Mythology

যে কাজ করলে স্বয়ং ঈশ্বর দৌড়বেন আপনার পিছনে

আসমুদ্রহিমাচলে যখন কিছু প্রয়োজন তখন তা সহজে মিটে যায় কোনও না কোনওভাবে। ভগবান খালি হাতে নয়, তার প্রয়োজনের সমস্ত জিনিসই নিয়ে ছোটেন।

যত সময় কাটছে ততই হৃদয় মন আমার ভরে উঠছে এক অব্যক্ত আনন্দে। সাধুবাবা নিজেই শুরু করলেন,

– বেটা, সংসারে কারও মনের অনুকূল কোনও ঘটনা ঘটলে কিংবা কিছু হলে আনন্দ, প্রতিকূল কিছুতে মন কষ্ট বা হিংসার সৃষ্টি হলে বুঝবি সেই নারী বা পুরুষের সংসারে আসক্তির মাত্রাটা অতিমাত্রায়। বেটা, সংসারে সকলকে নিয়ে আছিস, ভাল। তবে সব সময় নিজেকে একা ভাববি। যে নিজেকে একা ভাববে তার জাগতিক কোনও কষ্ট থাকবে না। কোনও কষ্টই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যে ভাবে তার সবাই আছে, তার দুঃখের আর শেষ নেই। এই ভাবনা মাথায় রেখে সকলের প্রয়োজন মেটাতে চেষ্টা করবি।


পড়ুন আকর্ষণীয় খবর, ডাউনলোড নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

সাধুবাবার কথা শেষ হল, দেখছি বাবা তিলভাণ্ডেশ্বরের প্রসাদ নিয়ে এলেন স্বয়ং মন্দিরের পূজারি। শালপাতায় নয়, মন্দিরের থালায়। বুঝলাম এই সাধুবাবা বেশ উচ্চমার্গের মহাত্মা। তাঁর সম্মানার্থে পূজারিজি নিজে হাতে এনে দিলেন প্রসাদ। থালা দুটো রাখতেই দেখি গোবিন্দভোগ চালের ভাত, চারখানা পুরি, কয়েক রকম ভাজাভুজি, আলাদা আলাদা বাটিতে ডাল, তিন পদের সবজি, টক দই, পেঁড়াজাতীয় সন্দেশ, আচার আর পায়েস। পরিমাণটা এতই যে, একথালা প্রসাদ তিনজন জোয়ান ছেলে পেটভরে খেতে পারে। প্রসাদ দেখে বেশ আনন্দ হল মনে। না চাইতেই পেলাম, কি ভাগ্য আমার। অনেকে চেয়েও পায় না। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রশ্ন এল মাথায়,

– বাবা, সাধুসন্ন্যাসীরা অর্থোপার্জনের জন্য তো কোনও কম্মই করে না। জীবনে বহু সাধুবাবার কথায় বুঝেছি, আসমুদ্রহিমাচলের সমস্ত সাধুসন্ন্যাসীদের যখন কিছু প্রয়োজন তখন তা সহজে মিটে যায় কোনও না কোনওভাবে। এটা কেমন করে হয়, আমাদেরই বা হয় না কেন?

সাধুবাবা ইশারায় প্রসাদ দেখিয়ে প্রাণের দরজা খুলে হাসলেন বটে তবে একশ্রেণির অসভ্য পুরুষ ও মহিলাদের মতো বিকট শব্দে মাড়ি বের করে নয়। হাসির রেশটা মুখে থাকতে থাকতেই বললেন,

– বেটা, প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনব্রতটা ত্যাগের। গুরু বা পরমাত্মা যাই বল, তাঁর উপরে ছেড়ে দিয়ে চলছে। সেই জন্যে তো সাধুদের প্রয়োজনের যা কিছু তা সবই তিনি তার পিছনে নিয়ে ছুটে বেড়ান, কারণ সাধুর ভাবনাটা থাকে তাঁকে নিয়ে। তাই সাধুর পিছনে ভগবান খালি হাতে নয়, তার প্রয়োজনের সমস্ত জিনিসই নিয়ে ছোটেন। এদিকে সংসারীরা তাঁকে ছেড়ে সর্বদা ছুটে বেড়ায় অন্য সবকিছুরই পিছনে। সেইজন্যে তো বেটা গৃহীরা অত্যন্ত প্রয়োজনেও অনেক সময় কিছু তো পায়ই না, মনের অভাবও মেটে না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

বেটা, সংসারীদের পার্থিব কামনা ও পাওয়ার চিন্তাভাবনাই ভগবানকে পাওয়া ও তাঁর দেওয়ার পথকে রুদ্ধ করে। সাধুসন্ন্যাসীদের অপার্থিব কামনা, জাগতিক ও পারমার্থিক পাওয়ার পথকে সহজ সরল ও সুগম করে। (এবার একটা সংস্কৃত শ্লোক বলে তার মানে করে নিজের কথাটা বললেন)। বেটা, জ্যোৎস্না যেমন রাতের সমস্ত অন্ধকার দূর করে, দাসত্ব যেমন মানুষের সম্মান বিনষ্ট করে, শরীরের সমস্ত লাবণ্য যেমন নষ্ট করে বার্ধক্য, ভগবানের গুণকীর্তন যেমন জীবনের সমস্ত পাপ নষ্ট করে, তেমনি মানুষের সমস্ত গুণ নষ্ট হয় প্রার্থনাতে। না বেটা, কোনও কিছু, এমন কি মুক্তিও চাইবি না ভগবানের কাছে। দেখবি সব কিছু মিলে যাবে অনায়াসে।

মনে মনে বললাম, যুগযুগ জিও সাধুবাবা। এবার ইশারায় প্রসাদ পাওয়ার কথা বললেন, কোনও কথা না বলে একটা থালা এগিয়ে দিলাম আর একটা নিলাম নিজে। প্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললাম,

– বাবা, দেখুন মহাদেবকে কি সুন্দর আচারভোগ লাগিয়েছে।

হাসিমুখে সাধুবাবা বললেন,

– ভক্ত যেটা ভালবেসে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে, তাই-ই তিনি গ্রহণ করেন নির্বিচারে। তবে খাদ্যবস্তুর বিচার আছে মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভজনশীল যারা, ধর্মপথে আর এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা যাদের অন্তরে, তাদের। যেমন ঘি মধু মাছ মাংসতে কাম বাড়ে। দেহমন শান্ত শীতল রেখে সাধনভজনে এগুলো বর্জন করলেই ভাল। অত্যন্ত ক্রোধ বাড়ে সরষে আর লঙ্কায়। এ দুটো শান্তি আর সুন্দর ব্যবহারের পরিপন্থী খাদ্য। একেবারে খেতে নিষেধ করছি না। তবে যতটা কম খাওয়া যায়। সাংসারিক মোহ আর বড্ড আসক্তি বাড়ে টক ও চাটনিতে। ডালের মধ্যে মুসুর ডালে বাড়ে অহঙ্কার। পিয়াজ আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করে। এসব কথা যোগীরা জেনেছেন যোগ সাধনায়। সাধনজীবনের উন্নতি ও অবনতির সঙ্গে এগুলোর খাদ্যগুণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সাধুসন্ন্যাসীরা এই খাদ্যগুলি প্রত্যেকেই এড়িয়ে চলেন।

একটা কথা থেকে শুরু হয় কত কথা। সেই জন্য তো কথায় আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে। ভোজনে বাড়ে পেট’। প্রসাদ সামনে নিয়ে বসে আছি কিন্তু খাওয়া শুরু হয়নি এখনও। খাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বললেন,

– বেটা, যে কোনও নারী বা পুরুষের হাতের স্পর্শ করা খাবার না খাওয়াই ভালো। কেন জানিস, যে দিচ্ছে তার হাতের মাধ্যমে তারই বৃত্তিগুলো অতি সূক্ষ্ম ভাবে সংক্রামিত হয় গ্রহীতার মধ্যে। ফলে নানান কামনা বাসনায় জর্জরিত নারী বা পুরুষের হাতের যেকোনো খাবার খেলে তা মনের শান্তি নষ্ট করে, সাধন আনন্দের হানি ঘটায়। অসম্ভব চঞ্চল হয়ে ওঠে মন।

সাধুবাবা দুটো চোখ বুজে বলতে লাগলেন কথাগুলো। এখন প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন,

– বেটা, খাদ্যদ্রব্যে স্পর্শের কথা বললাম, এবার বলি স্পর্শপ্রণামের কথা। অনেকেই দেখবি স্পর্শ করে প্রণাম করতে গেলে বাধা দেয়। কেন জানিস, স্পর্শ করে প্রণাম করলে প্রণাম গ্রহণকারীর মধ্যে প্রণামকারীর কর্ম চলে যায় বেশি করে। সেইজন্যে বাধা দেয়। যারা ভক্ত ও সাধনভজনশীল তারা কাউকে প্রণাম করলে ক্ষতি কিছু হয় না। যারা বিষয়াসক্ত, সবসময় অর্থচিন্তা, স্বামীসন্তানের চিন্তার বাইরে অন্য কোনও শুদ্ধ চিন্তা নেই, নারীভোগ বিপরীতভাবে পুরুষসঙ্গ লাভের আশায় অন্তর প্রায়ই উন্মুখ, সাধন ভজনে বিমুখ কিন্তু লোক দেখানোটা আছে, এমন কোনও নারী বা পুরুষ প্রণাম করলে প্রণাম গ্রহণকারীর ভিতরে অশান্তির সৃষ্টি হবেই বেটা। এমনকি প্রণামকারীর দেহে কোনও রোগ থাকলে তা প্রবিষ্টও হতে পারে প্রণাম গ্রহণকারীর ভিতর।

এতক্ষণ কথা বলছিলেন চোখ বুজিয়ে। এবার তাকালেন আমার দিকে। মনে হল সাধুবাবার দুচোখের করুণাধারায় স্নাত হল আমার দেহ মন। একটা অদ্ভুত শিহরন খেলে গেল সর্বাঙ্গে। এখনও আমরা কেউ প্রসাদ খাওয়া শুরু করিনি। তিনি বলেই চললেন,

– কোনও ভক্ত বা ভজনশীল মানুষ কোনও সজ্জন, মহাত্মা কিংবা সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গ করে যদি তাঁদের স্পর্শপ্রণাম না করে, তাহলে প্রণামকারীর ক্ষতি কিছু হয় না। কারণ তাদের দর্শন ও সঙ্গলাভেই অশেষ কল্যাণ হয়। বেটা, প্রণাম গ্রহণকারী মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলে আশীর্বাদকারী বা সাধুমহাত্মার শক্তি (তড়িৎশক্তি) প্রবেশ করে প্রণামকারীর ভিতরে। এতে দেহমনের গ্লানি দূর হয়। একটা অপার্থিব আনন্দ বয়ে যায় ওই তড়িৎশক্তির প্রভাবে। তবে ফলের তারতম্য ঘটে সাধকের সাধনজোর ও শক্তির উপরে। প্রণাম গ্রহণকারীর তড়িৎশক্তি দেহ গ্রহণ করে তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে স্পর্শপ্রণাম করলে। তবে স্পর্শপ্রণামের পর সেই হাত মাথায় স্পর্শ করলে তবে তড়িৎশক্তি পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।

সাধুবাবা থামলেন। উঠে নেমে গেলেন কয়েক ধাপ সিঁড়ির নীচে। নর্মদার স্ফটিকধারা ছিটিয়ে দিলেন মাথায়। জলের ঝাপটা দিলেন চোখে মুখে। উঠে আসার সময় এককোষ জল এনে দিলেন আমার মাথায়, সর্বাঙ্গে। উচ্চস্বরে বললেন, ‘শঙ্কর ভগবান কি, জয়। ভগবান তিলভাণ্ডেশ্বর মহাদেব কি জয়। গুরু মহারাজজি কি জয়’। তিনবার জয়ধ্বনি দিয়ে মুখে বললেন,

– ‘ভগবান কা পরসাদ সবসে বাঁটো, সাধুকা পরসাদ আপনি সাঁটো’। খা লে বেটা, প্রেম সে পরসাদ খা লে।’

বলে গুরুকে নিবেদন করে খাওয়া শুরু করলেন, আমিও। অত প্রসাদ সবটা খেতে পারলাম না। বাকিটা নর্মদার জলে দিলাম। সাধুবাবার প্রসাদ খাওয়া শেষ হতে থালাটা নর্মদার জলে ধুয়ে নিয়ে এলাম। বসলাম মুখোমুখি হয়ে যেমন বসে ছিলাম আগে। এখন বেলা প্রায় একটা। অনেকক্ষণ আগেই বুঝে গেছি সাধুবাবা অসংখ্য উপদেশমূলক কথা জানেন। বললাম,

– বাবা, আপনার মন থেকে একটা কিছু বলুন।

কথাটা শেষ হতে না হতেই সংস্কৃতে একটা শ্লোক আউড়ে পরে মানে করে বললেন,

– বেটা, মৌন অবলম্বন করা ভালো কিন্তু মিথ্যা কথা বলা ভালো নয়, পুরুষের ক্লীবতা বরং ভালো কিন্তু পরস্ত্রীতে সহবাস করা উচিত নয়। ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করা বরং অনেক বেশি সুখের পরধনে সুখভোগ করা ভালো নয়।

চারদিকে একনজর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,

– মনে হচ্ছে এটা হবে বা হতে পারে, ঘুরিয়ে বললে মানে দুটো হতে পারে, অর্ধেক সত্য অর্ধেক মিথ্যা, এমন ধরনের কথা কখনই বলবি না, বলা উচিতও নয়। এসব কথা একেবারেই সত্যের পরিপন্থী। এতে মিথ্যার আশ্রয়ে সত্যের অপলাপ হয় যা আধ্যাত্ম জীবনের উন্নতিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

বেটা, মানুষের ধন থাকলে কিছুতেই ঠিকমতো, মনের মতো করে ডাকা যায় না শ্রীভগবানকে। অথচ দ্যাখ, অভাবীর, নির্ধনের একমাত্র সম্পদই কিন্তু ভগবান। আবার ধন বেশি হলেও কিন্তু তাঁকে ঠিক মতো ডাকা যায় না সামাল দেয়ার ঠেলায়। অর্থ ছাড়া জগতে কারও একটা পাও চলার উপায় নেই। অর্থ অবশ্যই ভালো তবে তাতে বদ্ধতা কিছুতেই ভালো নয়। অন্তরে অভাব এমনই যে, এর বোধ কারও কিছুতেই শেষ হয় না। আবার ধন এমনই এক বস্তু, এর বৃদ্ধিতে কিছুতেই নিবৃত্তি হয় না আকাঙ্ক্ষার। বেটা, সংসারে ধন আর অভাব এ দুটোর বোধ পরিত্যাগ করে ত্যাগের পথ নিলে তবেই তাঁকে লাভ করা যায় অনায়াসে। তা না হলে কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়, পাওয়ারও নয়।

আর বেটা আকাঙ্ক্ষা, এ যে কি ‘খতরনাক’ তা তোর ‘দিমাকে’ আসবে না। মানুষ, সে সাধু বল আর সংসারীই বল, সে ভগবানের কাছে আছে না দূরে, তা আকাঙ্ক্ষাই জানিয়ে দেয়। কেমন করে জানিস, নারী বা পুরুষ যতই তীর্থ করুক আর মুখে ভগবানের কথা যতই বলুক, যার অন্তরে আকাঙ্ক্ষা যত বেশি, ভগবানের থেকে তত বেশি দূরে। যার আকাঙ্ক্ষা কম, যত কম তত বেশি তাঁর কাছে। যার একেবারে নেই তার কেল্লা ফতে। বেটা সে ভগবানের কোলে, গুরুজির কোলে শুয়ে আছে ‘আরাম সে’।

রাতে ট্রেন ধরব। এখন হাতে কোনও কাজ নেই। এমন নির্বিকার নিরহঙ্কার সাধু চাইলেই কি পাওয়া যায়? আমার ভাগ্য ভালো, জুটে গেছে। সময় কাটাতে বললাম,

– বাবা, যেকোনও উপদেশ, হিতোপদেশ, কবীর, তুলসীদাস, দাদু, মহামতি চাণক্য, মনুসংহিতা, শঙ্করাচার্যের মোহমুদ্গর এর মধ্যে থেকে যেকোনও উপদেশ, বাণী বা এমন কিছু বলুন, যা আমাদের মতো সংসারীদের কিছু কাজে লাগে।

মাথা নিচু করে কথাকটা বলে মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম, মুখখানা কেমন যেন একটা অব্যক্ত আনন্দে ভরে উঠেছে। বললেন,

– বেটা, জীবনে আমি তোকেই প্রথম পেলাম যে সাধুর কথা ধৈর্য ধরে শুনল, নানান ধরনের কথা জিজ্ঞাসা করল অথচ কোনও জিজ্ঞাসায় নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা নেই। তোর আচরণে মনটা সত্যিই আজ আনন্দে ভরে উঠেছে। গুরুজির কাছে প্রার্থনা করি, তুই সদাসর্বদা পরমানন্দে থাক, গুরুতে যেন তোর মনমতি নিবেদিত নিঃস্ব হয়ে যাক।

এমন আশীর্বাদে আমার কান্না পেয়ে গেল। মাথাটা সাধুবাবার পায়ে ঠেকিয়ে প্রাণভরে প্রণাম করলাম। মাতৃস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এইভাবে মিনিটখানেক কাটার পর মাথাটা তুললাম। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, এই বয়েসেও গুরুজির দয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর হাজার দশেক শ্লোক আমার মুখস্থ আছে। কিছু বলছি, তুই লিখেনে। সংস্কৃত শ্লোকটা লেখার দরকার নেই, মানেটা লিখবি।

আমার কাগজ কলম তৈরি। সাধুবাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন গুরুস্মরণ করলেন। শুরু করলেন এইভাবে,

– বেটা, মদ পান করা, পিতার গৃহে দীর্ঘকাল অবস্থান, অসৎ লোকের সঙ্গে বিবাহিতা কন্যার একত্রে থাকা, তীর্থ ভ্রমণের সময় বহুলোকের সঙ্গে বাস করা, স্বামীর সঙ্গে বিরহ, দীর্ঘকাল বিদেশে একাকী বাস, অন্যের গৃহে বহুবার যাওয়া, ভ্রষ্ট নারীদের সঙ্গে মেলামেশা করা, স্বামীর বার্ধক্যদশা, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হিংসা, আত্মীয়ের গৃহে অবস্থান, এগুলি যেমন নারীদের ভ্রষ্ট চরিত্রের কারণ তেমনি সাধুসন্ন্যাসীদের চরিত্র ভ্রষ্টের কারণ গৃহীদের বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া আসা করা, তাঁদের সঙ্গে অতিমাত্রায় যোগাযোগ রাখা। প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসীরা হাজার প্রয়োজনেও কখনও গৃহীর বাড়িতে যায় না।

যারা উপকারীর উপকার স্বীকার করে না তারা পুণ্যকে, মনস্তাপ মনের আনন্দকে, নীতি মানুষের বিপদকে, সূর্য অন্ধকারকে, মঙ্গললাভ শোককে আর দুর্নীতি বিনাশ করে অর্থ ও সম্পদকে। যারা অকৃতজ্ঞ তাদের জীবন থেকে সবসময়ই পরিত্যাগ করবি।

বেটা, বিদ্যাহীনের জীবন শূন্য। বিদ্যাহীন নারী বা পুরুষ যতই রূপযৌবনভরা হোক না কেন, গন্ধহীন পলাশফুলের মতো কোথাও সমাদর লাভ করতে পারে না এরা। সন্তান মূর্খ হয় পিতার দোষে।

বন্ধুহীনের সমস্ত দিকটাই শূন্য। বেটা, মন খুলে কথা বলা, প্রাণ খুলে নিষ্কপট কথা বলা, সুখদুঃখে একে অপরের সহায় সঙ্গী হওয়ার মতো একজনও নারী বা পুরুষ যদি জীবনে না থাকে, তার মতো অভাগা কপাল আর কার হতে পারে?

পুত্রহীনের গৃহশূন্য। যার সংসারে সন্তান আছে অথচ পুত্র নেই, তার সংসারে টাকাপয়সা ধন দৌলত সবকিছু থাকলেও গৃহ ভরপুর জমজমাট নয়।

বেটা, জগতের সমস্ত কিছুই শূন্য যে দরিদ্র। কর্মদোষেই মানুষ দরিদ্র হয়। কৃপণের কখনও সুখ হয় না। বংশের দোষেই মানুষ কৃপণ হয়। দাতা ও উদারচিত্ত বংশেরই গুণে। স্বার্থপর হলে মন ও ধর্মনষ্ট হয়। যশ নষ্ট হয় গর্ব করলে। বংশের সম্মান নষ্ট হয় কুপথে ইন্দ্রিয় গেলে আর বন্ধুত্ব নষ্ট হয় কপটতায়।

ঘি চিনি ক্ষীর ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে তাতে নিমফল রাখলে সেই ফল যেমন তার নিজস্ব স্বাভাবিক স্বাদ পরিত্যাগ করতে পারে না, কিছুতেই মিষ্ট হয় না। পিঁয়াজ যেমন তার স্বাভাবিক গন্ধ পরিত্যাগে অক্ষম তেমনি অসৎ ও নিচ প্রবৃত্তির মানুষ বাইরে যত সুন্দর ভাল ব্যবহার করুক, জন্মগত স্বভাব কখনও পরিত্যাগ করতে পারে না। কোনও না কোনও সময় তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে আচরণ ও ব্যবহারে।

একটানা কথাগুলো বলে থামলেন, জানতে চাইলাম,

– বাবা, ভারতের নানা তীর্থে গেরুয়াধারী দেখেছি হাজার হাজার কিন্তু গেরুয়া পরলেই কি সাধু হওয়া যায়? প্রকৃত সাধু কে?

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পর পর কয়েকটা শ্লোক বলে পরে বললেন,

– সকলকে সাধনভজনের উপদেশ দিয়ে নিজেও যিনি নিষ্কাম ভজন করেন তিনিই প্রকৃত পুণ্যবান সাধু। স্রোতস্বিনী নদীর জল সর্বদা নির্মল, বদ্ধ জল গন্ধেরই আধার। বিভিন্ন তীর্থে সর্বদা পরিভ্রমণরত সাধুমন সর্বদাই শুদ্ধ ও নির্মল। এদের মনে দাগ লাগে না। প্রকৃত সাধুর মন আর নদী এক। বেটা দুটোই কোমল। অটল পর্বত সহ্য করে জলধারার আঘাত, কাটাকাটি সহ্য করে সমস্ত বৃক্ষলতাদি, পৃথিবী সহ্য করে খোঁড়াখুঁড়ি আর নির্বিকার কুবাক্য সহ্য করে সাধুরা। সহ্যশক্তিহীন যে সাধু, সে সাধু পদবাচ্য নয়। বৃক্ষ নদী আর সাধু এই তিনের স্বভাব সমান। বৃক্ষ ফল দান করে, নদী দান করে জল, বিনিময়ে কোনও প্রত্যাশা নেই। পরম পথের সন্ধান দেন সাধুরা। কোনও প্রাপ্তির আশায় নয়।

এতক্ষণ পর সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, এখনই উঠতে হবে। আজই জব্বলপুর থেকে ট্রেন ধরে যাব অমরকণ্টকে। তোর সঙ্গে কথা বলে ‘বহুত আনন্দ মিলা’।

সাধুবাবাকে আটকানোর প্রবৃত্তি হল না। দুটো বিড়ি ধরিয়ে একটা দিলাম আর একটা নিলাম নিজে। ফুকফুক করে টানতে লাগলেন। আমি বললাম,

– বাবা, এমন একটা কথা বলুন যে কথা বা উপদেশ পালন করলে মনের উন্নতি হয়।

বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন,

– মেরা বাচ্চা, কাউকে উপলক্ষ করে জীবনে কোনও কিছু পেলে, সে প্রেম ভালবাসা, কোনও সঙ্কট থেকে মুক্তি, কোনওভাবে কোনও সহায়তা বা সাহায্য পেলে তো ভাল, এসব না হয়ে কোনও হিতকর কথা পেলেও তাকে কোনও দিন ভুলতে নেই। সে নারী বা পুরুষ, সৎ বা অসৎ, কোনও বিচারে যাবি না। ওসব ভাবার দরকার নেই। তা না হলে বেটা মনের অধোগতি হবে। যে কোনও ভাবে শান্তির পথ অবরুদ্ধ হবে। একটা কথা জানবি সে মানুষ। বেটা, এই দেহটার সঙ্গে মানুষের যখন চিরকাল সম্বন্ধ থাকে না, তখন সংসারে অন্য কারও সঙ্গে সারাটা জীবন সম্পর্ক থাকা কি সত্যি সম্ভব? তবে একটা কাজ তো সম্ভব (উপলক্ষকে) ভুলে না যাওয়া। মেরা বেটা, ভগবানেরই তো একটা বড় অংশ উপলক্ষ, যা থেকে চলছে এই সংসার, চলছি আমি তুই আর সকলে।

একথায় ডুকরে কেঁদে ফেললাম আমি। সাধুবাবারও দু-চোখ জলে ভরা। আর কোনও কথা সরলো মুখ থেকে। সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। প্রণাম করলাম। দুটো হাত মাথায় রেখে বললেন,

– ‘সব কাম মে বেটা তেরা জয় হো। সদা আনন্দ আনন্দ আনন্দ মে রহো বেটা, সদা আনন্দ মে রহো’।

শীর্ষচিত্র – নর্মদা নদীতীরে তিলভাণ্ডেশ্বর মন্দির – শিবশংকর ভারতী

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *