Mixed Bag

রং-তুলির নেশায় বুঁদ এক গাড়িচালকের গল্প

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। খালি পেটে তেমন শিল্পও হয় না। শিল্পী হতে গেলে টাকা লাগে। শিল্পীদের ভালো থাকতে হয়। সেজন্য টাকার দরকার সর্বাগ্রে। দিনে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ছবি আঁকেন অভিজিত দত্ত। গাড়ি চালানোই তাঁর পেশা। ২৩ বছর ধরে ড্রাইভারি করছেন। বাড়ির গাড়ি চালান। এভাবে কাজ করে গত সাত বছর ধরে মাসিক আয় ৭ হাজার টাকা। বিবাহিত, পুত্রসন্তান আছে ৪৩ বছরের অভিজিতের। অভিজিত খুব সম্প্রতি জীবনের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলেন। একটি পুস্তক প্রকাশনা সংস্থায় গাড়ি চালক হিসাবে যোগ দিয়েছেন। ১০ হাজার টাকা বেতন। এটাই এপর্যন্ত তাঁর হাতে পাওয়া সর্বোচ্চ মাসমাইনে। স্ত্রী গৃহবধূ। বাবা কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছেন। বাবার আয় বরাবরই ছিল অল্প। পেশা ছিল ব্লাউজ সেলাই। সেই কাজ করে ‌‌যেটুকু অর্থ উপার্জন করতেন সেই টাকায় সংসারের মুখে অন্নটুকুই শুধু তুলে দিতে পেরেছেন।

অভিজিতদের বাড়িটা প্রাচীন। ফুলবাগান থানার পঞ্চানন মিত্র লেনে দত্তদের এই পৈতৃক বাড়িটি প্রোমোটার কিনে নিয়েছে। অভিজিতরাও একটি ফ্ল্যাট ও কয়েক লক্ষ টাকা নগদে পাবেন। লক্ষ্মীলাভ হয়েছে মামাবাড়ির দিক থেকেও।  সম্পত্তির ভাগ বাবদ অভিজিতের মা কয়েক লক্ষ টাকা পেয়েছেন। ফলে দিন ফেরাতে জ্যোতিষীর দেওয়া পোখরাজের আংটি ধারণের আইডিয়াটা আপাতত বাতিল করেছেন অভিজিৎ। বরং আর্থ সমস্যা কিছুটা মেটায় একটু শান্তিতে ছবি আঁকতে পারবেন এটা ভেবেই বেজায় খুশি তিনি।

শত সমস্যার মধ্যেও ছবি আঁকার নেশাটা অনেকদিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছেন অভিজিৎ দত্ত। নিজের মনেই রং-তুলির টানে এঁকে ফেলেন দুরন্ত সব ক্যানভাস। রোজগারের জন্য নয়, নিছক সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। অভিজিতের ছবি দেশের নানা প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। কলকাতা, দিল্লি-সহ দেশের বেশ কয়েকটি আর্ট গ্যালারিতে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর আঁকা ছবি। সিমা আর্ট গ্যালারিতে গেলে দেখা যাবে তাঁর আঁকা ছবি। ৫০টিরও বেশি ছবি এখনও পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছে বলে জানান অভিজিৎ।

রিয়েলিস্টিক ছবি আঁকতেই পছন্দ করেন এই আপাত অখ্যাত চিত্রকর। অ্যাক্রেলিকে কাজ করেন। তেল রং ব্যবহার করেন না। এবার নতুন করে বিমূর্ত নিয়ে কাজে হাত লাগাতে চান। অভিজিতের কথায়, ‘প্রথম দিকে অ্যাবস্ট্রাক্টই এঁকেছি। কিন্তু বলা হয়, ৫০ বছর বয়সের আগে অ্যাবস্ট্রাক্টস না করাই ভাল। কিছু অ্যাবস্ট্রাকটস মাঝখানে করে তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে রিয়েলিস্টিক ছবি করেছি।’ সবে এঁকেছেন এমন একটা ছবি, একজন বয়স্ক মানুষের মুখ। তাঁর মুখের সামনে একটি ফ্রেম। ফ্রেমের কিনারে ঘুরছে একটি লাট্টু। জীবনের লাট্টুবাজি দেখানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এতকাল রিয়েলিস্টিক এঁকেছেন দুঃখ-দারিদ্র্য নিয়ে। মানুষ, মানুষের মুখ, তাঁদের কষ্ট। কাজ না থাকা, হতাশা, অর্থকষ্ট ইত্যাদিই অভিজিতের কাজের বিষয়। আঁকতে ভালোবাসেন পুতুল। অভিজিতের নিজের ভাবনার পুতুল সিরিজ আছে।

মানবজীবন সম্পর্কে দারুণ আশাবাদী এই শিল্পী। প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মানুষ অনেক সময় জন্মগ্রহণ করলেও সেইসব প্রতিবন্ধকতাগুলিরও নিরাময় সম্ভব। অভিজিতের আক্ষেপ, মাধ্যমিকের পরে উচ্চমাধ্যমিকটা শেষ করা হয়ে ওঠেনি। সেইসময়ে কলাভবনে চান্স পেয়েছিলেন। হোস্টেল খরচ, খাওয়ার খরচ ব্লাউজ সেলাই করে সংসার চালানো বাবার পক্ষে টানা ছিল অসম্ভব। ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সরকারি চাকরি জুটে যাবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি দফতরগুলিতে গাড়ির ড্রাইভার নিয়োগের পরীক্ষায় একাধিকবার পাশও করেন। তবে শেষ প‌র্যন্ত চাকরিটা আর কপালে জোটেনি। ডাক্তার, উকিল, বিজ্ঞানী, নানান পেশায় সফল মানুষজনের গাড়ি চালিয়েছেন অভিজিৎ। মনিবরা কেউ কেউ জানতেন, অনেকে জানতেনও না তাঁর  প্রতিভার কথা।

ছোটবেলা থেকেই শিল্পী মনস্ক অভিজিৎ। বাড়ির দাওয়ায় বসে ছেলেবেলায় ছবি আঁকতেন। তখন দুপুরে আঁকতে ভালোলাগত। এখন কাজের চাপে রাত ছাড়া আর আঁকার সময় হয়না। প্রেম করে বিয়ে সেরেছিলেন অল্প বয়সেই। এখন ছেলে দেবজিৎ ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। অভিজিৎ গাড়ি চালকের পেশাটা আগাগোড়া উপভোগ করেন। বললেন, ট্যাক্সির হেল্পারি দিয়ে শুরু করি। কিছুদিন ওলা চালানোর অফার পেয়েছেন। ওলা চালালে মাসে চারদিন ছুটি বাদ দিয়ে ১৮-২০ হাজার টাকা মাইনে। মন্দ নয়। তবে জিপিএসে ঠিকানা খোঁজা তাঁর দ্বারা হবে না।

এক বিজ্ঞানীর গাড়ি চালাতেন। কাজের জায়গায় সব ঠিকঠাকই ছিল। শুধুমাত্র বাড়তি টাকার জন্যে চাকরি ছাড়ছেন। নিজের জন্য  সময়ও বেড়েছে। এখন আর একটু ভালো করে ছবি আঁকবেন। সময় দিয়ে আঁকবেন। রিয়েলিস্টিক থেকে তথাকথিতভাবে সময়ের আগেই ফের অ্যাবস্ট্রাক্ট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন বলে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অভিজিৎ।

অভিজিতের নিজস্ব একটা জীবন দর্শন আছে। তাঁর মতে, ছবি, গান, কবিতা কিংবা যা কিছুই আপনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন, সেই গুণগুলি যে ঈশ্বরের উপহার তা যখন বিশ্বাস হবে, তখন আপনি পুরস্কৃত হবেন। হয়তো বা নিছক মনোরঞ্জনই হল। শিল্পী ধরাধামে মালিন্য ছড়াবেন কিনা তা শিল্পীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব। এ ব্যাপারে তাঁর সব ধরনের স্বাধীনতা আছে। শিল্পীর হাতে ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকেই। আবার পাঁকে পদ্মফুল ফোটানোও শিল্পরসের ক্ষমতার একটি নজির। আর কে না জানেন, প্রতিটি সহজাত শিল্পীর পৃথক একটি বা একাধিক সাম্রাজ্য আছে। সে সেখানের অধীশ্বর। নরক-টরক, দুঃখ-কষ্ট সে তো কলকাতার রেতে মশা, দিনে মাছির মতো আছে। অভিজিতের মনে হয়, জীবনটা একটা লটারি। মানে বাজি খেলা। কিন্তু একাএকা চেষ্টা করে আপনি যতই খেলুন, হবে না। কার হবে, কীসে হবে, কেন হবে এবং ভূতের রাজার তিন বরের মতো জামাই আদরে আপনিও জীবন কাটানোর জন্যে বিপুল সুযোগগুলি পাবেন কিনা, সেও জরুরি প্রশ্ন।

অভিজিতের ছবি আঁকার প্রতি টান কিন্তু কোথাও গিয়ে তাঁর পরিবারের থেকে পাওয়া।  রক্তে রয়েছে ছবি আঁকা। ঠাকুরদা সরকারি আর্ট কলেজের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছাত্র ছিলেন। পরে চাকরি করেছেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায়। তখন ব্রিটিশ আমল। কর্মসূত্রে দীর্ঘ দিন মধ্যপ্রাচ্যেও কাটিয়েছেন। তবে সেকালের শিল্পী হিসাবে বেশ খ্যাতি ছিল ঠাকুরদার। অভিজিতের কথায়, ঠাকুরদাকেও পারিবারিক প্রয়োজনে সরকারি চাকরি করতে হয়েছে। ঠাকুরদার সব ছবিই প্রায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে সার্টিফিকেটগুলি সযত্নে আলমারিতে রাখা আছে।

ক্রিক রো-র মিত্র ইন্সটিটিউশনের ছাত্র অভিজিতের আজও আক্ষেপ, ইজেল, রং-তুলির  খরচ টানা সহজ নয়। বড় ক্যানভাসে আঁকা আর পাঁচটা শিল্পীর মতো তাঁরও স্বপ্ন। টাকা ছাড়া শিল্প হয় না। ছবির বাজার কবে ভালো হবে, তাও তাঁর জানা নেই। মানুষের জীবনের কাহিনী কখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায় না। বহু দিক অজানাই থেকে যায়। নিজের ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিল্পীর মনে হয়, প্রতিটি ছবিতে রং-তুলির আঁচড়ে একটি গল্প বলতে চাইছেন তিনি।  অভিজিতের মনে হয়, দর্শক গল্পটা নিজের মতো করে পড়তে পারবেন। তারপর হয়তো ছবিটা তার ভিতর ছড়িয়ে যাবে। আর শিল্পী হিসাবে নিজে ধন্য হবেন। আপাতত মিতভাষী এই মধ্যবয়স্ক আপাত অখ্যাত চিত্রকর বাঁচার গল্প এঁকেই বেঁচে থাকতে চান। বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁর অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা শিল্পী সত্ত্বাটাকে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *