Mixed Bag

পুঁজি যখন ভাবনার অভিনবত্ব

মোটে বছর খানেক বয়স হয়েছে এডু রেডের। বলে রাখা ভালো, সারা ভারতের মতো কলকাতাতেও তরুণ প্রজন্ম নানা অভিনব বিষয়ের বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঝুঁকছেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে শুরু করে ইনফরমেশন টেকনোলজি, বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে গড়ে উঠছে একটার পর একটা স্টার্ট আপ সংস্থা। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই স্টার্ট আপগুলি লাভদায়ক ফল না পাওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সার্বিক ফলাফল ইতিবাচক।

এডু রেড তেমনই একটি সংস্থা। বছর খানেক আগে এই রাজ্যের বাসিন্দা কয়েকজন তরুণ উদ্যোগী এডু রেডের জন্ম দেন। ইতিমধ্যে সংস্থাটি কার্যক্ষেত্রে নানাভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এডু রেড প্রধানত এয়ারোমডেলিং করে থাকে। বর্তমানে আইআইএম কলকাতার সঙ্গে কাজ করছে এরা। এয়ারোমডেলিং ছাড়াও এডু রেডের কাজের ক্ষেত্রগুলি হল রোবোটিক্স, অটো মোবাইল, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, আইওটি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্থার তরফে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের বিষয়গুলি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেওয়া এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য।

১৩ জন উদ্যোগী তরুণ বর্তমানে সংস্থাটি পরিচালনা করছেন। এঁরা সংস্থার পরিচালনায় এক-একটি বিশেষ ক্ষেত্রের ভারপ্রাপ্ত। সংস্থার দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিতেশ কানু ও বিশ্বজিৎ দে। রিতেশ এখন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বিশ্বজিৎ চিফ টেকনিক্যাল অফিসার। এছাড়া, অন্যদের ভিতর রয়েছেন আরব খান, বিশাল দেব, নীলাংশু পাণ্ডা, প্রীতম সাহু, রাকিব মণ্ডল, শুভ্র মিত্র, কিংশুক রায়, বরুণ যোশী ও শুভম বিলাওয়ার সহ বাকিরা।

Edu Rade

প্রায় এক বছর আগে এডু রেডের জন্ম। ইতিমধ্যেই সাফল্যের নজির উল্লেখযোগ্য। সেই খতিয়ান পেশ করার আগে জেনে রাখা ভালো, এডু রেডকেও এই সাফল্য অর্জন করতে নানান বাধাবিপত্তির ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। চলার পথ প্রথম থেকে মোটেও মসৃণ ছিল না। তা সত্ত্বেও নিজেদের জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছে এডু রেড। যার হয়তো অন্যতম কারণ এডু রেডের কাজের বিষয়ের অভিনবত্ব। সংস্থাটি ইতিমধ্যে পুরস্কৃত হয়েছে দেশের নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। পুরস্কৃত হয়েছেন এর সঙ্গে যুক্ত পরিচালকমণ্ডলী। আইআইটি মাদ্রাজ, আইআইটি রুরকি, আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি কানপুর, আইআইটি মুম্বইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান তাঁদের পুরস্কৃত করেছে।

এডু রেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিৎ দে জানালেন, প্রথমে তিনি আর রিতেশ মিলে শুরু করেছিলেন যাত্রা। তারপর সমমনস্ক উদ্যোগীরা একে একে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল পেশাদার হিসাবেই তখন কাজ করছিলেন। কেউ হয়তো ছিলেন বড় কোনও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে কিংবা নামী কর্পোরেটে। সেনাবাহিনীর এভিয়েশন কর্পস থেকেও এসেছেন কেউ কেউ। বিশ্বজিৎ বললেন, এডু রেডের পরিচালনভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত রয়েছে, তাঁদের ভিতর রয়েছেন একঝাঁক ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েট ও স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কার। প্রত্যেকেই ভালো কাজ করছেন বলে জানালেন তিনি। ইতিমধ্যে এয়ারোমডেলিংয়ে সারা দেশের ১০ হাজার স্কুল পড়ুয়াকে নামমাত্র টাকায় এডু রেডের তরফে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। তাছাড়াও নিয়মিতভাবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আয়োজিত হচ্ছে প্রশিক্ষণ শিবির। স্কুল ছাত্রদের এয়ারোমডেলিং সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করাটাই এডু রেডের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করছে এডু রেড। যেমন কয়েকটি এয়ারবাস প্রকল্পে ইতিমধ্যে কাজ করা হয়েছে। এছাড়া, সেনাবাহিনীতেও ড্রোন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁদের।

স্কুল পড়ুয়াদের প্রশিক্ষণ দিয়েই এডু রেডের পথচলা শুরু হয়েছিল। সংস্থার পরিচালকরা জানালেন, প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে তাঁদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তার ছাপ রাখার চেষ্টা করেন তাঁরা। যেহেতু স্কুল পড়ুয়াদের প্রশিক্ষণ দেওয়াটাই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, সে কারণে শিবিরের পরিবেশের প্রতি সবক্ষেত্রেই বিশেষ নজর দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত তা সন্তোষজনক।

প্রশিক্ষণ দু’ভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত, এয়ারোমডেলিংয়ের তাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে পড়ুয়াদের অবগত করা। দ্বিতীয়ত, হাতেকলমে শেখানো। দু’টি দিকেই যত্ন নেওয়া হয়। তাছাড়া, যে পদ্ধতিতে শেখানো হয়, সেটিও সহজবোধ্য বলে দাবি করলেন বিশ্বজিতবাবু। তবে শুধুমাত্র স্কুল পড়ুয়াই নয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদেরও প্রশিক্ষিত করে তোলার কাজ শুরু করেছে এডু রেড। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ শিবির ও কর্মশালা আয়োজিত হয়েছে আইআইটি গুয়াহাটি, সুরাটের সর্দার বল্লভভাই ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, বিটস পিলানি, তেজপুরের অসম বিশ্ববিদ্যালয়, বদোদরার পারুল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিহারের মুজফফরপুর ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে। এও জানা গেল, সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য প্রথিতযশা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে এয়ারোমডেলিং কর্মশালা করার জন্যে আবেদন জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া মিলবে বলেই আশা সংস্থার। কলকাতার ছাত্রছাত্রীদের কাছে এয়ারোমডেলিং একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত বিষয়। তাই এডু রেড চাইছে এ সম্পর্কে এই শহরের ছেলেমেয়েদেরও প্রশিক্ষিত করতে।

Edu Rade

ভারতের অন্য রাজ্যে এডু রেডের কাজের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। দক্ষিণ ভারত, পশ্চিম ভারত, পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে কিংবা উত্তর-পূর্ব ভারতের একাংশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের লালফিতের ফাঁসে আটকা পড়তে হয়নি বলে জানালেন এডু রেডের কর্তারা। বরং আখেরে নতুন একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরে উপকৃত হয়েছেন পড়ুয়ারাই।

এপর্যন্ত এডু রেডের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এসেছে আইআইটি গুয়াহাটি ও সুরাটের এনআইটিতে সংস্থার তরফে আয়োজিত দুটি এয়ার শো-এর প্রসঙ্গ। খেই টেনে বিশ্বজিতবাবু বলেন, ওয়ার্ল্ড মোটর সাইকেল ডে-তে সুরাটের এনআইটিতে নাইট এয়ার শো-টি ছাত্রছাত্রীদের কাছে ব্যাপক সমাদর পায়। এ ধরনের ইভেন্ট বিভিন্ন সময়ে এরপরে আয়োজিত হয়েছে ত্রিপুরা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, জোড়হাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিআইটিএস পিলানি, আইআইটি গুয়াহাটি, বীজপুর সৈনিক স্কুল-সহ আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে সংস্থার আক্ষেপ, এডু রেডের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ হলেও এখানেই সে অনাদৃত।

এডু রেডের তরফে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, সংস্থার বাড়বৃদ্ধির পক্ষে গবেষণাটা জোরদারভাবে করা খুবই প্রয়োজনীয় এক শর্ত। এডু রেডের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল উইংটি বর্তমানে ড্রোন নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি, কিছু জরুরি সমস্যার মোকাবিলাতেও গবেষণা চালানো হচ্ছে। তার ভিতর রয়েছে কৃষি, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কিত ক্ষেত্র। এডু রেড কিছু ক্ষেত্রে কৃষকদের ড্রোন সরবরাহের কাজ শুরু করেছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকরা কৃষিক্ষেত্রের ফলন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিতে নজরদারি চালাতে পারবেন। প্রতিরক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ক্ষেত্রে নিজস্ব গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে এডু রেড আগামী দিনে নতুন ধরনের আরও কিছু উদ্যোগ নিতে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বয়ংক্রিয় ওই ড্রোনগুলি বিশেষ ধরণের সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের যেমন কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, তেমনভাবে কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়ারও কোনও দরকার পড়ছে না। তাছাড়া, সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত এই ড্রোনগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেইসঙ্গে এগুলি তুলনায় স্বল্প দামে মিলবে। সর্বতোভাবে নির্ভরযোগ্যও।

Edu Rade

এডু রেডই এদেশের একমাত্র স্টার্ট আপ যারা এখন পুনের ডিফেন্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে একটি স্টেট অব দি আর্ট ইউএভি ল্যাব তৈরির কাজ করছে। তাই প্রায় সদ্যোজাত একটি সংস্থা হিসাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এডু রেড যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দখল করে নিয়েছে, তা থেকে ফের প্রমাণিত হয় তরুণ উদ্যমীদের দূরদর্শিতা। অথচ তাঁদের কারোরই ব্যবসা-বাণিজ্য করার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। বরং পেশাদারি জীবনের নিশ্চয়তা ছেড়ে তাঁরা ১৩ জন উদ্যমী যুবক নিজেদের সামর্থ্যে এডু রেডকে দাঁড় করানোয় স্বপ্ন দেখেছিলেন। পুঁজি ছিল দুটি। এক তাঁদের পড়াশোনা লব্ধ জ্ঞান আর বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব। তার জোরেই আজ অতি স্বল্প সময়ে সাফল্যের অনেকটা পথ পেরিয়ে ফেলেছে এডু রেড।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *