Celeb Talk

ছন্দে তালে, গানে গানে

বাংলার তরুণ প্রজন্মের যে গুটি কয়েক প্রথম সারির কণ্ঠশিল্পীর নাম লোকের মুখে মুখে ঘোরে তারমধ্যে একটি অবশ্যই নীপবীথি ঘোষ। আমরা হাজির হয়েছিলাম সেই নীপবীথির অন্দরমহলে।

‘ব্রিটানিয়া, ব্রিটানিয়া, ব্রিটানিয়া মারি’, বাংলা বিজ্ঞাপনে অতি পরিচিত এক জিঙ্গল। কিন্তু যদি বলি, কে গেয়েছে বলুন তো? এটা জিজ্ঞেস করলে কিন্তু অনেকেই পারবেন না। কিন্তু নামটা যেই শুনবেন, বলবেন তাই! হ্যাঁ, ঠিক তাই। নীপবীথি ঘোষই গেয়েছেন এই জিঙ্গল। আর বাংলার তরুণ প্রজন্মের যে গুটি কয়েক প্রথম সারির কণ্ঠশিল্পীর নাম লোকের মুখে মুখে ঘোরে তারমধ্যে একটি অবশ্যই নীপবীথি। আমরা হাজির হয়েছিলাম সেই নীপবীথির অন্দরমহলে। তাঁর সঙ্গে চুটিয়ে বসে আড্ডা দিতে আর গান শুনতে।

বেলো বাজানো বড্ড ঝামেলার কাজ। বড্ড কষ্টের। তাই হারমোনিয়ামটা কোনও কালেই পছন্দ ছিলনা। কে অত কষ্ট করে গান গাইবে! তারচেয়ে পিয়ানো শেখায় মনোযোগটা অনেক বেশি ছিল। পিয়ানোই ছিল সবচেয়ে পছন্দের বাজনা। একজন সঙ্গীতশিল্পী যে কতটা গেঁতো হতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দিতে বললে এর চেয়ে ভাল উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নীপবীথি কিন্তু বেশ হাসি মুখেই এই কথাগুলো অকপটে স্বীকার করে নিলেন। এই গেঁতোমির কারণে নাকি কোনও দিন হারমোনিয়ামের আওয়াজটাকে ভাল লাগাতে পারলেন না। ভাবা যায়!

গানকে পেশা করার কথা কখনও মাথায় আসে নি। বরং পিয়ানো বাদক হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার একটা লক্ষ্য ছিল। আর সেই লক্ষ্যে ছুটে চলার জন্য যেভাবে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত তা চলছিল পুরোদমে। কিন্তু ডানপিটে মনটা স্কুল, কলেজ ফেস্টে গান গাওয়ার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতো। আর তার থেকেই নীপবীথির গানের প্রতি আগ্রহ। ছোট বয়স থকে গান শোনার একটা অভ্যাস থাকলেও প্রথাগত তালিম শুরু কলেজ জীবন থেকেই।

কলেজ জীবনে গান, মানে ফেস্টে গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া। আর তাতে বেশ সফল এক নাম হয়ে উঠলেন নীপবীথি। আর গান গাইতে গিয়ে বুঝলেন তাঁর গলায় সুর আছে। সে সুর ভগবানের দান। একটা প্রতিভা। ফলে সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে আপত্তি কোথায়! শুরু হল সেই গানকে পেশা করার জন্য অধ্যবসায়। কিন্তু একজন কণ্ঠশিল্পীর জন্য তখন পিয়ানোর চেয়ে অনেক বেশি দরকার ছিল হাতে একটা গিটারের। নীপবীথি বুঝলেন সেই জামানা গিটার হাতে গায়ক গায়িকা দেখতে বেশি স্বচ্ছন্দ। সেসময়ে সুরকার রকেট মণ্ডলই নীপবীথিকে একটা গিটার বানিয়ে দেন। ফলে জীবনের প্রথম গিটারটা নেহাত মন্দ ছিল না। তবে এখনও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এতটা উঠে যাওয়ার পরও নীপবীথির মনের কোনায় লুকিয়ে আছে স্কুল জীবন থেকে শিখে আসা পিয়ানোর সুর। নিজেই স্বীকার করলেন, ‘গানের জন্য যতটা দরকার অর্থাৎ গিটারের বেসিকটা শিখে নিয়েছিলাম। ওতেই চলে যাচ্ছে। গানের কর্ডটা ধরে রাখতে পারলেই তো হল। আর কী জানেন, এই গিটারটার সঙ্গে অনেকদিন তো কাটিয়ে দিলাম। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে। ফলে আজকাল আমি ওকে চিনি। ওও আমাকে চেনে। দু’জনে চালিয়ে নিই। আর কাঠের জিনিস তো, যত দিন যায় তত তার কদর বাড়ে, সুর বাড়ে, ভাল হয়’।

সেবার একটা প্রথম সারির চ্যানেলে গানের প্রতিযোগিতার কথা কানে এল। অনুষ্ঠানের নাম ‘জলসা’।  নাম দিয়ে দিলেন নীপবীথি। চেষ্টায় দোষ কী। দেখাই যাক না কি হয়। অনুষ্ঠানটির দায়িত্বে ছিলেন কবীর সুমন। অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে নীপবীথিও গান গাইলেন। কথায় বলে প্রতিভা চাপা থাকে না। নীপবীথির গলা কবীর সুমনের ভাল লাগল। তিনিই নীপবীথিকে ডেকে বললেন পদাতিক নামে একটি নাটকের দলের পক্ষ থেকে কত্থকের ওপর একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। নাটকের নাম ‘রাম কাহানি।’ নাটকের ওয়েস্টার্ন পার্টের গানগুলো গাওয়ার জন্য একজন শিল্পীর তখন খোঁজ চলছে। নীপবীথি যদি রাজি থাকেন তাহলে তাঁর নাম কবীর সুমনই প্রস্তাব করবেন। নীপবীথি তো এককথায় রাজি। কবীর সুমনের মত মানুষের প্রস্তাব। ফলে সুযোগ পেতে অসুবিধা হল  না। শুরু হল বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরা। তখন নাটকের দল যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই তাদরে সঙ্গে যেতে হচ্ছে। ফলে শুধু গান গাওয়াই নয় পরিচিতিটাও হচ্ছে। আর  উপরি পাওনা হিসাবে যেটা মনে গেঁথে যাচ্ছে তা হল অভিজ্ঞতা। শতশত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা।

গায়ে কালো কুর্তা। পরনে জিনস। এলো চুলে আলগা মেকআপ। হাতে গিটার। মুখে সবসময় একটা হাসি লেপটে আছে। দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। মিশে যাওয়া যায় নিজের মত করে। আর কথার ফাঁকে ফাঁকে টুক টাক গান তো আছেই। এহেন নীপবীথি একটা কথা মেনে নিলেন। স্বামী পুত্রের সংসারে আর পাঁচটা গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের মত তাঁকে অতটা সময় দিতে হয় না। ছেলে ছোট। তার মায়ের প্রতি একটা দাবি থেকেই যায়। মা তার সঙ্গে থেকে যাক, এমন আবদার করাটা তার দিক থেকে কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। নীপবীথির মতে তাঁর ছেলে কিন্তু সব বোঝে। সে জানে মা তার জন্যই বাইরে যাচ্ছে। কাজ করছে। তাই সেও অ্যাডজাস্ট করে নেয়।

আজকাল আর বড় একটা জিঙ্গল গান না। তবে একটা সময় পকেট মানির জন্য চুটিয়ে জিঙ্গল গেয়েছেন তিনি। কথার ফাঁকেই স্বীকার করে নিলেন হালফিলের বাংলা গনের জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম নীপবীথি ঘোষ। বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া কোনও ভাষা বাদ ছিলনা। কোনও বাছ-বিচার ছিল না। জিঙ্গল পেলেই হল। সামান্য সময়। তার মধ্যেই সুরের কেরামতি, প্রয়োজন মত ইমোশন, ড্রামা। সেটাকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, মজাও ছিল। তখন ব্রিটানিয়া থেকে স্যালিকল। হাসতে হাসতে বললেন, ‘সে সময়ে কিছুই বাদ দিই নি’।

জিঙ্গলে তখন নীপবীথি নামটা এতটাই সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল যে সীমানা পারে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল গাইতেও তাঁর ডাক পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের জিঙ্গলের আবার একটা সুবিধের দিক আছে। ওগুলোর বরাদ্দ সময়ও বেশি থাকে। কথাও বেশি থাকে। বেশ একটা গল্পের মত। ফলে অতটা তাড়াহুড়ো নেই। গুছিয়ে একটা গান গাওয়া যায়।

টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা। অ্যাংকর হিসাবে কাজ করা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নীপবীথি নামটাকে সাধারণের মুখে মুখে পৌঁছে দিয়েছিল। একথা নিজেই স্বীকার করে নিলেন নীপবীথি। ডিডি বাংলায় তখন মেগা সিরিয়াল হিসাবে ‘রূপকথা’-র খুব নামডাক। সেই ‘রূপকথা’-র বিখ্যাত টাইটেল সং ‘পৃথিবী সবার ভাল হোক’ নীপবীথিকে অন্য একটা জায়গায় তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই শুরু অন্য এক পথ চলা। জিঙ্গলের দুনিয়ার বাইরে গানের দুনিয়ায় সরাসরি পা রাখলেন নীপবীথি। এল তাঁর নতুন গানের অ্যালবাম ‘আমার বাড়ি।’ নিজের কথা ও সুরে সেই অ্যালবাম বাজারে আসতেই নজর কাড়ল। তারপর সত্যি বলতে কি কোনও দিন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

আজকাল দুর্গাপুজো মানেই অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে কাটাতে হয় তাঁকে। কখনও দিল্লি তো কখনও মুম্বই। তবে প্রতি বছর দিল্লিটা বাঁধা। শুধু দিল্লিতেই এক হাজারের ওপর পুজো হয়। ফলে বিরাট স্পেস। গান গাওয়ার জন্য অনেকেই ডাকেন। যেতেও হয়। স্টেজ শো করতে হয়। আর এই স্পেসটা আছে বলেই তাঁর সমকালীন বহু শিল্পী থাকা সত্ত্বেও কারো সঙ্গে কারো লড়াই নেই। অন্তত এমনই দাবি করলেন নীপবীথি।

সাক্ষাৎকারের শেষটা হয়েছিল অবশ্যই গান দিয়ে। তবে তার আগে একটা কঠোর বাস্তব স্পষ্ট করে দিলেন বাংলার এই তরুণী কণ্ঠশিল্পী। সিরিয়াল আর পাবলিক প্রোগ্রাম। প্রধানত এই দুয়ের উপর ভরসা করেই তাঁদের বাজার। তাঁদের কেরিয়ার। অন্তত তাঁর সমকালীন অধিকাংশ শিল্পীর। তাই ওদুটো যতদিন আছে তাঁদেরও মানুষ মাথায় তুলে রাখবেন। তাঁরাও ভেসে থাকবেন গানের জগতে। এরপর যদি মুম্বইতে প্লে ব্যাকে চান্স পান তাহলে তো কথাই নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *