Celeb Talk

জানি খারাপ হব, তবুও!

বাংলার দলগুলোতে বাঙালি ছেলেরা কোথায়? আমাদের সময় কলকাতার তিনটে দলেই বাঙালি ফুটবলার ভর্তি ছিল। এখন দলগুলোর দিকে চেয়ে দেখুন, বাঙালি ফুটবলার খুঁজেই পাবেন না।

ভারতীয় ফুটবলকে একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। এক, উন্নত পরিকাঠামো, দুই উন্নত পরিকাঠামো এবং তিন উন্নত পরিকাঠামো। এছাড়া ভারতীয় ফুটলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় ৫০ মিনিট অনর্গল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বকবক করার পর যে সারবত্তাটা বেরিয়ে এসেছিল, সেটা এটাই। অবশ্যই বুঝতে পারছেন, যিনি এসব কথা বলতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই ভারতীয় ফুটবলের এক পরিচিত নাম। তিনি অলোক মুখোপাধ্যায়। আশির দশকে বাংলার মাঠ কাঁপিয়েছেন। নিজের সময়ে বেশ কয়েকবার দেশের সেরা ফুটবলারের খেতাব তাঁর পকেটে। শুধু ক্লাব ফুটবল নয়, দেশের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাঁর খেলা এখনও মানুষ মনে রেখেছেন। আর মাঠ ছাড়ার পর কোচ হিসাবেও ‌যাঁর সাফল্যের খতিয়ান নতুন করে বাংলার ফুটবল মোদী মানুষজনকে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই।

ইছাপুরের ছেলে। ইছাপুরের নির্ভীক সংঘ ক্লাবে খেলা শুরু। এরপর জেলা স্তরে খেলার জন্য যান শ্যামনগরে। ডিসট্রিক্ট খেলতে খেলতেই চোখে পড়ে যান অনেকের। তাঁদের কয়েকজন কিশোর অলোককে কলকাতায় ট্রায়াল দিতে আসতে বলেন। আরও ভাল লেভেলে খেলার জন্য ইছাপুর থেকে ট্রেনে চেপে বসলেন তিনি। সোজা হাজির হলেন কলকাতার অরোরা ক্লাবে। সেখানে ট্রায়াল হল। তাঁর স্কিল দেখে অভিভূত বিচারকরা তাঁকে ডেকে বলেন ফার্স্ট ডিভিশনে তাঁর চেয়েও অনেক খারাপ খেলে এখন ছেলেরা চুটিয়ে খেলছে। সেখানে সে কেন পিছিয়ে আছে? বিচারকদের সুপরামর্শে ইস্টার্ন রেলে ট্রায়াল দেন। ১৫০ জন তাঁর সঙ্গে তখন রেলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন। বিচারের দায়িত্বে ছিলেন তখন কলকাতা মাঠের সুপরিচিত নাম বাঘা সোম, তাপস সোম। অলোক মুখোপাধ্যায়ের পায়ের কাজে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে যান। ১৫০ জনের মধ্যে মাত্র দু‍জন ওই ট্রায়ালে পাস করেন। তারমধ্যে একজন ছিলেন অলোক মুখোপাধ্যায়। এরপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখান থেকেই সন্তোষ ট্রফিতে চান্স পেয়ে যান তিনি। আর সন্তোষ ট্রফিতে সুযোগ পাওয়ার সুবাদে জুটে যায় পিকে ব্যানার্জির কোচিং-এ প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ।

ইস্টার্ন রেল থেকে অলোক মুখোপাধ্যায় সরাসরি সুযোগ পান মহামেডানে। আশির দশকের শুরুতে। তখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান, তিনটে দলই ভারত কাঁপাচ্ছে। ফলে মহামেডানে সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের চাকা আরও ঘুরিয়ে দিল। মহামেডানে খেলাকালীনই ভারতীয় দলের নির্বাচকরা তাঁকে ডেকে নেন। ফলে ১৯৮২ সালের এশিয়াডে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে যান অলোক মুখোপাধ্যায়। তখন তাঁর ফর্মও তুঙ্গে। ওই বছরই ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার হন তিনি। যদিও ভারতীয় দলে জায়গা পাওয়াটা তাঁর কাছে বেস নাটকীয়। সেবার ভারতীয় দল নির্বাচনের জন্য বম্বেতে ট্রায়াল হয়। সেই ট্রায়ালে যে কোনও কারণেই হোক প্রথম তালিকায় জায়গা পাননি তিনি। ‘পরে পিকে ব্যানার্জী, বাসারদা আর কুট্টির চেষ্টায় আমাকে আলাদা করে দলে ডেকে নেওয়া হয়’, বললেন অলোকবাবু। ১৯৮১ সালে ভারতীয় দলে জায়গা হয়। সে বছরই ভারতের হয়ে প্রথম ভারতের বাইরে খেলার সুযোগ পান তিনি। দুবাইয়ের সেই ম্যাচটা সে অর্থে অবশ্যই তাঁর কাছে স্মরণীয়। কারণ সেই প্রথম দেশের হয়ে দেশের বাইরে ফুটবল খেললেন কলকাতা মাঠের অতি চেনা নাম অলোক মুখোপাধ্যায়।

তবে খেলার জন্য পড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। অকপটে সেকথা স্বীকার করলেন অলোকবাবু। বারো ক্লাসে পড়তে সন্তোষ ট্রফিতে জায়গা পেয়ে যান। ফলে তখন ওই লেভেলে খেলা এবং পড়া সমান তালে চালানো অসম্ভব ছিল। তবু পাস করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। তবে ভাল রেজাল্ট যাকে বলে তা করে ওঠা হয়নি। যদিও একটা ব্যাপারে ভাগ্যবান অলোকবাবু। সে সময়ে অনেক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই পড়া উপেক্ষা করে খেলবেন, তা বাড়ি থেকে মেনে নিতে পারত না। কিন্তু অলোকবাবুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হয়েছিল। বাবা রেলে চাকরি করতেন। যখন প্রথম ইস্টার্ন রেলে ট্রায়াল দিতে আসেন তখন বাবাই তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে বাড়ির সাপোর্ট পেতে কখনই অসুবিধা হয়নি তাঁর। এটা অবশ্যই একজন খেলোয়াড়ের জীবনে একটা বড় প্রাপ্তি। সুবিধাও বটে।

তবে হালফিলের কলকাতা ফুটবল নিয়ে  তাঁর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এখনকার ফুটবল নিয়ে অনেকটা হতাশও তিনি। বললেন, ‘আমাদের সময় কলকাতা বেসড ফুটবল ছিল। এখন সেসব নেই। আমরা বড় বেশি ট্রফি ওরিয়েন্টেড হয়ে গেছি। ক্লাব কর্তারা পিঠ বাঁচানোর লড়াই চালাচ্ছেন। বিদেশ থেকে ফুটবলার এনে ভরিয়ে দিচ্ছেন। বাংলার দলগুলোতে বাঙালি ছেলেরা কোথায় বলুন তো? আমাদের সময় কলকাতার তিনটে দলেই বাঙালি ফুটবলার ভর্তি ছিল। এখন দলগুলোর দিকে চেয়ে দেখুন। বাঙালি ফুটবলার খুঁজেই পাবেন না।’ অলোকবাবুর মুখে চোখে ক্ষোভ। ‘এখন তো ডিসট্রিক্ট খেলাও বন্ধ হয়ে গেছে। আগে এই জেলাগুলো থেকেই বড় বড় ফুটবলার উঠে এসেছে। তখন ডিসট্রিক্ট দেখতে যেতেন ক্লাব কর্তারা। সেখান থেকে প্লেয়ার তুলে আনতেন। এখন সেসব আর হয় না। ডিসট্রিক্ট খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকাতা ফুটবলের একটা বড় ব্যর্থতা। তার ওপর নেই পরিকাঠামো। না সরকারের নজর আছে। না আছে ক্লাবগুলোর। টাকাও সেই অর্থে নেই। কলকাতায় কটা ফুটবল অ্যাকাডেমি আছে বলুন তো? ভাল ফুটবলার তুলতে গেলে তো এসব অ্যাকাডেমিতে ভাল প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে। সেসব কোথায়? গোয়ায় তবু আছে। অ্যাকাডেমি আছে। খেলোয়াড় তোলার চেষ্টা আছে। পরিকাঠোমোও কিছুটা তৈরি করেছে। কিন্তু কলকাতায় নেই। আরও কি জানেন, আপনি গোয়ায় যান, দেখবেন ওখানকার ক্লাবগুলো চায় না কোনও বাঙালি ফুটবলার ওখানে খেলুক। অথচ দেখুন কলকাতার দলগুলোয় কিন্তু অবারিত দ্বার। বিদেশি তো আছেই, এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তেরও খেলোয়াড়েই ভর্তি  ক্লাবগুলো। মোট কথা পরিকাঠামো দরকার। আমাদের প্লেয়ার আছে। কিন্তু তাদের তুলে আনার কোনও সিস্টেম নেই। প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুবন্দোবস্ত নেই। দেশের ফুটবলকে এশিয়া লেভেলেও যদি ভাল করতে হয় তাহলে তৃণমূল স্তর থেকে খেলোয়াড় তুলে আনতে হবে। আর তার জন্য ভাল অফিসিয়াল দরকার, ধান্দাবাজ নয়। ক্লাব কর্তাদের আরও দায়িত্ব নিতে হবে। নাহলে শুধু বাংলার ফুটবলই নয়, ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতও অন্ধকার। এই লেভেলের ফুটবল খেলে এশিয়া স্তরেও কিচ্ছু হবে না’।

বিদেশি কোচ আনা নিয়েও অলোক মুখোপাধ্যায় ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। বিদেশি কোচ আনার তিনি ঘোর বিরুদ্ধে। তাঁর মতে এখনও পিকে, আমল দত্তর তুলনা হয়না। বিদেশি কোচেরা এদেশের জলহাওয়া বোঝে না, খাদ্যাভ্যাস বোঝে না, খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাদের কথা বার্তার একটা সমস্যা থাকে। তারা এদেশের খেলোয়াড়দের ভাষা বোঝে না। খেলোয়াড়েরা কোচের ভাষা বোঝে না। অলোকবাবুর সাফ কথা ‘হাউটনের মত কোচ রেজাল্ট দিতে পারেনি, তো অন্য কোচেরা কি করবে?’

বিদেশ থেকে কোচ আনা হয়, অথচ তাঁকে কোচিং করতে দেওয়া হয়না, অলোকবাবুর কথাতেই স্পষ্ট যে ময়দানের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। আর তা নিয়ে তাঁর মধ্যে অনেক ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। সাফ বললেন, ‘এখনও কিছু ভাল প্লেয়ার পেলে আমি যে কোনও দলকে ভাল ফল দিতে পারি। এখানে তো কোচেরাই কোচদের বিরুদ্ধে বলে। আমাকে তো কোচিং করতেই দেওয়া হয়নি। গোয়ায় কিন্তু এসব হয়না। দেখুন গোয়ার ক্লাবগুলো কিন্তু এখন ভাল খেলছে।’ তবে আর সব বিষয়ে ক্ষোভ থাকলেও কোচ পরিবর্তনের ব্যাপারে ক্লাব কর্তাদের খুব একটা দোষারোপে রাজি নন অলোকবাবু। তাঁর মতে, মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল ট্রফি ওরিয়েন্টেড ক্লাব। এদের কোচকে কর্মকর্তারা তাড়ায় না। তাড়ায় এদের সমর্থকেরা। রেজাল্ট না দিতে পারলে সমর্থকদের এমন চাপ তৈরি হয় যে কোচ না বদলে উপায় থাকে না।

আমাকে বিশেষ প্রশ্ন করতে হয়নি। নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভটা সেদিন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম কলকাতা ফুটবলের এই খ্যাতনামা ফুটবলারের। অবসর নেওয়ার এতদিন পর এখনও ‌যাঁর খেলা নিয়ে কথা হয়, তাঁর অসামান্য প্রতিভার তারিফ করতেই হয়। ফুটবলকে তিনি আদ্যপ্রান্ত ভালবাসেন। বেশ বোঝা গেল যতই ক্ষোভ উগড়ে দিন না কেন, কোনও কথাই কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। ফুটবলের সার্বিক উন্নতিই তাঁর লক্ষ। দেশ বিশ্বমানের ফুটবল খেলুক তা তিনি মনে প্রাণে চান।

এমনিতে ফুটবল মাঠে অলোক মুখোপাধ্যায় কোনও কালেই বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন না। কারণ খেলার বাইরে তিনি আর কিছুর সঙ্গেই যুক্ত থাকতেন না। আপাত লাজুক অলোক খোলা শেষ হলেই বাড়ি ফেরা পছন্দ করতেন। মাঠে খেলার বাইরে অযথা সময় তিনি কোনও কালেই কাটাননি। তিনি যে খেলা আর চাকরির বাইরে এখনও বেশ ঘরকুনোই তা অকপটে স্বীকার করলেন অলোকবাবু।

তা আলোক মুখোপাধ্যায়ের মত ফুটবল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলব আর বিশ্ব ফুটবল নিয়ে কোনও কথা হবে না তা কি হয়! বিশ্ব ফুটবলে এক কথায় মেসি ভক্ত তিনি। এমনকি তাঁর মতে মেসি যেভাবে এগোচ্ছে, বা ওর পায়ে যা কাজ আছে তাতে ও যে কোনও দিন মারাদোনাকে ছাপিয়ে যাবে! অলোকবাবুর মতে, মারাদোনার চেহারা ছিল। মেসির তা নেই। কিন্তু ওর স্কিল চোখে পড়ার মত। মেসি যখন ছোট তখন তার অনুশীলনও তাঁকে মুগ্ধ করেছিল বলে জানালেন অলোকবাবু। তবে বিশ্ব ফুটবলের আদিঅনন্ত তর্কটা সুকৌশলেই এড়িয়ে গেলেন বাংলা ফুটবলের এই মহাতারকা। মারাদোনা না পেলে, কে শ্রেষ্ঠ? আপনার কি মনে হয়? প্রশ্নটা করতেই একটু নড়েচড়ে বসে অলোকবাবুর কৌশলী উত্তর, ‘এভাবে বলা যায় না! মারাদোনার সময় ও সেরা, পেলের সময় ও সেরা। দু’জনে তো এক সময়ে খেলেইনি। এভাবে কে সেরা কখনও বলা যায়?’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *