মাকালী নিজে স্বর্গলোক ঘুরিয়ে দেখালেন দৃষ্টিহীন বৃদ্ধাকে
যেদিন মা (মাকালী), ঠাকুর (শ্রীরামকৃষ্ণ), লোকনাথ (লোকনাথ ব্রহ্মচারী), রাধারানী আমার হাত ধরে আনে, সেদিন কোনও কষ্ট হয় না। গোপাল তো বাচ্চা, ছেলে মানুষ।
‘বুড়িমা’ আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় শব্দ। আমি বুড়িমা বলেই ডাকতাম। বয়েসের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছিলেন। আমার সঙ্গে পরিচয় হয় মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে। মাস্টারমশাই স্বর্গীয় জ্ঞানদাপ্রসাদ চৌধুরীর কাছে হিন্দুধর্মশাস্ত্র নিয়ে একটু আধটু পড়াশুনো করেছিলাম আঠারো বছর ধরে। প্রায় প্রতিদিনই যেতাম মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে।
একদিন গিয়ে দেখি, একজন বৃদ্ধা বসে আছেন মাস্টারমশাই-এর বিছানার এক পাশে। বৃদ্ধ মাস্টারমশাই আর এক পাশে। তখন বৃদ্ধার বয়েস আশি। গায়ের রং মেমদেরও যেন হার মানায়। টুকটুকে ফরসা। গালে দাঁত নেই। এলানো চুল পিঠ ছাড়িয়ে। সব সময় হাসিভরা মুখ। ধবধবে সাদা কাপড় পরা। পাতলা চেহারা। দুচোখে দৃষ্টি নেই। সাধারণত এই বয়েসে এমনটা হওয়ার কথা নয় তবে হয়েছিল, কারণটা জানা নেই। মাস্টারমশাই বুড়িমাকে দিদি, বুড়িমা মাস্টারমশাইকে দাদা বলে ডাকতেন।
আমি গিয়ে বসতেই মাস্টারমশাই বুড়িমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন আমার নিঃস্ব অবস্থা। প্রণাম ছাড়া দেয়ার কিছু ছিল না। প্রণাম করলাম। বুড়িমা চোখে দেখেন না। হাতটা তুলতে মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম হাতে। পরে বসলাম ওঁদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে।
এ লেখায় কখনও বুড়িমার কথা আমার ভাষায়, আবার কখনও তাঁর কথা তাঁরই ভাষায় তুলে ধরেছি। দ্রুত পড়তে গেলে লেখার রস ও ছন্দমাধুর্য হারানোর ভয়টা থেকে যাবে। একটা কথা বলে রাখি, বুড়িমা মাকালীকে ‘মায়’ বলতেন।
আমি যাওয়ার পর বুড়িমা মাস্টারমশাইকে যে কথা বলেছিলেন, সে কথাই বললেন আমাকে, ‘বাবা, বাড়িতে আমার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনি সবাই আছে। আমাকে ভালোবাসে সবাই, তবে একমাত্র বড় নাতি ছাড়া আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সারাদিন একা একা ঘরে বইয়্যা থাকি। কারও সঙ্গে কথা কইতে পারি না। আমি কথা কইলে কেউ শোনে না, বোঝেও না। আজ পূজার সময় গোপালরে কইলাম, আমারে এমুন কারও কাছে লইয়্যা চলো, যার সঙ্গে দুইটা মনের কথা কইতে পারি।’
একটু থামলেন। পরে বললেন (আমার ভাষায়),
– গোপাল বলল, তোর বাড়ির সামনেই (হাঁটাপথে ৫/৭ মিঃ) একজন অত্যন্ত সৎ সাত্ত্বিক নির্লিপ্ত ব্রাহ্মণ মাস্টারমশাই আছেন। ওখানে গিয়ে তোর মনের কথা বলবি। আনন্দ পাবি। বিশ্বাসও করবে তোর কথা। তাই গোপালের কথায় দাদার কাছে এলাম।
এসব কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না। পাড়ার কোন গোপালের কথায় বুড়িমা এখানে এলেন। তিনি থাকেনই বা কোথায়, কিছুই বুঝিনি তখন। এইভাবেই বুড়িমার সঙ্গে সেদিন আমার প্রথম পরিচয়।
বুড়িমার কাছেই শোনা। জন্ম রাজশাহীতে, কথায় তিনি ঢাকাইয়া। গালে একটা দাঁতও ছিল না। কিন্তু কথা বললেও হাসি, না বললেও সবসময় হাসিমাখা মুখ। প্রতিদিন আসতেন সাড়ে নটা দশটা নাগাদ। থাকতেন বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। একাই আসতেন, একাই ফিরে যেতেন বাড়িতে।
একদিন বুড়িমা এলেন। দেখছি সমানে হাঁপাচ্ছেন। খানিক বিশ্রামের পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি অত হাঁপাচ্ছিলেন কেন? শরীরটা খারাপ নাকি?’
হাসিভরা মুখখানা। হাসতে হাসতে বললেন,
– ‘বাবা, আজ আমার বড় কষ্ট হয়েছে। আমি তো চোখে দেখিনা। যেদিন আমাকে গোপাল হাত ধরে নিয়ে আসে, সেদিন বড় কষ্ট হয়। যেদিন মায় (মাকালী), ঠাকুর (শ্রীরামকৃষ্ণ), লোকনাথ (লোকনাথ ব্রহ্মচারী), রাধারানী আমার হাত ধরে আনে, সেদিন কোনও কষ্ট হয় না। ‘গোপাল তো বাচ্চা, ছেলে মানুষ। পোলাপান। অত বোঝে না। টানতে টানতে লইয়্যাইছে। আমি তো তাড়াতাড়ি চলতে পারি না। মায় আনলে কোনও কষ্ট হয় না। মায় তো!’
একটু থেমে বললেন,
– যেদিন মায় সঙ্গে থাকে, বাসে উঠলে বসার জায়গা না থাকলে লোকে উঠে আমাকে বসতে দেয়। গোপাল সঙ্গে থাকলে বসার জায়গা পাই না। গোপাল কষ্ট বোঝে না। মায় বোঝে।
মাস্টারমশাই আমাকে বুড়িমার অসাক্ষাতে তাঁর দিব্যজগৎ ও দৃষ্টি সম্পর্কে আগে সামান্য আঁচ দিয়েছিলেন, আজ তাঁর মুখে এ কথা শুনে গোপাল যে কে তা বুঝলাম। আনন্দে হৃদয় মন আমার ভরে উঠল। সঙ্গ যখন পেয়েছি তখন জানতে পারব অনেক অ-নে-ক কথা।
বুড়িমার সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে তা কখনও ধারাবাহিক ছিল না। এক একদিন তিনি নিজে এসে বলতেন, কখনও আমি কিংবা মাস্টারমশাই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে উত্তর পেতাম। প্রসঙ্গক্রমে বলি, চোখে দেখতেন না অথচ পথ চলতেন, এ রহস্যের সমাধান সূত্রটা জানতে পারলাম বুড়িমার কথায়। এর পরবর্তী সময়ে নর্মদাতটে ওঙ্কারেশ্বরে ১২০ বছর বয়েসের এক বৃদ্ধ সাধুবাবার সঙ্গ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনিও বুড়িমার মতো চোখে দেখতেন না কিন্তু সুন্দরভাবে পথ চলতেন। সাধুসঙ্গের সময় বিষয়টা জানতে পেরে বুঝেছিলাম, বৃদ্ধ সাধুবাবাকেও হয়তো মহাদেব, মা নর্মদা কিংবা তাঁর গুরুদেব হাত ধরে পৌঁছে দেন গন্তব্যে।
একদিন জিজ্ঞাসা করলাম,
– গোপাল কিংবা মাকালী কি আপনার সঙ্গে কথা বলে, আপনি কি তাঁদের দেখতে পান?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
– হ্যাঁ বাবা, মায় গোপাল এঁরা কথা কয়। শুনতে পাই। কখনও কথা না বলে ইশারায়, কখনও কোনও কিছুর সঙ্কেত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। ‘অগো দ্যাখতে পাই’ তবে সব জ্যোতির্ময় মূর্তি। এমুন আমাগো মতো রক্ত মাংসের দেহ নয়। তবে ‘চর্মচক্ষু’তে দেখি না। (আজ্ঞাচক্র দেখিয়ে) দুই ভ্রূর মাঝে জ্ঞাননেত্র দিয়া দেখা যায়।
কথাটা শুনে রাখলাম। অনেকদিন পর আমি দ্বারকা যাওয়ার জন্য টিকিট কাটলাম। মাস্টারমশাই-এর কোমরে একটা অস্ত্রোপচার হবে। ব্লাডসুগার পরীক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন। তখনও রিপোর্ট আসেনি। আজকাল যেমন সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট পাওয়া যায়, পঁয়ত্রিশ বছর আগে তেমন ছিল না।
বুড়িমা মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে আসতে বললাম,
– দেখুন তো, আমি দ্বারকার টিকিট কেটেছি, তা আমার যাওয়া হবে কিনা? মাস্টারমশাই-এর ব্লাড রিপোর্টে কি কোনও দোষ পাবে?
বুড়িমা আমাদের সামনে যখন বসে থাকতেন তখন চোখদুটো বন্ধই থাকতো। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন,
– ‘কাল পূজার সময় গোপালরে জিগামু।’
কাল এল। বুড়িমা এলেন আমাদের আসরে। বসার পর বললাম,
– গোপালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? গোপাল কি কয়?
বুড়িমা হাসতে হাসতে বললেন,
– ‘বাবা, গোপাল মুখে কিছু কয় না। তোমার যাওনের ব্যাপারে গোপাল বুড়ো আঙুল দিয়া কলা দেখাইছে। দাদার ব্যাপারে গোপাল চনচন কইর্যা মুইতা দিল।’
বুড়িমার এই ‘সিম্বলিক’ কথার অর্থটা ধরতে পারলাম না। বললাম,
– ‘এ কথার মানেটা কি?’ তিনি যা বললেন তার অর্থটা, কলা দেখানোর মানে হল কার্যসিদ্ধি অর্থাৎ যাওয়া হবে না। আর চনচন করে প্রস্রাব করাটা হল, সব পরিস্কার। সুগার নেই।
হলও তাই, অপ্রত্যাশিত বাধায় সেবার দ্বারকায় যাওয়া হল না। ট্রেনের টিকিট বাতিল করতে হল। মাস্টারমশাই-এর রক্তের রিপোর্টে কোনও দোষ ছিল না।
বুড়িমার কাছে প্রতিদিনই কিছু না কিছু অধ্যাত্মজগতের ঘটনার অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতাম, যা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হবে। বুড়িমা বলতেন,
– বাবা, চর্মচক্ষু যেমন পার্থিব জগতের অর্থাৎ জড়বস্তু পরিস্কার ও স্পষ্টভাবে দেখতে পায়, তেমন ভাবেই দিব্যচক্ষু (জ্ঞাননেত্র) দর্শন করে দিব্যজগৎ (সূক্ষ্মজগৎ)।
মাস্টারমশাই-এর বিছানার উপরে বসে কখনও কখনও বুড়িমাকে দেখেছি দেহ স্পন্দনহীন হয়ে যেতে। সাড়া শব্দ বাহ্যজ্ঞান নেই। কখনও ১৫/২০ মিনিট কখনও আধঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্থির দেহ। আমরা দুজনে এ সময় চুপ করে বসে থাকতাম। দীর্ঘদিন সঙ্গ করার ফলে বুঝেছিলাম, ওই সময় বুড়িমার আত্মা দিব্যজগতে বিচরণ করছে। এখানে ‘সমাধি’ শব্দটা লিখছি না, কারণ শব্দটা সাধক জীবনীতে বহুবার পড়া, বহুশ্রুত কিন্তু সমাধি বিষয়টা সম্পর্কে সম্যক কোনও ধারণা নেই আমার।
একদিন বুড়িমা কথা বলতে বলতে হঠাৎ স্থির নিশ্চল হয়ে গেলেন। প্রায় মিনিট কুড়ি পর ফিরে এলেন আগের ভাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল আপনার? শরীর খারাপ নাকি?
হাসতে হাসতে বুড়িমা বললেন,
– না বাবা, আমার শরীর ঠিক আছে। আজ ‘মায় আমারে’ বিভিন্ন লোকে সঙ্গে করে নিয়ে দেখিয়েছে। কত ভাগ্য আমার! চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, প্রেতলোক, স্বর্গলোক, নরক, ঋষিলোক, শিবলোক, দেবীলোক। বৈকুণ্ঠ, ধ্রুবলোক, ইন্দ্রলোক-এ সবই সত্য। মায় বিভিন্ন লোক ঘুরিয়ে দেখানোর পর আমাকে সঙ্গে নিয়ে দেবীলোকে যায়। ‘ওইখানেই এতক্ষণ বইসা ছিলাম।’ মা আমাকে দেখাতে লাগল আর মুখে বলতে লাগল লোকপ্রসিদ্ধ মহাত্মা ও মানুষদের মৃত্যুর পর কার কেমন গতি হয়েছে, কে কোন লোকে অবস্থান করছে, এই সব আর কি!
এমন এক অদ্ভুত কথা শুনে আমি আর মাস্টারমশাই মুখ চাওয়াচাইয়ি করলাম। পরে বললাম,
– আপনি একটু দয়া করে বলবেন, মা কি দেখাল আর কি বলল?
বুড়িমা বললেন,
– বাবা, মায় আমারে সিনেমার মতো সব দেখাইছে। এরপর একে একে অনেক মহাত্মার কথা বলেছেন, যাদের দেহরক্ষার পর কি গতি হয়েছে। একশ্রেণির মানুষ মৃত্যুর পর কর্মানুসারে দেহলাভ করে সেই দেহের উপযোগী লোকে যায়। সেখানে গিয়ে সুখ বা দুঃখ ভোগ করে। এরা প্রধানত ভোগী লোক। ভোগের পর আবার জন্ম নেয় নরলোকে। পরে উন্নত হয় সাধনভজন করে। তারপর এক সময় আত্মা মুক্ত হয় নরলোক থেকে।
বুড়িমার শাস্ত্রপুরাণ বা কোনও ধর্মগ্রন্থই পড়া ছিল না। তাঁর মুখে শুনেছি, জীবনে কখনও কোনও গল্প উপন্যাস তিনি পড়েননি, অথচ দারুণ সব কথা বলতেন ও খবর দিতেন, যা ছিল সব ভাবার বাইরে। পাঠক পরে তা অবগত হবেন। তিনি বলেছিলেন,
– বাবা, স্বর্গলোকে তিনটি স্তর আছে। কর্মানুসারে মানুষ তিন স্তরের কোনও একটা লাভ করে। মায় দেখিয়েছে, রাজা রামমোহন রায় স্বর্গলোকে বাস করছেন রজোস্তরে। তাঁর ইষ্টদেবী শ্রীরাধা। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তিনি ছিলেন একান্ত বিষ্ণুভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণের একান্ত আপনজন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে তাঁর কথা, ‘স্থূলদেহে জীবন্মুক্তি বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন স্বামীজি।’
স্বামীজির একান্ত প্রিয় মানসকন্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছেন ভগিনী নিবেদিতা।’
বুড়িমা বলেছিলেন, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বিবেকানন্দের অনুজ মহেন্দ্র দত্ত, ভবানীপুরের ঠাকুর জিতেন্দ্রনাথ প্রমুখরা স্বর্গলোকে অবস্থান করেছেন। আরও উন্নত লোক বা স্তরে যাওয়ার জন্য তাঁরা স্বর্গলোকে তপস্যারত আছেন।
যে সব মহাত্মাদের কথা বুড়িমা সেদিন বলেছিলেন, তাদের অধিকাংশের জীবন সম্পর্কে কিছু শুনেছেন বা জানতেন, এমন মনে হয় না। অথচ তিনি চোখ বুজে গড়গড় করে বলে গেলেন একনাগাড়ে। আমি ও মাস্টারমশাই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম।
– মায় আমারে বিভিন্ন লোকে লইয়্যা দেখাইয়া কইছে, বিদেহ মুক্তিপ্রাপ্ত মহাত্মাদের মধ্যে আছেন স্বামী নিগমানন্দ পরমহংস, সন্ত কবীর, সাধক রামপ্রসাদ, ব্রজবিদেহী মহন্ত স্বামী সন্তদাস বাবাজি মহারাজ প্রমুখ।
তারাপীঠ ভৈরব তন্ত্রসাধক বামাক্ষেপাবাবা যখন দেহত্যাগ করেন, তখন তাঁর অবস্থান ছিল সত্ত্বস্তরে। দেহত্যাগের পর তাঁর স্থান হয় শিবলোক। বর্তমানে ক্ষেপাবাবা মহাদেবের নিকটতম ভৈরবদের মধ্যে অন্যতম।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বুড়িমা বললেন,
– ‘মায় আমারে ঋষিলোকে লইয়্যা গেছিল।’
তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা, সেইখানে দ্যাখলাম, সারদা মায়ের শিষ্য যোগানন্দ স্বামী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্যামাচরণ লাহিড়ি, বারাণসীর কৃষ্ণানন্দ স্বামী, ভোলানন্দগিরি মহারাজ, প্রভু জগদ্বন্ধু প্রমুখ, এঁরা সকলেই ঋষিলোকে অবস্থান করছেন।’
আমি আর মাস্টারমশাই এসব কথা শুনে দুজনেই মুখ চাওয়াচাইয়ি করছি। উভয়ের ভাবটা এই, বুড়িমা যাঁদের কথা বললেন, যাঁদের কথা বলেছেন, তাঁদের জীবনকথা তিনি কোথাও পড়েছেন বা কারও কাছে কোনওভাবে শুনেছেন বলে আমাদের মনে হয় না। উদাহরণে বলি, সারদামায়ের শিষ্য যে যোগানন্দ স্বামী, তা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত এমন অনেক সন্ন্যাসী, ভক্ত বা শিষ্য কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ুয়াদের শতকরা ৯৮ শতাংশদের জানা আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে এ ধারনাই হয়েছে। সুতরাং বুড়িমার কথা শুনে বারংবার বিস্মিত হওয়ারই তো কথা!
বুড়িমা বলেছিলেন,
– ‘এ-গো আমি দেখছি জ্যোতির্ময় চেহারা। তবে আমারে সকলেই দেখছে কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা কয় নাই।’
জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
– আপনি তো এঁদের কাউকেই কখনও চোখে দেখেননি, ছবিও দেখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। এঁদের নাম জানলেন কি করে?
বুড়িমা বলেছিলেন,
– ‘মায় আমারে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেখাইয়া নাম কইয়্যা দিছে। দেবীলোকে দেখলাম সাধক কমলাকান্তকে।’
আরও বলেছিলেন, শিরডির সাঁইবাবা, নাথ সম্প্রদায়ের মহাযোগী গম্ভীরনাথ, ঋষি অরবিন্দ, স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস, বালানন্দ ব্রহ্মচারী প্রমুখরা বিদেহ মুক্তিলাভ করেছেন। হিমালয়তীর্থে যাঁর অবদান প্রতি পদক্ষেপে, সেই কালীকমলিবাবার সম্পর্কে বুড়িমা বলেছিলেন,
– ‘কোটি কোটিপতির ঘরে কালীকমলিবাবার জন্ম হইছে।’
লোকচোখে এমন বেশ কয়েকজন মহাপুরুষ বলে সমাজে প্রসিদ্ধ মানুষের কথাও বলেছিলেন, যাদের ফটো অসংখ্য শিষ্যভক্তদের বাড়িতে পুজো হয়, সেই সব মহাপুরুষদের অবস্থান প্রেতলোকে। লোকপূজ্য সেইসব গুরু তথা মহাপুরুষদের সম্পর্কে বুড়িমার কথা,
– বাবা, মায় কইছে, এরা যে কত শত বছর প্রেতলোকে থাকবো তার কোনও ঠিক ঠিকানা নাই।
১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। কনকনে ঠান্ডা। তখন বয়েস আমার যথেষ্টই কম। হৃষীকেশ থেকে গেছিলাম রামঝোলা হয়ে ২২ কিমি নীলকণ্ঠ মহাদেব দর্শনে। ওখানে এক বৃদ্ধ সাধুবাবার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে নানান বিষয়ে কথা হয়। ঠিক সেই কথাগুলি পরবর্তী কালে বুড়িমার মুখ থেকে শুনে হতবাক হয়েছি। তখন অত বোধবুদ্ধি ছিল না, হয়ওনি। এখন বুঝি, সেই সাধুবাবারও জ্ঞাননেত্র খুলে গেছিল। তা থেকেই সেদিন এই কথাগুলি বলেছিলেন তিনি।