Mythology

কোন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে কি ফল পাওয়া যায়

অলৌকিক ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শব সাধন, পাদুকা সাধন, কর্ণপিশাচী দেবতার সাধন ইত্যাদি তো আছেই, তাছাড়াও ভূতপ্রেত পিশাচ সাধনও আছে।

উপদেবী মধুমতী প্রসঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রে এই দেবীর বর্ণনায় আছে : ‘ইনি স্বীয় রূপলাবণ্যে ত্রিভুবন মোহিত করতে পারেন। গৌরবর্ণা বিচিত্র বস্ত্রবিধারিনী বিচিত্র অলঙ্কারে বিভূষিতা নর্ত্তকীর বেশধারিণী’।…

‘সাধনকালে, দেবী অর্দ্ধরাত্রি সময়ে আগমন করিয়া সাধককে ভয়প্রদর্শন করেন, তাহাতে সাধক ভীত না হইয়া মন্ত্র জপ করিতে থাকিবে। দেবী সাধককে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জানিয়া তাহার আলয়ে গমন করেন এবং বলিয়া থাকেন যে তোমার অভিলষিত বরপ্রার্থনা কর। সাধক দেবীর বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে স্থির করিয়া আপন ইচ্ছানুসারে মাতা ভগিনী অথবা ভার্য্যা বলিয়া সম্বোধন তদনুরূপ সাধন করিবে। পরে সাধক নটিনীকে ভক্তি দ্বারা সন্তুষ্ট করিবে। নটিনী তাহাতে সন্তুষ্টা হইয়া সাধকের মনোরথ পরিপূর্ণ করেন। যদি সাধক দেবীকে মাতৃভাবে ভজনা করে, তবে দেবী তাহাকে পুত্রবৎ পালন করেন এবং প্রতিদিন শতসংখ্যা সুবর্ণমুদ্রা ও অভিলাষিত দ্রব্য প্রদান করিয়া থাকেন। আর যদি ভগিনীরূপে সম্ভাষণ করেন, তাহা হইলে দেবী প্রতিদিন নাগকন্যা ও রাজকন্যা আনিয়া দেন। সাধক এই সাধনবলে অতীত ও ভবিষ্যৎ ঘটনা সকল জানিতে পারে। আর যদি সাধক দেবীকে ভার্য্যাভাবে ভজনা করে তাহা হইলে দেবী প্রতিদিন বিপুল ধন প্রদান করিয়া থাকেন।….


দেবী বিশুদ্ধ স্ফটিকের ন্যায় শুভ্রবর্ণা ও নানাবিধ অলংকারে সুশোভিতা এবং নূপুর হার, কেয়ূর ও রত্ননির্ম্মিত কুণ্ডলে পড়িমণ্ডিতা। (মধুমতীর) পূজা ও জপ করিলে প্রভাত সময়ে দেবী সাধকের নিকট আগমন করেন এবং সন্তুষ্ট হইয়া রতি ও ভোজন দ্রব্যদ্বারা সাধককে পরিতোষিত করিয়া থাকেন। …সাধক দেবীর বরে সর্ব্বজ্ঞ, সুন্দর কলেবর ও শ্রীমান হয়, সর্বত্র গমনাগমনে সাধকের শক্তি জন্মে। সাধক এইরূপে যোগিনী সাধন করিয়া প্রতিদিন দেবীর সহিত ক্রীড়া কৌতুকাদি করিয়া থাকে। এই সর্ব্বসিদ্ধিদায়িনী মধুমতী দেবী অতিগুহ্য’।…

ধীমান বিশ্বামিত্র মুনি মধুমতীদেবীর সাধন করেছিলেন।


তন্ত্রশাস্ত্রে যতগুলি বিশিষ্ট দেবদেবীর সাধনা আছে তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দশ মহাবিদ্যার সাধনার উপরে। দশ মহাবিদ্যা কিংবা কোনও উপদেবী অথবা কোনও যোগিনী সাধনায় আকাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় অতিদ্রুত। মাতৃরূপে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে সাধককে সন্তানের মতো রক্ষা ও পালন করে জাগতিক কাম্যবস্তু প্রদান করেন।

সংসারক্ষেত্রে নানান ধরনের কাজে সম্পূর্ণরূপে সাধককে সহায়তা করে থাকেন দেবীকে মিত্ররূপে সিদ্ধিলাভ করলে।

দেবী অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে সম্যক জ্ঞানদান করে থাকেন সাধককে যদি সাধক সিদ্ধিলাভ করেন পত্নীরূপে সাধনা করে।

তন্ত্রে জাগতিক সমৃদ্ধিলাভের জন্য অনেক উপদেবতার সাধনপ্রণালী বর্ণিত আছে। তবে এ সাধনায় আধ্যাত্মিক পরমার্থ লাভ হয় না। এই উপবিদ্যার সাধনা মূল ব্রহ্মবিদ্যালাভের সাধনা থেকে অনেক সহজসাধ্য এবং অল্পদিনের মধ্যেই এর সিদ্ধিলাভ হয়। উপবিদ্যায় সিদ্ধ সাধক অতি অদ্ভুতভাবে ইন্দ্রজালের মতো চমকপ্রদ প্রত্যক্ষ ফল তার শরণাপন্ন অর্থীকে অল্পকালের মধ্যেই দিতে পারেন অনায়াসে।

অলৌকিক ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শব সাধন, পাদুকা সাধন, কর্ণপিশাচী দেবতার সাধন ইত্যাদি তো আছেই, তাছাড়াও ভূতপ্রেত পিশাচ সাধনও আছে।

কর্ণপিশাচী হল উপদেবতা। দেবতার স্তরে নয় এরা তবে তাদের মতো অনেক শক্তিই ধারণ করে। অপদেবতা নয়। ভূত প্রেত পিশাচকে বলে অপদেবতা। এই দেবীর সাধনায় আপেক্ষিক সর্বজ্ঞতা লাভ হয়। অপরের মনে কি চিন্তার উদয় হয়েছে কিংবা প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তর দেবী অন্যের অগোচরে সাধকের কানে কানে জানিয়ে দেন।

যেমন প্রশ্নকর্তার কি নাম, কোথা থেকে আসছে, কি উদ্দেশ্যে, কি প্রশ্ন নিয়ে, কবে কি হবে, কি করলে ভালো হবে এই সব আর কি।

তন্ত্রের কর্ণপিশাচী সাধনায় সিদ্ধ এক সাধকের সান্নিধ্যলাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত আমি। ঠিক ‘দিন চলে না মাস বত্রিশ’ এমন দশা। রাস্তায় ঘুরি কুকুরের মতো। মানুষ হয়ে বাঁচার ইচ্ছা প্রায় সব মানুষেরই আছে। আমারও ছিল, কিন্তু সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তখন আমার দিন কাটতো সকালে খবরের কাগজ বেচে, বিকেলে বেচতাম নিজের হাতে আঁকা ছবি নিয়ে ফুটপাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা কোনও কাজে লাগবে না বলেই মা মিউজিয়ামের মতো যত্নে রেখেছিলেন সেই পুরনো দিনের ঠাকুমার বেনারসীর মতো।

তখন আমার বয়েস ২৫/২৬ হবে। আমার শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুরুকে আমি মাস্টারমশাই ডাকতাম। হুগলি জেলার অন্তর্গত শিয়াখালায় কর্ণপিশাচী সাধনায় সিদ্ধ একজন সাধক থাকতেন। নাম বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। এটা মাস্টারমশাই জানতেন এবং তিনি নিজেও একবার তাঁর সঙ্গ করেছেন। আমার সার্বিক কষ্টের কথা তাঁর অজানা ছিল না। একদিন তাঁর মেজ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে পাঠালেন শিয়াখালায়। কারণ ওপথের আমি কিছু চিনি না, জানিও না। যতদূর মনে পড়ে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ডানকুনি, ওখান থেকে বাসে শিয়াখালা।

যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম। বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখি এক ভদ্রলোক যেন আমারই অপেক্ষায়। আমাকে দেখামাত্রই বললেন,

– আপনি কি শিবশংকরবাবু? নারকেলডাঙ্গা থেকে আসছেন?

কথাটা শুনে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। ভদ্রলোক এবার বললেন,

– আপনার ডাক পড়েছে। ভিতরে আসুন।

কোনও কথা না বলে অনুসরণ করলাম। ভিতরে দেখলাম কিছু লোক বসে আছে। বৈদ্যনাথবাবু একটু আলাদাভাবে। হাতটা কানের পাশে যেন টেলিফোনে কথা হবে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি ইশারায় বসতে বললেন। মিনিট কয়েক পর মিচকে হেসে অতি ধীর কণ্ঠে বললেন,

– টেলিফোন এসেছে। তোমার কাগজ বেচার দিন ফুরিয়ে এল। কাগজে লেখার দিন আসছে। ভয় নেই, একটু ধৈর্য ধর। এখনও তোমার একটু কষ্ট আছে কপালে তারপর তোমার জীবনে…

বৈদ্যনাথবাবুর প্রত্যেকটা কথা ফলেছে অব্যর্থভাবে। আজ আমি যে কর্মে লিপ্ত তা বৈদ্যনাথবাবুরই বলা, যা ছিল আমার স্বপ্নেরও বাইরে। আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আরও অনেক কথাই বলেছেন। আমি জানি, প্রতিটা কথাই ঠিকঠাক হবে যথাসময়ে। শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষা করা।

যাই হোক, সকলে চলে যাওয়ার পর অনেক কথা হল। কথা প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম বৈদ্যনাথবাবু কর্ণপিশাচী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কোনও প্রশ্নকর্তা তার কাছে যাওয়ার আগেই দেবী সকলের অগোচরে বৈদ্যনাথবাবুর কানে কানে বলে দিতেন প্রশ্নকর্তার কি নাম, কোথা থেকে আসছে, কি উদ্দেশ্য, কি প্রশ্ন নিয়ে, কবে কি হবে, কি করলে ভালো হবে ইত্যাদি।

বৈদ্যনাথবাবু আজ আর নেই। কিন্তু কথাগুলো আমার জীবনে প্রতিটা পদক্ষেপে সত্য হয়েছে। তবে এ সত্যতা বৈদ্যনাথবাবুর নয়, এ সত্যতা তার সাধনের, ভারতীয় তন্ত্রের সঠিক প্রক্রিয়ায় নিয়মমাফিক প্রয়োগের মাধ্যমে করায়ত্ত শক্তির।

কর্ণপিশাচী সাধনা কি? এ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে সাধক কি ফল পেয়ে থাকেন, আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।

কর্ণপিশাচীর আকার কেমন? তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘দেবীর দেহ কৃষ্ণবর্ণ, লোচনত্রয় রক্তাভ, আকার খর্ব্ব, উদর বৃহৎ এবং জিহ্বা বন্ধুকপুষ্পের ন্যায় অরুণবর্ণ। দেবীর চারি হস্ত, এক হস্তে বরমুদ্রা, দ্বিতীয় হস্তে অভয়মুদ্রা এবং অপর হস্তদ্বয়ে দুইটি নরকপাল আছে। শরীর হইতে ধুম্রবর্ণ জ্বালা বহির্গত হইতেছে। ইনি উর্দ্ধবদনা, জটাভারমন্ডিতা ও চঞ্চলপ্রকৃতি। কর্ণপিশাচীদেবী সর্ব্ববিষয়ে অভিজ্ঞা ও শবহৃদয়ে বাস করিতেছেন। এইরূপ আকৃতি বিশিষ্ট দেবীকে নমস্কার করি’।

কর্ণপিশাচীদেবীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলে সাধক যখন মনে মনে কোনও প্রশ্ন করে, তৎক্ষণাৎ দেবী সাক্ষাৎ এসে প্রশ্নের সঠিক ও যথার্থ উত্তর দিয়ে থাকেন। দেবীসাধনায় সিদ্ধসাধক তাঁর পিঠে আরোহণ করে দর্শন করতে পারে ভূত ভবিষ্যৎ বিষয় সকল, বর্তমানও। এই দেবীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে অচিরকালে সর্বজ্ঞতা লাভ করেছিলেন মহামতি বিশালবুদ্ধি লক্ষশ্লোক মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাস।

গুপ্তযুগের কর্তৃপুর-ই আজকের কাংড়া অঞ্চল। হিমাচল প্রদেশের এই অঞ্চলে আছে জ্বালামুখী, চিন্তাপুর্ণী ও নয়নাদেবী প্রভৃতি সাতটি দেবীস্থান। তার মধ্যে অন্যতম জ্বালামুখীতে পড়েছিল সতীর দেহাংশ জিহ্বা। দেবীর ভৈরব এখানে উন্মত্ত ভৈরব নামে স্থিত আছেন, মতান্তরে অম্বিকেশ্বর মহাদেব।

কারুকার্যখচিত মুখ্য দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই একেবারে সামনে পড়ল একটি চারকোণা কুণ্ড। বাঁধানো কুণ্ডের দেওয়াল থেকে বেরচ্ছে দুটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। রুপোর জালে ঘেরা সবচেয়ে বড় সুশোভিত শিখাটিকে মহাকালীর রূপ বলা হয়ে থাকে। এটিই পূর্ণব্রহ্মজ্যোতি জ্বালামুখী নামে প্রসিদ্ধ। দেবীর কোনও বিগ্রহ নেই। জ্বালামুখী মায়ের কল্পরূপই হল এই অনিবার্য নীলাভ লেলিহান অগ্নিশিখা। এর একটু নিচে দ্বিতীয় জ্যোতির্ময় শিখাটির নাম দেবী অন্নপূর্ণা।

কুণ্ডের এক পাশেই বসে আছেন পূজারি। একের পর এক আসছেন তীর্থযাত্রী। তাদের আনা পূজাদ্রব্য নিয়ে ধরছেন প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায়। দেবীর প্রসাদ করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তীর্থকামীদের হাতে।

পাহাড়ের গায়ে চারটি স্তম্ভের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটি। কারুময় শ্বেত পাথরের দেওয়াল, মেঝে। দেওয়ালের গায়ে আরও কয়েকটি জায়গা থেকেও বেরচ্ছে অগ্নিশিখা। মোট নয়টি শিখায় মূল দেবীমন্দিরটি সুশোভিত। তৃতীয় শিখাটি শত্রু বিনাশকারিনী চণ্ডী নামে প্রসিদ্ধ। চতুর্থ শিখাটি ব্যাধিনাশিনী দেবী হিংলাজ, পঞ্চমটি শোকনিবারনী দেবী বিন্ধ্যবাসিনী, ষষ্ঠটি ধনদেবী মহালক্ষ্মী, সপ্তমটি বিদ্যাদেবী মহাসরস্বতী, অষ্টমটি সন্তানসুখদায়িনী দেবী অম্বিকা এবং নবম জ্যোতিটি দেবী অঞ্জনার, যিনি আয়ু আরোগ্য ও সুখ প্রদান করেন।

জ্বালামুখী মন্দিরের বাঁপাশেই বাঁধানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ওপরে। তার পাশে জ্বালামুখী মন্দিরের কার্যালয়। সিঁড়িতে ওঠার মুখেই লাল গণেশ আর ভৈরবের কালো বিগ্রহ, বাঁদিকে একেবারে কোণে পাথরের মূর্তিটি আচার্য শঙ্করের। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই বাঁয়ে পড়ল চোদ্দভুজা দুর্গার বিগ্রহ। ডানদিকে রাধাকৃষ্ণ আর গনেশজি। এ ছাড়াও মহাবীর, মহাকাল, বালকনাথ ও কালভৈরব প্রভৃতির বিগ্রহে দোতলা জমজমাট। দোতলার ডাইনের অংশটি ‘গোরখ ডিব্বা’ নামে পরিচিত। ভিতরে লেখা আছে শ্রীগুরু গোরখনাথজি কা ধুনা’। ধুনীর পাশে একটি ত্রিশূলও পোঁতা আছে। অনুমান, দশম শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন গোরখনাথ। নাথ সম্প্রদায়ের সাধুদের বিশ্বাস, গোরখনাথজির এক সময়ের তপস্যাক্ষেত্র এটি। গোরখ ডিব্বার সামনেই রাধাকৃষ্ণের ছোট্ট মন্দির।

দেখলাম জনা পাঁচেক সাধুবাবা বসে আছেন ধুনীটা ঘিরে। কারও মাথায় লম্বা, কারও মাথায় ছোট জটা। প্রত্যেকেই লালচে গেরুয়ায় মোড়া। কথা বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে। এরা সকলেই হিন্দিভাষী। এই পাঁচ-ছজন বাদে আর একজন আছে তবে এদের সঙ্গে নয়, আলাদাভাবে বসে আছেন দেওয়ালের পাশে। মুখের দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় ডাকলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলাম মুখোমুখি হয়ে।

প্রণাম করলাম। লাল কাপড়ে মোড়া দেহ। মাথার জটা কাঁধ ছাড়িয়ে। মাঝারি গড়ন। টানা টানা চোখ। টিকালো নাক। গায়ের রং ময়লা। উচ্চতায় আমার ধারণা সাড়ে পাঁচ ফুট হলেও হতে পারে। কোথায় থাকি, কি করি, জ্বালামুখীতে কেন এসেছি সবই জানালাম সাধুবাবাকে। কথা বলতে বলতে জেনে নিলাম এই সাধুবাবা নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী। খুব ছোট বেলায় গৃহত্যাগ করেছেন। বর্তমান বয়েস আটচল্লিশ (১৯৮১ সালে)। ভারতের অসংখ্য তীর্থ পরিক্রমা করেছেন। জ্বালামুখীতে আছেন মাস খানেক। এরপর এখান থেকে তিনি কোথায় যাবেন তা তাঁর জানা নেই। সাধুবাবা জানালেন, ‘দেবী কামেশ্বরী যোগিনী যেখানে নিয়ে যাবেন, সেখানেই তিনি যাবেন’।

‘কামেশ্বরী যোগিনী’র কথা বলায় বুঝে গেলাম এখানে কোনও রহস্য একটা লুকিয়ে আছে। বললাম,

– বাবা, কামেশ্বরী দেবী কে, কোথায় থাকেন তিনি, আপনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই কি? দয়া করে এ বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলবেন।

সাধুবাবার সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় আধঘণ্টা। তাঁর ভাবটা প্রসন্ন। তবে আমার প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। আমি সাধু বশ করার ফর্মুলাটা প্রয়োগ করলাম। ঝপ করে পা দুটো চেপে ধরে বললাম,

– বাবা, দয়া করে বলুন না, আপনার ক্ষতি তো কিছু হবে না। সাধুসঙ্গ করে তাদের জীবন সম্পর্কে জানাটাই আমার একমাত্র নেশা।

সাধুবাবা মাথা নেড়ে জানালেন তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে নারাজ। আমি তাঁর পা দুটো না ছেড়ে সমানে অনুরোধ করতে লাগলাম। প্রায় মিনিট সাত আটেক পর মুখ খুললেন,

– বেটা, তন্ত্রে বিভিন্ন উপদেবী তথা যোগিনীর সাধনার কথা উল্লেখ আছে। ছোটবেলায় আমার জীবন কাটে বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে। জাগতিক সমস্ত দুঃখ ও দুর্ভোগ ছাড়া কোনও সুখ ভোগই আমার কপালে জোটেনি। তাই ভারতের তীর্থে তীর্থে সেই গুরুর সন্ধান করতে লাগলাম, যে আমার পার্থিব জীবনের সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাসনা মিটিয়ে দেবে। বেটা, একদিন সত্যি সত্যিই গুরু মিলে গেল গয়াতে, ব্রহ্মযোনি পাহাড়ে। তাঁর কাছে অন্তরের সমস্ত কথা বললাম প্রাণ খুলে। জানালাম, ভগবানকে লাভ করার বাসনা আমার এতটুকুও নেই। আমি চাই জাগতিক সমস্ত রকম সুখভোগ। বেটা, একথা শুনে গুরু একটু হাসলেন। কিছু বললেন না। দীক্ষা দিয়ে শিখিয়ে দিলেন কামেশ্বরী যোগিনীর সাধন ও সিদ্ধিলাভের প্রক্রিয়া।

একটু থামলেন। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর বেশ আনন্দের সঙ্গে বললেন,

– বেটা, গুরুর শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে লেগে পড়লাম সাধনায়। অচিরেই সিদ্ধিলাভ হল। বেটা, আমি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, গাড়ি বাড়ি ধনদৌলত, কোটি কোটি টাকা, এসব দিয়ে আমার হবে কি? শুধু এটুকু বলি, একজন ধনবান মানুষ সংসার জীবনে থেকে যা কিছু ভোগ করে থাকে, তার থেকেও অনেক বেশি পেয়েছি পেয়ে যাব যতদিন বেঁচে থাকব আমি।

এরপর আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক। তবে একেবারে দিনের বেলায় ‘গোরখ ডিব্বায়’ আরও সাধুদের অবস্থান কারণে দেবী কামেশ্বরী যোগিনীর অলৌকিক কোনও ঘটনা সেদিন দেখিনি, সাধুবাবাকে দেখানোর জন্য অনুরোধ করিনি। তবে সাধুসন্ন্যাসীদের কথায় আমার বিশ্বাস ষোলোআনা নয়, আঠারো আনা। এক সময় কথা শেষ হল। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে মুখে বললেন,

– জয় হো বেটা, সদা আনন্দমে রহো।

যথাসময়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। তন্ত্রশাস্ত্রটা খুলে দেখলাম, নানান ধরনের যোগিনী সাধনার মধ্যে আছে, সুরসুন্দরী যোগিনী সাধন, মনোহরা যোগিনী সাধন, কনকারতি যোগিনী সাধন, কামেশ্বরী যোগিনী সাধন, রতিসুন্দরী যোগিনী সাধন, পদ্মিনী যোগিনী সাধন, নটিনী যোগিনী সাধন ইত্যাদি।

এখন দেখা যাক, নাথ সম্প্রদায়ের এই সন্ন্যাসী কামেশ্বরী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে কি পেয়েছিলেন, কাকে পেয়েছিলেন? ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্র কি বলে? তন্ত্রের কথায় –

যোগিনী সাধনের ক্ষেত্রে দেবীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘কামেশ্বরী দেবীর আকার এইরূপ ইনি শশাঙ্কবদনা, দেবীর লোচন খঞ্জনের ন্যায় চঞ্চল এবং সর্বদা চঞ্চল গমনে সঞ্চরণ করেন। ইহার হস্তে কুসুমময় বাণ আছে। এইরূপে ধ্যান করিয়া পূজা ও জপ করিলে দেবী আগমন করেন এবং সন্তুষ্টা হইয়া সাধককে বলেন, তোমার কি আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইবে? তৎপরে সাধক দেবীকে স্ত্রীভাবে পাদ্যাদি দ্বারা পূজা করিবে। তাহাতে দেবী সুপ্রসন্না হইয়া সাধককে পরিতুষ্ট করেন এবং অন্নাদি বিবিধ ভোজনীয় দ্রব্যদ্বারা পতিবৎ প্রতিপালন করিয়া থাকেন। দেবী সাধকের নিকট রাত্রি যাপন করিয়া ঐশ্বর্য্যাদি সুখভোগসামগ্রী, বিপুল ধন ও নানাপ্রকার অলঙ্কার প্রদানপূর্বক প্রভাতকালে প্রতিগমন করিয়া থাকেন। এই প্রকারে প্রতিদিন সাধকের অভিলাষানুসারে সিদ্ধি প্রদান করেন।’

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button