Festive Mood

শুভ বিজয়া

বিজয়া মানেই প্রণাম, বিজয়া মানেই আশির্বাদ, বিজয়া মানেই মিষ্টি মুখ, বিজয়া মানেই কোলাকুলি। বাঙালি যতই বদলে যাওয়া বিশ্বের সঙ্গে পা মেলাক না কেন, এই রীতিগুলো তাদের আজও নাড়া দেয়।

মা থাকবে কতক্ষণ, মা যাবে বিসর্জন। পুজো, পুজো, পুজো। পুজো শেষ। এবার বিদায়ের পালা। বাপের ঘর অন্ধকার করে ছেলে মেয়ে নিয়ে উমা ফিরবেন পতিগৃহে। তারপর বছরভরের অপেক্ষা। বাঙালি ফিরবে নিজের জীবনে। আর পাঁচটা আম দিনের মত সুখে দুঃখে কাটবে সময়। তার আগে অবশ্য বিজয়ার বিদায় বেলায় অন্য এক খুশির আনন্দে মেতে ওঠে বাঙালি। ঘাটে ঘাটে চলে ভাসান। নাচের তালে হৈহৈ করে সবাই চেঁচিয়ে ওঠেন ‘আসছে বছর… আবার হবে।’

বিজয়া দশমীর সকালে সুতোকাটা, আর সিঁদুর খেলার পরই শুরু বিসর্জনের তোড়জোড়। বাড়ির ঠাকুর আগেই জলে পড়ে। দুপুর দুপুর। পরিবারের লোকজনই ছোট টেম্পোয় অথবা ম্যাটাডোরে করে একচালার ঠাকুর নিয়ে হাজির গঙ্গার ঘাটে। দুপুরের দিক হলে ফাঁকা পাওয়া যায়। অনেক পরিবারেরই নিজস্ব কিছু রীতি আছে। সেই রীতি মেনে তবেই বিসর্জন দেওয়া যায়। ফলে গঙ্গার ঘাটেও তাদের বেশ কিছুটা সময় কাটে। আগে যেমন কলকাতার এক বনেদি বাড়ির পুজোর রীতি ছিল নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো। সে পাখি আকাশে উড়ত ঠিকই কিন্তু সামান্য ওড়ার পরই তার ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে যেত। তখন কাকেরা ঠুকরে মারত তাদের। ওই পরিবারের রীতি ছিল বিসর্জনের আগে নীলকণ্ঠ উড়িয়ে কৈলাসে আগাম জানান দেওয়া, উমা ফিরছেন। কিন্তু কালক্রমে সে রীতি আর নেই। সেই জায়গায় প্রতীকী একটি কাঠের নীলকণ্ঠ পাখি গঙ্গার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সাবেকরীতির মর্যাদা রক্ষা করেন নতুন প্রজন্ম।


বিকেল যত গড়াতে থাকে ততই শহরের বিভিন্ন ঘাটে জমতে থাকে বারোয়ারির ভিড়। এক এক করে লরি ভিড় জমাতে থাকে ঘাটে। কখনও পাড়ার ছেলেরা নিজেরা, তো কখনও ভাড়া করা লোক দিয়ে শুরু হয় একের পর এক ভাসান। কোনও সময় নষ্ট নয়। কোনও বেয়াদবি নয়। সুশৃঙ্খলভাবে চলে বিসর্জন। কড়া পুলিশি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। আর তাদের গায়ে লেপটে থাকে বিভিন্ন চ্যানেলের প্রতিনিধি, চিত্রগ্রাহক। দুরে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের ওবি ভ্যান। সবসময় ছাতা তোলা। শুধু একবার প্রডিউসারের নির্দেশ এলেই হল। লাইভ শুরু।

এদিকে রাত যত বাড়ে ততই বাড়তে থাকে বারোয়ারির ভিড়। লরির লম্বা লাইন পড়ে যায়। অনেক বারোয়ারিরই ভাসান দিতে ভোর হয়ে যায়। তবে এই সময়টা যে কিভাবে কেটে যায় বোঝাই যায় না। রাস্তার দুপাশে মানুষের ঢল। ভাসান দেখার ভিড়। আলো, হৈচৈ। একটা অন্য পরিবেশ।


বিজয়া মানেই প্রণাম, বিজয়া মানেই আশির্বাদ, বিজয়া মানেই মিষ্টি মুখ, বিজয়া মানেই কোলাকুলি। বাঙালি যতই বদলে যাওয়া বিশ্বের সঙ্গে পা মেলাক না কেন, এই রীতিগুলো তাদের আজও নাড়া দেয়। আনন্দ দেয়। ভাল লাগে। নাহলে কবে ছুঁড়ে ফেলে দিত এসব সনাতনি ভাবধারা। আসলে এটা একটা আবেগ, নস্টালজিয়া। নইলে ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকায় বসেও বাঙালি চুটিয়ে পদ্ম ফুল সাজিয়ে, বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে দুর্গাপুজো করে! কোথায় আছেন মশাই, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে একটি দুর্গাপুজো পুজো কমিটির সদস্যরা নিজেরাই নাকি গোটা মহালয়াটা নিজেদের মত করে করেছেন। মন্ত্র পাঠ থেকে গান সবই হয়েছে সেই পঙ্কজ মল্লিকের সাজানো ঢঙেই।

তবে হ্যাঁ, মিষ্টি মুখ থাকলেও কিছু প্রথাগত মিষ্টিতে বদল এসেছে বৈকি। মা, ঠাকুমাদের মুখে শুনেছি, বিজয়ার মিষ্টিমুখ মানেই নারকেল ছাপা। এককথায় নারকেলের বিভিন্ন মিষ্টি। নাড়ু, চন্দ্রপুলি, নারকেল ছাপা এসব আর কি! কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারকেল ছাপা এখন এন্ডেনজারড স্পিসিস। খুঁজে পাওয়াই ভার। খাওয়া তো দুরের কথা! সে জায়গা এখন দখল করেছে বাহারি সন্দেশ, নিদেনপক্ষে রসগোল্লা।

মনে আছে আগে ঠাকুর ভাসান দিয়ে ফিরে আমাদের পাড়ায় খুব নাচ হত। পাড়ার ছেলে ছোকরার দল ঢালের তালে কোমর দোলাত। এদের মধ্যে আবার কয়েকজন বেশ দক্ষ নাচিয়ে। তারা নাচতে শুরু করলে অন্যরা চারপাশে দর্শকের ভূমিকা নিত। আর তা না হলে সকলেই গো অ্যাজ ইউ লাইকের মত, নিজের নিজের ঢঙে নাচতে থাকতো। ঢাক থামলে সবাই বসে পড়ত রকে। আসত সিদ্ধি। কেউ এক চুমুক, কেউ এক গ্লাস। পরিমাণের ঠিক থাকতো না, তবে হাতে লাইসেন্সটা থাকতো। বাড়ির সকলের সামনে বেশ বুকফুলিয়ে এমন নেশার তরল পানের সুযোগ বছরের অন্য কোনও সময় ঠাকুরের দোহাই দিয়ে কিন্তু মেলা অসম্ভব ছিল। মনে আছে সব শেষে আসত শান্তির জল। পুরুত মশাই একটা আমশাখা দিয়ে জল ছিটিয়ে দিতেন। আর সকলের চেষ্টা থাকতো কোনোভাবে যেন এক ফোঁটাও কোমরের নিচের অংশ না ছোঁয়। বাড়িতে ঢোকার আগে একবার ঠিক নজর যেত প্যান্ডেলের দিকে। অন্ধকার বেদিতে তখন জ্বলত একটা টিমটিমে প্রদীপ। আর সেই প্রদীপের আলো বলে যেত পুজো শেষ। এবার একটা বছরের অধীর অপেক্ষা।

বিজয়ার পরের দিনটা বেশ ক্লান্তির মধ্যেই কাটতো। উৎসবের ধকলটা এবার মাথা চাড়া দিত। সারা শরীরে ব্যথা। শুধু মনে হত খাই আর ঘুমোই। কোনও কাজ নয়। তবে সে একদিনের ব্যাপার। দ্বাদশী থেকেই প্যান্ডেলের চেহারা বদলে ফেলা হত। ভাঙা হোক, তবু তাকেই এদিক ওদিক করে কিছুটা ম্যানেজ করে তৈরি হত লক্ষ্মী ঠাকুরের বসার জায়গা। ফের হ্যালোজেনের আলো জ্বলে উঠত প্যান্ডেলে, গলিতে। এসে পড়ত পূর্ণিমা। কোজাগরী পূর্ণিমা। লক্ষ্মী পুজোর নতুন আনন্দে ফের মেতে উঠত গোটা শহর। — চিত্রণ – সংযুক্তা

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button