Mythology

নারী বা পুরুষের চরিত্র বোঝার পথ মহাভারতের ব্যাখ্যায় দিলেন সাধুবাবা

মহাভারতে ব্যাসদেব বলেছেন পুরুষের শত্রু কে, বলেছেন নারীর মিত্র কে। ঋষি বাক্য বা শাস্ত্র সে অর্থ বিজ্ঞান না হলেও বিজ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

দেখছি সাবিত্রীমন্দির দর্শন করে ফিরছেন অনেক তীর্থযাত্রী। আবার আমাদের পাশ কাটিয়েও এগিয়ে চলেছেন অনেকে। পাশে নিচে তাকিয়ে দেখলাম বেশ অনেকটাই উঠেছি। সাধুবাবাকে বললাম,

– বাবা, সারা ভারতের সমস্ত তীর্থদর্শন করেছেন নিশ্চয়?


আকর্ষণীয় খবর পড়তে ডাউনলোড করুন নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

ঘাড় নাড়লেন পরে মুখেও বললেন,

– হাঁ বেটা, গুরু কৃপায় সমস্ত তীর্থদর্শনই হয়েছে আমার। তবে মানসসরোবর আর কৈলাসে যাইনি আমি। শুনেছি ওপথ বড় দুর্গম। আমার শরীরও ওপথের উপযুক্ত নয়। তাই চেষ্টা করিনি।

একটা প্রশ্ন এসে গেল মাথায়। করেই বসলাম,

– বাবা, সংসারে কেউই গ্রহণ করল না আপনাকে এতটুকু দেহসৌন্দর্য নেই বলে। যার কাছে দীক্ষা হয়েছে আপনার, তিনি আপনাকে দেখা মাত্রই নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করেছেন?

আনন্দবিগলিতকণ্ঠে লাঠিসমেত হাতদুটো উপরে তুলে উর্ধ্ববাহু হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন,

– জয় গুরুমহারাজ কি জয় – জয় গুরুমহারাজ কি জয় – জয় গুরুমহারাজ কি জয়। বেটা, ঘর ছেড়ে তো বেরলাম। তারপর এখানে সেখানে এ তীর্থে সে তীর্থ করেই কাটতে লাগল দিনগুলো। ভগবানকে ডাকি মনে মনে। দুঃখের কথা জানাই। শান্তি পাই না। তবে বাড়ির কথা, কারও কথা মনে পড়ত না, একমাত্র মাকে ছাড়া। মনে পড়ার মতো মনে কেউ ছাপ তো রাখেনি, তাই মনে পড়ত না। ছন্নছাড়া ভাবে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম বাবা বিশ্বনাথের দরবারে। একদিন সকালে দশাশ্বমেধঘাটে স্নান করে সবে উঠেছি, যাব বিশ্বনাথ মন্দিরে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠার পর দেখলাম এক বৃদ্ধ সাধুবাবাকে। বসে আছেন ঘাটে সিঁড়ির একপাশে। আমি আর মন্দিরে গেলাম না। সোজা গিয়ে প্রণাম করে জানালাম আমার জীবনমনের কথা। সমস্ত কথা শুনে বললেন, ভয় কি বেটা, আমি তো আছি। তোর সমস্ত ভার, তোর সারাজীবনের দুঃখের বোঝা আমি বইব। তুলে দে আমার কাঁধে। বলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন আমাকে। এমন কথা শুনে আনন্দে কেঁদে ফেললাম আমি। পরে একদিন দীক্ষা হল আমার ওই বৃদ্ধ সাধুবাবার কাছ থেকে। তিনিই হলেন আমার গুরুজি মহারাজ।

এবার আবেগে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

– বেটা তুই বিশ্বাস কর, গুরু মানুষের ধনসম্পদ যশ প্রতিপত্তি কিছু দেখেন না, ভুল করেও দেখেন না রূপ যৌবন। দেখেন শুধু শরণাগতের নিঃস্ব মনটা।

একটু দাঁড়িয়ে মুছে নিলেন চোখ দুটো। আবার শুরু হল পথ চলা। মনে প্রশ্ন এল।

বললাম,

– বাবা কি করে চলে আপনার, আহার সংগ্রহ করেন কোথা থেকে? আমার মনে হয় আপনার নিজের রূপচিন্তায় মন তো কারও কাছে নিয়ে যায় না হাত পাততে।

এতটুকু দেরি না করেই বললেন,

– হাঁ বেটা, তুই ঠিকই বলেছিস। কারও কাছে হাত পাতি না। আমি জানি, কারও কাছে ভিক্ষা চাইলে সে আমায় ভিক্ষা দেবে না। তাই যাই না কোথাও, তবুও আমার প্রতিদিন কিছু না কিছু জুটে যায়। কেন জোটে জানিস? সকাল থেকে রাতের মধ্যে আহার অন্ন জুটবে, এমন আশা আমি ভুল করেও করিনা বলে আমার কিছু জুটে যায়।

মনে মনে বললাম, ধন্য সাধুবাবা ধন্য তোমার মন। এই মুহুর্তে আর কিছু ভাবলাম না। সময় নষ্ট হয়ে যাবে। পরে ভাববার সময় পাব অনেক। বললাম,

– বাবা সংসারে এলেন অথচ সংসার হল না আপনার। মানুষ দেখলেন অনেক অথচ কোনও মানুষের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক, প্রেমের বন্ধন হল না। এ এক অদ্ভুত জীবন কাটালেন আপনি। তাই না ,বলুন?

একথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটু বিস্ময়ের সুরে বললেন,

– কি বললি বেটা, প্রেম।

ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। সাধুবাবা বললেন,

– বড় শক্ত কথা বলে ফেললি বেটা, বড় শক্ত কথা বললি। প্রেম কি জানিস? যা চোখে দেখা যায় না, মুখে বলা যায় না, কোনও বাহ্যকর্মের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না, যার প্রকাশে কোনও ভাষা বা অভিব্যক্তির সৃষ্টি হয়নি অথচ অন্তরে সর্বদাই অনুভব করা যায়, তার নাম প্রেম, তাকেই বলে প্রেম। বুঝলি বেটা? তবে প্রেম কথাটা হামেশাই শোনা যায়, কিন্তু প্রেমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ক’জনার? নারীপুরুষের জীবনে প্রেম এমনই এক বস্তু, যা আসলে সহসা চলে যায় না। চলে গেলে তা সহজে ফিরে আসে না। সংসারে প্রেমের স্বরূপ বেটা দেখেছে ক’জনা?

আবার চলতে শুরু করলেন সাধুবাবা, আমিও। চলছি অতি ধীরে ধীরে। পিছনের লোক এগিয়ে যাছে আমাদের পিছনে ফেলে। আমরা চলছি আমাদের মতো। প্রশ্ন করলাম,

– বাবা কি পরিস্থিতিতে, কখন মানুষ অনুভব করতে পারবে, প্রেমের উদয় হয়েছে তার অন্তরে? যে বস্তু দেখা যায় না, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, সে বস্তু বোঝার উপায় কি?

প্রশ্নটা শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটু সরে এসে একেবারে আমার মুখোমুখি হয়ে বললেন,

– বেটা, মন যখন কাম-গন্ধলেশ হয় তখনই বুঝবি প্রেমের উদয় হয়েছে অন্তরে। তখন এমন এক ভাবের সৃষ্টি হয়, যে ভাব অন্যে সংক্রামিত হলে সেও আনন্দময় ভাব অনুভব করে, যাতে অলক্ষ্যে সৃষ্টি হয় এক সূক্ষ্ম বন্ধনসূত্র, যে সূত্রে বাঁধা যায় মানুষ এমনকি ভগবানকেও। বেটা, বিরহ ছাড়া যেমন বৈরাগ্য আসেনা তেমনই প্রেম না আসলে ধৈর্যও আসে না। যার জাগতিক সমস্ত ব্যাপার ও বিষয়ে ধৈর্য এসেছে, একেবারে নিশ্চিত জানবি তার ভিতরে প্রেম এসেছে। যার ধৈর্য নেই, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রেম নেই। সে না পারবে মানুষকে, না পারবে ভগবানকে বাঁধতে। সুতরাং বুঝতেই পারছিস প্রেম কথাটা শোনা যায় তবে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে খুব কম মানুষের।

একটু থেমে বললেন,

– বেটা, সাধু আর গৃহী, এদের মধ্যে কারও মনে প্রেমের উদয় হলে সে আখ গাছ হয়ে যায়। নিংড়ালে মধুর রস ছাড়া আর কিছুই বেরোবে না।

সাবিত্রী পাহাড়ের অনেকটা উপরে উঠে এসেছি আমরা। শারীরিক কষ্ট কিছু হচ্ছে না ধীরে ধীরে উঠছি বলে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব মন্দিরে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এ জন্মে তো আপনার কোনও ভোগই হল না। না দুটো ভাল খাওয়া, না পরা বা অন্য কিছু। এর জন্যে মনে কখনও কোনও ক্ষোভ বা দুঃখ হয় না?

দেরি না করে বললেন,

– না বেটা, এখন কোনও ক্ষোভ দুঃখ জ্বালা ব্যথা বেদনা কিছুই মনকে আর পীড়িত করতে পারে না। কারণ কোনও আশা নিয়ে তো বেঁচে নেই আমি। বেটা, ময়লা যেমন দেহকে তেমনিই আশা কলুষিত করে মানুষের মনকে। যেদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, সেদিন সব ছেড়ে বেরিয়েছি। তাই আমার মনে আর ওসব কিছু হয় না।

এবার বললাম,

– বাবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

মুখের দিকে তাকালেন। মুখে কিছু বললেন না। ভাবটা এমন, যা খুশি জিজ্ঞাসা করতে পারিস আপত্তি নেই। বললাম,

– বাবা হিন্দুধর্মশাস্ত্রে যেসব কথা শুনি, যেটুকু পড়ি তাতে অনেক সময় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় মনে। কখনও কখনও একটা কথার সঙ্গে আর একটা কথার যোগসূত্র বা মিল খুঁজে পাই না। গোলমাল হয়ে যায় সব। অনেক উদাহরণই দিতে পারি। যেমন ধরুন মহাভারতের কথা। সেখানে ব্যাসদেব এক জায়গায় বলেছেন, পুরুষদের একমাত্র শত্রু তার স্ত্রী। আবার এক জায়গায় বলেছেন পুরুষের পরম বন্ধুও তার স্ত্রী। এবার দেখুন কথাটার মধ্যে কতটা ফারাক। এমন অসংখ্য কথা আছে যা প্রায়ই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না। আবার অনেক কথায় বিপরীত প্রশ্ন আসে মনে। উত্তরও তার খুঁজে পাওয়া যায় না। ঋষিরা ভুল বলেছেন, এ কথা বলার মতো স্পর্ধা আমার নেই। দয়া করে যদি বিষয়টা একটু বুঝিয়ে দেন তাহলে ঋষিবাক্যে বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় ও গভীর হয়।

কথাটা বললাম চলতে চলতে। সাধুবাবা একটা পাথরের চাঁই দেখিয়ে বললেন,

– চল ওখানে একটু বসি। এ কথার উত্তর দিতে হলে বসতে হবে।

একটু এগিয়ে গিয়ে বসলাম মাঝারি আকারের একটা পাথরের চাঁই-এ। এবার কণ্ঠে ফুটে উঠল দৃঢ়তার সুর। বললেন,

– না না বেটা, প্রাচীন ভারতের ঋষিরা একটা কথাও বেঠিক বলেননি। একটা কথার সঙ্গে অপরটার যোগসূত্র কোথাও ছিন্ন নয়। শাস্ত্রীয় কথায় মনে বিপরীত কোনও প্রশ্নের উদয় হলে, তৎক্ষণাৎ সেখানে মনে উদিত প্রশ্নের উত্তর না পেলেও জানবি, তার উত্তর দিয়েছেন ঋষিরা অন্য কোথাও। সেখানে কোনও ভুল নেই। তবে শাস্ত্রীয় কথার মানে বুঝতে গেলে ঋষিদের কৃপালাভ করতে হবে। নইলে সব কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারবি না। সাধারণ জ্ঞান যেটুকু ধরবে সেটুকুই বুঝবি, তার এক চুল বেশি নয়। ঋষিবাক্যের প্রতিটা বর্ণ সত্য। শুধু সত্য বললে মিথ্যা বলা হয়। তাদের কথা চিরন্তন শাশ্বত সনাতন সত্য। ঋষিদের জ্ঞান এক অখণ্ড জ্ঞানভাণ্ডার যে।

জীবনে বই–এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংস্পর্শহীন এক সাধুবাবা যার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে। প্রশ্নের উত্তরে বললেন,

– বেটা, বহু দৃষ্টান্ত দেখে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি। তাই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি এরই উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই আজকের বিজ্ঞান যত উন্নতই হোক না কেন, এর কোনও কাজ ও কথা, কোনওটাই পরিণত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এই বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানবিষয়ক কথা সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল বলে বিজ্ঞানের মূল সূত্র গুলির পরিবর্তন হচ্ছে, সর্বদা হবেও। এক কথায় বলতে পারিস আধুনিক বিজ্ঞান মানে অস্থির সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান। যদিও এটা বিশেষ জ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

সাধুবাবা থামলেন। এদিক ওদিক চোখদুটো ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসা করলেন,

– তুই কি আমার কথা কিছু বুঝতে পারছিস?

মুখে কিছু বললাম না। ঘাড় নেড়েই জানালাম, হ্যাঁ। আবার শুরু করলেন সাধুবাবা,

– বেটা শাস্ত্রে যেসব কথা লেখা আছে, সেই ঋষিবাক্য বিশেষ জ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত। তবে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ শব্দে মানুষ যে অর্থ বোঝে, ঋষি বাক্য বা শাস্ত্রে সে অর্থ বিজ্ঞান নয় কিন্তু বিজ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। কেমন করে জানিস? প্রাচীন ঋষিদের সমাধিকালীন মহাশূন্যে প্রতিভাত বিশেষ জ্ঞানের কথা যা শাস্ত্রে লেখা হয়েছে। এই জ্ঞানের কথা সত্য। আর তা পর্যবেক্ষণ এর উপর নির্ভরশীল নয় বলেই এই জ্ঞানলদ্ধ বাক্যের কোনও ভ্রান্তি নেই। একটা পরীক্ষা-নলে কোনও রাসায়নিক দ্রব্য বা গ্যাস ভরে নির্দিষ্ট মাত্রায় উত্তাপ দিয়ে ঋষিবাক্যের সত্যতা প্রমাণ করা যাবে না। চিরসত্য এই জ্ঞান বাক্যের কখনও কোনও পরিবর্তন ঘটে না পরিবেশের, স্থানের পরিবর্তনেও।

এই জ্ঞানের কথাই বিভিন্ন শাস্ত্রের কথা তথা মানুষের আত্মিক মানসিক ও সার্বিক কল্যাণের জন্যে। এখন ঋষি বাক্যের প্রয়োগকর্তা বা ব্যাখ্যাকার যদি প্রয়োগ বা ব্যাখ্যার ভুল করে, তাহলে ঋষিরা কি করবেন? বেটা, ঋষিদের অখণ্ড জ্ঞানভাণ্ডারের জ্ঞানকথার অন্তর্নিহিত সত্যকে বুঝতে হলে নিজেকেও প্রবেশ করতে হবে আধ্যাত্মিক তপোবনে। ওটাই ওই জ্ঞান লাভের আখড়া।

এবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কিছু একটা ভাবলেন মনে হল। কথা বলে চিন্তায় ছেদ টানলাম না। বললেন,

– তুই একটু আগে বললি ব্যাসদেব এক জায়গায় বলেছেন, পুরুষের একমাত্র শত্রু তার স্ত্রী। আবার তিনি বলেছেন, পুরুষের স্ত্রীই পরম বন্ধু হতে পারে। এ কথায় মনে তোর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, তাই না ? তুই কি মনে করিস ব্যাসদেব পাগল?

আমি হেসে ফেললাম। হাসলেন সাধুবাবাও। বললেন,

– বেটা ব্যাসদেব তো ঠিকই বলেছেন। পুরুষের একমাত্র শত্রু তার স্ত্রীই। কেমন করে জানিস? পুরুষের দেহরজ শত্রু। স্ত্রী সঙ্গে এই শক্তিক্ষয়ে পুরুষ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে ইহলোক পরলোক সব পথের দ্বারই রুদ্ধ করে ফেলে। অথচ দেখ, সংযমের মাধ্যমে পুরুষ জাগতিক যা কিছু, পারমার্থিক পরম ব্রহ্মপদ পর্যন্ত লাভ করতে পারে। কিন্তু সংসারে থেকে কোনওভাবে, প্রায় কোনও পুরুষের পক্ষেই তা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের হচ্ছে তারা ভাগ্যবান তবে এমন ভাগ্যবানের সংখ্যা একরকম বিরলই বলতে পারিস।

কথা ক’টা বলে একটু হাসলেন। হাল্কা হাসি, প্রসন্ন হাসি। তারপর আবার শুরু করলেন,

– বেটা, সংসারে পুরুষের একমাত্র পরমবন্ধু হতে পারে তার স্ত্রী। চরম শোকে দুঃখে সাংসারিক পরমসুখে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া কেউই সহায়সঙ্গী হতে পারে না। পিতা মাতা সন্তান ত্যাগ করতে পারে কিন্তু প্রকৃত স্ত্রী তার স্বামীকে কখনও ত্যাগ করতে পারে না প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। সন্তান বা পিতৃমাতৃবিরহে যতবেশি কাতর হয় পুরুষ তার চেয়ে অনেক বেশি কাতর হয় তার প্রকৃত স্ত্রীর বিরহে। পুরুষের জীবনে একটা সময়ের পর থেকে সারাজীবনব্যাপী তার স্ত্রীর ভূমিকাই বেশি, সেখানে বাবা মা ভাই বোন সন্তান আত্মীয় পরিজনের ভূমিকা শূন্য। সেইজন্যেই তো ব্যাসদেব বলেছেন, পুরুষদের পরমবন্ধু একমাত্র তার স্ত্রী হতে পারে, তবে হবেই এমন কথা বলেননি।

এখানে একটা প্রশ্ন আর খটকা এসে গেল। বললাম,

– ব্যাসদেব ‘হতে পারে’ বলেছেন, ‘হবেই’ বলেননি কেন ?

সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, নারীচরিত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য এবং বিশিষ্ট কিছু গুণের সমন্বয় ভগবান এমনভাবে করে দিয়েছেন, যেখানে স্ত্রীর ভূমিকায় নারীরপক্ষে যেটা করা সবক্ষেত্রে সহজ সম্ভব, সেটা অন্য কোনও পুরুষ বা নারীরক্ষেত্রে অন্য কোনও ভূমিকায় বা বিনিময়ে তা কিছুতেই করা সম্ভব হয়। অন্যের মাধ্যমে আংশিক পূরণ হতে পারে, স্ত্রীর মাধ্যমে পূর্ণ রূপে তা সম্ভব বলেই ঋষি প্রাধান্য দিয়েছেন স্ত্রীকে। মা এবং স্ত্রী একই মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিতে সৃষ্টি। মায়ের দ্বারাও পুরুষের পূর্ণতা আসতে পারে কিন্তু জাগতিক কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই স্ত্রীর ক্ষেত্রে হতে পারে বলেছেন। মায়ের মধ্যে একটু সম্ভাবনা রয়েছে বলে এখানে ঋষি একটু ছাড় দিয়ে কথা বলেছেন।

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল বসে বসে। আবার উঠে এগোতে লাগলাম। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, পুষ্কর সাবিত্রী দর্শনের পর কোথায় যাবেন?

হাসিমুখে বললেন,

– অনেকদিন হল হরিদ্বার যাইনি। ভাবছি হরিদ্বার যাব।

জানতে চাইলাম,

– বাবা পথ তো চলছেন, কখনো কোনওভাবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। দেহ যখন, তখন রোগভোগ তো হতেই পারে। যদি তেমন কিছু হয় তখন সেবা করার মতো কাউকে পাবেন বলে তো মনে হয় না। এ কথা বলছি আপনার চেহারার কথা ভেবে, যা সংসার ছাড়তে বাধ্য করেছে। এটা আপনি নিজের মুখেই বলেছেন। এমন যদি হয় কখনও সেই পরিস্থিতিতে কি করবেন?

আমরা দুজনে সাবিত্রী মন্দিরের কাছাকাছি এসে গেছি। সাধুবাবা কিছু না বলে বসে পড়লেন একটা বড় পাথরের চাঁই-এর উপরে। আমাকেও বসতে হল। এবার হাতের লাঠিটা পাথরে ঠুকঠুক করে ঠুকতে লাগলেন। তাকালেন মুখের দিকে। প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল সাধুবাবার মুখখানা। বললেন,

– সংসারে যাদের দেখার মানুষ আছে তাদের রোগভোগ দুঃখ-বেদনাও আছে। দেখার মানুষ থাকলেও তারা অনেক সময় দেখেনা কেউই। সাধুদের দেখার মতো কেউ নেই, তাই রোগভোগ তেমন কিছু নেই। সাধু পড়ে থাকলে তো দেখতে হবে ভগবানকে, তাতে তাঁরও তো কষ্ট। কারণ সাধুরা তো তাঁর উপরেই সব ছেড়ে দিয়ে পড়ে আছে। সেই জন্যই তো বেটা ভগবান তাঁর ভক্তকে, সাধুকে, শরণাগতকে ঝামেলায় ফেলে দেহ কষ্ট দিয়ে নিজে ঝামেলায় পড়তে চান না। এই দেখ না বেটা, এতগুলো বছর তো কেটে গেল পথে পথে, আজ পর্যন্ত শারীরিক কোনো কষ্ট পাইনি, রোগভোগও হয়নি। আমি মনে করি ভগবান আমাকে রোগে ফেলে নিজে ঝামেলায় পড়তে রাজি নন।

কথাগুলো বলে এক অদ্ভুত আনন্দে হাসতে হাসতে একটু নুয়ে পড়লেন। একটু রসিকতার সুরেই বললেন। অথচ কথার মধ্যে পরিস্কার ফুটে উঠল ঈশ্বরে একান্ত বিশ্বাস ও শরণাগতের গভীর অনুরাগের কথা।

আবার দুজনে উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। সামান্য চলার পরে কানে এল ঘণ্টাধ্বনি। নজরে এল দেবী মন্দির। অসংখ্য তীর্থযাত্রী নেমে আসছে সাবিত্রীদর্শন করে। উঠছেন অনেক দর্শনার্থী। আমরা উঠে গেলাম মন্দির চত্বরে। এখন ছেড়ে যেতে হবে সাধুবাবাকে। সংসারে কেউই যখন ধরে রাখতে পারেনি, সেখানে পথচলায় আমাকে তো ছাড়তেই হবে। সাধুবাবা আর আমি দাঁড়িয়ে আছি মুখোমুখি হয়ে। বললেন,

– বেটা আজ বড় আনন্দের দিন আমার। জীবনে এই প্রথম গুরুজিকে ছাড়া তোর কাছে বলতে পারলাম মনের কথা। জয় হোক তোর জয় হোক।

দেখলাম চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তাকাতে পারলাম না চোখের দিকে। এমন সুন্দরী মন সাধুবাবার, কুৎসিত রূপ আর চোখে পড়ে না। দারিদ্র্যে মানুষের যেমন সমস্ত গুণ নষ্ট হয়, এখানে সাধুবাবার কুৎসিত রূপ নষ্ট হয়েছে শরতের শিউলির মতো সুন্দর মনের জন্যে। শেষ প্রশ্ন করলাম,

– বাবা যে রূপস্রষ্টা আপনার এই রূপ সৃষ্টি করে সংসার ও ভোগহীন এই জীবনে এনেছেন সেইরূপ স্রষ্টার স্বরূপ দর্শন কি আপনার হয়েছে?

সাবিত্রী মন্দির অঙ্গন এখন গমগম করছে লোকে, সাধুবাবার চোখ দুটো ছলছল করছে জলে। চোখে জল, অমানবিক মুখখানা। বললেন,

– বেটা, আমার ভিতরে আর কোনো যন্ত্রণা নেই।

সাধুবাবাকে প্রণাম করব বলে একটু ঝুঁকতেই একটু পিছনে সরে, সরিয়ে নিলেন পাদুটো। ধরে ডান হাত মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– বেটা ভগবানের স্থাপিত মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে প্রণাম করতে নেই, নিতেও নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *