মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, সাধুবাবা দিলেন দুটি আত্মার ভালবাসার ব্যাখ্যা
মৃত্যুর পর প্রিয়জন যদি আবার ফিরে আসে জীবজগতে তবে আবারও ফিরে আসতে হবে প্রেমিককে। যেকোনও ভাবে মিলন তাদের হবেই হবে।
![Ayodhya](https://www.nilkantho.in/wp-content/uploads/2018/08/ayodhya.jpg)
১৯৭০ সাল থেকেই লেখক ও পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতীর ভ্রমণ ও সাধুসঙ্গের জীবন শুরু, যা আজও জারি আছে। আসমুদ্র হিমাচলের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। প্রায় পাঁচ হাজার পথচলতি (রমতা সাধু) বিভিন্ন বয়স ও সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
সাধুসন্ন্যাসীরা কেন ঘর ছেড়েছেন, কিসের আশায়, কিভাবে চলছে তাঁদের, কেমন করে কাটে জীবন, এমন অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্নই লেখককে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের অসংখ্য তীর্থে, পথে প্রান্তরে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আছে এ লেখায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে অনুভূত ও উপলব্ধ মতামত।
তাঁদের জ্ঞানের পরিধির বিশালতা উপলব্ধি করে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন লেখক। যাঁকে প্রথমে নিতান্তই ভিখারি ভেবেছেন, পরে কথা বলে পেয়েছেন অগাধ জ্ঞানের পরিচয়। অশিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানহীন সাধুদের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ কথা, যা অনেক পণ্ডিতমনাদের ধারণায় আসবে না। তাঁদের কাছে পর্যায়ক্রমে কথোপকথন, বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ, যা অধ্যাত্ম্যজীবন, ভারতীয় দর্শন ও জীবনধারার পরিবাহক।
এ লেখায় কোনও মঠ, মন্দির, আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীদের কথা লেখা হয়নি। কারণ অধিকাংশই তাঁরা গৃহীজীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উপর নির্ভরশীল। এখানে সেইসব পথচলতি সাধুদের কথা আছে, যাঁদের জীবন জীবিকা চিন্তাভাবনা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত। যাঁরা সংসারের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়েছেন এক অজানা অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে। যাঁদের কৌতূহলী অন্বেষণ নেই। চাওয়া পাওয়ার বাসনায় যাঁরা নির্বিকার অথচ আত্মতৃপ্ত। এ লেখায় তাঁদের কথাই লিখেছেন পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতী।
বেশ আন্তরিকতার সুরে বললাম,
– বাবা, জীবনে বহু সাধুসঙ্গ করেছি কিন্তু আপনার মতো এত সহজ ভাবে, প্রেমের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি খুব কম সাধুদের।
কথাটা শুনে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। এমন নির্বিকার পরিচ্ছন্ন হাসি না দেখলে, হাসির যে প্রকৃত কি রূপ তা বোঝা যায় না। হাসতে দেখে বললাম,
– বাবা, আপনি হাসছেন! আমি কিন্তু সত্যি কথাই বলেছি আপনাকে।
হাসির রেশটা তখনও মিলিয়ে যায়নি সাধুবাবার মুখ থেকে। হাসতে হাসতে বললেন,
– বেটা, আমি হাসলাম কেন জানিস? তুই প্রেম কথাটা বললি বলেই হাসলাম।
এ কথার উদ্দেশ্যটা ঠিক ধরতে না পেরে বললাম,
– তার মানে!
চট করে উত্তর দিলেন না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে পরে বললেন,
– প্রেম কাকে বলে জানিস? যাতে আসক্ত হলে বা যা করলে মন সদা সর্বদা আনন্দময় সাগরে ডুবে থাকে, তাকেই তো বেটা প্রেম বলে। সেটা পার্থিব বা অপার্থিব যেকোনও ব্যক্তি বিষয় বস্তু বা প্রাণিতেও হতে পারে। বাচ্চা, প্রকৃত প্রেম ভালবাসা কখনও আনন্দবর্জিত হয় না।
কথাচ্ছলে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় এ রকম একটা কথা শুনব, আশাই করেতে পারিনি। এ কথায় আরও গভীরে যাওয়ার কথা ভেবে পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, প্রেমের রূপান্তরিত অবস্থা যদি মনের আনন্দময়তা, তাহলে এই আনন্দময় অবস্থা আসতে প্রথমে একের প্রতি অপরের যে আসক্তি থেকে প্রেম ভালবাসা, সেটা আপনিই সৃষ্টি হচ্ছে অন্তরে, অথচ এটা তো কেউ ভেবে করছে না। অন্তরে এই প্রেম ভালবাসার সৃষ্টি হয় কেমন করে?
এইভাবে প্রশ্ন করায় সাধুবাবা আবার চুপ করে রইলেন মিনিটখানেক। বারকয়েক তাকালেন আমার মুখের দিকে। কি যেন একটা ভাবলেন। হাসিমাখা মুখে ছাপও পড়ল একটা। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। একটু পরে ফিরে এল সেই প্রসন্ন হাসি। বললেন,
– বেটা, পূর্বজীবনে দুটি আত্মার মধ্যে ভালবাসা, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, মায়ের সঙ্গে সন্তানের, ভক্তের সঙ্গে ভগবানের, যা বর্তমান জন্মে অজ্ঞাতেই প্রতিফলিত হয় মনের উপরে। ফলে নারীপুরুষ নির্বিশেষে অনুভব করে যেন তাদের মধ্যে আগেও কোনও একটা সম্পর্ক ছিল। বেটা, আত্মার এই পারস্পরিক আকর্ষণই প্রেম ভালবাসা। পূর্বজীবনের আত্মিক সম্পর্কের আকর্ষণই তো এইভাবে এজন্মে প্রেমের সৃষ্টি করে একের সঙ্গে অপরের।
আবার প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, দুটি আত্মার আকর্ষণে তো একে অপরের প্রতি আসক্ত হল। কিন্তু তাতে আনন্দ কোথায়?
![Sarayu](https://www.nilkantho.in/wp-content/uploads/2017/10/sarayu.jpg)
প্রসন্ন মনে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, প্রেম ভালবাসা কোনও মোহ নয়। এর কার্যক্ষেত্র আমাদের এই জড় জগৎও নয়। আত্মার মাঝেই এর পূর্ণ বিকাশ। কেননা, প্রেমের পরিপূর্ণ রূপ হল ঈশ্বর এবং অপার্থিব শক্তিই হল প্রেম। দুটি আত্মার মাঝে এ এক স্বর্গীয় আকর্ষণ, যার থেকেই তো সৃষ্টি হয় আনন্দ।
প্রশ্নের আর শেষ নেই! জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনি বলছেন প্রেম শাশ্বত, অবিনশ্বর। প্রেমের মৃত্যু নেই। কিন্তু…
কথাটা শেষ হতে না দিয়ে বললেন,
– না বেটা, প্রেমের মৃত্যু নেই, এখানে কোনও ‘কিন্তু’ও নেই।
কৌতূহলী হয়ে বললাম,
– বাবা, সংসারজীবনে মায়ের সঙ্গে সন্তানের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর, একের সঙ্গে অপরের যে প্রেম ভালবাসার সৃষ্টি হচ্ছে, তার মৃত্যুও তো হচ্ছে অবিরত। দুটি আত্মার আকর্ষণে যে প্রেমের সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে প্রায়ক্ষেত্রে শোক আর প্রেমের মৃত্যুই তো দেখছি তার শেষ পরিণতি।
মনোযোগ দিয়ে কথাটা শুনলেন সাধুবাবা। মুখে ভাবেরও পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। বেশ গম্ভীর হয়ে এল মুখখানা। চিন্তা যে একটা হচ্ছে তা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। মিনিটকয়েক পর বললেন,
– বস্তুজগতে বাহ্যদৃষ্টিতে যা দেখিস তাতে মূলত এটাই দেখা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয় বেটা। যদি কোনও নারীপুরুষের মাঝে, ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মাঝে সত্যিকার প্রেম ভালবাসা থাকে তবে তা জানবি মৃত্যুর পরেও থাকবে। একথা বেটা শুধু নারীপুরুষের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাণের স্পর্শ আছে যেখানে, সেখানেই এটা হবে। সাময়িক বিচ্ছেদব্যথার উদ্ভব হলেও তার শেষ পরিণতি জানবি উভয়ের আত্মিকমিলনে। এ জন্মে না হলে দেহবিনাশের পর কোনও না কোনও জন্মে। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই বেটা প্রেম ভালবাসার সমাপ্তি হয় না। মিলনে আনন্দই যে তার শেষ পরিণতি। তবে সেটা অবশ্যই পারস্পরিক হওয়া চাই।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন। মুখখানা থেকে চিন্তার ছাপ একেবারে মুছে যায়নি। আমারও প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেছে,
– বাবা, এই প্রেম ভালবাসা যদি একতরফা অথবা বহুমুখী হয়ে ওঠে তাহলে তার পরিণতি?
সাধুবাবার মুখখানা দেখে মনে হল এখন যেন এই প্রশ্নই তিনি আশা করেছিলেন। উত্তরে বললেন,
– বেটা, কেউ যদি একজনকে ভালবাসে, একইসঙ্গে সে যদি অপরকেও ভালবাসে তাহলে জানবি, কি এ দেহে, কি দেহবিনাশের পর তাদের আত্মিক বা পুনর্মিলনে আনন্দের কোনও সম্ভাবনা নেই, যতক্ষণ না উভয়ে উভয়ের প্রতি সমান নিবিড় আকর্ষণ বা প্রেম অনুভব করছে। আকর্ষণে তীব্রতার অভাবই তো বেটা ব্যথা বেদনা আর শোকের সৃষ্টি করে।
মনে একটা প্রশ্ন এল। বলতে যাব, ইশারায় সাধুবাবা বললেন, তাঁর কথা শেষ হয়নি। তাই কিছু বললাম না। তিনি বললেন,
– বেটা, পার্থিবজীবনে এজন্যই তো প্রয়োজন পারস্পরিক ভালবাসাকে জাগিয়ে তোলা। যে পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য ভালবাসা অনন্তকাল ধরে বেঁধে রাখবে প্রেমিককে তার প্রিয়জন বা প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে, ভক্তের সঙ্গে ভগবানকে, এক প্রাণ আর এক প্রাণের সঙ্গে। এতে নিরানন্দ ও বিচ্ছেদের কোনও প্রশ্ন নেই।
প্রকৃত প্রেম ভালবাসায় বিচ্ছেদের কোনও অবকাশ নেই। অথচ লৌকিক জগতে সাময়িকভাবে তা অনেকক্ষেত্রেই ব্যথা বিরহের। এসব কথাগুলো শুধু ভাবছি। এমন সময় বললেন,
– আরও একটু কথা আছে বেটা, প্রকৃত প্রেমে প্রিয়জন হতে, ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে ভীত হওয়ার কোনও কারণ নেই। মৃত্যুর পর প্রিয়জন যদি আবার ফিরে আসে জীবজগতে তবে আবারও ফিরে আসতে হবে প্রেমিককে। ঈশ্বর বা অপাথির্ব শক্তি প্রেমকেও। যেকোনও ভাবে মিলন তাদের হবেই হবে। তখন দুজনেই আস্বাদন করবে নিঃস্বার্থ স্বর্গীয় প্রেমের মধুময় অমৃতফল আর ভক্তের সঙ্গে ভগবান হবে একাত্ম, অভিন্ন।
কথাগুলো শুনে মনটা আমার আনন্দময় হয়ে উঠল। সাধুবাবা বললেন,
– পার্থিব জীবনে যা কিছু বিচ্ছেদ, আন্তরিক প্রেমে তা বিচ্ছেদ নয়। কোনও না কোনও জীবনে তার পূর্ণতা আসবে। প্রকৃত ঈশ্বরপ্রেমে সাধকের সাময়িক যে অপূর্ণতা, এতেও ভয়ের কোনও কারণ নেই। দেহবিনাশের পর একাত্ম করার জন্য ঈশ্বরকেই লেগে থাকতে হয় প্রেমিকসাধকের সঙ্গে। অনন্তজীবনে বিচ্ছেদের কোনও স্থানই নেই। বেটা, পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন একদিন নিশ্চয়ই হবে।
এ কথার পর আমরা দুজনে চুপ ও স্থির হয়ে বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। মাঝেমধ্যে আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখছেন সাধুবাবা। দেখছি আমিও তাঁর প্রশান্ত মুখখানা। হাসছেন আপন মনে। প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, আজ জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসেছেন আপনি। এখন থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কি করবেন, কি করে চলবে, কেমন করে কাটাবেন নিঃসঙ্গ শেষের দিনগুলো, এসব কথা কি কখনও ভেবে দেখেছেন?
কথাটা শুনে মুখে ফুটে উঠল ফুলের মতো হাসি। মনে হল, এমন হাসি হয়ত ফুলেও ফোটে না। হাসতে হাসতেই বললেন,
– বেটা, আমার কি হবে, কি করব, কেমন করে, কিভাবে কাটবে আমার শেষের দিনগুলো, ঈশ্বর আমাকে দিয়ে কি করিয়ে নেবেন, তা তো আমি কিছুই জানি না। এসব কথা জীবনে ভাবিনি কখনও, ভাবিও না।
সাধুবাবার আত্মচিন্তাশূন্য মনে ঈশ্বরে এমন নির্ভরতা আর নির্লিপ্ততার কথা ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। একথার উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, ঈশ্বর কে?
এ প্রশ্ন শোনামাত্র আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সাধুবাবার মুখখানা। এ মুখ দেখার মতো মুখ। এবার উত্তরে এমন আবেগ জড়ানো সুর, মনে হল যেন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। ছলছল চোখে বললেন,
– বেটা, না চাইতে যিনি অনেক দেন, তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বর তিনিই – যাঁকে সহজেই প্রত্যাখ্যান করা যায়।