প্রতিভায় জাদুকরী
ভারতীয় ম্যাজিক ইতিহাসের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব পি সি সরকারের নাতনি, জুনিয়র পি সি সরকারের বড় মেয়ে মানেকা সরকার। একথায়, ম্যাজিশিয়ান পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম।
‘আই অ্যাম নট এ ম্যাজিশিয়ান বাই ফোর্স, আই অ্যাম এ ম্যাজিশিয়ান বাই চয়েস!’ ‘এটা তেলের দোকান নয়, যে বাবা ছাড়ার পর আমি গিয়ে বসলাম। আমাকে ম্যাজিশিয়ান করার জন্য কেউ চাপ দেয়নি। বরং নিজের ইচ্ছায় আমি এই পেশাকে বেছে নিয়েছি। আমার ম্যাজিক দেখাতে ভাল লাগে। ম্যাজিক আমার ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা।’ এক নিঃশ্বাসে যিনি এই কথাগুলো বলে গেলেন তিনি ভারতীয় ম্যাজিক ইতিহাসের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব পি সি সরকারের নাতনি, জুনিয়র পি সি সরকারের বড় মেয়ে মানেকা সরকার। একথায়, ম্যাজিশিয়ান পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম। বলা ভাল পারিবারিক পরম্পরার সুযোগ্য ধারক ও বাহক।
নীলকণ্ঠের যারা ধারাবাহিক পাঠক, তাঁরা জানেন, গত দু’সপ্তাহে আমাদের এই সেলেব টক বিভাগে পি সি সরকার জুনিয়র ও তাঁর ছোট মেয়ে মুমতাজ সরকারের সাক্ষাৎকারকে প্রবন্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই লেখাটাকে তারই তৃতীয় ও শেষ ভাগ হিসাবে নিতে পারেন। এ লেখা মানেকা সরকারকে নিয়ে। পি সি সরকার জুনিয়রের তিন মেয়ের মধ্যে মানেকাই একমাত্র পারিবারিক পেশাকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। আর ওপরের উত্তরটা এসেছিল তারই হাত ধরে। বাড়ির পরম্পরাকে ধরে রাখতেই কি জাদুকর হওয়া? প্রশ্নটা করার পরই বেশ দৃঢ় কণ্ঠে উপরিউক্ত উত্তরটি এসেছিল মানেকার দিক থেকে।
‘স্টেজ আর শো বিজনেসের মধ্যেই আমার ছোটবেলা কেটেছে। ফলে আর পাঁচটা ছেলে-মেয়ে যেভাবে বড় হয় সেভাবে আমি বড় হইনি। অধিকাংশ সময় গ্রিন রুমে বসে লেখাপড়া করতে হয়েছে। ফলে ছোট থেকেই স্টেজের প্রতি আমার একটা আগ্রহ ছিল। শো এর পর বাবা-মাকে অনেকে ছেঁকে ধরত। অটোগ্রাফ নিত। হ্যান্ডশেক করত। সেটা দেখে আমার খুব হিংসা হত। মনে হত বাবা-মাকে আমার কাছ থেকে যেন কেউ কেড়ে নিচ্ছে’।
মা আমার কাছে ‘আল্টিমেট আইডল’, ‘ড্রিম কুইন।’ ছোটবেলায় সেই মায়ের কাছে আমার একটা অদ্ভুত আবদার ছিল। মা স্টেজে যা পরবে আমারও তার জোড়া চাই। মা সেই আবদার মেনেও নিয়েছিলেন। মা স্টেজে যে ঝলমলে ড্রেস পড়তেন তারই একটা হুবহু ছোট সংস্করণ বানানো হত আমার জন্য। আর স্টেজে যখন বাবা–মা ম্যাজিক দেখাতে ব্যস্ত থাকতেন তখন গ্রিন রুমে বসে আমি সেই জামা পড়ে একমনে পড়াশোনা করতাম। আসলে এই ছোট সংস্করণ বানানোর পিছনে এটাই ছিল আসল কারণ। মা দেখতেন আমায় ওই জামাটা দিলে আমি গ্রিনরুমে বসে পড়া করি। তাই ওটা দেওয়াতে মা কোনও দিন আপত্তি করেননি।
একবার স্টেজে মা নাচছেন। সঙ্গে অনেকে রয়েছে। আমি স্টেজের পাশ থেকে সেটা দেখছিলাম। সেদিন কি মনে হল, যিনি আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর হাত ছাড়িয়ে আচমকা স্টেজে নেমে নাচতে শুরু করলাম। মায়ের মত একই জামা পড়ে আমাকে নাচতে দেখে দর্শকরা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম মা আমায় ইশারায় ভেতরে যেতে বলছেন। সেদিন অনুষ্ঠানের পর বকুনি খেতে হয়নি। বরং বাবা-মা দু’জনে আমাকে মাঝখানে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন আমি এমন করলাম। পরে বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন এটা যদি তোমার ভাল লাগে তাহলে কর, তবে আগে লেখাপড়া। লেখাপড়াটা শেষ করে তোমার যেটা ইচ্ছা হয় সেটা কোরো।
‘যখন আমি জাদুকরী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। অনেকেই ভেবেছিলেন বাড়িতে আছে, তাই এটা আমার একটা শখ। কয়েকদিন স্টেজে যাদু দেখাব। লাইম লাইটে আসব। তারপর অন্য অনেক মেয়ের মত একদিন কোনও এনআরআইয়ের হাত ধরে বিয়ে করে বিদেশে চলে যাব। এটা তখন যত শুনতাম তত আমার জিদ পেয়ে বসত। ওই জিদটা আমায় আজকের মানেকা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
যেদিন প্রথম স্টেজে একক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন মানেকা, সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা আজও ভোলেননি। সেই সন্ধেটা। যেদিন হল ভর্তি দর্শকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ‘মনে হচ্ছিল দর্শকরা আমায় দেখতে এসেছেন। আমার যাদু দেখতে এসেছেন। তখন যে ফিলিংসটা হচ্ছিল বলে বোঝানোর নয়। আর যেটা হল সেটা হল চাপা জিদটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হল দর্শকরা তো হাত পেতেই আছেন। আমার কাজ ভাল হলে তাঁরা নিজেরাই আমায় দুহাত দিয়ে জড়িয়ে নেবেন।’ বলতে বলতে কোথায় যেন হরিয়ে গেলে মানেকা। তবে কি এক মুহুর্তের জন্য সেই দিনটায়, সেই সন্ধেটায় ফিরে গেলেন তিনি। হয়তো তাই।
চারিদিকে এখন শো করতে হয় তাঁকে। দেশে-বিদেশে। দেশে যাদু দেখানো একরকম। কিন্তু মানেকার মতে বিদেশে একটা চাপা কম্পিটিশন থেকেই যায়। কারণ একে এটা পুরুষতান্ত্রিক পেশা। বিশ্বে কজন জাদুকরী আছেন তা হাতে গুণে বলা যায়। তার ওপর আমি ভারতীয়। ফলে বিদেশে সকলেই আমার পারফরমেন্সের সঙ্গে ভারত সম্বন্ধেও একটা ধারণা করতে চায়। এখানকার মহিলাদের সম্বন্ধে একটা ধারণা পেতে চায়। ফলে সেই বাড়তি দায়িত্বটা আমার ওপর থেকেই যায়।
বিদেশের কথা উঠতে নেপালের রাজার কথা এসেই পড়ল। নেপালের প্রয়াত রাজা বীরেন্দ্র মানেকার ভক্ত ছিলেন। সে কথা অনেকেই জানেন। নেপালের রাজার সামনে ম্যাজিক দেখানোর সেই অভিজ্ঞতার কথাও শোনালেন মানেকা। ‘একজন রাজা কেমন হন তা আমরা কল্পনা করে নিই। কিন্তু সত্যিকারের একজন রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছি এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করছিল। তখন যদিও বাবাকে সাহায্য করতাম। বয়সও কম। নেপালে একটা শোয়ে রাজা বীরেন্দ্র ও রানি ঐশ্বর্য আমার ম্যাজিক দেখেছিলেন। শোয়ের শেষে রাজা নিজে এসে বাবাকে বলেছিলেন, ও যেন তোমার যাদুবিদ্যার ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, আমারাও তাই ইচ্ছা, কিন্তু এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মানেকাই’।
একবার একটা শোয়ে একটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। বাবা আমার সেই শো দেখতে এসেছিলেন। লুকিয়ে। কিন্তু আমি ধরে ফেলি। আমি যাতে দেখতে না পাই সেজন্য বাবা একদম সাধারণ পোশাকে মঞ্চের একদম পিছনের সিটে গিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু আমিও জাদুকরী, ঠিক দেখে ফেলেছিলাম। সেদিন বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল। আমি বুঝিয়েছিলাম তুমি যে আমার শো দেখতে গেছিলে তা আমি জানি। সেদিন রাতে খাবার টেবিলে বাবা শুধু একটাই কথা বলেছিলেন, ‘হচ্ছে, এগিয়ে যাও, আরও ভাল হবে।’ বাবার কাছে পাওয়া এই সার্টিফিকেটই আমার কাছে আল্টিমেট প্রাপ্তি।
জাদুকররা এমন ঝলমলে পোশাক পড়েন কেন? প্রশ্নটা অনেকদিন ধরেই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মানেকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললাম। ‘আসলে জাদুকররা অবাস্তব জগত নিয়ে কাজ করেন। স্টেজের ওপর অভিনয় করেন। মানুষকে বিশ্বাস করান তাঁরা স্বপ্নের রাজত্বে আছেন। সাধারণ পোশাক পরে ম্যাজিক দেখালে সেই অনুভূতিটা মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া মুশকিল। তাই পোশাকটাও হয় স্বপ্নের মত। জাদুকরের কাজে তার পোশাকের একটা বিশেষ মাহাত্ম আছে।’ সাবলীল ভাবে ব্যাখ্যা দেন মানেকা।
আরও অনেকে তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ম্যাজিক পেশায় আসুক তা সবসময় চান মানেকা। এখনও কচিকাঁচার দল এসে পাকড়াও করলে যাদুর দুএকটা কৌশল তাদের শিখিয়েও দেন। তবে পড়ুয়ার দল জাদুকর হওয়ার জন্য চাপ দিলে তাদের সুপরামর্শ দেন মানেকা। বলেন আগে পড়াশুনো শেষ কর, তারপর সব কিছু।
নিজের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে মানেকাকে। আর সেখানে বাঙালি খানার টানে নিজেই হাত পুড়িয়ে রাঁধতেও হয়েছে। সেখান থেকেই রান্নার হাতটাও পড়াশোনার সঙ্গে পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। সময় অসময়ে মাকে বিরক্ত করে যে সব রান্নার রেসিপি তিনি লিখেছিলেন তা একটা ফাইলবন্দি করে ফেরার সময় ওখানকার ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর দিয়েও এসেছেন। দিয়ে এসেছেন বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া মশলাগুলোও। কারণ এখানে যেসব মশলা ব্যবহার হয় সেগুলো অন্য দেশে সবসময় পাওয়া যায় না। তাই যখন কোনও দোকানে সেগুলো দেখতে পেতেন, তখনই সময় নষ্ট না করে বেশি করে সেটা কিনে নিতেন। হাসতে হাসতেই জানালেন মানেকা। সেই মশলার পসরাও তিনি তাঁর ভারতীয় বন্ধুদের বিলিয়ে এসেছেন।
মানেকা বইও লেখেন। যাদুর বই। ইতিমধ্যেই ছোটদের জন্য দুটো বই লিখে ফেলেছেন। এখন চলছে বড়দের কথা মাথায় রেখে একটা পূর্ণাঙ্গ বইয়ের লেখালিখির কাজ। বইটিতে থাকছে সহজ সরল ভাষায় যাদুবিদ্যাকে মানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এছাড়া বইটিতে অন্য একটি দিকও রেখেছেন মানেকা। যেটা বোধহয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব। পুরুষতান্ত্রিক এই পেশায় একজন মহিলা জাদুকরীকে কি কি চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয় তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে নিয়ে ঘটনা আকারে সকলকে জানানোর চেষ্টা এই বইয়ের একটা বড় পাওনা হবে। বিশেষত মহিলাদের জন্য। যাঁরা আজ মানেকাকে দেখে এই পেশায় সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
সাক্ষাৎকার প্রায় শেষ। এবার সেই প্রশ্নটা করেই ফেললাম। যেটা খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হয়। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তরে যে এতটা পাব আসা করিনি। এককথায় উত্তর দিতে গিয়ে বোমা ফাটালেন মানেকা। বলে দিলেন নিজের সেই সুপ্ত ইচ্ছার কথা। যা এখনও কোনও সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমের সামনে তিনি বলেননি বলেই আমার ধারণা। ‘সিনেমা দেখতে ভাল লাগে। আমি একটা সিনেমা বানাতে চাই। তার স্ক্রিপ্টও তৈরি করে ফেলেছি। সেটা ব্রাশ আপও হয়ে গেছে। অবশ্যই বিষয়টা ম্যাজিকের উপর দাঁড়িয়ে। সিনেমায় ভাল লাগবে ম্যাজিকের এমন দিকগুলোই সিনেমায় রাখা হয়েছে। ম্যাজিকের রিয়ালিটিটাকে রূপোলী পর্দার মধ্যে দিয়ে দর্শকের সামনে তুলে ধরাই আমার মূল উদ্দেশ্য। এই সিনেমায় বোনেদের নিয়ে কাজ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল লাগবে। তবে ওরা যদি সময় দেয়’! কথাটা বলেই হেসে ফেললেন মানেকা।