Mythology

ভাঙা সংসার জোড়ার উপায় জানালেন বৃদ্ধ সাধুবাবা

সন্তানের সঙ্গে বাবা মায়ের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, কারও সঙ্গে কারও আন্তরিকভাবে মানসিক যোগাযোগ নেই। সাধুবাবার বলা কথায় জোড়া লাগবে সব সম্পর্ক।

একদিন রাত তখন পৌনে নটা। বসে আছি দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িতে। দেখি এক বৃদ্ধ সাধুবাবা তাঁর ঝোলাটা রাখলেন ঘাটের এক পাশে। আমার থেকে সামান্য দূরে। তারপর একটা গামছা পরে নেমে গেলেন ঘাটে। স্নান সেরে এসে তাঁর আসন পাতলেন যেখানে ঝোলাটা রেখেছিলেন। এবার ছোট্ট একটা আয়না বের করে তিলক আঁকলেন কপালে, পরে সর্বাঙ্গে। তারপর বসে রইলেন স্থিরভাবে।

এই সাধুবাবার মাথায় কোনও জটা নেই। এলোমেলো চুল কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বয়স অনুসারে যেমন শীর্ণ চেহারা হয় তেমনই। ৭০/৭৫ এর কম হবে না। গায়ের রং ময়লা। ভাঙা গালে মুখের হনুদুটো বেরিয়ে পড়েছে। নাকটা টিকালো। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, আজ পর্যন্ত যত সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে, তাঁদের কারও নাকই খাঁদা আর চো‌খদুটো কুতকুতে শয়তানি চোখ না। প্রায় প্রত্যেকেরই চোখদুটো হয় মাঝারি, নইলে ফালাফালা। তাকালে চোখের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। বেশ চওড়া কপাল। ঘাটের আলোতে সাধুবাবার সুন্দর চোখ আর নাকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার চোখে। বসে আছেন নিজের আসনে। আমিও বসে আছি সামান্য দূরত্বে। দেখেছি যাত্রীদের আনাগোনা। আর আপন মনেই ভাবছি গঙ্গার কথা, যে গঙ্গাকে দেখেছি গঙ্গোত্রী গোমুখে, কাশীতেও দেখছি সেই বয়ে আসা গঙ্গাকে। হিমালয়ের বুকে গঙ্গার এক রূপ, আর কাশীগঙ্গার রূপ আর এক। ভরা যুবতী, উত্তরযৌবনা।

সাধুবাবাকে দেখে আমার ভাল লেগেছে কিন্তু ইচ্ছে করেই যাচ্ছি না। দেখলাম রাত সোয়া নটা। হোটেলে ফিরতে হবে। অনেকটা সময় কেটে যাবে কথা বলতে গেলে। হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এসব ভেবেই যাচ্ছি না, তবে মনটা আমার ছটফট করছে। অন্য কিছু ভাবলেও সাধুবাবা ঢুকে বসে আছে মাথার মধ্যে। তাই মাঝেমাঝে ওইদিকে তাকাচ্ছি আবার চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। দেখছি, চোখ বুজেই বসে আছেন তিনি। এইভাবে কেটে গেল প্রায় আরও কুড়ি মিনিট। এবার আমি উঠলাম। চোখদুটো কিন্তু সাধুবাবার দিকেই আছে।

উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন টের পেলেন। চোখদুটো খুললেন। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হতে প্রশান্তমুখে বললেন,

– ক্যায়সা হ্যায় বেটা?

কথা এইটুকু অথচ এমন আন্তরিকতার সুর যেন কতকালের পরিচয় রয়েছে আমার সঙ্গে। মোহিত হয়ে গেলাম সাধুবাবার বাচনভঙ্গি আর কণ্ঠস্বরে। এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,

– ম্যায় আনন্দ মে হুঁ বাবা।

কথাটা শুনে সাধুবাবা হাসতে হাসতে মাথাটা দোলাতে লাগলেন। তারপরই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রশ্নটা শুনে বসে পড়তে হল আমাকে। তিনি বললেন,

– তা ভাল বেটা, সংসারে এসেছিল, আনন্দে থাকাটাই তো বড় কথা। কজনা থাকে। ইয়ে তো বহুত বডিয়া বাত হ্যায়। লেকিন এক বাত হ্যায় বেটা, ইয়ে আনন্দ তেরা ইন্দ্রিয়ানন্দ হ্যায়, না ব্রহ্মানন্দ?

কথাটা শুনে বুঝে গেলাম এই সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলে বেশ মজা পাওয়া যাবে। জানা যাবে অনেক কথা। রাতে আর‌ হোটেলে ফিরব না, এটা মনে মনেই ঠিক করেই নিলাম।

Varanasi

খুব কঠিন প্রশ্ন। আমার যে আনন্দ সেটা ইন্দ্রিয়ানন্দ বা ব্রহ্মানন্দ, তা জানব কেমন করে? আর এসব তো কখনও ভেবে দেখেনি। প্রকৃত উত্তরও আমার জানা নেই। তবুও উল্টে প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, ইন্দ্রিয়ের আনন্দ তাৎক্ষণিক। যতক্ষণ ভোগ ততক্ষণই তো আনন্দ। তারপরে আর আনন্দ কোথায়?

হেসেই বললেন সাধুবাবা,

– ওইখানেই তো ভুল হয়ে গেল বেটা। ইন্দ্রিয়ের আনন্দ তাৎক্ষণিক হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তার আনন্দ সুদূরপ্রসারী। মানুষ ব্রহ্মানন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জন্মান্তরের সুকৃতি, সদগুরুর আশ্রয়লাভ আর প্রবল সাধনবলে। এখন বল তো দেখি বেটা, তোর আনন্দটা কিসের?

কথাটা ঠিকমতো বুঝতে না পেরে বললাম,

– বাবা, আপনার কথার ভাব বা উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিস্কার হচ্ছে না। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলুন।

বেশ খুশিখুশি ভাব নিয়ে বললেন,

– বাবা, যেমন ধর কোনও একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে মনে খুব আনন্দ হল। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই আনন্দের স্মৃতি ইন্দ্রিয়ে যতক্ষণ, যতদিন থাকবে, জানবি আনন্দও থাকবে ততক্ষণ, ততদিন বা তত বছর পর্যন্ত।

এই পর্যন্ত বলে চুপ করে রইলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। দশাশ্বমেধ ঘাট বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। সাধুবাবা বললেন,

– এটাই শেষ কথা নয় বেটা, পূর্বজন্মের কোনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দের স্মৃতি বা সংস্কার নিয়ে যদি কারও আত্মা জন্মগ্রহণ করে তাহলে তার রেশ এই জন্মে তাকে অজ্ঞাতে অজান্তে আনন্দ দিতে পারে, দেবেও। আবার এ জন্মের যে কোনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দের স্মৃতি যদি কারও সংস্কারে বিন্দুমাত্র থেকে যায়, তাহলে তা পরজন্মে অজান্তে তাকে আনন্দ দেবে। তবে ইন্দ্রিয়ানন্দের আনন্দে মাঝেমধ্যে ভাঁটা পড়ে। ব্রহ্মানন্দের বেলায় ও কথা খাটে না। একেবারে ডুবিয়ে দেয় মহানন্দসাগরে। তফাৎটা এখানেই, বুঝলি বেটা। সংসারে অনেককে দেখবি, প্রায়ই সে বেশ মানসিক আনন্দে আছে। এটা কয়েক ঘণ্টা বা মাত্র কয়েকটা দিন চলে। আবার দেখলি, সে আনন্দ কোথায় ছুটে গেছে। মানসিক দিক থেকে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। এতে বুঝবি ওটা তার ইন্দ্রিয়ের আনন্দ।

এবার বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা পঁচিশ। হোটেলের দরজা বন্ধ হয় রাত দশটায়। সাধুবাবা আমার মুখের দিকে একবার তাকালেন। ভাবটা বুঝে বললেন,

– ঘরে যাবি না বেটা?

একটু মানসিক অস্বস্তিতে পড়লেও বললাম,

– না বাবা, এখানে একটা হোটেলে উঠেছি। দরজা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আর যাব না। আপনার সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দেব সময়টা।

একথায় সাধুবাবা বেশ খুশি হয়ে বললেন,

– ঠিক আছে বেটা, কোনও অসুবিধে নেই। যদি কিছু মনে না করিস তো আমার কাছে কিছু লাড্ডু আর রুটি আছে দুজনে খেয়ে নেব। এটা আমি ভিক্ষে করে পেয়েছি।

নিঃসঙ্কোচে মাথাটা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি কি বাবা কোনও তীর্থদর্শন করে বেনারসে এলেন?

ঘাড় নাড়লেন। মুখেও বললেন,

– চিত্রকূট থেকে আজ সকালেই এসেছি। তবে বাবা বিশ্বনাথের কাছে এর আগেও এসেছি বহুবার।

এতক্ষণ বসেছিলাম গঙ্গার দিকে মুখ করে। এবার সাধুবাবার দিকে ফিরে বসে বললাম,

– বাবা, আপনার ডেরা কোথায়?

ঘাটের আলোয় তত জোর নেই। হাল্কা আলোতেও দেখা গেল তাঁর হাসিমাখা মুখখানা। বললেন,

– না বেটা, কোথাও ডেরা নেই আমার। এখন এই ঘাটই আমার ডেরা। এটা লক্ষ্য করলাম, সাধুবাবা প্রথম থেকেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন বেশ প্রসন্ন মনে। এতে নিজের মনেও বেশ আনন্দ হচ্ছিল। তাই এবার সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম,

– আচ্ছা বাবা, আপনি কি বিয়ে থা করেছেন?

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে নিলেন। নিঃশব্দ হাসি। হাসলাম আমিও। একটা কম্বল ভাঁজ করতে করতে বললেন,

– হাঁ, বেটা বিয়ে করেছিলাম। আমার একটা মেয়ে দুটো ছেলে। আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে ঘর ছেড়েছি। বাচ্চা বউ এরা সব কোথায় কিভাবে আছে, বেঁচে আছে কিনা আমি কিছুই বলতে পারব না। ঘর ছাড়ার পর ওদের আর কোনও খোঁজখবর রাখিনি।

এ যাত্রায় বেনারসে এসে সাধুসঙ্গ করেছি অনেক। তবে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছে এমন সাধু পেলাম এই প্রথম। তাই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– সবই তো ছিল আপনার, তবুও কেন ঘর ছাড়লেন?

মানসিক দিক থেকে একটুও বিব্রত না হয়ে প্রসন্ন‌মনে বললেন,

– বিয়ে করে বহুদিন সংসার করেছি এটা ঠিক। কিন্তু সংসার আমার ভাল লাগত না। কেন তা তো বেটা তোকে বোঝাতে পারব না।

জানতে চাইলাম,

– কারও সঙ্গে অশান্তি করে ঘর ছেড়েছে‌ন?

হো-হো করে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। হাসিতে ফাঁকা দশাশ্বমেধ ঘাটের নিস্তব্ধতা একেবারে ভেঙে গেল। হাসির রেশটা মুখে থাকতে থাকতেই বললেন,

– না বেটা, কোনও অশান্তি করে ঘর ছাড়িনি। বিয়ের আগে ঘর ছাড়ার কথা মনেও হয়নি। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। সংসারে মোটেই ভাল লাগত না। তবুও যতটা সম্ভব মনটাকে সংসারে রাখার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই আর পারলাম না বেটা। একদিন কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লাম সংসার ছেড়ে।

সাধুবাবার কথায় অসংখ্য প্রশ্ন এল মনে। বললাম,

– সংসার করলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। স্ত্রী পুত্র কন্যার প্রতি কি বিন্দুমাত্র মায়া জন্মায়নি আপনার? যখন যে মুহুর্তে ঘর ছাড়ছেন, ঠিক সেই সময় ওদের জন্যে মনটা এতটুকুও খারাপ হয়নি? কিভাবে থাকবে ওরা, কিভাবে চলবে ওদের এসব কথা একটুও ভাবলেন না? আপনি কি মনে করেন না যে আপনি কর্তব্যে অবহেলা করেছেন?

Haridwar
কাশীর সাধুবাবা হরিদ্বারের কুম্ভে

একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করায় সাধুবাবা আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি রইলাম উত্তরের অপেক্ষায়। কোনও কথা বললেন না তিনি। ঝোলা থেকে শালপাতায় মোড়া রুটি, কিছু ভাঙা আর গোটা মিলিয়ে লাড্ডু বের করলেন। তিনটে রুটি আর মিষ্টির অর্ধেক দিলেন আমাকে‌। দুটো রুটি আর বাকি অর্ধেক মিষ্টি নিলেন নিজে। আমি একটা রুটি দিতে গেলে তিনি হাত বাড়িয়ে বাধা দিলেন। কোনও কথা না বলে খেয়ে নিলাম। তারপর ঘাটে নেমে গঙ্গাজল খেয়ে এসে বসলাম মুখোমুখি। দুটো বিড়ি ধরালাম। একটা দিলাম সাধুবাবার হাতে। আপত্তি না করেই নিলেন। নিজে একটা টানতে লাগলাম। বার তিনেক টেনে তিনি বললেন,

– বেটা, ভগবান ছাড়া মায়ার বাইরে কি মানুষ হতে পারে? মায়া আমার তখনও ছিল, আজও আছে। যখন যে মুহুর্তে ঘর ছাড়লাম, তখন কারও জন্যে মন এতটুকুও খারাপ হয়নি। তাহলে কি ঘর ছাড়তে পারতাম? তবে গৃহত্যাগের পর মাঝেমধ্যে ওদের জন্যে মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। কোনও কিছুই ভাল লাগত না। তারপর ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। এখন আর কিছু মনে হয় না।

হঠাৎই দেখি দুজন পুলিশ এসে হাজির। কথা বন্ধ করলেন সাধুবাবা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত বারোটা। পুলিশ দুজনের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলেন এত রাতে এখানে বসে কি করছি? বললাম হোটেলের ঠিকানা। সাধু পেয়েছি। তাঁর সঙ্গ করছি। ঝামেলা এড়াতে আর যা বলার দরকার তা বলতে ওরা চলে গেল। রাতে টহল দিতে বেরিয়েছে। আবার শুরু করলেন সাধুবাবা,

– আর কর্তব্যের কথা বলছিস? ভগবানের রাজত্বে উচিত, অনুচিত, কর্তব্য, অকর্তব্যের কোনও স্থান নেই বেটা। যার যে কর্মফল নির্দিষ্ট আছে সে সেই অনুসারেই চলে। আমার সংসারে থাকা বা না থাকাতে ওদের কিছু যায় আসে না। ওরা চলবে ওদের কর্মফলের উপর। আমার কর্তব্য পালন বা না পালনেও কারও কিছু আসে যায় না।

এমন কথায় একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম,

– বিয়ে করে একজনকে ঘরে আনলেন। রিপুর তাড়নায় সন্তানের জন্ম দিলেন। তারপর ঘর ছেড়ে একদিন বেরিয়ে পড়লেন, এরমধ্যে আপনার কর্তব্যকর্ম বলে কিছু নেই?

কণ্ঠে উত্তেজনার সুরটা শুনে হাতের ইশারায় সংযত হতে বললেন সাধুবাবা। এতে একটু লজ্জিত হলাম আমি। তিনি হাসিমুখেই বললেন,

– তোর সব কথাই আমি মেনে নিলাম বেটা। এবার আমাকে বল, বিয়ের পর সন্তানের জন্ম দিয়ে যার বাপ মারা যাচ্ছে তার কর্তব্যটা যাচ্ছে কোথায়? সংসার করতে করতে যার বাপ কঠিন ব্যাধিতে পঙ্গু হয়ে গেছে, সে শুয়ে শুয়ে কি কর্তব্যটা করছে? ছোটবেলাতেই যার বাবা মা মারা গেছে, সেই অনাথ সংসারে কি অচল হয়ে গেছে, জীবনপ্রবাহ কি থেমে থেকেছে না থাকছে কোথাও, কখনও? আসলে জানবি বেটা, মানুষের জীবনের প্রতিটা মুহুর্তকে নিয়ন্ত্রণ করেছে জন্মান্তরের কর্মফল। সেই অনুসারে চলছে সকলে, এ প্রবাহকে রোধ করার ক্ষমতা কারও নেই। অতএব ওসব কর্তব্যের কথা তোর বা আমার ভেবে লাভ নেই। তাছাড়া ভগবান তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাকে দিয়ে কি করিয়ে নেবেন, তা তুইও জানিস না, আমিও না।

ঠিক এই মুহুর্তে সাধুবাবার এ যুক্তির কাছে অন্য কোনও যুক্তিই খাড়া করতে পারলাম না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে দিলাম,

– বাড়ি কোথায় ছিল আপনার? পড়াশুনাও নিশ্চয়ই কিছু করেছেন?

– বাড়ি ছিল আমার বিহারের আরা জেলায়। আর ‘পড়ালিখা’ বেটা আমি কিছু শিখিনি।

– গৃহত্যাগের পর প্রথমে কোথায় গেলেন?

কপালে হাতদুটো ঠেকিয়ে গুরুজি বা ভগবানের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে সাধুবাবা বললেন,

– ঘর ছাড়ার পর তীর্থে তীর্থেই ঘুরে বেড়াতাম আমি। এইভাবে কেটে গেল প্রায় বছর তিনেক। গুরুর সন্ধান কিছু মিলল না। সে বার এলাম এলাহাবাদে কুম্ভস্নানের যোগ পড়েছিল। আমিও গেছিলাম। ওখানে আমার গুরু মিলল। দীক্ষাও হল। দীক্ষার পর গুরুজির সঙ্গে ছিলাম বছর পাঁচেক তবে তাঁর কোনও ডেরা ছিল না। নানা তীর্থপর্যটন করে বেড়াতাম আমরা। হঠাৎ একদিন আমাকে তিনি বললেন, তুই তীর্থের পরিক্রমা করতে থাক, আমি হিমালয়ে যাব। ব্যস, আর একটা দিনও তিনি থাকলেন না। গুরুজি চলে গেলেন হিমালয়ে।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– প্রতিদিন কি করে কিভাবে কাটে আপনার?

এবার সাধুবাবা নিজের থেকেই একটা বিড়ি চাইলেন। একটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেও ধরালাম একটা। বেশ আমেজ করে টেনে বললেন,

– যখন যে তীর্থে মন চায় সেখানেই চলে যাই। ভগবানের নাম করি। ভিক্ষায় যা মেলে তাই খাই। এইভাবে দিনগুলো আমার কেটে যায়। যেখানে একটু বেশি ভাল লাগে কয়েকটা দিন বেশি থাকি, না লাগলে আবার চলে যাই অন্য কোনও তীর্থে। এমন করেই তো জীবনের এতগুলো বছর আমার কেটে গেল।

বিড়িতে টান দিতে একটু দেরি হলে নিভে যায়। সাধুবাবার বিড়িটা নিভে গেল। আবার ধরিয়ে নিলাম। প্রশ্ন করলাম,

– অসুখ বিসুখ হলে তখন কি করেন?

বিড়িটা ফুকফুক করে টান দিয়ে বললেন,

– বেটা, গুরুজির কৃপায় আমার বড় কোনও অসুখ করেনি কখনও। টুকটাক শরীর খারাপে কিছু হয় না।

একটা প্রশ্ন এল মনে। এই বৃদ্ধ সংসার করেছে। হয়ত কিছু বলতে পারবে। তাই ভাবলাম, দেখি এই লেখাপড়া না জানা সাধুবাবার কাছ থেকে যদি কোনও উত্তর পাই। বললাম,

– বাবা, আপনি তো সংসার করেছেন, সাংসারিক অভিজ্ঞতাও কিছু আছে। আবার সেসব ছেড়ে আর এক জীবন, বৈচিত্র্যময় জীবন আপনার। জীবনে চলার পথে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে অনেক, তা থেকে অভিজ্ঞতাও হয়েছে যথেষ্ট। তাই একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। বললাম,

– বাবা, পাশ্চাত্যের কিছু কিছু অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ উন্নত দেশের কথাই বলছি। সেখানে টাকাপয়সা ধনদৌলত কোনও কিছুরই অভাব নেই। যতদিন যাচ্ছে, তাতে তাদের আরও অনেক অনেক হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সন্তানের সঙ্গে বাবা মায়ের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, কারও সঙ্গে কারও আন্তরিকভাবে মানসিক যোগাযোগ নেই। সংসারে থেকেও এদের সংসার নেই অনেকের। যে কোনওভাবে দেহের যোগাযোগে এদের ঘাটতি নেই। এককথায় সবথেকেও এদের কিছু নেই। পাশ্চাত্যজীবন সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় ওরা একেবারেই নিঃসঙ্গ। কিন্তু আপনি ভারতীয় নারীপুরুষদের দেখুন, ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া, শত দুঃখ কষ্টেও মা সন্তান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

স্বামী বা স্ত্রী পঙ্গু, একে অপরকে ছেড়ে যায় না। ধরুন স্বামী তার স্ত্রীকে ধরে সকালে বেদম মার মারল। অথচ স্বামী যখন কাজে যাচ্ছে তখন দেখা গেল, নির্যাতনের কথা ভুলে স্ত্রী তার টিফিনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্বামীর কষ্ট হবে না খেলে। সন্ধ্যায় অপেক্ষা করছে, ছটফট করছে মা তার সন্তানের জন্য, স্বামীর জন্য স্ত্রী ফিরতে দেরি হলে। এই যে বোধ, এই যে মানসিকতা, ওদের মধ্যে এটার বড় অভাব আছে বলেই মনে হয়। এ কথাগুলো আপনাকে বললাম উদাহরণস্বরূপ। আসলে ওখানে একের সঙ্গে অপরের মনের বাঁধনটা বড় আলগা ঠুনকো। ভারতীয় নারীপুরুষদের সঙ্গে এদের তফাৎটা কোথায় এবং কিসের?

কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন সাধুবাবা। পাশ্চাত্যদেশ সম্পর্কে তাঁর কোনও ধ্যানধারণা আছে কিনা, তা নিজেও বুঝে উঠতে পারলাম না। বসে রইলাম শুধু উত্তরের আশায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত পৌনে একটা। উত্তরে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, ভগবানের সৃষ্টি এই বিশ্বসংসারে কোনও নারীপুরুষই পূর্ণ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কোনও না কোনওভাবে একজনকে আর একজনের ওপর নির্ভর করতেই হবে। সংসারজীবনে যতই টাকাপয়সা ধন দৌলত যশপ্রতিষ্ঠা থাকুক, তাতে কিছু যায় আসে না। না থাকলেও কিছু যায় আসে না। দেহের ক্ষুধা মেটানোর জন্যে অন্যের প্রতি আকর্ষণবোধ করাকেও দোষের মধ্যে ধরি না। পার্থিব প্রতিষ্ঠায় যে কোনও নারীপুরুষের আত্মনির্ভরতাও কোনও দোষের নয়, বরং ভাল। তবে একটা কথা আছে বেটা, কিছু পেতে হলে, কাউকে পেতে হলে ‘নির্ভর’ করতেই হবে। সে ঈশ্বরেই বল আর স্বামী তার স্ত্রীতে, স্ত্রী তার স্বামীতে, মা সন্তানে সন্তান মায়ে, প্রেমিক তার প্রেমিকাতে। এই নির্ভরতা যেটা দেহ দিয়ে, সম্মান অর্থযশ খ্যাতি প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা দিয়ে হবে না। এ নির্ভরতা মনের। একের প্রতি অপরে মানসিক দিক থেকে নির্ভরশীল না হলে কখনই মনের নিঃসঙ্গতা কাটবে না, কাউকে আপন করেও নিতে পারবে না।

যেখানে যাবে, সব থাকতেও তুমি কিন্তু একা। এখানেই মানুষ অসম্পূর্ণ। নির্ভরতাতেই মানুষ পূর্ণ। সেটা পার্থিবজীবন এবং অপার্থিব, সবক্ষেত্রেই। আর এই মানসিক নির্ভরতা সমলিঙ্গে আসে খুব কম, বিপরীত লিঙ্গেই এর ভিত্তি। সেখানেই সহজ, সম্ভব। আর একটা কথা সকলেরই ব্যক্তিগত ও মনের স্বাধীনতা থাকা ভাল, তার প্রয়োজনও আছে। তবে সংসারক্ষেত্রে সেটা যেন কখনও মানসিক নির্ভরতাকে দুর্বলতা ভেবে উপেক্ষা না করে। তা করলে কিন্তু গোল বাঁধবে।

একটানা কথাগুলো বলে সাধুবাবা একটু বিশ্রাম নিলেন। কোনও কথা বললাম না। দশাশ্বমেধ ঘাট ফাঁকা। ইতস্তত ঘুমিয়ে আছে কয়েকটা কুকুর। গঙ্গার শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে। একটা বিড়ি দিলাম সাধুবাবার হাতে। নিস্তব্ধ ঘাট। দেশলাই কাঠি জ্বালতেই আওয়াজ হল ফস করে। আগের থেকে অনেক জোরালো। বিড়ি ধরিয়ে আবার শুরু করলেন সাধুবাবা।

– প্রতিষ্ঠা আর বিষয়ই অনেকক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ করতে পারে কিন্তু মানসিক নির্ভরতা মানুষের মনকে কখনও নিঃসঙ্গ তো করেই না বরং অপরকে, এমনকি ভগবানকেও আপন হতে আপন করতে সহায়তা করে। যেখানে ওটি নেই সেখানে কি নারী, কি পুরুষ একেবারেই একাকী, নিঃসঙ্গ। সব থেকেও নিঃসঙ্গ হবে, কি জনে, কি মনে। মানসিক নির্ভরতা থেকে প্রেমপ্রীতি বিশ্বাস ভালোবাসা আর সহানুভূতির সৃষ্টি। আর এগুলোই সৃষ্টি করে একে অপরকে ধরে রাখার জন্য মানসিকবন্ধন। এই নির্ভর মানসিকতা আছে বলেই ভারতীয় নারীপুরুষের অতুল ঐশ্বর্যে আবার চরম দুঃখেও সাংসারিক বিচ্ছেদের সংখ্যা নেহাতই কম। এই বন্ধনই ধরে রাখে একে অপরকে। মৃত্যু পর্যন্ত একের দুঃখ অপরকে দুঃখী করে তোলে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যার সংসার ভেঙেছে‌, জানবি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মানসিক নির্ভরতার ঘাটতি আছে। আরও জানবি, চরম অপরাধও ক্ষমা হয়ে যায় নির্ভরতায়। এই মানসিকতা নিয়ে ভারতীয়রা, বিশেষ করে হিন্দুরা ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মানসিক নির্ভরতাই সবচেয়ে লক্ষ্যের বিষয়। উন্নত পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাঠামোটি আত্মনির্ভরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেখানে মানসিক নির্ভরতার প্রাধান্য সামান্যই।

এই প্রসঙ্গে আর কোনও কথা বললেন না সাধুবাবা। কথাগুলো বিচার বা বিতর্কের উর্দ্ধে কিনা আমার জানা নেই। তবে অবাক হয়ে গেলাম সাধুবাবার যুক্তি ও বোধশক্তি দেখে, যে স্কুলের দরজা কখনও স্পর্শ করেননি। উভয়ে চুপ করে বসে রইলাম মিনিট পনেরো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– সংসারজীবন ছেড়ে সাধুজীবনে আসার পর আপনার সাধনভজনে কি কোনও অসুবিধা হয়েছে?

মাথাটা একটু নেড়ে বললেন,

– ঘরছাড়ার পর প্রথম দিকে বেটা অসুবিধা হয়েছে খুবই। বিশেষ করে সংযম আর বীর্যধারণের ক্ষেত্রে। পরে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে। তবে সময় লেগেছে অনেক।

এবার কোনও সঙ্কোচ না করেই প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, গৃহত্যাগের পর আপনার মনে কি কখনও নারীভোগের ইচ্ছা বা কামনা জেগেছে?

দ্বিধাহীন চিত্ত হ‌য়ে অকপটে বললেন সাধুবাবা,

– বেটা, শীত গ্রীষ্ম বর্ষাতে দীর্ঘদিন ধরে স্নান করা যার অভ্যাস, সে যদি হঠাৎ একেবারে স্নান বন্ধ করে দেয় তাহলে প্রথমে অসহায় আর দেহমনের অস্বস্তি তো একটা হবেই। স্নানের জন্যে মন তো আনচান করবেই। তারপর স্নান না করাটাই যখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় তখন দেহমনের আর কোনও অস্বস্তিই থাকে না।

কোনও মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে নির্মম সত্যকে কি সুন্দর বুঝিয়ে দিলেন সাধুবাবা। মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত পৌনে তিনটে। সেই একই প্রশ্ন এবার একটু ঘুরিয়ে করলাম,

– বাবা, কি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি ঘর ছেড়েছিলেন সে কথা তো বললেন না?

মুখে হাল্কা হাসির ভাব নিয়ে বললেন,

– বেটা, তোকে তো আগেই বলেছি, সংসার আমার ভাল লাগত না তাই ঘর ছেড়েছি। কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। তোকে মিথ্যা বলে কি আমার কোনও লাভ হবে? তবে বেটা বাধাহীন এই মুক্ত জীবনের আনন্দ তো একটা আছেই, যেটা সংসারজীবনে নেই।

উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– কি সেই আনন্দ, দয়া করে বলবেন বাবা?

সাধুবাবা বড় একটা হাই তুলে বললেন,

– রাত অনেক হল বেটা, এখন তুই আর আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। সকালে আবার কথা হবে।

বলেই তিনি শুয়ে পড়লেন লম্বা হয়ে। দেহের কিছু অংশ রইল আসনে কিছুটা বাঁধানো সিঁড়িতে। আমারও বেশ ঘুম পাচ্ছিল। তাই আর কথা বাড়ালাম না। ধুলোয় ভরা সিঁড়িতে শুয়ে পড়লাম টানটান হয়ে। মুহুর্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্নানের যাত্রী কোলাহলে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি সকাল হয়ে গেছে। আকাশ পরিস্কার। দেখলাম মাথার কাছে সাধুবাবা নেই – নেই তাঁর আসনটিও। ঘাটের কাছে নেমে খুঁজলাম। এদিক ওদিক কোথাও নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। খারাপ হল এইজন্যে, শোনা হল না সাধুবাবার শেষ কথা, ঈশ্বর সম্পর্কে উপলব্ধি আর মুক্ত জীবনের অনাবিল আনন্দের কথা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *