Mythology

বিশ্বাসভক্তির জোর ঠিক কতটা, বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন সাধুবাবা

সাধুবাবা থামলেন। দেখছি তীর্থযাত্রীদের ঢল বয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। ফিরছেও কিছু তবে বেশিরভাগই চলেছে ত্রিবেণীসঙ্গমে। আমার চোখদুটো মাঝেমধ্যে ওদের দিকে গেলেও মনটা রয়েছে সাধুবাবার কথায়। সাধুরা যখন কথা বলেন তখন কানে শুনি আর মনে মনে তৈরি করি প্রশ্ন। কথা শেষ হতে প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, অনেক সময় অনেক মঠ মন্দির মিশন আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসী বা গুরুদের নামে কুৎসা শুনি। অনেকে এ পথে থেকেও অসৎভাবে জীবনযাপন করছে বলে শোনা যায়। ধরুন ব্যাপারটা সত্য। এখন প্রশ্ন কোনও ভক্ত বা শিষ্য যদি না বুঝে তাকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা বিশ্বাস বা ভক্তি করে তাহলে তার ফল কি হবে? এক্ষেত্রে জেনে বুঝে তাকে আমার কি উপদেশ দেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

এতক্ষণ কথার মধ্যে এতটুকুও নড়াচড়া করেননি। স্থির হয়ে বসেছিলেন। এবার একটু নড়েচড়ে দুহাত দু-হাঁটুর উপরে রেখে আমার দিকে তাকালেন করুণাভরা দৃষ্টিতে। এ দৃষ্টিতে দেহমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। সাধুবাবার তপস্যাজীবনের শক্তি যে কি তা এই মুহুর্তে সঙ্গ করতে করতেই বুঝতে পারছি। দৃষ্টিতে যে কত শক্তি নিহিত থাকে বিশেষ করে অধ্যাত্মজীবনে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের, সঙ্গ না করলে তা বোঝার কারও সাধ্য নেই। দৃষ্টিতে যেমন ক্রোধ প্রকাশ, কামের আবেশ ও নেশার ঘোর বোঝা যায়, তেমন প্রেমের বহিঃপ্রকাশেও চোখের ভাষার জুড়ি নেই। দৃষ্টিতে যেমন বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, অন্তরে প্রেমের বন্যাও বয়ে যায় দৃষ্টিশক্তিতে। এখন সাধুবাবার দৃষ্টিতে করুণার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই মনে হল না। আরও শান্ত আরও মধুর কণ্ঠে বললেন,

– বেটা সংসারে বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র তার ভাব। একজনের ভাবের সঙ্গে আর একজনের মিল খুঁজে পাবি না। একটা বিষয় বা বস্তুতে মানুষের মনে বিভিন্নভাবের উদয় হচ্ছে, ভাবের তারতম্য ঘটছে সংস্কার ও বুদ্ধিবৃত্তি অনুসারে। পরে তোর কথায় আসছি, আগে ভাবের কথা বলি। যেমন ধর তুই একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখলি, দেখলাম আমিও। মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু তোর চোখে যেভাবে তার সুন্দরতা প্রকাশিত হচ্ছে আমার কাছে সেভাবে প্রকাশিত না হয়ে অন্যভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তার সৌন্দর্য। আমি হয়ত তার চুল থেকেই সৌন্দর্যের প্রকাশ দেখছি, তুই হয়ত নাক থেকে ধরছিস সৌন্দর্যের প্রকাশ। সুন্দরভাবের প্রকাশটা হচ্ছে তোর আমার মনের ভাব অনুসারে। তোর ভাবের পরিবর্তন আমি করাতে পারব না, তুইও পারবি না আমার ভাবের পরিবর্তন করতে। সুতরাং যার যে মনের ভাব সেটা কখনও নষ্ট করা উচিত নয়। ওই বিশ্বাস ভক্তিতে সে নিজে উতরে যাবে। কারণ, বাহ্যত তার সামনে দেহটা থাকলেও পরোক্ষে বিশ্বাস ভক্তি করছে তারই ঈশ্বরীয় ভাবকে, তোর কথানুসারে একটা অসৎ দেহকে সামনে রেখে। বেটা, কেউ যদি অসৎ হয় তার কর্মফলে সে ভুগবে। তাতে বিশ্বাসভক্তিকারীর এতটুকুও অমঙ্গল বা ক্ষতি হয় না। উপরন্তু তার লাভই হয়। তাঁর করুণা বঞ্চিত হয় না বিশ্বাসভক্তির জোরে।

সাধুবাবা থামতে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আপনার কথায় বুঝলাম বিশ্বাসভক্তির জোর বড় সাংঘাতিক। কথা হল কখনও বিশ্বাসকারী যদি জানতে পারে যে সত্যিই যাকে এতদিন ধরে বিশ্বাস ভক্তি করে এসেছে সে সত্যিই অসৎ তখন তার কি হবে?

এ প্রশ্নে সহজ সরল উত্তরে বললেন,

– বিশ্বাসকারীর আধ্যাত্মিক বা পারমার্থিক ক্ষতি কিছু হবে না। শুধু মনটা সরে আসবে তার কাছ থেকে, আর কিছু হবে না। তবে বিশ্বাসকারী যদি অভিমানী হয় তাহলে তার মানসিক কষ্ট বাড়বে। কারণ অভিমান মানুষের সব সময়ই মানসিক কষ্টের কারণ। বিশ্বাসকারীর ওটা না থাকলে অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছু হবে না।

এই পর্যন্ত বলে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা এবার আমি উঠি। এখান থেকে আজই যাব বেনারসে।

হুট করে উঠি বলায় মনটা আমার দারুণ খারাপ হয়ে গেল। পা দুটো ধরে অনুরোধের সুরেই বললাম,

– বাবা দয়া করে আর একটু বসুন। আপনাকে তো ধরে রাখতে পারব না। জীবনে কখনও দেখাও হবে না। দয়া করে সঙ্গ দিলেন কথা বললেন, এর ঋণও আমি শোধ করতে পারব না। আর একটু বসুন দয়া করে।

আমার অনুরোধ উপেক্ষা করলেন না। প্রশান্ত চিত্তে বললেন,

– আর কি জানতে চাস বল?

আমি বিব্রতভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বললাম,

– বাবা, কি করলে একটা মানুষ আপনার মতো একজন ভালো সাধু হতে পারবে, সাধু হওয়ার পথটা বলবেন?

কথাটা শুনে সাধুবাবা হাসিতে ফেটে পড়লেন। হো হো করে সমানে হাসতে লাগলেন। এমন ছেলেমানুষি প্রশ্নে নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। এ অবস্থায় উত্তরের আশায় হাসিভরা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাসির রেশটা ধীরে ধীরে কমে এল, গম্ভীর হয়ে গেল মুখখানা। শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, আমার হাসিতে তুই লজ্জা পেয়েছিস ঠিকই তবে এ যে কি কঠিন প্রশ্ন করেছিস তা তুই নিজেও জানিস না। বেটা, এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই জোর করে হওয়া যায় না, জোর করে কাউকে কিছু করানোও যায় না। যদি সম্ভব হত তাহলে ঘরে ঘরে বাপ মা তাঁদের ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যিক দার্শনিক বিজ্ঞানী এমন অনেক কিছুই ইচ্ছামতো তৈরিই করতে পারতো। সব বাপমায়ের ইচ্ছা তাদের ছেলেমেয়ে একটা বিরাট কিছু হোক। তা কিন্তু হয় না বেটা। মানুষের মনের নিয়মেই আসে এমন ভাবনা। আর এই নিয়মে সবকিছু হলে প্রতিটা ঘরে বস্তা বস্তা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যিক শিল্পী এমন কত কিছুর লাট লেগে যেত। তা কোনও কালেই হওয়ার নয়। ঠিক এমনটা তোর প্রশ্নের ক্ষেত্রেও। জোর করে ভাল সাধু হওয়া যায় না, হওয়ানোও যায় না, কিন্তু মানুষই সাধু হয়, ডাক্তার হয়, শিল্পী হয়, সাহিত্যিক হয়, বিজ্ঞানী হয়। এরকম কত কি হয় যারা সংসারের, সমাজের এমন কি গোটা দেশের নাম উজ্জ্বল করে, মরে গিয়েও বেঁচে থাকে মানুষের মধ্যে। কেমন করে এসব হয় জানিস? তুই আমার কথাটা একবার ভেবে দেখ, আমি কি চেয়েছিলাম সাধু হব? সাধু হওয়ার জন্য কি কারোর চেষ্টা করতে হয়েছে? কেউ কি আমাকে জোর করে সাধু করে দিয়েছে? কোনওটাই নয়। তাহলে কেমন করে হলাম আর মানুষই বা কেমন করে অমন হয়?

বুঝতে পারছি সাধুবাবা অস্থির হয়ে উঠেছে চলে যাওয়ার জন্য। বললাম,

– বাবা, দু একটা কথা বলেই ছেড়ে দেব আপনাকে। আপনার বাড়ি কোথায় ছিল?

– নাগপুরে। ওখানেই আমার জন্ম। পড়াশুনা কিছু করিনি। গুরুজির দয়াতে চলি বলি। তাঁর কৃপাতেই এ পর্যন্ত চলেছে, বাকিটাও কেটে যাবে আনন্দে।

মাথায় একটা প্রশ্ন এসে গেল। করে ফেললাম,

– বাবা সেই কোন ছোটবেলায় অজান্তে বেড়িয়ে পড়লেন সংসারের সবকিছু ফেলে দিয়ে। জীবনে মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় পরিজন প্রেম ভালবাসা পেলেন না। সাংসারিকজীবনে পত্নীসুখ ও আনন্দটাও আপনার কপালে জুটল না। যা কিছু আনন্দ তা সবই পেয়েছেন গুরুজির কাছে। আমার জিজ্ঞাসা, বাবা, প্রকৃত ভালোবাসা কি আর তার রূপটাই বা কেমন?

এ প্রশ্নে সাধুবাবার চোখদুটো আমার চোখে রেখে স্থির হয়ে গেল। মুহুর্তে মুখখানা কেমন যেন অপার্থিব উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। দু-চোখ ভরে উঠল জলে। কয়েক ফোঁটা নেমে এল গাল বেয়ে। মনে হল কণ্ঠ যেন রোধ হয়ে এসেছে। দৃষ্টি অপলক। কাটল মিনিটখানেক। আবেগরুদ্ধ মমতা ভরা কণ্ঠে বললেন,

– মেরা বাচ্চা, ‘ভালোবাসা’ কথাটা কি জানিস? দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়ে একজনকে ধরে রাখার নাম ভালোবাসা। বেটা, মেরা বাচ্চা, আজ কি প্রশ্ন করে আমার জীবন মন ধন্য করে দিলি, যা আগে এমন করে কখনও ভাবিনি। বেটা, ভালোবাসা শব্দের অর্থটা তোর নিজের জন্য নয়, আমার নয়, ওই শব্দটা ব্যক্তিগতভাবে কারও জন্যও নয়, যাকে ভালোবাসছো তার সুখ ও আনন্দ চাওয়ার নামই ভালোবাসা।

কথাটা শেষ হতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। মিনিটখানেকের মধ্যে সামলেও নিলেন। আর কোনও কথা বলে বিব্রত করলাম না। সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। আমি ধুলোর মধ্যেই টানটান হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম।

সাধুবাবা ঝোলাটা মাটিতে রাখলেন। দুটো হাত মাথায় রেখে বললেন,

– বেটা, দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়ে একজনকে, তোর গুরুজিকে ধরে রাখার আশির্বাদ করি। যতদিন বেঁচে থাকবি ততদিন পরমানন্দেই থাকবি।

সাধুবাবা পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন। আমি উঠলাম বটে তবে পা দুটো যেন অবশ। চলতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে মহাত্মা চলে গেলেন দৃষ্টির বাইরে। একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *