Mythology

কোন নারীপুরুষ সংসর্গ ঠিক, জানালেন হিংলাজ মায়ের দর্শন পাওয়া সাধু

পথে যেতে যেতে কোনও সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ল। সুন্দরী বিবাহিত বা কুমারী মেয়েদের দেখতে ভালো লাগে সব পুরুষদের। সংসারে রূপ নিয়েই তাঁর বিচিত্র খেলা।

জ্বালামুখী মন্দিরের বাঁপাশে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। তার পাশে জ্বালামুখী মন্দিরের কার্যালয়। সিঁড়িতে ওঠার মুখেই লাল গণেশ আর ভৈরবের কালো বিগ্রহ। বাঁদিকে একেবারে কোণে পাথরের মূর্তিটি আচার্য শঙ্করের। দোতলায় ডাইনের অংশটি ‘গোরখ ডিব্বা’ নামে পরিচিত। ভিতরে লেখা ‘শ্রীগুরু গোরখনাথজিকা ধুনা’। ধুনীর পাশে একটা ত্রিশূল পোঁতা আছে। এরই পাশে বসে আছে অতি বৃদ্ধ এক সাধুবাবা। পরনে গেরুয়া বসন। মাথায় লম্বা জটা কুণ্ডলী করে পাকানো। পাতলা চাহারা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ না বলে কালো বলাই ভালো। টিকালো নাক রবি ঠাকুরের মতো। মুখের হনুদুটো বেড়িয়ে আছে। বয়সের ধাক্কায় চোখদুটো অনেকটাই বসে গেছে। মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠা বলিরেখা দেখে আমার আন্দাজ বয়স ৮৫/৯০ এর কাছাকাছি।

মুখোমুখি বসে মাথাটা বৃদ্ধের পায়ে ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। হাতজোড় করে নয়, পায়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। সাধুবাবা মুখে বললেন,


– ‘ওঁ নমো নারায়ণায় নমো’।

বৃদ্ধই শুরু করলেন,


– কাহাঁ সে বেটা?

বুঝে গেলাম এই সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলে মজা পাব। অনেক কথা জানা যাবে। আনন্দে ভোরে উঠল মনটা। ভ্রমণ ও তীর্থদর্শনে এসেছি। বাড়ি কলকাতায় জানিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলাম, (যদিও এই গোরখ ডিব্বায় বসে আছেন আরও কয়েকজন সাধুবাবা),

– বাবা, আপনি কোন সম্প্রদায়ের সাধু?

সাধুবাবা বিনয়ের সঙ্গে জানালেন,

– বেটা, আমি নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। এই সম্প্রদায়ের নাম কি তুই কখনও শুনেছিস?

সজোরে ঘাড় নেড়ে ও মুখে বললাম,

– হ্যাঁ বাবা শুনেছি।

বলেই জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এখন আপনার বয়েস কত হল?

বয়সের কথা জিজ্ঞাসা করতেই হেসে ফেললেন। উল্টে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

– তোর বয়েস কত?

হাসতে হাসতে বললাম,

– সাতাশ চলছে।

সাধুবাবা হাসিমাখা মুখে বললেন,

– বেটা, শও হোনেকে লিয়ে অউর তিন সাল বাকি।

একটু চমকে গেলাম। একশো হতে আর তিনবছর বাকি। এত দীর্ঘায়ু এক সাধুবাবার চরণস্পর্শ করতে পেরেছি, এটাই আমার ভাগ্য। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতে হতে আমার একটা সমস্যার কথা জানালাম,

– বাবা, আমি একটা সমস্যায় আছি। বহুদিন ধরেই ভুগছি। যদি দয়া করে মুক্তির পথটা বাতলে দেন তো বাঁচি।

সাধুবাবা অনুমতি দিতে আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বললাম,

– বাবা, সুন্দরী বিবাহিত বা কুমারী মেয়েদের দেখতে ভালো লাগে সব পুরুষদের, আমারও। তাদের দেখে অন্তরে নোংরা চিন্তা বা কামনার উদ্রেক হচ্ছে এমনটা কখনও হয় না। সমস্যাটা আমার অন্য জায়গায়। যেমন, আমি সাইকেল চালাই। পথে যেতে যেতে কোনও সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ল। দেখলাম ভালো লাগল। অনেকটা দূরে চলে গেছি। ওমা, ওই মহিলাকে আবার দেখার জন্য সাইকেল ঘুরিয়ে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে, তাকে মন ভরে দেখে যেখানে যাচ্ছিলাম, সেই দিকেই চলে গেলাম। এটা আমার প্রতিদিনের ঘটনা। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই মনকে সুন্দরী দেখার প্রলোভন থেকে মুক্ত করতে পারছি না। কি করলে মন এর থেকে মুক্ত হতে পারে, দয়া করে বলবেন বাবা?

সাধুবাবা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। তারপর শব্দহীন হাসি হাসলেন। মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন,

– বেটা, তোর কি বিয়ে হয়েছে?

– না বাবা, এখনও আমার বিয়ে হয়নি।

সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, এতে তোর কোনও দোষ নেই। ফুলের রং রূপ ও সুগন্ধের মতো প্রকৃতির তথা মহামায়ার এক বিচিত্র প্রকাশ নারীর রূপে। নারীদেহ এক ভিন্ন উপাদানে সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতি, যার টানকে, যার বিস্ময়কর ও বিমুগ্ধ আকর্ষণকে অনাদি অনন্ত কালেও কোনও পুরুষ অবহেলা করতে পারবে না। যেমন ধর, কোনও নারীর রূপ তোর কাছে গ্রহণযোগ্য হল না, সে কিন্তু অন্য কোনও না কোনও পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়। জগৎ সংসারে রূপ নিয়েই তাঁর বিচিত্র খেলা। রূপের আকর্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে, মৃত্যুও হচ্ছে অবিরত। রূপকে তুই অস্বীকার করবি কি করে?

সাধুবাবা থামলেন। কোনও কথা বললাম না। মিনিট খানেক চুপ করে থেকে এই প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা হল। সাধুবাবা পাশে থাকা চিমটেটা আমার ব্রহ্মতালুতে তিনবার স্পর্শ করে বললেন,

– আর কিছু ভাবতে হবে না। ‘সব ঠিক হো যায়েগা’।

আমি বললাম,

– বাবা, আপনি যখন মাথায় চিমটে ঠেকিয়ে বললেন সব ঠিক হো যায়েগা, আমি নিশ্চিন্ত আজ থেকেই ওই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি হবে। তবে আমার, মতো আর যে সব পুরুষ রূপের আকর্ষণে পড়ে আছে, তারা মুক্ত হবে কি করে?

সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, অন্য কোনও দেবদেবী নয়, প্রতিদিন বাসি বিছানায় বসে মহামায়া অথবা রাধারানীর কাছে তিনবার একই কথা বলে (মা, আমাকে রূপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত কর) প্রার্থনা করলে দেখবি অদ্ভুত নারীর রূপসৌন্দর্য দেখার ইচ্ছেটাই অন্তর থেকে চলে যাবে। মন আবিলতা মুক্ত হবে।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, জ্বালামুখী থেকে বাড়ি ফেরার পর আমার সাইকেল নিয়ে ফিরে এসে দেখার ইচ্ছেটা আজ পর্যন্ত হয়নি। যাইহোক, প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– বাবা, বয়েস তো অনেক হল, এখনও কি ভিক্ষা করেন? কি করে চলে আপনার?

আনন্দময় মূর্তিটি বললেন,

– বেটা, সেই দশবছর বয়েসে গৃহত্যাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত কারও কাছে হাত পাতিনি। গুরু মহারাজ কি কৃপা, সে প্রতিদিন কিছু না কিছু জুটে যায়। কখনও না খেয়ে ছিলাম, এমন কথা আমার আজও মনে পড়ে না। বেটা, একটা ঘটনা বলি শোন, তখন আমার বয়েস বছর তেরো হবে। গুরুর সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করতাম। গুরুর বয়েস ১৩০ বছর। যোগী ছিলেন। চেহারায় কারও মালুম হবে না। দেখলে মনে হবে ৬০/৬৫। চলেছি হিংলাজ মাতার দর্শনে। মাতাজি তো অভি পাকিস্তান মে পড়গিয়া।

পথে একদিন প্রবল ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়লাম। সকাল থেকে বেশ কিছুক্ষণ তুমুল ঝড় হয়ে থেমে গেল। বেটা, বৃষ্টি কিন্তু থামল না। পথে একটা ভাঙ্গাচোরা আগের যাত্রীদের ফেলে যাওয়া কুঠিয়াতে আশ্রয় নিয়েছি। আমি আর গুরুজি ছাড়া কেউ নেই। বৃষ্টির এমন তোড়, কুঠিয়া ছেড়ে বেরোয় কার সাধ্যি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হল। গুরুজি জিজ্ঞাসা করেন মাঝে মাঝেই, হ্যাঁরে বেটা, তোর কি খুব ভুখ লেগেছে। আমি লজ্জায় বলি, না গুরুজি, তেমন ক্ষিদে কিছু পাইনি কিন্তু আমার তখন ক্ষিদে আর পিপাসায় গলা বুক শুকিয়ে আছে। গুরুজি বললেন, ‘বেটা ঘাবড়াও মত্, তেরা বহুত ভুখ লাগা। মাঈয়া তেরে লিয়ে খানা লা রাহা হ্যায়’।

এবার আমার দিকে চেয়ে জলভরা চোখে ঢুকরে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ সাধুবাবা। কপাল বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা। বললেন,

– বেটা, গুরুর কথা শেষ হতে না হতেই দেখি এক বৃদ্ধ মহিলা একটা ঝুড়ি এনে গুরুজির পায়ের কাছে রাখলেন। কোনও কথা বললেন না। তখন অত না বুঝলেও দেখলাম তুমুল বৃষ্টির মধ্যে তাঁর পরনের বসন আর ঝুড়ি শুকনো খটখটে। জ্যোতির্ময়ী বৃদ্ধা ওটা রেখে দাঁড়ালেন না এক মুহুর্ত। ঝড়ের বেগে এলেন, চলে গেলেন পলকে।

একটু থেমে সাধুবাবা বললেন,

– এই সময় গুরুজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। ইশারায় বললেন, ঝুড়ির মধ্যে কি আছে দেখতে। আমি ঝুড়ি খুলে দেখলাম নানান ধরণের বেশ কিছু সুমিষ্ট ফল, শুকনো খাবার, যেমন আখরোট কিসমিস বাদাম এইসব। বেটা সবচেয়ে বেশি ‘তাজ্জব বন গয়া গরম পুরী অউর সবজি দেখ কর’। এসব দেখে বললাম, ‘ইয়ে খানা কাঁহাসে বুঢঢা মাঈ লাকে আয়া? উনকি নিবাস কঁহা? উনকো মালুম ক্যায়সে হুয়া কি হামলোগ হিঁয়া সুবেসে ভুখা হ্যায়’। পরবর্তীকালে বুঝেছিলাম, আজও বুঝি, আমার মতো ভাগ্যবান আছে, তবে সংখ্যায় খুব কম।

সাধুবাবার কথা শুনে সাধক রামপ্রসাদের জীবনকথা মনে পড়ে গেল। কোনও এক দুঃসময়ে তাঁর জীবনেও ঘটেছিল এমন এক ধরণের বিস্ময়কর ঘটনা। এরপর কথা হল অজস্র। সময় কেটে গেছে প্রায় ঘণ্টা তিনেক। বললাম,

– বাবা, আপনার কি মনে হয়, ওই বৃদ্ধা মহিলা কে এবং বৃষ্টি বাদলের মধ্যে কোথা থেকে এসেছিল?

প্রসন্নচিত্ত সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, তোর মতো আমিও ওই ঘটনার পর আমার গুরুজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সেদিন বা পরে গুরুজি আমার জিজ্ঞাসার কোনও উত্তর দেননি, শুধু হেসেছিলেন।

অনেক কথার পর বললাম,

– এমন কিছু উপদেশ দিন যা আমার জীবন চলার পথে কাজে লাগবে।

অতি বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বললেন,

– তোরা লিখাপড়া জানা মানুষ। কি উপদেশ দিই বলতো? বেটা, নিজের কোনও যোগ্যতা নেই, এমন অনেক পুরুষ ও রমণী আছে যারা পূর্বসূরিদের বংশগৌরবকে অবলম্বন করে নিজেকে তাদের আলোয় আলোকিত করতে চায় নিজের অপদার্থতা ও অকর্মণ্যতাকে লুকিয়ে রাখতে। এমন মানুষ পরিত্যাজ্য। এরা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করতে পারে না এমন কোনও কাজ নেই। যাদের দৃষ্টি নির্মল, মুখমণ্ডল প্রসন্নতায় ভরা, সুন্দর ও মধুর কথা বলে, কথায় আগ্রহ আছে, অন্তর স্নেহভরা এবং নির্বিচারে সম্মান প্রদর্শন করে, এদের সঙ্গ করলে নিজের আত্মিক ও মানসিক উন্নতি হয়। বেটা, সুখের সময় আনন্দের সঙ্গে তা ভোগ করবি, দুঃখ এলে তা সহ্য করবি হাসিমুখে, কারণ এ দুটো সবসময় পরিবর্তিত হচ্ছে।

অনেকটা সময় কেটে গেল সাধুবাবার সঙ্গে। একসময় প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধও উঠলেন আমার সঙ্গে। বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘তেরা জয় হো বেটা, তেরা জয় হো।’

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button