Mythology

ভগবানকে ডেকে মানুষের কী লাভ, জীবনে এঁদের প্রয়োজন কোথায়, বোঝালেন সাধুবাবা

ভক্ত প্রসঙ্গে আর এক সাধুবাবার কথা। ১৯৭৮ সাল। পরিশ্রান্ত সূর্যদেব। বেশ এলিয়ে পড়েছেন পশ্চিমে। সন্ধ্যা তখনও লাগেনি, লাগো লাগো করছে। একাই ইতস্তত ঘুরছি হরিদ্বারে ‘হর কি পেয়ারিতে’। চোখ খুঁজছে সাধুকে। সঙ্গী ছাড়া একাই বেরিয়েছি, থাকলে তাদের ব্যস্ততা আমাকে অস্থির করে তোলে, তাই একা।

গঙ্গা ওপারে, সবাই যেখানে বসে সন্ধ্যায় গঙ্গাদেবীর আরতি দেখে, সেখানে চোখ পড়ল বড় ঘড়ির তলায়। দেখলাম, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক সাধুবাবা। পরনের সাদা কাপড়টা ভাঁজ করে পরা, কাছা ছাড়া। দীর্ঘকাল ব্যবহারে ময়লার ছোপটা এমন হয়েছে এককালে যে ওটা সাদা ছিল তা মনেই হয় না। গায়ে তাপ্পিমারা একটা ফতুয়ার মতো তবে ফতুয়া নয়। মাথাভর্তি পাকা চুলগুলো এলোমেলো ঝোড়ো কাকের মতো। কপাল বেয়ে নেমে এসেছে কিছু। গালভর্তি দাড়ি, তবে ঘন নয়। নাকটা খাড়া। দেহে বয়সের ভারটা বেশ চোখে পড়ার মতো। সারাজীবন জলে ভেজা রোদে পোড়া রং যেমন হয় তেমনই গায়ের রং। কাঁধে একটা ঝুলি সামান্য দেখা যাচ্ছে কারণ তার উপরে লম্বা করে ভাঁজ করা একটা কম্বল। বেশ মোটা। আর রয়েছে বুড়ো বয়েসের সম্বল তাঁর আঁকা বাঁকা লাঠি একটা। সাধুর আকর্ষণেই গেছি সাধুবাবার কাছাকাছি। দেখছি কমনীয় চোখদুটো বড় বড়। অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল। চামড়ায় বেশ ভাঁজ পড়েছে।

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,

– বৈঠিয়ে না বাবা। আপকা কুছ কাম হ্যায় অভি?

প্রশান্ত মুখে বললেন সাধুবাবা,

– পরমাত্মা কা ভজন ছোড়কে দুসরা কোই কাম তো মেরা নেহি হ্যায় বেটা।

হাত দিয়ে বসার ইঙ্গিত করেও মুখে বললাম,

– তব অউর ক্যা, বৈঠিয়ে না।

আমার মুখের দিকে তাকালেন কয়েক মুহুর্ত। কি ভাবলেন বুঝলাম না। উবু হয়ে বসলেন। বললাম,

– বাবা, আপ আরাম সে বৈঠিয়ে।

এবার বসলেন বাবু হয়ে। বসলাম আমিও। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আপকা সম্প্রদায়?

গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

– ম্যায় নিম্বার্ক সম্প্রদায়কা সাধু হুঁ। ইস সম্প্রদায়কা নাম তু শুনা হ্যায় কভি?

হাসি হাসি মুখ করে বললাম,

– হ্যাঁ বাবা, রামদাস কাঠিয়াবাবা কা সম্প্রদায়। নাগাজি মহারাজ, দেবদাসজি কা ধারা, পরম্পরা।

সাধুবাবা বৈষ্ণব। কথাটা শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন,

– হাঁ বেটা, তু ঠিক সমঝা। অভি বোল তেরা ক্যা পুছনা হ্যায়?

যখন যেখানে যে সাধুসঙ্গ করেছি, তাদের সকলের কাছে প্রথমে যে প্রশ্ন করি, সেই একই প্রশ্ন করলাম এই সাধুবাবাকেও,

– বাবা আপনি ঘর ছেড়ে সাধু হলেন কেন, কিসের আশায়?

নির্লিপ্তভাবে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, আমি সাধু। তুই সংসারী। এসব কথা জেনে তোর কি হবে? সাধু সন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কোনও কথা বলতে নেই।

মুখটা একটু নিচু করে রইলাম। কোনও উত্তর দেব না ভেবেও বলে ফেললাম,

– আপ কা যো মর্জি।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর কি ভেবে বলতে শুরু করলেন,

– মেরা বাচ্চা, যখন বয়েস আমার বারো তখন আমি ঘর ছেড়েছি। এখন তো প্রায় নব্বই হতে চলল। সারা ভারতের সমস্ত তীর্থই দর্শন করেছি। বলতে পারিস ভগবানের দয়াতেই এসব হয়েছে। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি, কথাও হয়েছে অনেক, তবে তোর মতো এমন প্রশ্ন কেউ করেনি কখনও।

পড়ুন : সংসারে সুখী হওয়ার পথ দিলেন ১৩৩ বছরের সাধুবাবা

এক নিঃশ্বাসেই কথাগুলো বললেন। মুখের ভাবটা বেশ উদাসীন লাগল। পকেট থেকে বিড়ি বের করতে করতে বললাম,

– মেরা পাস বিড়ি হ্যায় বাবা।

বলে সাধুবাবার হাতে একটা বিড়ি দিলাম। নিজে একটা ধরিয়ে আগুনটা দিলাম সাধুবাবাকে। বেশ লম্বা করে একটা টান দিয়ে বললেন,

– বেটা, সাধু হব এমন চিন্তা করিনি কখনও। বারো বছর বয়েসে কি কেউ সাধু হবার কথা ভাবে তুই বল?

– হ্যাঁ বাবা, এটা তো ঠিক কথা। তবুও কেমন করে কেন এলেন এপথে?

স্বতঃস্ফূর্ত মনেই শুরু করলেন সাধুবাবা তাঁর বাল্যজীবনে গৃহত্যাগের কথা,

– বেটা, আমার বাড়ি ছিল মধ্যপ্রদেশে। বাবা ছিলেন জমিদার। আমরা দু’ভাই এক বোন। আমিই সকলের ছোট। তখনকার দিনে পড়াশুনার অত চল ছিল না। সুতরাং পড়াশুনা আমি কিছু শিখিনি।

বিড়িতে দুটো টান দিয়ে বললেন,

– বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আমাদের ক্ষেতি জমি। কিছু জনমজুর চাষের কাজ করত সেখানে। তাদের দুপুরের খাবার আমাদের বাড়ির থেকে দেয়া হত। চাকরই রোজ খাবার দিতে যেত। একদিন কি একটা কাজে চাকরটা কোথায় গিয়েছিল, তাই মা আমাকে খাবার দিয়ে পাঠালেন মাঠে। খাবার দিয়ে যখন ফিরছি তখন দেখি জনাদশেক সাধু যাচ্ছেন গ্রামের পথ দিয়ে। এর আগে একসঙ্গে এত সাধু দেখিনি কখনও। দেখামাত্র ছুটে গেলাম ওদের কাছে। একে একে প্রণাম করলাম সকলকে।

কথাগুলো বলে একটু বিশ্রাম নিলেন। মুখের ভাবটা কেমন যেন লাগল। উৎসুক হয়ে বললাম,

– তারপর কি হল বাবা?

ভুরু দুটো একটু কোঁচকালেন। মনে হল যেন তিনি ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিছবি দেখছেন। মিনিট খানেক পরে বললেন,

– তখন দুপুর বেলা। গ্রামের পথঘাট সব ফাঁকা। আমি সাধুদের বললাম, ‘হামকো লে চলো বাবা, হামকো লে চলো।’ সাধুরা আমাকে নেবে কেন? কিছুতেই নেবে না। আমিও ছাড়ব না। পিছন পিছন ছুটতে লাগলাম। কিছুটা পথ যাবার পর সাধুরা আমাকে আর বাধা দিলেন না। হাঁটাপথ, ট্রেন, এইভাবে চলতে চলতে কয়েকদিন পর আমরা এসে পৌঁছলাম এই হরিদ্বারে। এসে দেখি এক বিশাল মেলা বসেছে এখানে। আমরা একটা তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। তাঁবুটা ওদেরই পরিচিত এক সাধুর। জানতে পারলাম, সে বার কুম্ভস্নানের যোগ পড়েছে হরিদ্বারে। কয়েকদিন থাকার পর মাথা মুড়িয়ে দীক্ষা হল আমার। দীক্ষা দিলেন আমি যাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলাম তাঁদেরই একজন। তিনি বেশ বয়স্ক। তখন থেকেই শুরু হল আমার এক নতুন জীবন।

Uttarkashi
উত্তরকাশী, ছবি – সৌজন্যে – উইকিপিডিয়া

অনেক কথার পর বৃদ্ধ সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, জ্ঞানের পর থেকে আমি যা শুনেছি ও জেনেছি তাতে বিষয়টা দাঁড়ায় এই রকম, প্রতিটা মানুষ তার পূর্বজন্মের অর্থাৎ জন্মান্তরের সংস্কার অনুযায়ী এজন্মে ফল ভোগ করে, সে তার কর্মানুসারে সুফল বা কুফল, যাইহোক না কেন! আমার জিজ্ঞাসা, জন্মান্তরের কর্মফলই যদি ভোগ করতে হবে, এটাই যদি সত্য হয় তাহলে ভগবান বিষ্ণু, শঙ্কর আর গুরুজি যাই বলুন না কেন, এঁদের ডেকে আমাদের লাভটা কি? মানুষের জীবনে এঁদের প্রয়োজনই বা কোথায়?

মাথাটা দোলাতে দোলাতে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন কথাগুলো। মুখখানা এতক্ষণ পর একটু যেন গম্ভীর হয়ে এল। দু-ভ্রুর নিচ থেকে ড্যাবড্যাব করে বার কয়েক তাকালেন মুখের দিকে। হিন্দিতে কথা হলেও বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হচ্ছে না। সাধুবাবা এবার আমার ব্রহ্মতালু ও দু-গালে চুমু খেয়ে বললেন,

– বেটা, এখন তোর উপরে লছমীর কৃপাটা কম আছে, সরস্বতীমাঈর কৃপাটা আছে বলে তুই এ রকম প্রশ্নটা করতে পেরেছিস। সারাটা জীবন এতটা পথ আমি চললাম কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা মানুষকে পাইনি যে এমন সুন্দর জিজ্ঞাসা করেছে। তোর উপর আমি অত্যন্ত প্রীত ও প্রসন্ন হয়েছি। সামনে দিয়ে আমার গঙ্গামাঈ বয়ে চলেছে, বসে আছি হিমালয়ে, ‘ভগবান শিউজি, শঙ্করজির’ কোলে, এঁদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করে আশির্বাদ করি, ‘আজ বড় কষ্টে আছিস, জীবনে এমন একটা সময় আসবে যখন ‘মা লছমী অউর সরস্বতী মাঈয়ার’ করুণাধারা বর্ষিত হবে তোর উপরে। আমার গুরুজি সত্য, আমার বাক্যও সত্য।

পড়ুন : সুখ ও দুঃখ কী, কয়েক শব্দে জানালেন ১৩৩ বছরের সাধুবাবা

আর কোনও কথা বললেন না। এমন আশির্বাদে আমার দেহমন শিহরিত হয়ে উঠল। আনন্দ ও আবেগে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মাথাটা আমার নুয়ে এল সাধুবাবার চরণে। বৃদ্ধবাবা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

– ওঠ বেটা, ওঠ ওঠ। মেরা বাচ্চা, মাথাটা তোল।

মাথাটা তুলে বসলাম। দু-হাত দিয়ে আমার দুচোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

– তোর প্রশ্নটা এত সুন্দর, এত মর্মস্পর্শী যে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। বেটা, একশো তেত্রিশটা বছরে অনেকটা পথই চললাম। এই চলার পথে মানুষ দেখলাম অগণিত, কথাও হয়েছে অফুরন্ত কিন্তু আজ পর্যন্ত একমাত্র তুই ছাড়া এই প্রশ্ন আর কেউই কখনও করেনি। এবার তোর জিজ্ঞাসার উত্তরে বলি, ‘ভগবান বা গুরুকে ডেকে লাভটা কি? বেটা, লাভ বলতে যা, তা কিন্তু নেই। উপাসক বা শিষ্যের গুরুজি তথা ইষ্ট দেবদেবী শিষ্যের জন্মান্তরের কর্মফল ষোলোআনাই ক্ষয় করিয়ে তিনি নিজের করে নেন অর্থাৎ পার্থিব বন্ধন মুক্ত করেন। মুক্তি দেন। বার বার আর ফিরে আসতে হয় না সংসারজীবনে। শিষ্য এখানে তার কর্মানুসারেই চলবে তবে দেহরক্ষার পর পরলোকে গুরুর আস্তানায় মাথাগোঁজার একটা ঠাঁই পায়। সুতরাং এখানে গুরুর কোনও কেরামতি কিছু নেই। গুরুর অসীম শক্তি। কর্মফল রোধ করার ক্ষমতা তাঁর আছে কিন্তু তিনি তা করেন না।

বৃদ্ধবাবা একটু থামলেন। বসে আছি স্থির হয়ে। একটু মুচকি হেসে বললেন,

– একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞ গুরু তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর সন্তান তথা শিষ্যের জন্মজন্মান্তরের কর্মফল মহাব্যোমে ভস্মীভূত করে মুক্তি দিতে পারেন কিন্তু বেটা তাও তিনি করেন না। কর্মক্ষয় করিয়েই নেন।

কথা শেষ হতে জানতে চাইলাম,

– বাবা, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বলতে আপনি কাদের কথা বলছেন আর সংসারজীবনে আমরা যাদের গুরু বলে স্বীকার করি তাদের ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হিসাবে অবস্থান কোথায়?

সাধুবাবা গম্ভীর সুরে বললেন,

– যেসব মহাত্মা বা মহাপুরুষ দেহরক্ষার পর রক্ত মাংসের দেহে আবির্ভূত হতে পারেন তারাই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বলে বিবেচিত। তবে দেহধারণের শক্তি থাকলেও অনেক মহাত্মাই ওসবে যান না। পরোক্ষে শক্তি প্রয়োগ করে তাঁর সন্তানের কল্যাণ করে থাকেন। আমার সাধারণ জ্ঞানে যেটুকু বুঝেছি তার মধ্যে আছেন অনেক তবে আমি কয়েকজনের নাম বলছি। যেমন ভোলানন্দ গিরিমহারাজ, ব্রজবিদেহী মহন্ত মহারাজ ১০৮ শ্রীশ্রীরামদাস কাঠিয়াবাবাজি, স্বামী সন্তদাস বাবাজি মহারাজ, লোকনাথ ব্রহ্মচারীজি, যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ি মহারাজ, মহাযোগী গম্ভীরনাথজি, স্বামী বালানন্দ ব্রহ্মাচারীজি, তৈলঙ্গস্বামীজি, নাঙ্গাবাবাজি প্রমুখ। এঁদের নাম কি তুই কখনও শুনেছিস?

মাথা নেড়ে বললাম ‘হ্যাঁ’। এই সময় বিশ্বনাথ মন্দিরের পূজারিজি দুটো থালায় সাজানো প্রসাদ এনে সাধুবাবার সামনে রেখে প্রণাম জানিয়ে চলে গেলেন। বৃদ্ধবাবা আমাকে একটা থালা নিতে বলে নিজে নিলেন একটা। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের মতো উত্তরকাশীর বিশ্বনাথের ভোগে রয়েছে অন্নপ্রসাদ, রুটি, ডাল, সবজি, ভাজা, পায়েস ইত্যাদি। আমরা দু’জনে প্রসাদ পেলাম পরিতৃপ্তির সঙ্গে। পরে আবার শুরু হল কথা। বললাম,

– বাবা, আমি দেখেছি আজকাল অধিকাংশ সন্ন্যাসীরাই সঞ্চয় করে। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

কথা শুনে বৃদ্ধ হেসে ফেললেন। কথায় মিষ্টি হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বললেন,

– তুই ঠিকই দেখেছিস, বলেছিসও ঠিক। সমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সাধুদের অর্থ সঞ্চয় করাটা দোষের। এতে আমার সমর্থন নেই। এতে বাসনা বাড়ে। সাধু জীবনের উন্নতির পথ অবরুদ্ধ হয়। তবে বেটা এখন যৎসামান্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন আছে। যেমন ধর, এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থে যেতেও তো গাড়িভাড়াটা লাগে। সাধু কার কাছে বলবে যে ভাড়াটা দাও। এখন কি আর আগের মতো দিন আছে যে গাড়িতে উঠলে ভাড়াটা পর্যন্ত চাইত না। ‘পরন্তু’ প্রণামী কিছু দিত। এখন আর সেই দিন নেই বেটা, তবে তাঁর উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করে পড়ে থাকলে সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কলির বাতাস এমনভাবে বয়ে চলেছে মানুষের দেহ মনের উপর দিয়ে, যত দিন যাচ্ছে তত ভগবানের উপর নির্ভরতাও যেন ক্রমশ কমে আসছে।

এবার একশো তেত্রিশ ইশারায় জানতে চাইলেন ‘গাঁজা’ সাজবেন কিনা? আমিও ইশারায় ঘাড় নেড়ে জানালাম আপত্তি নেই। সারদামায়ের একটা কথা আছে, ‘যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন।’ এই নীতিতে চলে আমার লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হয়নি। কোলকাতা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে, হিমালয়ে উত্তরকাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরঅঙ্গনে মহাদেবের কোলে বসে, ‘গাঁজা খাব না’ বলে সাধুবাবার অনুরোধ উপেক্ষা করে, তাঁর জীবনপ্রসঙ্গ জানব, ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। মা সারদা যুগযুগ জিও। বৃদ্ধ সুন্দর করে কল্কে সাজাতে লাগলেন। আমি জানতে চাইলাম,

– বাবা, ভাবি এক কিন্তু করি আর এক। কোনও একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে মন স্থির হয় না। এই যেমন ধরুন, আপনি কিছু না ভেবেই কি সুন্দর একজন সাধু হয়ে গেলেন। আমি সেই ছোটবেলা থেকে শুধু ভেবে যাচ্ছি সাধু হব কিন্তু আজও তা হতে পারলাম না। এরকম শত শত উদাহরণ দিতে পারি। জানতে চাই, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির হওয়ার পথটা কি? এখন আমার মনের অবস্থাটা ঠিক এই রকম, ‘তাকাই ঘুঘু, মারি বক’। তাকাব বক, মারব বক, কি করলে হবে?

কথাটা শুনে হেসে ফেললেন। পাখি হিসাবে বকটা উনি বুঝতে পারলেন কিন্তু ঘুঘু যে কি পাখি তা কিছুতেই সাধুবাবাকে বোঝাতে পারলাম না। তাই সহজ করে বোঝাতে ঘুঘুর পরিবর্তে কথায় বসালাম কাক। বললাম ‘কাউয়া’। এবার বৃদ্ধবাবা আমার কথাটা বুঝলেন। বললেন,

– বেটা, প্রতিটা মানুষের মনে একটা দেবভাব আছে। কামনা বাসনা সেই ভাবকে নষ্ট করে দেয়। ফলে দেবভাব নষ্ট হয় বলে লক্ষ্য নষ্ট হয় অর্থাৎ লক্ষ্যের স্থিরতা আসে না। লক্ষ্যে স্থির হতে গেলে বেটা যে কোনও ভাবেই বাসনা ত্যাগ করতেই হবে। মনকে বাসনামুক্ত করতেই হবে। আর এটা করতে হলে ভগবানে নিবেদিত হতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে ভালবাসতে হবে। বাবা মা যেমন তার শিশুসন্তানকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে তেমনটা। ঈশ্বরে ভালোবাসা এল মানে ক্রমে ত্যাগের সৃষ্টি হল অন্তরে। ত্যাগের আসল মানে মন বাসনামুক্ত হল, প্রেম আসল। বেটা, প্রেমের সৃষ্টি তো ত্যাগ থেকেই হয়। ঈশ্বরে মানুষের দেহমন প্রাণ নিবেদিত হয় এই প্রেম থেকেই। আর তা নিবেদিত হলে লাভ করা যায় আরাধ্যকে। অর্থাৎ লক্ষ্য স্থির হলে এই পর্যন্ত হয়, বুঝেছিস?

পড়ুন : হিন্দুদের কেন দাহ করা হয়, সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন সাধুবাবা

মাথা নেড়ে বললাম বুঝেছি। সাধুবাবা এক নজর এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে নিলেন চোখদুটোকে। ডানহাতটা বুলিয়ে নিলেন দাড়িতে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল সাধুবাবার সঙ্গ। এখন ঠিক কি জিজ্ঞাসা করব তা মাথায় আসছে না। এবার ব্যাসদেবের টেকনিকটা কাজে লাগলাম।

লক্ষ শ্লোক মহাভারত লিখবেন বিশালবুদ্ধি ব্যাসদেব। একজন হেল্পার চাই। দুর্গানন্দন গণেশজিকে পাকড়ালেন। বললেন, শ্রুতিলিখন করতে হবে মহাভারতের। গণেশজি বললেন, রাজি আছি তবে একটা শর্ত আছে। আমার কলম মুহুর্তমাত্র থামবে না। কলম থামলেই কিন্তু আমি আর লিখব না। ইঁদুরের পিঠে উঠব। ঢ্যাং ঢ্যাং করে সোজা চলে যাব কৈলাসে মায়ের কাছে। হয় সাপলুডো নইলে এক্কা দোক্কা খেলব মায়ের সঙ্গে। মা ব্যস্ত থাকলে একা একা ‘জয় হনুমান’ কার্টুন দেখব টিভিতে।

কথাটা শুনে ব্যাসদেব একটু ঠুসে গেলেন, মুহুর্তমাত্র। পড়ে মহামতি ব্যাস বললেন, ঠিক হ্যায় গণেশজি। রাজি আছি লেকিন আমারও একটা কথা আছে। আমি যে শ্লোকগুলো বলব তার মানে বুঝে তোমাকে লিখতে হবে। মানে না বুঝে লিখতে পারবে না।

রাজি হলেন গণেশজি। এবার শ্লোক বলে যাচ্ছেন ব্যাসদেব, লিখছেন দুর্গানন্দন। মাঝে মাঝে ব্যাসদেব এমন শ্লোক বলছেন যা লিখতে গিয়ে গণেশের কলম থেমে যাচ্ছে। ভাবছেন, খানিক পরে লিখবেন। এই সময়ের ব্যবধানে ব্যাসদেব তৈরি করে ফেলছেন পরের আর একটি শ্লোক। এইভাবে চলতে লাগল হিমালয়ের গিরিগুহায় বসে ব্যাসদেবের লক্ষশ্লোক মহাভারত রচনা। যখন গণেশের কলম থামছিল তখন ব্যাসদেব যে শ্লোক বলছিলেন সেগুলি ছিল একটা বিষয়ের দুটো করে অর্থ। গণেশকে দুটো শ্লোকের অর্থ বুঝে নিয়ে লিখতে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে, ফলে কলম থামাতে হচ্ছিল। সেই সময়েই ব্যাসদেব তৈরি করে ফেলতেন পরবর্তী শ্লোক। একটা বিষয়ের দুটো অর্থকে বলা হয় ব্যাসকূট। সাধুসঙ্গে যখন কোনও প্রশ্ন খুঁজে পাইনা তখন সময় নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করার জন্য সব সময়েরই সাধুবাবাদের বলেছি, এখন এখানেও একশো তেত্রিশবাবাকে বললাম,

– বাবা, বেশ সুন্দর সুন্দর কয়েকটা কথা বলুন না, যা মেনে চললে আমার কল্যাণ হয়।

কথাটা শুনে সাধুবাবার মুখমণ্ডলে কেমন যেন একটা আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। মুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বললেন,

– বেটা, কি বলব বলতো? আমার কি তোর মতো জ্ঞান আছে? তু তো বেটা লিখাপড়া হ্যায়, মুঝসে তু জাদা সমঝতা তা ভি হ্যায় লেকিন বলি, জীবনে যত দুঃখ কষ্টেই থাকিস না কেন, মনের দুঃখের কথা অন্তরেই চেপে রাখবি। কাউকে শোনাবি না। যাকে শোনাবি সে কিন্তু ভয়েতে তোর কাছ থেকে সরে যাবে, সাহায্য করার ভয়ে। যদি দুঃখের কথা শোনাতেই হয় তবে তা শোনাবি গুরু বা ইষ্টকে। দুঃখের কথা একমাত্র তিনিই শোনেন, প্রতিকারও করেন তিনিই।

একটু থামলেন। তাকালেন মুখের দিকে। আমি খুশিতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। হাতটা মাথায় বুলিয়ে দিলেন। বললেন,

– বেটা, যারা দীক্ষিত, তারা গুরুমন্ত্র ছেড়ে দিয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে জপতপ না করে, এদের বিভিন্ন মঠমন্দির ও তীর্থভ্রমণ আর বিবাহিত রমণীর স্বামী থাকা সত্ত্বেও অন্য পুরুষের শয্যার শয়ন এক। গুরুমন্ত্রে নিহিত আছে ভক্তির বীজ। অন্তরক্ষেত্রে ভক্তির বীজ রোপণ না করে মুখে ভক্তির কথা, শাস্ত্রের কথা বলে লাভ নেই বেটা। মানুষের মন সর্বদাই আশা নিয়ে ঘুরে চলেছে কলুর বলদের মতো। আশা ছেড়ে লেগে পড়লে ‘সবকিছু মিল যায়গা।’

এবার একটু এদিক ওদিক চোখদুটোকে বুলিয়ে নিলেন। প্রসন্ন মুখমণ্ডল। দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন,

– বেটা, সংসারজীবনে অজস্র গুণ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্ররা যেমন কোথাও সম্মানিত হয় না, কেউ সম্মান করে না, ঠিক তেমনই সাধুজীবনে থেকে কামুক, গৃহীজীবনে থেকে কখনও ঈশ্বরের সন্ধান পায় না বিষয়াসক্তরা। সংসারে যেমন মূর্খরা সময়ের মূল্য বোঝে না, তেমন মূর্খেরই দ্বিতীয় সংস্করণ যাদের বিগত হয়েছে সাধনহীন যৌবনকাল। বেটা, সাধনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় হল যৌবনকাল।

প্রায় ঘণ্টাচারেক অশীতিপর বৃদ্ধ নির্বিকার নির্লিপ্ত মহাপুরুষ একশো তেত্রিশ সাধুবাবার সঙ্গ হল নাগাড়ে। এবার উঠতে হবে। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল দেবভূমি উত্তরকাশীতে। কাল হরিদ্বার থেকে বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা আছে। ‘আজ ফিরতে হবে হরিদ্বারে’, এ কথা জানিয়ে ওঠার অনুমতি চেয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। পাঞ্জাবীদেহ উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে জড়ানো কম্বলটা নামিয়ে রাখলেন গা থেকে। আজানুলম্বিত যোগীবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। বার বার চুমু খেলেন ব্রহ্মতালু ও গালে। উচ্চস্বরে মুখে বললেন, ‘জয় হো বেটা, জয় জয়কার হো তেরা, সদা আনন্দমে রহো।’

বৃদ্ধের সেই গহন চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে দেখি বয়ে চলেছে উত্তরকাশীগঙ্গার করুণাধারা। এর বহুবছর পর ঠিক এমনটাই দেখেছিলাম বেনারসে এক বৃদ্ধ সাধুবাবার দু-চোখ বেয়ে নেমে আসা কাশীগঙ্গার অমৃতধারা।

Show More

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *