Feature

রামপ্রসাদের গলায় শ্যামাসংগীত শুনে কেঁদে ফেললেন বাংলার নবাব সিরাজ

ভাবতন্ময় মাতৃসাধক রামপ্রসাদ। আপন ভাষায় গাইলেন শ্যামাসংগীত। ভক্তিরসের ভরা জোয়ারে ভাসিয়ে দিলেন নবাব সিরাজের অন্তর, মন।

গভীর রাতে প্রায়ই রামপ্রসাদ উপবিষ্ট হন সিদ্ধাসনে। একান্তে বসে আপন মনে সম্পন্ন করেন শ্যামা মায়ের আরাধনা ও শক্তিসাধনার নিগূঢ় ক্রিয়াদি। কিন্তু কিছুতেই মন ভরে না সাধকের। জগন্মাতার সদাসর্বদা সান্নিধ্যের জন্য অন্তরে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। নিগূঢ় তান্ত্রিক ক্রিয়াদিতে ব্রতী হলেন অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে। পরম নিষ্ঠায় এগিয়ে চলে তাঁর হৃদয়ভেদী শক্তিসাধনা।

প্রথমে বাহ্যিক পঞ্চ-ম-কারযুক্ত বীরভাবের সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন রামপ্রসাদ। কৌলাচারের এই পথ ধরে চললেন প্রায় আট-দশ বছর। তারপর এক সময় উত্তরণ ঘটল তাঁর দিব্যাচারী সাধনার স্তরে।

এই সাধনার সময় রামপ্রসাদ গুরুরূপে বরণ করলেন তৎকালীন এক তন্ত্রাচার্যকে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ও তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁরই সাধনধারার এক সংবাহকের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন ঈশ্বর-অন্বেষী সাধক রামপ্রসাদ।

এরপর দিনের পর দিন শক্তিসাধনার সিদ্ধির স্তরগুলি একের পর এক ভেদ করে চলেছেন শক্তিসাধক রামপ্রসাদ। এবার সাধারণ নিয়মেই একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ল নতুন গুরু তথা নতুন পথপ্রদর্শকের। নিগূঢ় এই শক্তি সাধনার পথে করুণাময়ী কখন পাঠাবেন কোন সিদ্ধমহাত্মা তথা গুরুকে, কে তা বলতে পারে? একেবারেই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন শ্যামা মায়ের বরপুত্র রামপ্রসাদ।

ভক্তের উপরে ভগবানের করুণা আর কাকে বলে! অচিরেই মিলে গেল গুরু। ঈশ্বর প্রেরিত হয়েই আবির্ভাব ঘটল তাঁর জীবনে। একদিন প্রসাদ একলা চলেছেন গঙ্গার ধার দিয়ে শ্যামনগরের পথে। অপ্রত্যাশিতভাবে দর্শন পেলেন এক জটাজূটধারী তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর। দিব্যকান্তি সমুন্নত দেহ। আজানুলম্বিত বাহু। ফালাফালা আয়ত নয়ন। দর্শনমাত্র প্রসাদের মাথাটা শ্রদ্ধায় নত হয়ে গেল সন্ন্যাসীর চরণতলে। দীক্ষা দিলেন সন্ন্যাসী। তারপর সেই মহাপুরুষের নির্দেশেই এ সময় কালীসাধক রামপ্রসাদ সিদ্ধ হলেন শবসাধনায়। অজ্ঞাতনামা এই লৌকিক দীক্ষাগুরুর নাম ও পরিচয় আজও রয়ে গিয়েছে অজ্ঞাত।

শবসাধনার স্থানটি শ্যামনগর ও ইছাপুরের মাঝখানে বড়তির বিলের কাছে। একটি পুরনো শ্মশান ছিল এখানে। সন্ন্যাসী শক্তিধর মহাপুরুষ গুরু এই শ্মশানেই তন্ত্রের নিগূঢ়তম ক্রিয়াগুলি সুনিষ্ঠায় অনুষ্ঠান করান প্রসাদকে দিয়ে।

নিজের বাস্তুভিটের কাছেই নানান গাছগাছালিতে ভরা নির্জন একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। সেখানেই পঞ্চবটীর স্নিগ্ধ নিবিড় শীতল ছায়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পঞ্চমুণ্ডির আসন। তন্ত্রের নিয়মানুসারে আসন প্রতিষ্ঠায় লেগেছিল দু’টি চণ্ডালের মুণ্ড, একটি শিয়ালের, একটি বানরের আর একটি সাপের মুণ্ড।

তন্ত্রমতেই তান্ত্রিকদের মতো পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রস্তুত করে তান্ত্রিক রামপ্রসাদ আত্মনিয়োগ করেছিলেন সাধনায়। এই সময় দিব্যকান্তি ফুটে উঠেছিল প্রসাদের সারা দেহে। ভাববিহ্বল প্রসাদের অধিকাংশ সময়ই অতিবাহিত হতে থাকে মৌনভাবে। দিনের পর দিন তিনি ডুবে থাকেন অধ্যাত্মচেতনার গভীরতর স্তরে। তারপর ধীরে ধীরে অধিষ্ঠিত হলেন শক্তিসাধনার উচ্চতম শিখরে। হালিশহর তথা কুমারহট্টে আপন হাতে স্থাপিত পঞ্চমুণ্ডির সাধন আসনেই এক সময় রামপ্রসাদের সর্বসত্তায় ওতপ্রোত হয়ে যান পরম ব্রহ্মময়ী আরাধ্য দেবী শ্যামা মা।

প্রসাদের আমলে কলকাতার প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলির মধ্যে ছিল বাগবাজারে গোবিন্দ মিত্রের নবরত্ন মন্দির ও সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, চিত্তেশ্বরী মন্দির, কালীঘাট, নিমতলায় মা আনন্দময়ীর মন্দির, ঠনঠনিয়ায় সিদ্ধেশ্বরী কালী। রামপ্রসাদ কলকাতায় এলে বিভিন্ন কালীমন্দিরে শ্যামাসংগীত গাইতেন উদাও কণ্ঠে।

রামপ্রসাদের সমসাময়িক ছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। তিনি ছিলেন কালীভক্ত। রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতেন তিনি। জনশ্রুতি, প্রসাদ সংগীতের একজন অনুরাগী ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তিনিও রামপ্রসাদের সংগীত শুনে মুগ্ধ হতেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

সাধক কবি রামপ্রসাদের গুণমুগ্ধ ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনি প্রকৃত জহুরিও বটে। প্রসাদের প্রকৃত মূল্য বুঝতে তাঁর এতটুকুও দেরি হয়নি। একদিন প্রসাদকে নিয়ে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলেন মহারাজা। আর নৌকাতেই ছিলেন রামপ্রসাদ। নৌকাতেই তাঁর দেহমন ভরে থাকত সুধামাখা কণ্ঠে মাতৃনামের অমৃতধারায়।

একদিন প্রায় সন্ধ্যায় বায়ুসেবনে নৌকায় বেরিয়েছিলেন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এক সময় মহারাজার নৌকার কাছাকাছি আসতেই প্রসাদের পাগলপারা মাতৃসংগীতের সুরলহরি পৌঁছল নবাবের কানে। বিমুগ্ধ নবাব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই নৌকা কার, নৌকায় কে গান গায়, কী তাঁর নাম?’

নবাব সমস্ত পরিচয় পেলেন প্রসাদের। নিজের নৌকায় আহ্বান করে অনুরোধ করলেন গান গাইতে। তাঁর গান যেন জাদুতে ভরা। টেনে এনেছেন স্বয়ং নবাবকে। এবার জগজ্জননী ব্রহ্মময়ীর উদ্দেশে প্রাণের আকুতির অর্ঘ্য ঢেলে একটি গজল আর একটি খেয়াল গাইলেন ফারসি ও হিন্দিতে। এই গান দুটি গাইলেন নবাবের রুচি অনুমান করে, তাঁর কোনও ইচ্ছা বা অনুরোধে নয়।

মন দিয়েই গান শুনলেন। কিন্তু এতটুকুও মন ভরল না। বিরক্তি প্রকাশ করলেন নবাব। বললেন, ‘তোমার নিজস্ব সুর ও ভাব নিয়ে যে শ্যামাসংগীত গাইছিলে, যা স্পর্শ করেছে হৃদয় মনকে, তুমি তোমার সেই আবেগভরা নিজের গানই গাও প্রসাদ, সেই অন্তরস্পর্শী গানই আজ শুনতে চাই আমি।’

ভাবতন্ময় মাতৃসাধক রামপ্রসাদ। এবার আপন ভাষায় গাইলেন শ্যামাসংগীত। ভক্তিরসের ভরা জোয়ারে ভাসিয়ে দিলেন নবাব সিরাজের অন্তর, মন। প্রসাদের সুধাধারায় নবাবের মন ভরে উঠল এক অনাস্বাদিত পরিতৃপ্তিতে, দু-চোখ বেয়ে নেমে এল পারমার্থিক প্রেমের অশ্রুধারা।

পরিতৃপ্ত নবাব আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সাধুবাদ জানালেন প্রসাদকে। এতেই তৃপ্ত হলেন না তিনি। প্রস্তাব দিলেন, উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাঁকে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তাঁর এ প্রস্তাব মুহুর্তে হেলায় প্রত্যাখ্যান করলেন শ্যামাবলে বলীয়ান সাধক রামপ্রসাদ সেন।

মাতৃসাধক রামপ্রসাদ তাঁর জীবনে প্রথম প্রার্থনা সংগীত রচনে করেন, ‘আমায় দেও মা তবিলদারী।’ ভক্তের আকুল আকুতিভরা সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন ব্রহ্মময়ী, আর এই বিপুল বিশাল ঐশ্বর্য অকৃপণ করে প্রসাদ বিলিয়ে দিয়েছেন বাংলার ঘরে ঘরে। একই সঙ্গে শক্তিসাধনার ঊষর পথকে তিনি সিঞ্চিত করেছেন সুধামাখা করুণাময়ী কালীনামের অমৃতধারায়।

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার অন্তর্গত আমডাঙা করুণাময়ী কালীর জন্য সুখ্যাত। দেবী করুণাময়ী পঞ্চমুণ্ডির আসনে দোতলায় প্রতিষ্ঠিত। উচ্চতায় আন্দাজ ফুট দুয়েক। পাথরের বেদিতে শুয়ে আছেন মহাদেব। তাঁরই বক্ষোপরি সুদর্শনা করুণাময়ী। সালংকারা দেবীর করুণাঘন ত্রিনয়ন সবসনা।

মন্দিরের একতলায় ১৯৮টি নারায়ণ শিলার উপরে পাথরে নির্মিত রত্নবেদি। রামপ্রসাদ মাঝেমধ্যেই হালিশহর থেকে আমডাঙায় আসতেন রত্নবেদি ও করুণাময়ীর চরণদর্শনে।

সহায়ক গ্রন্থ : সাধক কবি রামপ্রসাদ – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ভারতের সাধক – শঙ্করনাথ রায়, দেবালয়ে দেবালয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ – দেবব্রত বসু রায়, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস – সত্যচরণ মিত্র, কথামৃত – শ্রীম, শ্রীশ্রীসুবোধানন্দের জীবনী ও পত্র (শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা), বরানগর আলমবাজার মঠ – রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, লীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব, উত্তরার্ধ। এছাড়াও সাহায্য নিয়েছি আরও অসংখ্য গ্রন্থের। সব গ্রন্থ ও লেখকের নাম লেখা হল না। কৃতজ্ঞ লেখক ক্ষমাপ্রার্থী। — শিবশংকর ভারতী

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *