Celeb Talk

মোহনবাগানের ছেলে

উত্তম কুমার থেকে শুরু করে, হিন্দি সিনেমার প্রায় সব নায়ককেই ভাল লাগতো। শো শেষ হলে সেখান থেকে সোজা মাঠে প্র্যাকটিসে। বাড়িতে জানতেই পারতো না।

‘সালটা ১৯৮৬, সকালবেলা। হঠাৎই বাড়িতে এসে হাজির শৈলেন মান্না। এসেই দাদুর ওপর চোটপাট। একি শুনছি কার্তিকদা, তোমার নাতি নাকি ইস্টবেঙ্গলে সই করছে? দাদুও সরাসরি বলে দিলেন, কি করবে, তোমরা কি ওকে অফার করেছ? ইস্টবেঙ্গল ডাকছে। সেখানে না করতে যাবে কেন? এরপর যদিও ইস্টবেঙ্গলে খেলা আর হয়নি। ওই বছরই প্রথম মোহনবাগানে সই করি।’ ময়দানের টেন্টে বসে নিজের জীবনের এই কাহিনি যিনি শোনালেন তিনি আর কেউ নন, মোহনবাগানের ঘরের ছেলে সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বয়স বেড়েছে। কাঁচাপাকা চুল, দাড়ি, গোঁফে বয়সের ছাপ। খেলা ছেড়েছেন সেই ২০০০ সালে। তবে মাঠের সঙ্গে যোগাযোগটা থেকেই গেছে। কলকাতার মাঠে এই মানুষটাকে চেনে না এমন বোধহয় কেউ নেই। সেই ফুটবলার সত্যজিতের জীবনের নানা কথা শুনতেই এদিন আমার টেন্টে আসা।

বাড়িতে সবাই আপাদমস্তক মোহনবাগানি। ছোট থেকেই তাই হাড়ে মজ্জায় মোহনবাগান শব্দটা ঢুকে গেছিল। দাদু ও কাকা দুজনেই ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছেন। ফলে বাড়িতে ফুটবল চর্চার একটা আবহ ছিলই। ছিল মোহনবাগান বলতে পাগল কিছু মানুষের সান্নিধ্য। ফলে শৈশবের সেই দিনগুলো থেকেই মোহনবাগানে খেলার একটা স্বপ্ন সযত্নে লালিত হতে থাকে সত্যজিতের মনে।

ছোট থেকে ফুটবল বলতে অজ্ঞান। সারা দিন সব ফেলে প্র্যাকটিস করতে পারলেই ভাল হয়। ফলে উত্থানের গ্রাফটাও বেশ ভাল। উত্তরপাড়া স্পোর্টিং-এ হাতে খড়ি। তার আগে যদিও বালির একটা ক্লাবে খেলেছেন। উত্তরপাড়া স্পোর্টিং-এর পর জর্জ টেলিগ্রাফ। কলকাতা মাঠের বড় দলে খেলা বলতে যা বোঝায় তা এই জর্জের হাত ধরেই শুরু। তবে চোখে পড়াটা জুনিয়র ন্যাশনালের হাত ধরেই। জুনিয়র ন্যাশনালে দারুণ পারফরমেন্স বড় দলের নজর কাড়ে। তখনকার সিনিয়র খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্লাবের কর্মকর্তা, সকলেরই নজরে পড়ে যান সুঠাম কিশোরটি। পায়ে কাজ আছে। প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড়। ফলে প্রথম অফার আসে ইস্টবেঙ্গল থেকে। মোহনবাগান থেকে যদিও তখনও কেউ ডাকেনি। তখন কলকাতা মাঠের বড় দলে খেলার সুযোগটাই মুখ্য। তাই বাড়িতে মোহনবাগান আবহের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে কথা শুরু। আর সেকথা জানতে পেরেই শৈলেন মান্নার বাড়িতে আসা। আর মোহনবাগানে সই। তারপর পনেরো বছরের ফুটবলার জীবনে মোহনবাগান ছাড়েননি। মোহনবাগান সত্যজিতের কাছে একটা ক্লাব নয়, একটা ভালবাসা। ক্লাবকে মনেপ্রাণে ভালবাসা। তাই সে সময় অন্য দলের থেকে অফার এলেও তা হেলায় ছেড়ে দিতে একবারের জন্যও ভেবে দেখতে হয়নি সত্যজিতকে।

এসব কথা পর যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী, সেটাই করলাম। তাহলে আজকাল আর কোনও খেলোয়াড়কে এভাবে একটা ক্লাবেই পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে না কেন? প্রশ্নটার জন্য বোধহয় তৈরিই ছিলেন সত্যজিৎ। দেখুন, আজকাল ফুটবলে টাকা এসে গেছে। মোটা টাকার হাতছানি। একইদলে খেলে যেতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বর্তমান ফুটবলে সেটা কঠিনতম কাজ। এখনকার ফুটবলাররা অনেক পেশাদার। তবে এক ক্লাবে খেলা নয়, ফুটবলকে ভালবাসাটাই আসল। যখন যে ক্লাবে খেলছি, সেই ক্লাবের জন্য নিজের একশভাগ দেওয়াটাই আসল। কারণ শেষ পর্যন্ত খেলাটা ফুটবলকে ভালবেসে। ক্লাবকে ভালবেসে ফুটবলে আসা নয়।

মোহনবাগানের সত্যজিৎ হয়ে ওঠার পেছনে সত্যজিতের জীবনে কয়েকজনের অবদান রয়েছে। আর সেকথা তিনি আজও ভোলেননি। রবীন পাত্র, কাকা প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়-এর অবদান তো রয়েছেই। তবে সবার আগে যে নামটা, তিনি শঙ্কর সরকার। শুধু কোচিং করানোই নয়, সত্যজিতের মধ্যে যে ফুটবল আছে, একথাটা কলকাতা মাঠের তাবড় লোকজনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই শঙ্কর সরকারই।

স্কুলে তখন ক্লাস ফাইভে পড়েন। ক্লাস টিমে খেলছেন। লটারিতে একবার খেলা পড়ল ক্লাস ইলেভেনের সঙ্গে। সকলে হায়হায় করে উঠলেন। এ কিকরে হয়? ফাইভের বাচ্চারা কখনও পারে! কিন্তু লটারিতে যখন পড়েছে তখন খেলতেই হবে। অগত্যা মাঠে নামা। মাঠে কিন্তু ইলেভেনের ছেলেরা ক্লাস ফাইভের অন্য রূপ দেখল। খেলা প্রায় শেষের পর্যায়ে, কিন্তু তখনও গোলের দেখা নেই। জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ফাইভের ছেলেদের মারতে শুরু করল ইলেভেনের খেলোয়াড়েরা। টেকনিকে আটকানো গেলেও মারের মুখে এক গোল খেয়ে গেল ফাইভ। কিন্তু খেলার শেষে ওভাবে মেরে জেতার জন্য মাস্টারমশাইরা মাঠে নেমে ইলেভেনের ছেলেদের খুব মেরেছিলেন। সেদিনের ছবি এখনও চোখের সামনে ভাসে সত্যজিতের।

জার্মানির একটি জুনিয়র দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলা থেকে শুরু করে অমল দত্তের কোচিং-এ সন্তোষ ট্রফি খেলা। মোহনবাগানে সই। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া। সবই এক একটা মধুর স্মৃতি হয়ে আছে কলকাতা মাঠের এই স্বনামধন্য মানুষটার কাছে। ফুটবল খেলেছেন। কোচিং করেছেন। আগামী দিনেও করবেন। এই নিয়েই জীবন কাটাতে চান তিনি। অন্য কিছুই তাঁর না পসন্দ।

তবে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও বেশ চেগে ওঠেন আপাত শান্ত সত্যজিৎ। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলার কথা উঠতেই বেশ নড়ে চড় বসলেন। ওহঃ, সে এক অন্য লড়াই। স্নায়ুর চাপের লড়াই। যদিও সত্যজিতের মতে, ৮৬ থেকে ৯০-এর মধ্যে তেমন চাপ পড়ত না। বরং আবহটা উপভোগ করতাম। চাপ থাকতো সিনিয়রদের ওপর। বড়দের দায়িত্ব অনেক বেশি। আমি নতুন খেলোয়াড়। ফলে দায়িত্ব সেই অর্থে নেই। তবে মাঠে দর্শকরা যে অত চেঁচান, সেসব মাঠে নামলে আর কানে ঢোকেনা বলেই জানালেন সত্যজিৎ। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে যখন সিনিয়র হলাম। মোহনবাগানের অধিনায়কের দায়িত্ব কাঁধে এল তখন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলার দিনে ভয় জিনিসটা টের পেলাম। এত মানুষের আশা। ক্লাব কর্মকর্তাদের আশা। দায়িত্বটাই ভয়ের আকারে চেপে বসত। আসলে যে দলের সঙ্গেই খেলি না কেন। ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর আনন্দ বলে বোঝানোর নয়। সে এক অন্য অনুভূতি। মনে প্রাণে মোহনবাগান কাকে বলে, তা এই কথাগুলো বলার সময় সত্যজিতের মুখ দেখে আমার এতটুকুও বুঝতে অসুবিধে হল না।

মোহনবাগানকে সত্যজিৎ যে কতটা ভালবাসেন তা একটা কাহিনির পর আরও পরিস্কার হয়ে গেল। খেলোয়াড় জীবনেই কোচিং করানোর ইচ্ছেটা মনের কোণায় লুকিয়ে ছিল। সিনিয়র খেলোয়াড় থাকাকালীন কোচরাও পরামর্শ চাইতেন। এটা মাঠের পুরনো দস্তুর। সেখান থেকে কোচিং-এর ইচ্ছেটা ছিলই। খেলা ছাড়ার পর মোহনবাগানের কোচও হয়েছেন। তবে সত্যজিতের মতে দলকে ডোবাবো না। যদি বুঝি দলকে কিছু দিতে পারছিনা, কোচিং ছেড়ে দেব। আমার কাছে নিজের স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থ অনেক বড়। একবার মোহনবাগানের কোচিং ছাড়ার পর সুভাষ ভৌমিক ইস্টবেঙ্গলের সহকারি কোচ হওয়ার জন্য ডেকেছিলেন, কিন্তু সেই অফার এককথায় ছেড়েছিলেন এই মোহনবাগানের ছেলে। সাফ জানালেন, বাড়ির কাছে ছোট ছোট বাচ্চাদের কোচিং করাই। তবে বড় দল বলতে মোহনবাগান ছাড়া আর কোনও দলের কোচ হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

বাংলা থেকে ইদানিং সেই অর্থে ভাল ভাল ফুটবলার না ওঠায় আক্ষেপ রয়েছে সত্যজিতের। কিন্তু কেন হচ্ছে না? সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল। সেই ফুটবলেই কিনা খেলোয়াড়ের খরা! উত্তরটা দিলেন সত্যজিতই। আগে বাংলার মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা ফুটবলে আসত। ফুটবল খেলত। কিন্তু আজকাল তারাই ভাল স্কুলে পড়ছে। পড়ার চাপে মাঠে আসতে পারছে না। আসছে দরিদ্র ঘরের ছেলেরা। তাদের সমস্যা হল অপুষ্টি। ফুটবল কায়িক পরিশ্রমের খেলা। দরকার পুষ্টিকর খাবারের। কিন্তু দরিদ্র পরিবারে সে খাবার কোথায়? তাছাড়া সত্যজিতের মতে, দরিদ্র ঘরের ছেলেদের বুদ্ধির বিকাশে খামতি থাকে। পরিবেশের কারণেও অনেক প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায়। এদের যদি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোচিং করানো যায়, তাদের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে আবার ভাল ভাল খেলোয়াড় উঠে আসবে বাংলা থেকে। কিন্তু সেই পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে।

অনেকক্ষণ ফুটবলের পর এবার ফুটবলের বাইরের সত্যজিতকে চেনার চেষ্টা শুরু করলাম। ফুটবল ছাড়া আর কি ভাল লাগে? গান, সিনেমা। বিশেষ গুরুত্ব না দিয়েই উত্তর দিলেন সত্যজিৎ। কথা চলল। আর কথার পিঠে কথা থেকে বেরিয়ে এলেন অচেনা এক সত্যজিৎ। স্কুলে যখন পড়তাম তখন থেকেই সিনেমার পোকা ছিলাম। এমনকি স্কুল পালিয়েও সিনেমা দেখেছি। সত্যজিতের অকপট স্বীকারোক্তি। স্কুল পালিয়ে দেড়টা সাড়ে চারটের শো দেখতে যেতাম। কোনও বাছ বিচার ছিলনা। যেকোনো সিনেমা হলেই হল। উত্তম কুমার থেকে শুরু করে, হিন্দি সিনেমার প্রায় সব নায়ককেই ভাল লাগতো। শো শেষ হলে সেখান থেকে সোজা মাঠে প্র্যাকটিসে। বাড়িতে জানতেই পারতো না। ভাবতো স্কুল থেকে মাঠে এসেছি। তবে সিনেমা আর ফুটবল আমার পড়াশোনার অনেক ক্ষতি করেছে। অকপটে বললেন সত্যজিৎ। এখনও সিনেমা দেখেন। তবে আজকাল বয়সের ভারে বেছে বেছে সিনেমা দেখাই পছন্দ তাঁর। তবে অনুরাগ বসু, মধুর ভান্ডারকরের সিনেমা ছাড়েন না। মোহনবাগানেরে ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের কাহিনি নিয়ে তৈরি এগারো সিনেমাটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত সত্যজিৎ। বলেই ফেললেন, সিনেমা দেখতাম ঠিকই কিন্তু হিরো হব ভাবিনি। তবে এগারোতে একটা পার্ট দিলে করতাম। অবশ্যই করতাম।

গানও ভালবাসেন। তবে কোনও বিশেষ ধরণের গান নয়। ভাল গান হলেই হল। সলিল চৌধুরী থেকে আর ডি বর্মণ, নৌসাদ থেকে হেমন্ত কোনও কিছুই বাদ নেই। আর ভালবাসেন রবীন্দ্র সংগীত।

ফুটবল জীবন শেষ। যতদিন পারবেন কোচিং করবেন। আর মোহনবাগানকে ভালবেসে যাবেন। ছোট থেকেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাস থেকেই ভালবাসা। ফুটবলের বাইরে মনেপ্রাণে শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত সত্যজিৎ। ভালবাসেন স্বামী বিবেকানন্দ, মা সারদাকে। বেশ আবেগমথিত গলায় জানালেন, জীবনে যতদিন বাঁচবেন শ্রীরামকৃষ্ণের আরও, আরও কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তাতেই তাঁর আনন্দ, তাতেই তাঁর সুখ, তাতেই তাঁর প্রাপ্তি। সাক্ষাৎকারের শেষ। ওঠার আগে বললেন কারও প্রতি কোনও রাগ নেই, কোনও ক্ষোভ নেই। শুধু শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা, শেষ দিন পর্যন্ত যেন ফুটবলকে ভালবেসে যেতে পারি, আর যেন ঠাকুরের কাছে থাকতে পারি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *