Mythology

সুন্দরী রমণীকে দেখা, সঙ্গ করা কী দোষের, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন সাধুবাবা

এটা আমার বয়েসের দোষই বলব। সুন্দরী বিবাহিতা কিংবা অবিবাহিতা রমণীদের রূপ আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। দেখলে তাদের রং ও রূপরস আমি পান করি মনের অধরপল্লব দিয়ে। সাধুবাবা এখন না হয় বুড়ো হয়ে গেছে। রক্তমাংসের দেহ। যখন ভরা যৌবন ছিল, এখন আমার মতো, তখন কি এমনটা তাঁর মনে কখনও হয়েছে? কুমার ব্রহ্মচারীর তাপসজীবন। না হলে তো কোনও কথাই নেই। হয়ে থাকলে কি করতেন তিনি? মনে হওয়ামাত্র এই কথাগুলো জানতে চাইলাম। এতক্ষণ স্থিরভাবে বসে ছিলেন। একথায় তিনি একটু নড়ে বসলেন। মেলে বসা পা গুটিয়ে বসলেন বাবু হয়ে। হাতদুটো রাখলেন হাঁটুর উপরে। এদিক ওদিক নজরটা ঘুরিয়ে চোখদুটোকে রাখলেন আমার চোখে। লজ্জায় মাথাটা নুয়ে এল। মিনিটখানেক কাটল এইভাবে। বললেন,

– বেটা আমি সাধু যখন, তখন কিছুতেই মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারি না। জানতে চেয়েছিস, সত্যি কথাই বলেছি তোকে। জীবনে একটা দিনের জন্যও নারীভোগের ইচ্ছা বা বাসনা অন্তরে আসেনি আমার গুরুজির অপার অন্তর করুণায়। নারীর রূপসৌন্দর্য দেখতে ভালো লাগা, প্রাণভরে দেখা, এ আমার যৌবনে ছিল, এখনও আছে বলতে পারিস, তবে ভোগের বাসনা তখনও ছিল না, আজও নেই।


আকর্ষণীয় খবর পড়তে ডাউনলোড করুন নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

একটু থেমে বললেন,

– একটা কথা মনে রাখবি, সাধন চলাকালীন সংসার কিংবা সাধুজীবনে সুন্দরী কুমারী যুবতী বা বিবাহিতা রমণীকে দেখা বা কথা বলাটা কোনও দোষের তো নয়ই, মানসিক অপরাধও নয়। আবার কোনও না কোনও অজুহাতে অবজ্ঞা করা বা এড়িয়ে যাওয়াও কোনও কাজের কথা নয়, সঠিক কাজও নয়। এটা ঠিক, প্রায়ই মেলামেশা দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা ইত্যাদি হতে থাকলে মনের উপরে কামের একটা প্রভাব পড়ে বিপরীত লিঙ্গের দেহ রূপ ও সৌন্দর্যের কারণে। নিজের সংযম রক্ষা করতে তাদের এড়িয়ে গেলে মনে একটা অহংকার আসবে। একইসঙ্গে এড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা সৃষ্টি করবে নিদারুণ মানসিক অশান্তি। এটা সাধনভজনের পক্ষে, মনের পক্ষে ভালো নয়। বরং এদের দেখা, কথা বলা, এদের সঙ্গ করা ভালো তবে মনটাকে রাখতে হবে সমভাবে, সঙ্গে আরাধ্য দেব বা দেবী স্মরণে থাকলে কোনও দোষ হয় না, কোনও কুফল স্পর্শ করে না মন ও অন্তরকে।

একটু থামলেন। পরে বললেন,

– বেটা, কোনও যুবতী নারীর দেহ জেনে বুঝে স্পর্শ না করাই ভালো। কারণ তাদের ভিতরে সৃষ্টির নিয়মে রয়েছে এক অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি। এই শক্তি পুরুষের দেহ ও মনকে অজান্তেই প্রভাবিত করে, প্রলুব্ধ করে কামে। তবে চলার পথে, মাঠে হাটে, কোনও দেবালয় বা মন্দির দর্শনে গিয়ে কিংবা নিজের অজান্তে কোনও নারীদেহ স্পর্শ হলে স্পর্শদোষ হয় না। কারণ তখন মনটা স্পর্শের ভিতরে ও কোনও কার্যকারণে থাকে না। বেটা, স্পর্শ একটা মারাত্মক ব্যাপার। যেমন অসৎ প্রবৃত্তি যার এবং ভোগীর স্পর্শের দান গ্রহণ করতে নেই। এই স্পর্শজনিত কারণে সাধনভজনে বিঘ্ন হয়। চিত্তের চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। মানসিক প্রশান্তি নষ্ট আর গুরুর স্মরণ মনন ও অনুধ্যানে বাধা জন্মে।

সাধুদের সঙ্গে কথা বলে মজা আছে। একটা বিষয় নিয়ে শুরু করলেও কথায় কথায় এসে যায় নানা বিষয়ে হাজার কথা। জানা যায় অজানা অনেক কথা। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, সারাটা জীবন তো শুধু পথই চললেন। এই নিঃসঙ্গ একাকী চলার পথে কখনও কোনও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছিলেন, যে কথা আজও অন্তরে লেখা আছে!

একটু ভেবে উত্তরে জানালেন,

– বেটা, সংসারজীবনে দরিদ্রব্যক্তির সুন্দরী যুবতী স্ত্রী যেমন বিড়ম্বনা স্বরূপ, সাধুসন্ন্যাসীদের বিড়ম্বনা যেমন চঞ্চলতা, তেমনই সংসারীদের ধর্মীয়জীবনে উন্নতির পথে বড় বিড়ম্বনা পাওয়া সত্ত্বেও আরও পাওয়ার তৃষ্ণা। বেটা, চলার পথে এমনিতে আমার কোনও বিষয়ে কখনও পাওয়ার তৃষ্ণা মনে জাগেনি। অল্প বয়েসে চঞ্চলতা তো একটু ছিলই, পরে গুরুমহারাজের করুণায় তা চিরতরে গেছে। বিড়ম্বনা বলতে যা বোঝায় তা বেটা এ জীবনে কখনও আসেনি।

ঠিক এই মুহুর্তে হঠাৎ করে প্রশ্নটা মাথায় এল। করেই ফেললাম,

– বাবা, আমার পরিচিত বহু মানুষ আছে যারা দীক্ষা নেওয়া তো দূরের কথা, বছরে একবার মন্দিরের মুখদর্শন করে না। কেউ যদি জোর করে নিয়ে গেল তো অনিচ্ছায় যাওয়া। না গেলেই যেন ভাল হত। সাধনভজনের পথে নেই। তবে অন্যের বিশ্বাসে খুব একটা হস্তক্ষেপ করে না। ঘুম থেকে উঠে চা খবরের কাগজ, তারপর বাজার, ফিরে এসে স্নান খাওয়া সেরে কেউ চাকরি, কেউ চলল ব্যবসায়। সন্ধ্যায় ফিরে এসে টিভি। নইলে বউবাচ্চাদের পিছনে লাগা অথবা মদ, এরপর রাতের খাওয়া সেরে ‘মুড’ ভালো থাকলে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস, না হলে এক কাতেই রাত কাবার। অনেক সময় বউ কিংবা বাড়ির অন্য কারও ইচ্ছা বা উদ্যোগে লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতীপুজো। সেখানেও এতটুকু আন্তরিকতা নেই। অথচ এদের দেখেছি ভালোই অর্থোপার্জন করছে। ঠাটবাট আত্মীয়স্বজন বজায় রেখে তো দেখি বেশ চলছে। আর যারা দিনরাত ভগবানকে ডেকে মরছে, তারা যেন আরও বেশি করে মরছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?

Mahakaaleshwar Temple
মহাকালেশ্বর মন্দির

খুব ভালো হিন্দি বলতে পারি না কিন্তু বলতে পারি। কাজ চলে যায় সুন্দরভাবে। লিখতে পারি না তবে পড়তে পারি। এখন এতগুলো কথা বুঝিয়ে বলতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। মোটের উপর বোঝাতে পেরেছি। সাধুবাবা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন হাঁ করে। চোখদুটো দেখে মনে হল, ভাবছেন এ কোন উৎপাতের পাল্লায় পড়লাম। মুহুর্তমাত্র ভাবা। বললেন,

– বেটা, আমি তোকে কোনও উৎপাত ভাবছি না। ভাবছি তোর চিন্তাভাবনার কথা। সারাটা জীবন এমন ধরনের প্রশ্ন আজ পর্যন্ত আমায় কেউই করেনি। আনন্দে মনটা আমার ভরে উঠেছে। সব কথার উত্তর দেব। তোর প্রশ্নের উত্তর অনেক বিশাল এবং ব্যাপক। দু-এক কথায় উত্তর দেয়া সম্ভব না। আমার উত্তরে তোর কিছু কৌতূহল থেকে যাবে তবুও অতি সংক্ষেপে তোকে বলছি।

প্রথমে বলি, অদীক্ষিতদের মৃত্যুর পর সদ্গতি হয় না, সে যত সৎপথেই থাকুক কিংবা লোকের সেবা করুক না কেন! গরিবদের পেট ভরে খাওয়াচ্ছে, ভাণ্ডারা দিচ্ছে, এর তো ফল একটা আছেই। আবার জন্ম হবে তবে বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে। এর থেকে বেশি কিছু হবে না। বেটা, খুনির চাইতেও চরমদণ্ড ভগবান দেন ঘুষখোর আর সুদখোরকে। একদিনের জন্যে ঘুষ অথবা সুদ খেয়ে থাকলে স্ত্রীপুত্রকন্যা সারাজীবন অশান্তি ভোগ করে কাটাবে। নানান রোগব্যাধিতে ধরবে। সদগুরুর আশ্রিত হলেও মৃত্যুর পর এরা কে কতকাল কোন নরকে পচবে তা ভগবান ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। এই জীবনযন্ত্রণা চলবে পরপর তিনপুরুষ ধরে। ক্ষমা নেই, মুক্তিও নেই। বেটা, তোর কথা অনুসারে ভগবানের সঙ্গে যাদের তেমন সম্পর্ক বা কোনও ‘গুড রিলেশান’ নেই, তাদেরও সাংসারিক জীবনের সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্য যেমন, পৈত্রিকসূত্রে বা নিজের প্রচেষ্টায় বাড়ি, ব্যবসায় বা চাকরি, শিক্ষা ইত্যাদি সমস্ত জাগতিক বিষয়গুলি তার জুটতে পারে তবে সেটা পূর্বজন্মের সুকৃতিতে। এমন মানুষ তুই তো হামেশাই দেখতে পাস যাদের সঙ্গে ভগবানের কোনও সম্পর্ক নেই। তেমন কোনও যোগ্যতা নেই অথচ অর্থোপার্জন করছে প্রচুর। এটাও ওই পূর্বজন্মেরই কর্মফল। তবে বেটা এদের সদ্গতিলাভ হয় না। মৃত্যুর পর বার বার ফিরে আসতে হয় পৃথিবীতে। সব কিছু পেয়েও এরা শান্তিহীন জীবন যাপন করে। এদের সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো।

তোর কথার মধ্যে এক জায়গায় তুই বললি না যে, যারা দিনরাত ভগবানকে ডেকে মরছে তারা যেন আরও বেশি করে মরছে। শুধু একটা কথা বলি বেটা, দুদিনের এই সংসারে এলেও এরা বিরল প্রজাতির নারীপুরুষ। এরাই ভগবানের কোলে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমোয়, মৃত্যুর পরেও পরমশান্তি লাভ করে ভগবানের সঙ্গলাভ করে।

একটু থামলেন। মাত্র তিরিশ কি চল্লিশ সেকেন্ড হবে। দেখলাম চোখদুটো আধবোজা হয়ে এল। কেমন যেন একটা আবেগভরা ঘোরে বললেন,

– বেটা, সংসারজীবনে বড় দুঃখী কে জানিস? যে অভাবী, দরিদ্র। তার চেয়ে দুঃখী কে জানিস, যে ঋণে জর্জরিত। বেটা সংসারে দুঃখীর যেন আর শেষ নেই। এদের চাইতেও বেশি দুঃখী সব সময় যে একটা না একটা রোগে ভুগছে, রুগী। তারচেয়েও বড় দুঃখী আছে সংসারে। কে জানিস? যার স্ত্রী অন্য পুরুষে আসক্ত। তবে বেটা এরা দুঃখী হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিত জানবি এরা কেউ হতভাগ্য নয়। সবচেয়ে হতভাগ্য দুঃখী হল মনুষ্যজন্ম গ্রহণ করে, গুরুলাভ করেও যে মন্ত্রের সাধন করে না।

সাধুবাবার বয়েস তো আর কম হল না, তাই হয়ত এক নাগাড়ে কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। একটু থেমে দম নিচ্ছেন আবার বলছেন। আমার মুখের দিকে একটু চাইলেন। হয়ত বোঝার চেষ্টা করলেন আমি তাঁর কথা ঠিক বুঝছি কি না! এবার আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন,

– মেরা বেটা, মেরা বাচ্চা আজ আমার বড় আনন্দের দিন, জীবনে এই প্রথম তোকে পেলাম যাকে ভগবৎ প্রসঙ্গে বলতে পারছি। হাঁ রে বেটা, তোর তো দেখছি গালভর্তি দাঁড়ি। মাথায় বড় লম্বা লম্বা কোঁকড়া চুল। দেখতেও তোকে সাধুদের মতো। তুই কেন সাধু না হয়ে সংসারে রইলি।

তাকালেন মুখের দিকে। কথা বললাম না। একটু হতাশার সুরেই যেন তিনি বললেন,

– বেটা, ফলহীন গাছকে যেমন পাখিরা, জলহীন শুষ্ক জলাশয়কে বক, মধুহীন সুন্দর ফুলকে ভ্রমর মৌমাছি, অর্থহীন সুদর্শন পুরুষকেও যেমন পরিত্যাগ করে পতিতারা, তেমন শ্রীভগবান সর্বদাই পরিত্যাগ করেন স্বার্থ অর্থ ও সংসারচিন্তামগ্ন সাধনভজনহীন নারীপুরুষকে। সংসারে এদের সংখ্যাই বেশি। এদের দুঃখ ও মানসিক কষ্টের যেন আর অন্ত নেই।

কথাকটা বলে আবারও তাকালেন মুখের দিকে। এসময় সাদা কাপড় পরা, কপালে কেশরী চন্দনের তিলক দেয়া একজন এসে দাঁড়ালেন সামনে। হাতজোড় করে অনুরোধের সুরে জানালেন পুজারিজি ডেকে পাঠিয়েছেন। মহাকালেশ্বরের ভোগপ্রসাদ পাওয়ার জন্য যেতে হবে। এতক্ষণ বেশ কথা হচ্ছিল। আর কোনও কথা হল না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কি আর করা যাবে! আমরা দুজনে উঠে দাঁড়ালাম। প্রণাম করলাম সাধুবাবাকে। মাথায় দুহাত বুলিয়ে আশির্বাদ করলেন। এ যে একেবারে প্রাণভরা আশির্বাদ তা অনুভব করলাম অন্তরে।

শান্ত ও ধীর পায়ে নির্বিকার নির্লিপ্ত বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পাশে পাশে একই পদক্ষেপে কাম ও কামনা জর্জরিত এক ঘোর সংসারী চলল মহাকালেশ্বরের প্রসাদ পেতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *