Mythology

ঈশ্বরের করুণা বুঝবেন কি করে, সহজে বুঝিয়ে দিলেন সাধুবাবা

জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনার গুরুজির বয়স কত ছিল?

কপালটা একটু কোঁচকালেন। মনে হল ভেবে ঠাঁই পেলেন না। বললেন,

– গুরুজির বয়স কত ছিল ঠিক বলতে পারব না বেটা। আমি তোর মতো এসব কথা জিজ্ঞাসা করিনি কখনও। প্রথম যখন দেখি তখন তো গুরুজি একেবারেই বুড়ো কিন্তু দেখলে মনে হত না। অথচ দেহের চামড়া কুঁচকে ভাঁজ হয়ে মোটা হয়ে গেছে। আমিই তো তাঁর সঙ্গ করেছি প্রায় সত্তর বছর। আর খাওয়ার কথা বলছিস, ওটা গুরুজি জোগাড় করে আনতেন। ওসবের কোনও চিন্তা ছিল না আমার।


আবার জিজ্ঞাসা করলাম ওই একই কথা,

– হিমালয়ের ওই নির্জন গিরিগুহা। তীর্থযাত্রীর সংখ্যা ছিল নেহাতই কম। বলতে গেলে ভিক্ষে দেয়ারও লোক ছিল না। সেখানে প্রতিদিনের আহার সংগ্রহ হত কেমন করে? তখন তো এমন লোকবসতি ছিল না যে গেলেই পেয়ে যেতেন।

এতক্ষণে সামান্য হাসির রেখা ফুটে উঠল সাধুবাবার মুখে। বললেন,

– গুরুজি আহার সংগ্রহ করতেন কোথা থেকে বলতে পারব না। তবে প্রতিদিন সুমিষ্ট ফল, উৎকৃষ্ট ঘি, আটা সবজি আনতেন। যখন যা খেতে ইচ্ছে করত, প্রয়োজন হত তাই-ই আনতেন। কোনওদিন না খেয়ে থাকিনি আমরা।

কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। দুর্গম হিমালয়ে সাধুবাবার খাবার সংগ্রহের রহস্য ভেদ করতেই হবে। বলে কি এসব কথা! মাথাটাই দেখছি আমার খারাপ করে দেবে। কৌতূহলে অধৈর্য হয়ে বললাম,

– গুরুজি প্রতিদিন খাবার আনতেন কোথা থেকে, দিতই বা কে?

নির্বিকার সাধুবাবা বললেন,

– তোর মতো অত কৌতূহল আমার ছিল না। গুরুজি আশ্রয় দিয়েছেন এটাই তখন ছিল যথেষ্ট। তাই ওসব কথা জিজ্ঞেস করিনি কখনও।

মনে হল বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। তাই কথার ফাঁস মেরে একটু ঘুরিয়ে বললাম,

– বাবা, নির্জনে দেবার মতো লোক নেই অথচ আহার সংগ্রহ করে আনতেন গুরুজি। কোথা থেকে কেমন করে আনতেন, এত বছর যখন এপথে আছেন, তখন ধারণা তো কিছু আছে আপনার।

কথাটা একটু ঘোরাতেই মুখ খুললেন সাধুবাবা,

– আমার গুরুজি ছিলেন যোগী। অসাধারণ ছিল তাঁর যোগেশ্বর। এসব আহার আনতেন তিনি অতি সহজে। গুরুজিকে ‘ভিখ মাঙতে’ দেখিনি কখনও, দেখিনি কারও কাছে হাত পেতে কিছু নিতে।

কৌতূহলের সীমা রইল না আমার। উৎসুক হয়ে বললাম,

– নিজের চোখে আপনি কখনও তাঁর যোগৈশ্বযের্র কিছু দেখেছেন?

খুশিতে ভরে উঠল সাধুবাবার মুখখানা। বললেন,

– দেখেছি মানে! গুরুজির অসাধারণ ক্ষমতা দেখতে দেখতেই তো কেটে গেছে জীবনের অতগুলো বছর। টেরই পাইনি। ওসব কথা বলেও শেষ করতে পারব না কোনওদিন! আহার সংগ্রহের কথা বললি যখন একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি শোন। একদিন সকাল থেকে শুরু হল তুষারপাতের সঙ্গে বৃষ্টি। বাপরে সে কি বৃষ্টি! এমন বৃষ্টি সচরাচর হতে কখনও দেখিনি। সঙ্গে চলছে ঝোড়ো হাওয়া। বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বেলা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গুহা থেকে বেরোয় কার সাধ্যি। এদিকে কাঠ নেই, খাবারও নেই গুহায়। এ সবই জানতেন গুরুজি, তবুও বললাম তাঁকে। শুনে হাসলেন তিনি। বললেন, ‘ঘাবড়াও মত বেটা’ বলে গুহায় বসে ধীরেধীরে গুহার বাইরে প্রসারিত করে দিলেন হাতটাকে। ক্রমশ বড় হতে থাকল। চেয়ে রইলাম অবাক হয়ে। দৃষ্টির নাগাল পার হয়ে গেল আমার। মুহুর্তের মধ্যে হাতটা নিয়ে এলেন পূর্বাবস্থায়। দেখলাম ওই প্রচণ্ড বৃষ্টি আর তুষারপাতের মধ্যেও হাতে একবোঝা শুকনো কাঠ, আটা, সবজি, ঘি। এ যুগে এসব কথা তো কেউ বিশ্বাসই করবে না, বিশ্বাস হবে না তোরও।

একটু থামলেন। মিনিট খানেক। পরে বললেন,

– বেটা একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করতাম, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনও জিনিস গুরুজি আনতেন না, সঞ্চয়ও থাকত না। যেদিন যে জিনিস যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু আনতেন। একটা রুটিও কখনও অতিরিক্ত থাকত না, হতও না।

এসব কথা ভেবে কোনও কূলকিনারা করতে পারতাল না। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পরে জিজ্ঞাসা করলাম,

– সারা ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থ ঘুরেছেন নিশ্চয়ই?

মাথাটা নাড়িয়েও মুখে বললেন,

– না না বেটা, কেদারবদরী, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী গোমুখ গেছি। আর কোথাও যাইনি। হিমালয় তপোবন, ওখানে সর্বদাই বয়ে চলেছে আনন্দের হিল্লোল। এমন আনন্দ কি আর অন্য কোনও তীর্থে পাওয়া যায়! সেইজন্যেই তো হিমালয় ছেড়ে অন্য কোথাও যাইনি। মনও চায় না।

জানতে চাইলাম,

– তাহলে কেন হিমালয় ছেড়ে নেমে এলেন এই জনকোলাহল তীর্থে?

এতক্ষণ সাধুবাবার দৃষ্টি ছিল আমার উপরে। এবার এদিক ওদিক তাকালেন একটু। পরে চোখটা ঘুরিয়ে আমার দিকে রেখে বললেন,

– গুরুজির দেহরক্ষার পর ভাবলাম, যাই একবার লোকালয়ে। বহুবছর তো যাইনি তাই চলে এলাম। আবার ফিরে যাব সেই গুহায়, যেখানে শুরু করেছিলাম আমার সাধনজীবন।

কথাটা বলার পর দেখলাম ভাবটা কেমন যেন উদাসীন হয়ে উঠল। মনে হল সেই গুহাজীবনে চলে গেলেন তিনি।

আমি বললাম,

– ফিরে তো যাবেন। গুরুজিও নেই। নির্জনে খাবেন কি? আপনার গুরুজির কায়দায় খাবার আনবেন?

হেসে ফেললেন কথাটা শুনে। এ হাসিতে মিশে রয়েছে যেন এক অপার্থিব আনন্দ। এড়িয়ে যাওয়ার ছলেই হাসতে হাসতে বললেন,

– গুরুজিই মিলিয়ে দেবেন।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা আমরা, প্রায়ই বলে থাকি, ঈশ্বর আছেন তিনি দয়া করছেন, তাঁর করুণায় চলছি, আমাদের উপর তাঁর কৃপা আছে এমন অনেক কথাই বলি। এ সব তো কথার কথা। বুঝতে পারি কই?

আনন্দভরা মুখে বললেন,

– বেটা, মানুষের সাধারণ চিন্তা ভাবনার বাইরে ঘটে যাওয়া মঙ্গলজনক কোনও ঘটনা বা কার্য সংঘটিত হলে তার সুফল দেখে অন্তরে যে আনন্দের অনুভব, সেটাই ঈশ্বরের দয়া বা করুণা। এটা না বোঝার কারণ কই? প্রতিটা মানুষ তার নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝতে পারে সহজে। তবে সেই ঘটনা কারও জীবনে ছোট, কারও বা বড় আকারে ঘটে, পার্থক্য এটুকুই, কিন্তু ঘটে প্রায় প্রতিদিনই। অথচ ভুল করেও ভাবেনা, অনুভব করতে চেষ্টাও করে না অলক্ষ্যে বর্ষিত ঈশ্বরের এই কৃপা ও করুণার কথা। আসলে অকৃতজ্ঞের উদাহরণে মানুষই যে প্রথম।

কথাটা শুনে ভাবতে লাগলাম। সাধুবাবা বললেন,

– কি রে বেটা, কি এত ভাবছিস? ভাবনার কি শেষ আছে? যত ভাববি, ভাবনা তোকে আরও ভাবিয়ে তুলবে।

ভাবলাম, সত্যিই ভেবে লাভ নেই কিছু। প্রশ্ন করলাম,

– একটু আগে বললেন, স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি শুয়ে থাকলে একের কামচিন্তা অপরের দেহমনকে প্রভাবিত করে তোলে। আপনিতো সংসার করেননি। সারাটা জীবন কাটিয়েছেন হিমালয়ে। কোনও মেয়েমানুষের পাশে না শুয়েও বিষয়টা জানলেন কি করে?

উত্তর দিতে এতটুকু দেরি করলেন না,

– বেটা, ওটা তো জগতের সৃষ্টিরহস্যের কথা। মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ হলে ওটা আপনা থেকেই জানতে পারা যায়। শিখিয়ে বা বলে দিতে হয় না কাউকে।

লজ্জার মাথা খেয়ে হিমালয়ের এই সাধুবাবাকে বলে ফেললাম,

– বলুন দেখি বাবা, কামের এই প্রভাবে আপনি কি কখনও প্রভাবিত হয়েছেন?

এ কথায় অসন্তুষ্ট তো হলেনই না, হেসে ফেললেন। বললেন,

– জীবজগতের কেউই কামের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়, তবে আমার কথাই বলি। একেবারে সেই ছোট্টবেলায় গুরুজির সঙ্গে গেছি হিমালয়ে। তখন তো ওসবের কিছু বুঝতাম না। তারপর দীর্ঘকাল বলতে পারিস, জীবনের সবটাই তো কেটেছে ঠাণ্ডা আর হিমালয়ের নির্জন গুহায়। তপস্যা ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না আমার। ওখানে থাকাকালীন নারীর মুখ খুব কমই দেখেছি। বছরে এক-আধটা হয়ত! কারণ গুহা থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হত না। দেখেছি শুধু গুরুজিকে, দেখেছি প্রকৃতির নিত্যদিন রূপের পরিবর্তনে মনোমুগ্ধকর শোভা। যৌবনের প্রথম অবস্থায় কাম দেহকে একটু নাড়া দিয়েছে, মনকে না। কঠোর তপস্যা, সংযম, ব্রহ্মচর্যপালন ও গুরুকৃপা, এ সবের জন্য মনের উপর কামের কোনও ক্রিয়াই হয়নি, কোনওদিন এক মুহুর্তের জন্য নয়।

কথাটা শুনে কেমন যেন খটকা লাগল মনে। বলে ফেললাম,

– বাবা আপনি বললেন, কাম আপনার দেহকে একটু নাড়া দিয়েছে, মনকে নয়। কথাটা কি ঠিক? চিন্তার থেকেই তো ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া। মনে কামচিন্তা না এলে দেহে তার ক্রিয়া হবে কি করে? দেহে কামের ক্রিয়া আছে অথচ মনে কামচিন্তা নেই, এ কেমন কথা?

কথাটা শেষ হতে উত্তরটা যেন মুখেই ছিল সাধুবাবার। জিজ্ঞাসা করব জানতেন মনে হল। বললেন,

– বেটা, একেবারে বাল্যকালে শিশুর দেহে কামের যে অবস্থা থাকে, যৌবনে আমার সেই অবস্থাই ছিল। একটা পুরুষশিশুর মনে কামচিন্তা স্পর্শ করে না, থাকেও না। অথচ লক্ষ্য করলে দেখবি, অনেক সময় ঘুমন্ত অথবা জাগ্রত অবস্থায় কামের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে দেহে। এ প্রকাশ তার কোনও কামচিন্তার প্রসূত নয়। কামের এ প্রকাশ প্রাকৃতিক নিয়মেই, বুঝলি? কাম আমার দেহে ছিল শিশুর মতো অবস্থায়। শুক্রের প্রভাবে দেহে তার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে, মনে কোনও ক্রিয়া হয়নি, হতও না।

প্রশ্ন করলাম,

– আপনার মতে কোন জীবনটা ভালো, সংসার না সাধুজীবন?

একটু ভেবে হাসতে হাসতে বললেন,

– সংসার যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সব দিক থেকে সে তো ভাবতেই পারবে না সাধুজীবনের কঠোরতার কথা। তার কাছে সংসার জীবনটাই ভালো হবে। যে প্রতিষ্ঠা পায়নি তার কাছে মনে হবে, সাধুজীবনে কত সুখ, কত আনন্দ। কিসসু নেই সংসারে। বেটা এই জীবনেও তো দেখলাম দীর্ঘকাল এ পথে থেকে, অসহ্য কষ্ট আর কঠোরতা সহ্য করতে না পেরে অনেক সাধুই তো ফিরে গেছে সংসারে। তাই ভালো মন্দের বিচার করাটা শক্ত।

একটু চাপ দিয়ে বললাম,

– তবুও আপনার মতে কোনটা ভালো বলে মনে হয়?

নির্লিপ্তভাবে বললেন,

– দেখ বেটা, সংসারে সব কিছু থাকলেও শান্তিটা নেই। যার শান্তি নেই, সব কিছু থাকলেও তার কিছুই নেই। তার মানে সংসারে কারও কিছুই নেই। সাধুজীবনে আর কিছু না থাকলেও শান্তি আছে। সংসার ভালো তবে সংসার যদি করতেই হয় তাহলে সংসারে থেকে পরমাত্মার সঙ্গে সংসার করাটাই ভালো। তাতে শান্তিটা থাকবে সংসারে থেকেও।

সব সময় মনে থাকে না সব কথা। বহুদিন ধরে ভেবে রেখেছি কথাটা জিজ্ঞাসা করব কোনও সাধুবাবাকে পেলে। পেয়েছিও। কথায় কথায় হারিয়ে গেছে কথাটা। নিজেই তলিয়ে যাই সাধুবাবাদের কথায়। এখন হঠাৎ মাথায় এল কথাটা। জিজ্ঞাসা করলাম,

– প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে তো বাবা বহু সাধুসন্ন্যাসী, যোগী, মহাপুরুষ এসেছেন যুগেযুগে। আরও আসবেনও হয়ত। বর্তমানে যে একেবারে নেই এমন নয়। আমার বিশ্বাস তাঁদের অনেকেই অসাধারণ ক্ষমতা ও ঐশীশক্তিসম্পন্ন। কিন্তু সমাজের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য তাঁরা শুধু জ্ঞান বিতরণ ছাড়া আর কিছুই করেননি, করেনও না। তাঁদের সকলের উপর শ্রদ্ধা রেখে এ কথা স্পর্ধার সঙ্গেই বলছি ত্রৈলঙ্গস্বামী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, গম্ভীরনাথ, গোরক্ষনাথ, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, বালানন্দ ব্রহ্মচারী, ভোলানন্দগিরি, বামাক্ষেপা, কাঠিয়াবাবা থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পর্যন্ত, ভারতের প্রায় সমস্ত সাধকের জীবনীই আমি পড়েছি। তাতে আমার ওই ধারণাই হয়েছে। তাঁদের জ্ঞানের কথা কটা লোক মেনে চলে? তাঁরা কি জানতেন না তাঁদের উপদেশ অসার হয়ে যাবে? যে উপদেশ কার্যকারী হয় না, সে উপদেশের মূল্য কি? তাঁদের সাধনলব্ধ ঐশীশক্তি সমাজ ও সংসারীদের কোনও উপকারেই আসেনি কেন? এখন যাঁরা এই শ্রেণির বলে খ্যাতিলাভ করেছেন, তাঁরাই বা কি করছেন? অসাধারণ ঐশীশক্তিসম্পন্ন আপনার গুরুজি তাঁর শক্তিদ্বারা সমাজ ও সংসারীদের জন্যই বা কি করেছেন?

এ প্রশ্নে সাধুবাবাকে বিব্রত হতে দেখলাম না। শুনে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। আমিও রইলাম চুপ করে মুখের দিকে তাকিয়ে। কেটে গেল মিনিটদশেক। এতক্ষণ পর এবার বসলেন সোজা হয়ে। একেবারে সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– বেটা তুই তো অনেক কথাই বললি। এবার আমি কিছু বলি। সাধনবলে মানুষ ঈশ্বরের সমস্ত শক্তিই লাভ করতে পারে একটা শক্তি ছাড়া। সেটা হল জগৎ বা সৃষ্টিবিষয়ক শক্তি। জগৎ বা সৃষ্টির ধারাকে রোধ বা পরিবর্তন করার শক্তি কোনও সাধুসন্ন্যাসী, যোগী, মহাপুরুষেরই লাভ হয় না। এমনকি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরও নয়, যদিও এঁরা ঈশ্বরের সমস্ত শক্তিতেই শক্তিমান হতে পারেন। এঁরা সাধনবলে অর্জিত ঐশীশক্তি দ্বারা ক্ষেত্র বা ব্যক্তিবিশেষে কিছু উপকার করতে পারেন। সেটুকুও সাময়িক তবে সৃষ্টির ক্ষেত্রে, সমষ্টিগতভাবে সমাজ ও মানুষের কল্যাণের জন্য কোনওকিছুই করা সম্ভব হয় না। কারণ ঈশ্বরের সৃষ্টিকারক, সৃষ্টিরোধক বা পরিবর্তক কোনও শক্তিই মহাপুরুষের নিজের ইচ্ছাধীনে প্রকটিত হয় না, যতই তিনি ঐশীশক্তিসম্পন্ন হোন না কেন। অসীম শক্তিসম্পন্ন মহাত্মা হলেও জগৎ বিষয়ে সৃষ্টির ধারাকে রোধ বা পরিবর্তন করে মানুষ ও সমাজের জন্য কিছু করে দেয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। সেইজন্যই তো কিছু করতে পারেন না। করুণার হৃদয় তাঁদের। কোটি কোটি মানুষের নানা দুঃখ কষ্ট তাঁরা দেখেছেন, অথচ ব্যথিত হৃদয়ে নির্বিকার চিত্ত। আসলে বেটা, আসল ক্ষমতা যে দেননি তিনি। তা দিলে তো ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্বই থাকে না।

ঐশীশক্তিসম্পন্ন সাধক মহাপুরুষদের সম্পর্কে বহুদিনের ক্ষোভ একটা অন্তরে ছিল। এ কথা শোনার পর তা আর রইল না। আরও কথা হল অনেক। সময়ও কেটে গেল অনেকটা। এবার ফিরতে হবে। তাই এখন এলাম মূল প্রশ্নে,

– বাবা, সাধুজীবনে আসবেন, এমন কথা স্বপ্নেও ভাবেননি অথচ এসে গেলেন। এত বছর ধরে কঠোরতার মধ্যে জীবন কাটিয়ে কি পেলেন এই জীবনে?

অপলক দৃষ্টি সাধুবাবার। প্রসন্নতায় ভরা মুখমণ্ডল। হাসি ফুটে উঠল মুখে। মধুর কণ্ঠে বললেন,

– কেন বেটা, এই জীবনটাই তো পেলাম, ক-জনা পায় এমন জীবন!

প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যমূলক। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন মনে হল। তাই সোজাসুজি বললাম,

– বাবা, আপনার এমন পরমানন্দময় জীবনের কথা ভুল করেও ভাবতে পারি না। সে কথা বলছি না আমি। জানতে চাইছি, কি পেলেন এই জীবনে, ঈশ্বর সম্পর্কে উপলব্ধিই বা কি হল আপনার?

হিমালয়ের বৃদ্ধ তাপস এখন কথা বলেছেন একটা গাছের তলায় বসে পথের ধারে। যাঁর পরনে একটা টুকরো নোংরা কাপড় ছাড়া সারা অঙ্গে আর কিছুই নেই — নেই পিপাসায় জল পানের প্রয়োজনে ছোট্ট একটা চায়ের ভাঁড়, ভাঙা কোটো পর্যন্ত। এখন ‘নিঃস্ব’ শব্দের প্রতীয়মান অর্থ যিনি এই সাধুবাবা, বসে আছেন আমার সামনে। তাঁর দীর্ঘজীবনে পাওয়ার প্রশ্নের নির্লিপ্ত উত্তর,

– চাইলে হয়ত কিছুই পেতাম না, ঈশ্বর সম্পর্কে এই উপলব্ধিই আমার হয়েছে।

এবার শেষ প্রশ্ন করলাম শেষে,

– ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার শেষ কথা কি?

উদাসীনভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– বেটা, যে অনন্ত সত্যের শুরুই জানি না তার শেষ কথা বলব কেমন করে! ঈশ্বর সম্পর্কে শেষ কথা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন।

প্রণাম করলাম। অনুমতি চাইলাম ফিরে আসার। মুখে বললেন ‘ঠিক হ্যায় বেটা’। বসে রইলেন সাধুবাবা। কিছুটা চলছি আবার ফিরে দেখছি পিছনে। দেখছি চেয়ে রয়েছেন তিনিও। আরও কিছুটা, তখনও। এবার দৃষ্টির বাইরে। ভাবতে ভাবতেই চলছি সাধুবাবার কথা।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button