Let’s Go

জাগ্রত এই শনি মন্দির গুলিতে বড়ঠাকুর কথা শোনেন, মনস্কামনা পূরণ হয়

প্রতিষ্ঠিত এবং নিত্য পূজা হয় এমন শনিদেবের মন্দিরের বিবরণে শিবশংকর ভারতী।

প্রতিষ্ঠিত এবং নিত্য পূজা হয় এমন শনিদেবের মন্দিরের বিবরণে শিবশংকর ভারতী।

‘শ্রী শ্রী কালীমাতার মন্দির
আদি শনির মন্দির
শ্রী শ্রী শনৈশ্চরয় নমঃ
প্রতিষ্ঠাতা তান্ত্রিক অখিলকৃষ্ণ চক্রবর্তী
১৭/২ নং বিডন স্ট্রিট, স্থাপিত-১৩৪১’

কথাগুলি লেখা আছে মন্দিরের দেওয়ালে পাথরের ফলকে। ১৯৩৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পুজো চলছে তিনপুরুষ ধরে। গতানুগতিক ধারায় নির্মিত শনিদেবের বিগ্রহের সঙ্গে এঁর পার্থক্য আছে অনেকটাই। স্বপ্নাদিষ্ট এই মূর্তি কৃষ্ণভাবে ভাবান্বিত। কপালে তিলক। দেহে অলংকারের ছোঁয়াটুকু নেই, মাথা কেশহীন। সেবাইত জানিয়েছেন, মাথায় রুপোর মুকুট পরানো হয় না।

Shani Mandir
৩২/৫, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা-৬-এর শনি মন্দির

‘শ্রী শ্রী শনি ও কালীমন্দির
স্বর্গীয় পণ্ডিত শ্রী সুধীর চন্দ্র গোস্বামী (স্থাপিত), স্থাপিত-১৩২২’

১৯১৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করলেও শ্রদ্ধেয় সুবীর চন্দ্রের পিতা আগেই কামাখ্যা থেকে ৬টি মড়ার মাথাসহ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

Shani Mandir
৩২/৫, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা-৬-এর শনি মন্দির

ভক্তদের দুর্ভোগ মুক্তির কারণে তাঁদের দেওয়া সোনা ও রুপোর অলংকারে দেবী কালিকা ও শনিদেবের রূপ যে উথলে উঠেছে। ৩২/৫, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা-৬-এর সেই মন্দিরের বর্তমান সেবাইত কার্তিক গোস্বামী।

‘শ্রী শ্রী পশুপতিনাথ জীউ
স্থাপিত-১৩৩৬, নারকেলডাঙা খালপুল’

Shani Mandir
নারকেলডাঙা খালপুল-এর শনি মন্দির

নারকেলডাঙা থানার কাছে ১৯২৯ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ভুবনমোহন দে এবং শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। তখন টিনের চালাঘর ছিল। সংস্কারে এখন পরিবর্তন হয়েছে। ৫০ বছর আগে মন্দির লাগোয়া একটি অশ্বত্থ গাছ দেখেছি। গোড়ায় ছিল কয়েকটি কালো ছোটবড় নুড়ি। এগুলি এখন মন্দিরে আছে তবে গাছটি নেই।

Shani Mandir
নারকেলডাঙা খালপুল-এর শনি মন্দিরে দেববিগ্রহের সঙ্গে নিত্য সেবাইত নিত্যানন্দ ভট্টাচার্য

মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন স্বর্গীয় রামতত্ত্ব ভট্টাচার্য, পরে রামানুজ, বর্তমানে নিত্য সেবাইত রামানুজ পুত্র নিত্যানন্দ ভট্টাচার্য।

‘কাঁকুড়গাছি জোড়া শিব ও শ্রী শ্রী মনোরমা
দক্ষিণাকালীর মন্দির, স্থাপিত বাংলা-১২৫৯।’

একেবারে সাদামাটা দালান মন্দির। প্রাচীনত্বের ছাপ এর সারা গায়ে। মন্দিরটি রামকৃষ্ণ সমাধি রোডে। মন্দিরে ঢোকার মুখে উপরে একফালি কার্নিশের উপরে লেখা আছে –

১৮৫২ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা। বিগ্রহ স্থাপন করেন স্বর্গীয় মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বর্তমানে পুজো চলে আসছে বংশপরম্পরা।

গর্ভমন্দিরে স্থাপিত দেবী কালিকার মাটির বিগ্রহের বাম পাশে দাঁড়িয়ে ভগবান শনিদেব। এই বিগ্রহের বিশেষত্ব হল, গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নয়, দূর্বাদল শ্যামবর্ণ। তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। মাথার রুপোর মুকুট।

এককালে জঙ্গলে ভরা পরিবেশ থেকে মুক্ত শনিদেব ইট কাঠ পাথরের কলকাতায় ১৬২ বছর ধরে নিত্য পুজো পেয়ে আসছেন অপ্রতিহত গতিতে।

পূর্বমুখী সূর্যপুত্র, দক্ষিণমুখী দেবী কালিকা
২৭ বৃন্দাবন পাল লেন, কলকাতা-৩

দোতলা বাড়ির চেহারা, দরজা জানালাগুলো দেখলে বোঝা যায় এরা বয়েসে বৃদ্ধ। এরই নিচের তলায় অনাড়ম্বর মন্দির। প্রতিটি শনি মন্দিরে দেখেছি দেবী কালিকার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ভগবান শনিদেব। একমাত্র এখানে দেখলাম দেবী বিগ্রহ দক্ষিণমুখী, তাঁর ডানদিকে আলাদা বেদিতে পূর্বমুখী সূর্যপুত্র।

নবগ্রহ ও মা বগলা মন্দির
কালীঘাট, আদি গঙ্গা

শতাধিক বছরের প্রাচীন মন্দির। ভট্টাচার্য পরিবারের স্বর্গীয় নলিনীকান্ত ভট্টাচার্যের গর্ভধারিণী মা এই মন্দিরে প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেন দেবী দক্ষিণা কালিকার বিগ্রহ। পরবর্তীকালে কোনও এক সময় স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভট্টাচার্য পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন ভগবান শনিদেবের বিগ্রহ। বিগ্রহদ্বয় নিত্য পুজো পেয়ে আসছেন শতাধিক বছর ধরে।

সাল তারিখ কালের গর্ভে তবে একশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কালীঘাটে গঙ্গার ঘাটে তখন ছিল টিনের চালের মন্দির। এখন সব সিমেন্ট ইট পাথরের। আদিগঙ্গার চরণছুঁয়ে মন্দির।

গর্ভমন্দিরের বেদি অলংকৃত শনি রাহুসহ নবগ্রহের বিগ্রহে। শিবলিঙ্গ ছাড়াও আছে মঙ্গলের উপাস্য দেবী মা বগলা। বিগ্রহ স্থাপন ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বর্গীয় সিদ্ধেশ্বর পাণ্ডা। বংশপরম্পরায় আগত বর্তমানের সেবাইত হরেকৃষ্ণ পাণ্ডা। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা আছে ‘নবগ্রহ ও মা বগলা মন্দির।’

‘শান্তিময়ী মা
শ্রী শ্রী শীতলামাতার মন্দির, স্থাপিত-১২৭২’

সাবেক কলকাতার ফুলবাগানে বর্তমানের মন্দির এলাকাটি ছিল জমিদার ‘ব্যানার্জী’ পরিবারের। ১৮৬৫ সালে স্বর্গীয় অম্বিকাচরণ চক্রবর্তীর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের কেউ এখানে হোগলা পাতার ছাউনি ও মাটির দেওয়াল ঘেরা ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন দেবী শীতলামাতার বিগ্রহ। পরে একে একে ওই ছাউনি দখল করেন দেবী কালিকা, ভগবান শনিদেব, মহাবীর হনুমানজি। এর অনেক বছর পর উড়ে এসে মন্দির জুড়ে বসেছেন রাম লক্ষ্মণ সীতা ও দেবী দুর্গা।

বর্তমানে পাথর বাঁধানো মন্দিরে নিত্য পুজো করে আসছেন বংশানুক্রমে চক্রবর্তী বংশীয় সেবাইতরা।

‘কৃষ্ণপুর আদি কালী ও শনি মন্দির, হানা পাড়া
প্রবর্তক-শ্রীমতী কুসুমবালা নস্কর
স্থাপিত-১৩৪৬ সন, ইংরাজি-১৯৩৯ সাল’

দমদম বিমান বন্দরে যাওয়ার পথে ভিআইপি রোডের ডান হাতে পড়ে কৃষ্ণপুর। যা এখন কেষ্টপুর নামে পরিচিত। মাঝারি আকারের মন্দির। আগে টিনের ছাউনি আর বেড়ার ঘর ছিল। কালের নিয়মে সমস্ত ব্যাপারটা এখন কংক্রিটের। গর্ভমন্দিরের বেদী সুসজ্জিত দেবী কালিকা আর শনিদেবের বিগ্রহে। অত্যন্ত জাগ্রত বলে এই মন্দিরের খ্যাতি আছে।

‘শনি ও কালীমাতার মন্দির
৭, পূর্ব সিঁথি রোড, কদমতলা বাজার, কলকাতা-৭০০০৩০’

মন্দিরটি প্রতিষ্ঠাকাল বাংলা ১৩৬৬ সন। প্রথমে এটি ছিল বেড়ার ঘর, উপরে টালির চাল। ১৪১৭ সনে সংস্কারের পর এখন কংক্রিটের। গর্ভমন্দিরের বেদিতে আসীন দেবী কালিকা আর ভগবান শনিদেবের বিগ্রহ। এছাড়া অন্যান্য বিগ্রহের সঙ্গে আছেন দেবী শীতলামাতা।

নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দেবী কালিকাসহ অন্য দেব দেবীরা পুজো পেয়ে আসছেন ১৯৫৯ সাল থেকে।

হাওড়ায় বাঁধাঘাটে শনি মন্দির

ঐতিহ্যবাহী অতি প্রাচীন এই শনি মন্দিরটি অবস্থান হাওড়ার বাঁধাঘাটে। বয়স ৩০০ বছর ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাংলায় এর চেয়ে পুরনো কোনও শনি মন্দির আছে বলে আমার জানা নেই। এই মন্দিরের প্রথম প্রতিষ্ঠা ও বিগ্রহ স্থাপন করেন স্বর্গীয় লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রবর্তী। বর্তমানে বংশপরম্পরায় ৬ পুরুষ এর সেবাইত। চিরায়ত ঘোর কৃষ্ণবর্ণের সঙ্গে এই বিগ্রহের গায়ের তফাত অনেকটাই। শকুনের উপরে দাঁড়ানো মূর্তিটি ধূসর বলে ডানহাতের উপরে তির, নিচে পদ্ম, বামহাতের উপরে ধনুক, হাতে গদা। মাটির তৈরি বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। গর্ভমন্দির আসন বেদিতে দেবী কালিকা প্রায় ২ ফুট। মাথার মুকুট নির্মিত দক্ষিণ ভারতের আদলে। ৫ ফুট উচ্চতার সুদর্শন সত্যনারায়ণে বিগ্রহটি নিমকাঠের। কষ্টিপাথরের একটি শিবলিঙ্গ স্থাপিত আছে গর্ভমন্দিরের বাঁদিকে।

পরম্পরাগত কথা, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একবার এসেছিলেন এই মন্দিরে।

আকড়া-অরুণ মিস্ত্রির ঘাট

পূর্বরেলের শিয়ালদা-বজবজ শাখায় আকড়া স্টেশন। এখান থেকে সামান্য পথ অরুণ মিস্ত্রির শ্মশানঘাট। এখানে শনি মন্দির আছে বাংলা ১৩৩৫ সনে প্রতিষ্ঠিত। উক্ত সনে ঘাটটি সংস্কার করার পাথরের ফলকটি বসানো হয়। নিত্য পূজারির কথায়, তারও প্রতি ৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরটি।

গর্ভমন্দিরে স্থাপিত শনিদেবের বিগ্রহ উচ্চতায় প্রায় ৪ ফুট।

ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বিগ্রহ। মাথায় মুকুট। কোনও হাতে কোনও অস্ত্র নেই। নিত্য পূজারি প্রেমানন্দ চক্রবর্তীর বর্তমান বয়স ৬০। তিনি পুজো করে আসছেন ১০ বছর বয়স থেকে।

ঠিক পাশের মন্দিরটিও সমসাময়িক। এই মন্দিরে ভগবান শনিদেব ডানহাতের উপরে চক্র, নিচের হাত অভয় মুদ্রায়, বামহাতের উপরে কুড়ুল, নিচের হাতে শঙ্খ। এই মন্দিরের নিত্য সেবাইত অলোক চক্রবর্তী। তিনি পুজো করে আসছেন ১১ বছর বয়স থেকে। অবিরাম ধারায় আজও শনিদেব নিত্য পুজো পেয়ে আসছেন ১১ সাল থেকে।

বিচালিঘাটের শনি মন্দির

অশীতিপর বৃদ্ধ শনি মন্দির। বয়স ১০০ বছর পর হয়ে গিয়েছে। মন্দিরটি অবস্থান গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির পাশে বিচালিঘাটে।

এই মন্দিরটি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমান জেলার কোনও এক ভক্তপ্রাণ ঘোষ পরিবার। মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের এক উত্তপ্ত সময়ে। এটি পুনঃনির্মাণ করেন ১৯৫০সালে নারায়ণচন্দ্র পাণ্ডা। এরপর মন্দিরটি পুনরায় সংস্কার করেন ১৯৬০ সালে ঘোষ পরিবার।

গর্ভমন্দিরে স্থাপিত ভগবান শনিদেবের বামহাতের উপরে গদা, নীচের হাতে তির, ডানহাতের উপরে পদ্ম, নিচের হাত অভয় মুদ্রা এই মন্দির সংলগ্ন মন্দিরে স্থাপিত বিগ্রহগুলির মধ্যে আছেন রাধাকৃষ্ণ, দেবী কালিকা ও শিবলিঙ্গ।

শতাধিক বছর ধরে বিচালিঘাটের শনি মন্দিরে নিত্য ও নিয়মিত শনিদেব পুজো পেয়ে আসছেন আর্তভক্তদের।

‘শান্তিময়ী কালীমাতা মন্দির
স্থাপিত-১লা কার্তিক ১৩৫৯ সাল
প্রতিষ্ঠাতা ও সেবাইত শ্রী শশধর চক্রবর্তীর অসাধারণ ত্যাগ ও সাধনায় মন্দিরের এই নব রূপায়ণ সম্ভব হইয়াছে।’

১৯৫২ সালে নির্মিত মন্দিরটি মাঝারি আকারের। দেবী কালিকা ভগবান শনিদেবের বিগ্রহে কোনও বৈচিত্র্য নেই। বিগ্রহও মাঝারি আকারের। শ্রদ্ধেয় শশধরের পুত্র স্বর্গীয় পুলিনবিহারী, পুলিন পুত্র কার্তিকচন্দ্র চক্রবর্তী, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র রোড ও হেম নস্কর রোডের সংযোগস্থলের কালী ও শনি মন্দিরের নিত্য সেবাইত।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – তথ্য সংগ্রাহক : সুব্রত ভাওয়াল, সমরেশ সাহা, সর্বাণী মল্লিক

Show More

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *