Celeb Talk

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস

বাংলা সংস্কৃতিচর্চার জগতের অন্যতম নক্ষত্র জগন্নাথ বসু। ‌যাঁকে নতুন করে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করাতে যাওয়া মানে পাঠককুলকে অপমান করা।

‘তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। দারুণ ছুটতাম। বেঙ্গল মিট হবে। উত্তর কলকাতা থেকে নির্বাচিত হলাম আমি। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হয়ে ছিটকে যাই। আমি কখনও কিছুতে সেকেন্ড হইনি। কিন্তু সেদিনের সেই পরাজয়ের গ্লানি আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। তখন দৌড় আর কবিতাই ছিল আমার প্রাণ। তাই দৌড়ের ব্যর্থতা ভুলতে কবিতাকে আঁকড়ে ধরলাম। সেই যে আঁকড়েছিলাম, আজও তা ধরে আছি। তারপর থেকে আমি আর কোনও দিন দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিইনি। ক্রীড়া জগত থেকেই অনেক দূরে চলে গেলাম। হয়তো আমার ভাগ্যই আমাকে ওই পরাজয় দিয়ে সংস্কৃতি জগতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল। আর কি জানো, খেলাধুলো তুমি একটা বয়স পর্যন্ত করতে পারবে। কিন্তু সংস্কৃতি জগতে অনেক বেশিদিন থাকা যায়। নিজের পছন্দের কাজটা অনেকদিন ধরে করা যায়।’ বাংলা সংস্কৃতিচর্চার জগতের এক অন্যতম নক্ষত্র জগন্নাথ বসুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। ‌যাঁকে নতুন করে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করাতে যাওয়া মানে পাঠককুলকে অপমান করা। তাই সেই রাস্তায় না হেঁটে সরাসরি জগন্নাথ বসুর অচেনা জীবনটাকে আপনাদের চেনানোর কাজে মন দিলাম।

‘স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম। দারুণ খেলতাম। দৌড় ছিল আমার প্রাণ। আর ছিল কবিতা। মনে আছে, ছোটবেলায় মেঘলা দুপুরে একাকী জানালার দিকে চেয়ে থাকলে রবীন্দ্রনাথ আমায় টানতেন। নিঃশব্দ মুহুর্তে আমি ডুব দিতাম কবিতার সমুদ্রে। আসলে আমার বাড়িতে একটা সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল। আমার কাকা ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা প্রেমাংশু বসু। ঠাকুরদা ছিলেন পেশাদারী নাটকের নাট্যকার। তাঁর লেখা বহু নাটক মঞ্চ কাঁপিয়েছে। তবু আমি নাটক, কবিতায় আসি তা বাড়ির লোকের পছন্দ ছিলনা। এসব করেও তখন ভাল রোজগার করা যায় একথা কেউ ভাবতে পারতেন না। ফলে প্রথম জীবনে বাড়ির সাপোর্ট পাইনি। একরকম নিজের উদ্যমেই রেডিও-তে অডিশন দিই। এক চান্সে পাসও করে যাই। রেডিওতে প্রথম দু’তিনটি নাটক করার পরই চোখে পড়ে যাই। তখন খুব রোগা ছিলাম। সাদামাটা চেহারা। কিন্তু গলা আমায় চোখে পড়িয়ে দিয়েছিল।’ বললেন হালফিলে শ্রুতি নাটক বা আবৃত্তি জগতে বাংলার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র জগন্নাথ বসু।

আকাশবাণীর নাট্য প্রতিযোগিতায় সেসময়ে পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার জেতেন তিনি। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে লড়াই করতে হয়েছিল। কারণ সেই সময়ে তাঁর সমসাময়িক ‌যাঁরা ছিলেন তাঁরা জগন্নাথবাবুর সাফল্যকে হিংসা করতে শুরু করেন। এক সময়ে শুরু করেও কেউ তাঁদের টপকে অনেক দূর এগিয়ে যাবে, এটা তাঁরা ভাল চোখে নিতে পারছিলেন না। একবার নয়, সেই ঈর্ষার শিকার তাঁকে বারবার হতে হয়েছে বলে জানালেন জগন্নাথবাবু। তবে প্রতিভাকে কোনও ঈর্ষাই চেপে রাখতে পারে না। ফলে তাঁর সাফল্যের বিজয়রথও কোনও ঈর্ষাই থামাতে পারেনি।

কথায় কথায় স্ত্রী ঊর্মিমালার কথা উঠতে একটু নড়েচড়ে বসলেন জগন্নাথ বসু। প্রথমেই স্বীকার করে নিলেন স্ত্রীর অসামান্য প্রতিভার কথা। এও স্বীকার করলেন যে আরও আগেই ঊর্মিমালা এই জগতে আসতে পারতেন। কিন্তু পরিবার। ছেলে-মেয়ের বড় হওয়া। এসব সামলাতে সামলাতে একটু দেরিতেই এই জগতে প্রবেশ করেন তিনি। তবে তিনি এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে এসেই বাজিমাত করতে তাঁর সময় লাগেনি, অকপটে স্বীকার করলেন জগন্নাথবাবু।

তা স্ত্রীর কথাই যখন উঠল তখন বিয়ের কথাটা এসেই পড়ে। জিজ্ঞেস করলাম আপনার বিয়েটা কিভাবে হল? সহজ প্রশ্নে একটু হেসেই উঠলেন জগন্নাথ বসু। তারপর বেশ রসিক কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি তখন রেডিওতে শ্রোতাদের চিঠির উত্তর দিই। রেডিওতে আমাকে সব ধরণের কাজই করতে হত। গান ছাড়া খুব কম জায়গাই আছে যেখানে আমি কাজ করিনি। এমনকি ক্রীড়াজগতেরও বেশ কিছু সাক্ষাৎকার আমায় নিতে হয়েছিল। ‌যাইহোক, সেই চিঠির উত্তর দেওয়ার সময় অনেক চিঠি আসত। উত্তর দিতাম। ঊর্মি তখন প্রায়শই চিঠি লিখত। ওর কালো কালিতে সুন্দর করে লেখা চিঠিগুলো পড়ে আমার ভীষণ ভাল লাগতো। তা একদিন ছলছুতো করে ওর বাড়িতে দেখা করতে যাই। সেই শুরু। তখন আমাদের সম্পর্কটা আমাদের দুটো বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারেননি। আমার বাড়িতে তো আপত্তি ছিলই। ঊর্মির বাড়িতে আরও বেশি ছিল। ফলে আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছিল অনেকটা বীর রাজপুত্রের মত। একরকম ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে রাজকন্যাকে হরণ করে বিয়ে করার মত। আমায় জীবনটাই সংগ্রাম। আমায় জীবনে সব কিছুই লড়ে নিতে হয়েছে। বিয়েতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর জানো তো, আমি কিন্তু খুব পাকা ছিলাম। খুব কমবয়সেই বিয়ে করি।’ বেশ রসিকতার ছলেই বললেন বাংলার বাচিক শিল্প জগতের মহাতারকা জগন্নাথ বসু।

নিজের কথা অকপটে এর আগেও অনেকে বলেছেন। তবে কথা বলতে বলতে জগন্নাথবাবু সেদিন আরও যা বললেন তাতে একটা প্রাণখোলা মানুষ হিসাবে তাঁর তারিফ না করে পারলাম না। বলে চললেন জগন্নাথবাবু। ‘স্কুল জীবনে খেলাধুলো নিয়েই মেতে থেকেছি। তখন অত মেয়েদের দিকে তাকাতাম না। তবে কলেজ জীবনে মেয়েদের দিকে তাকানোর অভ্যেস ছিল বৈকি। কলেজ লাইফে বেশ একটা প্রেম প্রেম ব্যাপার এল। স্কটিশ কলেজে পড়তাম। কো-এড কলেজ। চারদিকে সুন্দরীরা ঘুরছে। আমার একটা মেয়েকে ভাল লাগতেই পারে। পরে রেডিওর জীবনেও প্রচুর প্রেমপত্র পেয়েছি। আসলে প্রেমের অভিনয় করতাম। গলাটা সকলে শুনতে পেত। অনেকেই রেডিওতে গলা শুনে প্রেমে পড়েছে। একবার রাণাঘাটের একটি মেয়ে আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে খুব আশাহত হয়েছিল। আময় এসে বলেছিল, ‘আচ্ছা আপনি এত বড় কেন’? মানে ওর মনে হয়েছিল আমি বেশ ইয়ং হব। ব্যাচেলর। কিন্তু তা না হওয়ায় ও খুব ভেঙে পড়েছিল। এমন কত অফার পেয়েছি। আমি মনে করি, অবসরে আমার একটি মেয়েকে ভাল লাগতেই পারে। তার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করতেই পারে। তবে তা কাজে ফাঁকি দিয়ে নয়। সেসময়ে আকাশবাণীতে আমি সোনালি দিন কাটিয়েছি। তবে এমন মনে কোর না যে আমি শুধু মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেই ভালবাসতাম। যা বললাম সবই জীবনের কিছু অবসর মাত্র। নিজের কাজ করেছি মনপ্রাণ ঢেলে। পড়াশোনা করেছি। নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। বিদেশে গেছি। সেখানকার নাটক দেখেছি। তা নিয়ে চর্চা করেছি। এখানে ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছি। এখনও আমার হাতে সময় খুব কম। তবে যা করি মনপ্রাণ ঢেলে করি। তা না হলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।’ হাসতে হাসতেই বললেন জগন্নাথ বসু।

আজকাল ‌যাঁরা বাচিক শিল্পী হতে আসছেন তাঁদের নিয়ে কিছুটা হলেও হতাশ জগন্নাথবাবু। তাঁদের অনেকের গলা থাকলেও বড় চটজলদি সবকিছু পেতে চায়। লেগে থেকে সাফল্য ছোঁয়ার চেষ্টা বড়ই কম। কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছনোর ধৈর্যের বড়ই অভাব বলে জানালেন জগন্নাথবাবু। তাঁর মতে, আবৃত্তিশিল্পী হতে গেলে গলা দরকার, দরকার ভাল উচ্চারণ, মান্য ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন ছন্দ বোধ, কবিতার ভাবকে বোঝার ক্ষমতা। সেইসঙ্গে অনুশীলন মিশলে তবেই সাফল্যের শিখর ছোঁয়া যায় বলে বিশ্বাস করেন তিনি। আবৃত্তির ক্যাসেটের চাহিদার কম হওয়ার কথা উঠতে নিজেই বললেন, ‘বলুন তো ব্রততীকে ক্যাসেট বিক্রি নিয়ে ভাবতে হয়?  ওর একক অনুষ্ঠান দেখার লোকের সংখ্যা কম? প্রতিভা থাকলে আপনাকে সবাই শুনবে’।

মায়ের বড় ছেলে। ফলে খুবই আদরের। রান্নার দিকে যেতে হয়নি কখনও। স্ত্রীর হাতে হাতে যে কিছু করে দেবেন তা তাঁর ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠেনি, স্বীকার করলেন জগন্নাথবাবু। বিদেশে গিয়ে একবার এক মহিলার বাড়িতে গেছেন। তা সেই মহিলা একদিন সকালে একটা অমলেট বানাতে বললেন জগন্নাথবাবুকে। সেই অপ্রস্তুত অবস্থার কথা আজও ভুলতে পারেননি জগন্নাথবাবু। হাসতে হাসতে বললেন, ‘খুব ইচ্ছে ছিল একটা সকালে স্ত্রীকে দুটো টোস্ট, একটা অমলেট আর চা করে খাওয়াবো। কিন্তু সে ইচ্ছা আজও পূরণ করতে পারিনি। আজকালকার দিন হলে তো আমার বিয়েই হতনা! চিরকুমার থেকে যেতাম’।

বেড়াতে যাওয়ার সময় বড় একটা হয়না। তাই কোথাও শো করতে গেলে সেখানকার চারপাশ একটু ঘুরে নেন তিনি। ওটাই তাঁর বেড়ানো। পাহাড়ের চেয়ে সমুদ্র ঢের বেশি পছন্দের। অভিনয় করেছেন সিনেমায়। এগারো সিনেমায় এক জমিদারের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে। সাফল্যের শিখর ছোঁয়া এই মানুষটি নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস। প্রবাদটা সর্বাংশে সত্যি। একসময়ে শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্তর মত দিকপালদের সঙ্গে কাজ করেছি। গলাকে কিভাবে চরিত্রের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় তা তাঁদের কাছেই শেখা। এই সব মানুষের সঙ্গ আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। আর যদি জীবনে কোনোদিন আত্মজীবনী লিখি তাহলে সেই বইয়ের নাম দেব ‘সৎসঙ্গ’।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *