Mythology

ফাঁসি হল মহারাজ নন্দকুমারের, ভেঙে পড়ল তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত মাকালীর মন্দির

মহারাজের ফাঁসির দিন রাতে মন্দিরের উত্তর ও পূর্ব দেওয়ালে পরপর দুটি মারাত্মক বজ্রপাত হয়। বড় বড় ফাটল ধরে দেওয়ালের বিভিন্ন দিকে।

বীরভূম জেলার আকালিপুর মৌজায় ভদ্রপুরের গুহ্যকালীর কথা। ব্রাহ্মণী নদীর পাশে শ্মশান। গ্রামের দক্ষিণে শ্মশানটারই কোলে আজ রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ মন্দির। এই মন্দিরে স্থাপিত বিগ্রহ দেবী গুহ্যকালীর। ইতিহাস বিশ্রুত মহারাজ নন্দকুমারের জন্ম আনুমানিক ১৭০৫ সালে। তাঁর ফাঁসির দিনটি ছিল ১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট। ভদ্রপুরেই নন্দকুমারের জন্ম। পরম্পরাগত কথা, শ্মশানে মন্দির নির্মাণকালে অপ্রত্যাশিত কারণে বিদীর্ণ হয়ে যায় মন্দিরের চারপাশ। স্বপ্নাদেশে দেবী মহারাজকে বলেন, যেহেতু তিনি শ্মশানবাসিনী তাঁর জন্য প্রয়োজন নেই দেবায়তনের। সেই জন্যই মন্দির ফেটে গিয়েছে। মন্দিরের উত্তর দেয়ালের বিরাট ফাটল আজও সে ঘটনার সাক্ষ্য দেয়।

এবার মন্দিরের কথা। সুউচ্চ মন্দিরটি নির্মিত ইট দিয়ে। অষ্টকোণাকৃতি মন্দির। এর চারপাশ দিয়ে রয়েছে প্রদক্ষিণ করার পথ। পরিক্রমা পথের চারধার আবার উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। মন্দিরের প্রবেশদ্বার তিনটি। মূল দ্বারটি দক্ষিণ দিকে। এখানে দেবীর অধিষ্ঠান দক্ষিণাভিমুখী। অন্য দুটি দ্বার পূর্ব ও পশ্চিমে। মন্দিরের চৌকাঠগুলি নির্মিত ব্যাসল্ট (Basalt) পাথরে।


পড়ুন আকর্ষণীয় খবর, ডাউনলোড নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

গুহ্যকালীর বিগ্রহটি অভিনব। দুশো বছরের বেশি প্রাচীন বিগ্রহটি দেড় ফুট উঁচু বেদিতে প্রতিষ্ঠিত। কষ্টিপাথরে নির্মিত। সর্পকুণ্ডলীর উপরে যোগমুদ্রায় দেবী উপবিষ্টা। উচ্চতায় প্রায় চার ফুট। সর্পালঙ্কারে ভূষিতা দেবী দ্বিভুজা। ত্রিনয়নীর ডান হাতে বরাভয়, বাম হাতে অভয় মুদ্রা। লোলজিহ্বা দেবীর, গলার মালাটি পঞ্চাশটি মুণ্ড সমন্বিত। দন্তপংক্তি ও চোখদুটি তৈরি হয়েছে মহাশঙ্খ দিয়ে। বিকট দর্শনা দেবীর মধ্যেও প্রসন্ন রূপ মনোমুগ্ধকর। মন্দিরের বিগ্রহটি খণ্ডিত। কথিত আছে, বর্গীদের হামলায় তাদের হাতে খণ্ডিত হয়েছে দেবীমূর্তি। তান্ত্রিক উপাসনা পদ্ধতি অনুসারে দেবীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত যন্ত্রম্‌ তথা মণ্ডলের উপরে। পঞ্চমুণ্ডি বলে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন আছে মন্দিরের দক্ষিণে।

বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবীর রূপ বর্ণনায় আছে, ‘গুহ্য কালিকাদেবী চতুর্দ্দিকে নাগ ফণাবেষ্টিতা, তক্ষক নাগরাজ দ্বারা বামকঙ্কণ, অনন্ত নাগ দ্বারা দক্ষিণ কঙ্কণ, নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ননূপুর ধারণ করিয়াছেন। বাম ভাগে শিবস্বরূপ কল্পিত বৎস রহিয়াছে। দেবীর দুই হস্ত, শ্রুতিযুগল নরদেহ সংযুক্ত কুণ্ডলদ্বয়ে মণ্ডিত, বদন প্রসন্ন, আকৃতি সৌম্য। নবরত্নে বিভূষিতা শিবমোহিনী দেবীকে নারদাদি মুনিগণ সেবা করিতেছেন। অট্টহাসা ও মহা ভয়ঙ্করা দেবী সাধকের অভীষ্ট ফল প্রদান করেন। গুহ্য কালিকাদেবী চতুর্বর্গ দায়িনী, মহাপাতক প্রবিনাশিনী, সর্বসিদ্ধিদাত্রী, সনাতনী, ভক্তি-মুক্তি দায়িনী মহাবিদ্যা। এই মহাবিদ্যা ত্রিভুবনে অতি দুর্ল্লভা।’

মহারাজ নন্দকুমার ছিলেন শক্তি সাধক। শ্যামাসংগীত রচয়িতা হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। শক্তিসাধনায় গোপনতা অবলম্বনই ছিল তাঁর সাধনা। গুহ্যকালী দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠার পর লোক সমাজে প্রকটিত হয় তাঁর শক্তিসাধনার কথা।

মালীহাটির প্রসিদ্ধ রাধারমণ ঠাকুরের কাছে দীক্ষান্তে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব রূপে পরিগণিত হলেও সমস্ত দেবদেবী ও সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন মহারাজ নন্দকুমার।

তৎকালীন কাশীর রাজা ছিলেন চৈৎ সিংহ। বর্তমান গুহ্যকালীর বিগ্রহটি ছিল তাঁর কাছে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮) কোনও কারণে কাশীরাজের সমস্ত ধনসম্পত্তির সঙ্গে লুট করে আনেন গুহ্যকালী বিগ্রহ। ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল পদে ছিলেন ১৭৭৩-১৭৮৫ পর্যন্ত। সেটি বহুকাল অযত্নে পড়ে থাকে হেফাজতে। অপ্রত্যাশিতভাবে সেই বিগ্রহ হাতে আসে মহারাজ নন্দকুমারের, কিন্তু তিনি নিজে সে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি।

মহারাজা নন্দকুমার মন্দির নির্মাণ শুরু করেছিলেন ১৭৭৫ সালের প্রথম দিকে। কাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। ওই সালের ১৬ জুন মহারাজকে বিচারের জন্য আনা হয় কলকাতায়। তাঁর বিরুদ্ধে মোহনপ্রসাদ নামে এক রত্ন ব্যবসায়ী জালিয়াতির মামলা আনেন তৎকালীন কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে। ইংরেজ সরকারের ষড়যন্ত্রে আনা হয় এই মামলা। বলা হয় মহামূল্য রত্ন সংক্রান্ত একটি ঋণপত্রের স্বাক্ষর নাকি জাল করেছেন নন্দকুমার। বিচারের নামে প্রহসন চলল সুপ্রিম কোর্টে। মহারাজ বুঝেছিলেন ইংরেজ সরকার তাঁকে ছাড়বে না। তাই তাঁর পুত্র গুরুদাসকে নির্দেশ দিলেন খুব তাড়াতাড়ি মন্দির নির্মাণ শেষ করে যেন গুহ্যকালীকে প্রতিষ্ঠা করেন।

শোনা যায়, ১৭৭৫ সালের ১৫ জুলাই দ্বারোদঘাটন হল বর্তমান মন্দিরের। এদিকে ফাঁসির আদেশ হল মহারাজ নন্দকুমারের। এ আদেশ দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার ইলাইজা ইম্পে। ১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট কলকাতা ময়দানে, মতান্তরে খিদিরপুরে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয় এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে।

লোক পরম্পরাগত কথা, মহারাজের ফাঁসির দিন রাতে মন্দিরের উত্তর ও পূর্ব দেওয়ালে পরপর দুটি মারাত্মক বজ্রপাত হয়। বড় বড় ফাটল ধরে দেওয়ালের বিভিন্ন দিকে। ভেঙে পড়ে মন্দিরের চূড়া, তবে সেগুলি গর্ভমন্দিরের উপরে না পড়ে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। গর্ভমন্দির ও বিগ্রহ অক্ষত থাকলেও মন্দিরের দেওয়ালে ফাটলগুলি দেখা যায় আজও।

Gujjha Kali Bhadrapur

আকালি কালীর চূড়াহীন মন্দির প্রসঙ্গে দুটি জনশ্রুতি আছে। প্রথম, মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলাকালীন দেবী মহারাজকে স্বপ্নাদেশে বলেন, দেবী শ্মশানবাসিনী সুতরাং সুউচ্চ মন্দির গড়ার প্রয়োজন নেই। এই দৈবাদেশের পর নাকি মহারাজ মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।

দ্বিতীয়, দেবীর আদেশ অগ্রাহ্য করে নাকি নন্দকুমার মন্দির গড়ার কাজ চালিয়ে যান সমানে। যার চরম ও করুণ পরিণতি মহারাজের অকালমৃত্যু ও বজ্রপাতে মন্দিরের বাইরের অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া। মন্দিরের বাইরের অংশ আজও সংস্কার করা হয়নি।

জনশ্রুতি, মহারাজ নিজে উপস্থিত থাকতে পারেননি দেবী প্রতিষ্ঠার সময়। তান্ত্রিক মতে প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন পুত্র গুরুদাসকে। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার আগেই ফাঁসি হয়ে যায় মহারাজ নন্দকুমারের।

পূর্ব রেলের জেলা বীরভূম নলহাটি আজিমগঞ্জ শাখায় লোহাপুর স্টেশন। এখান থেকে প্রায় ৭ কিমি ভদ্রপুর গ্রাম। স্টেশন থেকে আমার যাওয়া রিকশায়। এখন অটো যায়। তারাপীঠ থেকেও যাওয়া যায় বাসে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *