উত্তেজিত হয়ে সিদ্ধান্তবাগীশ বললেন,
– মুখ সামলে কথা বল চিত্তরঞ্জন। আমি জীবনে কোনওদিন মিথ্যা কথা বলিনি অথচ তুমি আমাকে সমানে মিথ্যাবাদী বলছো?
এইভাবে নানান ধরনের কথোপকথনে কেটে যায় বেশ কয়েকদিনের শুনানি। প্রতিটা শুনানিতে লোকভর্তি কোর্টের মধ্যে সিদ্ধান্তবাগীশ কোনও কথা বললে চিত্তরঞ্জন মিথ্যাবাদী হিসাবে অভিহিত করতে থাকেন। একদিন চরমভাবে উত্তেজিত করলেন সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়কে। উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে তখন চিত্তরঞ্জন কোর্ট স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো এক ধমক দিয়ে বললেন,
– সেই থেকে সমানে মিথ্যা কথা বলছেন আর নিজেকে বলছেন সত্যবাদী ব্রাহ্মণ। কালোজাম গাছের গোড়ায় বসে সেদিন কি করছিলেন?
এবার উত্তেজনায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন ভারতবরেণ্য পণ্ডিত শ্রীমদ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য। ঢাকা কোর্টে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সুখ্যাত আইনজীবী চিত্তরঞ্জনকে বিদ্রূপ করে বললেন,
– কালোজাম গাছের গোড়ায় বসে সেদিন আমি কালোজাম খাচ্ছিলাম।
ব্যস, আর কোনও সওয়াল বা জবাবের প্রয়োজন হল না চিত্তরঞ্জনের। তিনি আদালতকে জানালেন,
– মহামান্য আদালত, আমার মক্কেল নির্দোষ। সে কাউকে গুলি করে হত্যা করেনি। আসলে এই বৃদ্ধের বয়স হয়েছে। চোখে কম দেখেন অথবা আবছা কিছু দেখেন। সেই ভাবে হত্যার ঘটনা একটা দেখেছেন, তবে তা একেবারেই অস্পষ্ট। কেউ কাউকে গুলি করে মেরেছে তবে আমার মক্কেল নয়, এটাই সত্য। সাক্ষী সিদ্ধান্তবাগীশ যে একটা প্রথম শ্রেণির মিথ্যাবাদী তা আদালত যেন নোট করে। কারণ তিনি জানিয়েছেন, কালোজাম গাছের গোড়ায় বসে সেদিন তিনি কালোজাম খাচ্ছিলেন। মহামান্য আদালত, শীতকালে কোনও দিন কালোজাম হয় না।
যথা নিয়মে খুনের মামলা খারিজ হল। জয়ী হলেন চিত্তরঞ্জন। এই ঘটনার দিন কয়েক পর চিত্তরঞ্জন গেলেন সিদ্ধান্তবাগীশের বাড়ি। দেখামাত্রই বৃদ্ধতাপস মহাভারতের অনুবাদক বললেন,
– বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও চিত্তরঞ্জন। আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাইনা। অসংখ্য লোকের মধ্যে তুমি আমাকে অপমান করেছ, মিথ্যাবাদী বানিয়েছে। সেদিন পায়ের কাছে রুপোর থালায় সাজানো মোহর রেখে দেশবন্ধু সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন,
– আমি জানি, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ জীবনে কোনওদিন মিথ্যা কথা বলেননি। এমন নির্লোভ সৎ ও সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ যা এযুগে প্রায় বিরল। এটাও জানি, নিত্য নারায়ণ শিলায় তুলসী না দিয়ে জীবনে কোনও দিন একঢোক জল পান করেননি। জীবনে কখনও কারও দান গ্রহণও করেননি। আমি জানি সিদ্ধান্তবাগীশ গুণসাগর। আমার যা অন্যায় অপরাধ তা আপনি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। মাত্র কয়েকটা কথা বলার আছে আপনাকে। আমি যে হত্যাকারী জমিদারের হয়ে মামলা লড়লাম, সে আমার কাছে স্বীকার করেছে যে, সেইই হত্যা করেছে জমিদারকে। আমি যদি আপনাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে না পারতাম তা হলে আপনার সাক্ষ্যের উপরে আমার মক্কেল জমিদারের একমাত্র সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড। একটা পরিবার তো অনাথ হয়েছে। আপনার কথার উপরে শিশুসন্তান নিয়ে আর একটা পরিবার অনাথ হয়ে যেত। আমি একজনের প্রাণরক্ষা করে আর একটা পরিবারকে অনাথ হতে দিইনি। এতে আমার অপরাধ কোথায় দয়া করে বলবেন?
এ কথা শোনার পর সিদ্ধান্তবাগীশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভাবলেনও খানিক সময়। পরে বললেন,
– হ্যাঁ চিত্তরঞ্জন, তুমি ঠিক কাজই করেছ, নইলে আর একটা পরিবার আমার সাক্ষ্যের উপরে অনাথ হয়ে যেত। প্রাণদণ্ড হত ওই জমিদারের তবে তুমি এটাও জেনে রাখো, সামনের জন্মে হত্যাকারী ওই জমিদারের জন্ম হবে ‘কুক্কুর যোনিতে’।
ঠিক এই মুহুর্তে সাধুবাবার কাছে বসে ভাবছি, একজন হত্যাকারীর মৃত্যুর পর কুকুর যোনিতে জন্মই যদি সাজা হয়, সাধুবাবার কথায় ঘুষ ও সুদখোরদেরও ওই একই সাজা, তাহলে তাদের পাপের মাত্রা কি হত্যাকারীর পাপের মাত্রার সমতুল?
আর কিছু ভাবলাম না। বললাম,
– বাবা, সংসারে থেকেও মানুষ জাগতিক সমস্ত দুঃখকষ্টের হাত থেকে কি করলে মুক্ত হতে পারবে?
জিজ্ঞাসার উত্তরটা মুহুর্ত ভাবলেন না। প্রসন্নচিত্ত বৃদ্ধ হাসিমাখা মুখে বললেন,
– কারুমণ্ডিত কলসের সৌন্দর্য দেখে কোনও লাভ নেই। ওর ভিতরে ভগবানের নামরূপ সুধা ঢেলে পান করলে তবেই সংসারের যাবতীয় রোগ শোক দুঃখ দুর্ভোগ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। পলকে সময় কেটে জীবন যাচ্ছে ছোট হয়ে। ক্রমশ ছোট হতে হতে একসময় শ্বাসের গতি যাবে রুদ্ধ হয়ে। আর দেরি নয় বেটা, এখনই হাজার কাজের মধ্যে থেকেও তাঁর নামামৃত পান করে যা, দেখবি কোনও কষ্ট, জগতের কোনও মলিনতা, কোনও আবিলতাই মনকে স্পর্শ করতে পারবে না। মন সদা সর্বদা থাকবে পরমানন্দে মজে।
এরপর হাসতে হাসতে বললাম,
– বেশ কিছু খাবারের উপরে আমার বড় লোভ। সেই খাবারটা খাচ্ছি মন ভরে তবুও ওই খাবারের উপরে লোভটা আমার কিছুতেই যাচ্ছে না। কি করলে এই লোভের হাত থেকে নিস্তার পেতে পারি?
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ তিরানব্বই। প্রাণের দুয়ারখোলা হাসি। এ হাসি যেন মন্দাকিনীর স্ফটিকধারা। এ হাসি একমাত্র সাধুরাই পারে হাসতে। ভগবান যেন হাসির ঠিকেদারিটা টেন্ডার ডেকে সাধুদেরই দিয়ে রেখেছেন। জ্ঞানত কোনও গৃহীকে আজ পর্যন্ত এমন নির্মল হাসি হাসতে দেখিনি। যে হাসি দেখি তা কৃত্রিম, ভেজালে ভরা কিন্তু খোলসে লেখা থাকে ১০০ শতাংশ খাঁটি। সাধুবাবা বললেন,
– হাঁ বেটা, সংসারী মানুষদের এটা একটা সমস্যা বটে। তবে এ সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পথটা বলছি শোন। যে কোনও খাদ্যবস্তু যাতে যার লোভ আছে, সেই বস্তুটি কিনে সে যদি কোনও মানুষকে প্রাণভরে খাওয়াতে থাক, দেখবি কিছুদিনের মধ্যে ওই খাদ্যবস্তুর উপর থেকে লোভ চলে যাবে চিরতরে। সেধে কেউ খাওয়াতে আসলে তখন হাতে পেলেও অন্তর থেকে খাওয়ার প্রবৃত্তিটা একেবারেই আসবে না। কাজটা কিছুদিন করলেই ফলটা পেয়ে অবাক হয়ে যাবি। খাওয়ানোটা কিন্তু নিজেকেই করতে হবে।
কথাকটা শেষ করেই বৃদ্ধ আবার হাসতে লাগলেন। বুঝলাম এ হাসির মধ্যে কোনও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে নইলে এমন করে হাসবেন কেন? কারণটা জিজ্ঞাসা করলাম না। দেখি নিজের থেকে কিছু বলেন কিনা? বৃদ্ধ বললেন,
– বেটা, মদের নেশাও কাটানো যায় তবে একটু সময় লাগলেও কাটবে। যার মদের নেশা আছে, তাকেই করতে হবে কাজটা। যার মদের নেশা নেই এমন কোনও মানুষকে কিছুদিন ধরে নেশাকারী নিয়মিত মদ পান করালে নেশাকারীর মদে আসক্তি যাবেই যাবে। কাজটা বেশ কিছুদিন ধরে চালালেই ফল পাওয়া যায় নিঃসন্দেহে। আসক্ত বস্তু অন্যকে দিয়ে ভোগ করালে সেই বস্তুতে আসক্তি কেটে যায়।