Durga Pujo

করোনা পরিস্থিতিতে এবার মাদুর্গার কিসে আগমন, কিসে গমন, কী তার ফল

আদিঅনন্তকাল ধরে ৪টি যানেই গমনাগমন করেন। প্রতিটি যানবাহনে গমনাগমনের আবার প্রভাবও পড়ে জগত সংসারে, মানব জীবনে।

এক সময় দেবতাদের স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত করলেন মহিষাসুর। লাভ করলেন স্বর্গরাজ্য। বিপন্ন অনন্যোপায় দেবতারা শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মার। ব্রহ্মা দেখলেন তাঁর কিছু করার নেই। স্বয়ং শিব ও দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। আনুপূর্বিক সমস্ত দুর্দশার কথা জানালেন। বিগলিতহৃদয় বিষ্ণুকে অনুরোধ করলেন তাঁদের রক্ষা করতে।

কারণ, মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য হয়েছেন ব্রহ্মারই বরে। সমস্ত কথা শুনে বিষ্ণু বললেন, পুরুষের অবধ্য এই অসুরকে বধ করতে হলে নিজ নিজ স্ত্রী সঙ্গে মিলিত হয়ে, স্ব স্ব তেজের কাছে প্রার্থনা করতে হবে যে, এই সমবেত তেজ থেকে যেন কোনও নারীমূর্তি আবির্ভূতা হন। সেই নারীই পারবেন অসুরকে বিনাশ করতে।


এ কথা শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে নির্গত হল তেজ। সেই সমবেত তেজোরাশি থেকে আবির্ভূতা হলেন এক পরমা সুন্দরী নারী। তাঁকে বিবিধ অস্ত্র দান করলেন দেবতারা।

এদিকে নারীরূপী দেবীর রূপে আকর্ষিত হলেন মহিষাসুর। বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হল। এবার ক্রুধ্ব অসুরের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ হল দেবীর। নিহত হলেন মহিষাসুর।


মহিষাসুর জন্মগ্রহণ করেন তিনবার। ত্রিবিধ রূপ ধারণ করে তাঁকে তিনবারই বিনাশ করেন এই দেবী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য প্রথমে অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয়বার ভদ্রকালী এবং তৃতীয়বার বধ করলেন দশভুজা দেবী দুর্গা রূপে। দুর্গাই হলেন পরমা প্রকৃতি। শিবপত্নী দেবী বিশ্বের আদি কারণ।

রাত্রিকালে স্বপ্নে ভদ্রকালী মূর্তি দেখলেন মহিষাসুর। শুরু করলেন তাঁর আরাধনা। আরাধনায় প্রীত ও প্রসন্ন দেবী এলেন। নিবেদিত হৃদয়মন মহিষাসুর জানালেন, ‘আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ নেই এতটুকুও। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যাতে সকলের পূজিত হই তারই ব্যবস্থা করুন দেবী। এছাড়া আর কিছুই চাই না আমি।’

দেবী ভদ্রকালী তখন আশীর্বাদ করে বললেন, ‘উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী আর দুর্গা, এই তিন মূর্তিতে আমার পদলগ্ন হয়ে তুমি সব সময়েই পুজ্য হবে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের।’

Durga Puja
ফাইল : দুর্গাপুজো, ছবি – আইএএনএস

সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি নামক বৈশ্য তিন বছর বসন্তকালে গৌণ চান্দ্র চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে প্রথম পূজার্চনা করেছিলেন দুর্গামূর্তি প্রস্তুত করে। ত্রেতাযুগে লঙ্কেশ্বর রাবণ দেবী দুর্গার পুজো করতেন চৈত্র মাসে বসন্তকালে। সেই জন্যে এই পুজো বাসন্তীপুজো নামে সুখ্যাত। রাবণ বধের জন্যেও দেবীর পুজো করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র অকালে বোধন করে। এসব কথা দেবীভাগবত, মার্কন্ডেয় চণ্ডী ও কালিকাপুরাণের। ‘কুরুক্ষেত্রে ভদ্রকালী ব্রজে কাত্যায়নী পরা’, দেবী ভদ্রকালী এইভাবে উল্লিখিত হয়েছেন আদ্যাস্তোত্রে। দ্বাপরের কথা। মহাভারতীয় যুগ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে (হরিয়ানা রাজ্য প্রথমে স্থানেশ্বর মহাদেব হয়ে পরে আসেন দেবী ভদ্রকালীর কাছে। পুজো ও যজ্ঞ করেন। দেবীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়লাভের। এসব লেখা আছে ভদ্রকালী মন্দিরপ্রাঙ্গণের একটি সাইনবোর্ডে।

বঙ্গজীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব শুরু থেকে শেষ হয় দেবী দুর্গার বাপের বাড়ি আগমন থেকে স্বামীগৃহে গমন পর্যন্ত। তো কৈলাস থেকে ৪ সন্তানকে নিয়ে মা তো আর হেঁটে আসবেন না পিতৃগৃহে। তাই যানবাহন প্রয়োজন। দেবী কিন্তু আদিঅনন্তকাল ধরে ৪টি যানেই গমনাগমন করেন। প্রতিটি যানবাহনে গমনাগমনের আবার প্রভাবও পড়ে জগত সংসারে, মানব জীবনে। ফলে প্রতি বছরই বাঙালির কমন প্রশ্ন হল মা কিসে আসছেন আর কিসে ফিরছেন?

এবার অজ্ঞাত এক লেখকের আগমনি গান দিয়েই শুরু করা যাক বিজয়িনী দেবী দুর্গার মর্তলোকে আগমন, কৈলাসে ‘ভোলানাথ ভিলা’য় ফিরে যাওয়া তথা গমনের কথা।

‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী,
উমা নাকি বড় কেঁদেছে।
দেখেছি স্বপন, নারদ বচন,
উমা মা মা বলে কেঁদেছে।।’ …

মা দুর্গা প্রতিবছর দুবার আসেন, একবার শরতে আর একবার বসন্তে। দিন চারেক থেকে আবার ফিরে যান কৈলাসে শ্বশুরবাড়িতে। আধুনিক বিমান, হেলিকপ্টার আর মেট্রোর যুগেও দেবী আদ্যিকালের মনোভাবের ছিটেফোঁটাও পরিবর্তন হল না। সেই অনাদি অনন্তকালের যান তাঁর চারটে। হাতি, ঘোড়া, নৌকা আর দোলা। বড় নৌকা হলে নো প্রবলেম। পনেরো কুড়িজন যাত্রী মালপত্তর নিয়ে অনায়াসে খাল, বিল, নদীনালা পেরিয়ে আসা যায় মর্তলোকে। হাতিঘোড়ার ওইটুকখানি পিঠ, ঘুপচির মতো একটা দোলায় দু-দুটো জোয়ান মেয়ে লক্ষ্মী আর সরস্বতী, স্লিম কার্তিক, ভুড়িয়াল গণপতি দেবা, ব্যায়ামবীর মার্কা দশাসই অসুর, আধমরা মোষ, ইঁদুর, প্যাঁচা, হাঁস, সিংহ, ঢাল-তলোয়ার, তির-ধনুক আর জামাকাপড়ের সুটকেস নিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থায় বসে যেভাবে মা আসেন, সে কষ্টের কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। তবুও মাকে আসতে হয় আমাদের মুখ চেয়ে।

এবার মা আসছেন ৬ কার্ত্তিক ১৪২৭, ২৩ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার সপ্তমীতে। দেবীর এবার দোলায় আগমন। অর্থাৎ দোলায় আসছেন মা। মণ্ডপে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন হয়ে থাকে সপ্তমী তিথিতে। ওই তিথিতেই দেবীকে আবাহন অর্থাৎ সাদরে আমন্ত্রণ এবং অনুরোধ করা হয় পুজো গ্রহণের। সপ্তমীর দিনটিই দেবী দুর্গার মর্তে আগমনের দিন, ষষ্ঠী তিথিতে নয়। এবার মায়ের দোলায় আগমন। আর কিসে মা আসছেন বা ফিরছেন তার ওপর নির্ভর করে জগত সংসারের ভালমন্দ। দোলায় আগমনের ফল হল ‘মড়ক’। ভাবার্থ দাঁড়ায় দেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা, সার্বিক বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধবিগ্রহ, মৃত্যু, হানাহানি। দেবী দুর্গা যে বাহনে মর্তলোকে আসেন, তাঁর আগমন কিংবা গমনজনিত কারণে মর্ত্যবাসীরা কখনও কিছু সুফল বা কষ্টদায়ক কিছু ফল লাভ করে থাকেন। সেই ফল দেশের রাজা-প্রজা থেকে শুরু করে সকলেই ভোগ করেন।

৯ কার্ত্তিক ১৪২৭, ২৬ অক্টোবর ২০২০ সোমবার দেবীর বিসর্জন, বিজয়া দশমী। সপরিবারে লটবহর, বাপের বাড়ির তরফে সিনথেটিক আর পাড়ার পুজো মণ্ডপ থেকে পাওয়া দশহাতি লালপেড়ে বস্তা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে গমনের বারটিই নির্দেশ করে দেবীর যান কোনটা হবে। এবার তা পড়েছে সোমবার। ফলে গজে দেবী দুর্গার গমন, অর্থাৎ ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। এ কথার অন্তর্নিহিত ভাব এই, পরিমিত বর্ষা বা জল হয়। ফলে ফুলে নানান শস্যে সুশোভিত হয়ে ওঠে বসুন্ধরা। গজে দেবী দুর্গার আগমনে এই লাভ করে থাকেন মর্তবাসীরা।
সুতরাং এই বছর দেবী দুর্গার গজে গমনের জন্য আগামী বছর দুর্গাপুজোর পূর্ব পর্যন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও শস্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের দেশ, বসুন্ধরা। আগমনের ফলও ওই গমনের মতো।

বাপের বাড়ি থেকে উমা আবার ফিরে যাবেন স্বামীর ঘরে। কন্যাবিরহে কাতর গিরিরাজের অন্তরবেদনা এইভাবে প্রকাশ করেছেন কবিয়ালদের উত্তরসূরি বলহরি রায় তাঁর ‘লহর মানসী’ গানে –

‘হ’ল নবমী যামিনী গত দশমীর উদয়। / গিরিবর হ’য়ে সকাতর অভয়ারে কয়।। / আমার মা তুমি গো ত্রিপুরেশ্বরী। / তব পিতা আমি গিরি। / ওমা হেরে তোমার চাঁদ বদন। / দিতে হবে বিসর্জন।।… / মেনকারাণী শুনে শিবের সিঙ্গার ধ্বনি / হলো অচৈতন্য নিমিষ-শূন্য কি করে প্রাণ ধরে রবে।’

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button