বাংলার ছেলের ঝুলিতে ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতি বসু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে শত্রুঘ্ন-অনিল
আশির দশকে পোস্টার কিংবা পোস্টকার্ডে বম্বের নায়ক-নায়িকাদের ছবি ছাপা হত। বিক্রিও হত দেদার। তখন সিনেমা পত্রিকায় ফ্রি-ল্যান্স করতেন গোপাল দেবনাথ। সেইসূত্রে টলিউডের নায়ক-নায়িকাদের ছবি তুলতে তুলতে তাঁর মনে হয়েছিল, বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকাদের নিয়েও বম্বের ধাঁচে পোস্টাকার্ড কিংবা পোস্টার করা যেতে পারে। সেটা করতে পারলে তা লাভজনকই হবে। গোপালবাবু প্রস্তাবটি পেশ করেন ‘ক্রাউন পিকচার’ নামে একটি সংস্থাকে। ওরা প্রস্তাবটি লুফে নেয়। দারুণ সফল হয়েছিল সেই উদ্যোগ। কলকাতার ফটোগ্রাফি চর্চার জগতে দ্রুত নিজের আলাদা জায়গা করে নেন গোপাল দেবনাথ।
পরিচিতদের কাছে গোপাল দেবনাথ আর উদ্যোগ সমার্থক। বর্তমানে বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি নিয়মিত দেখা যায়। কখনও কোনও সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে চাকরি করেননি। ব্যবসামনস্কতা থেকে দুটি সংস্থা তৈরি করেছেন গোপালবাবু। দেবনাথ ডিজিটাল ও স্টুডিও দেবনাথ নামে ওই দুই সংস্থাই চলছে রমরমিয়ে। স্টিল ও ভিডিও মিলিয়ে প্রায় জনা পনেরো ফটোগ্রাফার গোপালবাবুর সঙ্গে নিয়মিতভাবে কাজ করছেন।
ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হিসাবে গোপালবাবুর মানসিকতা বরাবরই ছিল ব্যবসামুখী। স্কুলে পড়াকালীনই ফটোগ্রাফিতে আকৃষ্ট হন। ঠিক করেছিলেন পরবর্তী সময়ে ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু বাবার অমত ছিল। বাবা চেয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যু্ক্ত হন তিনি। পরে অবশ্য তাঁর সাফল্য পিতাকে গর্বিতই করেছিল।
সংবাদপত্রের দুনিয়ায় গোপালবাবু কাজ করেছেন গৌরকিশোর ঘোষ বা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সঙ্গে। ৫৪ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে সেসব এখন সুখস্মৃতি। ইতিমধ্যে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। ঝুলিতে রয়েছে উত্তমকুমার অ্যাওয়ার্ড, বঙ্গ শিরোমনি সম্মান, বঙ্গ কৃতী সম্মান, সার্থক জীবন সম্মান, বাংলা চলচ্চিত্র পুরস্কার সমিতির দেওয়া পুরস্কার, ক্যালকাটা আর্ট ফোরামের দেওয়া কিশোরকুমার স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার সংসদের দেওয়া পুরস্কার, প্রমথেশ বডুয়া অ্যাওয়ার্ডের মত পুরস্কার।
ছোটবেলায় প্রতিদিন স্কুলের টিফিনের জন্য সামান্য কিছু পয়সা পেতেন গোপালবাবু। সেই সামান্য অর্থ জমিয়ে ঠিক করেছিলেন ক্যামেরা কিনবেন। টিফিনের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে একসময়ে ৪০০ টাকা হল। প্রথমে একটা ক্লিক থ্রি ক্যামেরা কিনলেন। সেই ক্যামেরা দিয়েই ছবি তোলা শুরু। যা ভালোলাগত সেই ছবিই ক্যামেরা বন্দি করতেন। সেসব ছবি দেখে অনেকে প্রশংসাও করতেন।
ক্রমে উৎসাহ বাড়তে থাকে। এরপরে কেনেন ন্যাশনাল থার্টিফাইভ ক্যামেরা। সেটি দিয়ে খবরের কাগজে ফ্রি-ল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু করেন সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র গোপাল দেবনাথ। ফটোগ্রাফির নেশায় কলেজে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ক্লাসও করেননি। তবে কলেজের নানা অনুষ্ঠানের ছবি তুলে দিতেন। পরীক্ষার আগে পার্সেন্টেজ না থাকায় পরীক্ষায় বসা নিয়ে গোলযোগ বাঁধল। পরে যদিও অধ্যাপকেরা যখন জানলেন তিনি কাগজে কাগজে ছবি তুলে বেড়ান, তখন সাতখুন মাফ।
সংবাদপত্রের সঙ্গে গোপালবাবুর যুক্ত হয়ে পড়া আকস্মিকভাবেই। কথা বলতে বলতে নিজেই জানালেন যে একদিন হঠাৎ আলাপ হয় সত্যযুগ পত্রিকার ফটোগ্রাফার অলোক বসুর সঙ্গে। তিনিই খবরে কাগজে ছবি দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সদ্য স্কুলের গণ্ডি পার করা কিশোর বয়সে সেই প্রস্তাব তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। খবরের কাগজের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সত্যযুগ পত্রিকার। বেলেঘাটায় গান্ধীজির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির সংস্কারের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর সেটি পরিদর্শনে আসেন বামফ্রন্টের তৎকালীন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী। সেই ছবিই তুলতে হয়েছিল তাঁকে।
প্রেস কার্ডের তখন বালাই ছিল না। নিজের ঝুঁকিতে ছবি তুলতে হত। ১৯৮২ সালে ব্রিগেডে ইন্দিরা গান্ধীর জনসভা পর্যন্ত কভার করেছেন বিনা প্রেস কার্ডে! পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার নানান কায়দা-কানুন শিখে নিয়েছিলেন। বুকের ব্যাজে কর্তব্যরত অফিসারের নাম পড়ে নিয়ে তাঁকে দাদা পাতিয়ে এমন ভাব দেখাতেন যেন তিনি পূর্ব পরিচিত। পাশ কাটিয়ে একবার ঢুকে পড়তে পারলে আর কেউ সাধারণত আটকাতেন না।
এভাবেই প্রেস ফটোগ্রাফির প্রায় সবক্ষেত্রে প্রথমযুগে কাজ করেছেন গোপালবাবু। তার ভিতর রয়েছে রাজনীতি, বিষয়ভিত্তিক ফিচার কিংবা সিনেমা-সংস্কৃতি।
তবে প্রেসে কাজ করতে নেমে গোপালবাবু টের পান কোনও একটি বিষয়ে স্পেশালাইজেশন করতে হবে। তখন বেছে নেন সিনেমা জগত। টলিউড। সেসময়ে একটা সাইকেল কিনেছিলেন। ক্যামেরা কাঁধে সাইকেলটা নিয়েই গোটা কলকাতা শহরটা চক্কর দিয়েছেন দিনের পর দিন।
তখন ছবি তুলতেন পেনটেক্স ক্যামেরায়। একদিন ভিক্টর ব্যানার্জির কাছে গিয়ে দরবার করেন ওঁর কয়েকটা প্রোফাইল ছবি তুলতে চান। শুনে ভিক্টরবাবু জিজ্ঞেস করেন কোন ক্যামেরায় তুলবেন? পেনটেক্স শুনে উনি বলেন, হলিউডে ওরা তো তাঁর ছবি লাইকায় তোলে। যদি পরে পেনটেক্সে ছবি তুলতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। ছবিগুলি দেখে পছন্দও করেছিলেন।
এভাবে ক্রমে সুপ্রিয়া দেবী, শতাব্দী রায়, প্রসেনজিতের মতো টলিউডের নবীন-প্রবীণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ঘরের ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠেন গোপাল দেবনাথ। গোপালবাবুর মতে দুটি পরিচয় মানুষকে উন্নতিতে সহায়তা করে। প্রথমত, কাজের পরিচয়। মানে কাজটা খুব ভালো করে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আপনার ব্যবহার। মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহারের চেয়ে বড় জনসংযোগ কৌশল আর কিছু হয় না।
বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে এখনও ছবি ছাপা হয় তাঁর। চাকরি করার অফার পেয়েছিলেন কলকাতা ও সর্বভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু চাকরি নেননি। ব্যবসায়ীর ছেলে হিসাবে ব্যবসাক্ষেত্রটা ভালো লাগত। তাছাড়া, প্রেস ফটোগ্রাফিতে ছিল অনিশ্চয়তা। চোখের সামনে কত কাগজ বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছেন। তাই ফটোগ্রাফি নিয়ে স্বাধীনভাবে কী ধরণের কাজ করা যায় সেব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখা দরকার ছিল বলে জানালেন গোপালবাবু। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কম্পানির ফটোগ্রাফার হিসাবেও কাজ পেতে শুরু করেন তিনি। এখন দেবনাথ ডিজিটাল ও স্টুডিও দেবনাথ মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফটোগ্রাফি নিয়েই কাজ করছে।
একসমেয় মুম্বইয়ের কলাকুশলীদের অনেকের ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন গোপালবাবু। অনিল কাপুর, শক্রুঘ্ন সিনহার প্রসঙ্গ টেনে আনলেন তিনি। হোপ এইটি সিক্স কভার করতে গিয়ে শক্রুঘ্ন সিনহার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। কাঁহা সে কাঁহা গুজর গ্যয়া ছবির শ্যুটিংয়ে কলকাতায় এসেছিলেন অনিল কাপুর। সেইসূত্রে ওঁর সঙ্গে আলাপ। পরবর্তী সময়েও যোগাযোগ থেকে গিয়েছে।
গোপালবাবুর পরামর্শ কাজের মানুষ হতে গেলে সবার আগে শিখে নিতে হবে মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাথার কৌশল। না হলে ফ্রিলান্স করে টিকে থাকাটাও কিন্ত মুসকিলের। জ্যোতি বসু থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও তিনি স্নেহভাজন হয়েছেন ওই একই কৌশলে।
বর্তমানে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রপত্রিকার উপদেষ্টা বা বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছেন। দেবশ্রী রায়, চিরঞ্জিত, তাপস পালের সঙ্গে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু ‘আশা’ সিনেমায়। এরপরে কড়ি দিয়ে কিনলাম, এক পশলা বৃষ্টি, লহ প্রণামের মত বিখ্যাত সিনেমায় তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। গোপালবাবু অভিনয় করেছেন পুলিশ ফাইল, ছ’দিনের গল্প, সাহিত্যের সেরা সময়ের মত বিভিন্ন নামকরা সিরিয়ালেও। বেশকিছু টেলিফিল্মেও তিনি অভিনয় করেন।
আশির দশকে কলকাতা শহরে প্রথম প্রোফেশনাল ভিডিওগ্রাফি শুরু হয় গোপালবাবুর হাত ধরেই। তাঁর হাতে তৈরি সেদিনের বেশকিছু ছাত্র বর্তমানে নামি টেলিভিশন চ্যানেলে চুটিয়ে কাজ করছেন। এছাড়াও বেশকিছু নামকরা বইয়ের প্রচ্ছদে গোপাল দেবনাথের তোলা ছবি আজও জ্বলজ্বল করে। আগামী দিনে একটি অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন গোপাল দেবনাথ। প্রয়োজনীয় সাহায্য পেলে কলকাতাতেই গড়ে তুলতে চান দেবনাথ ফটোগ্রাফি অ্যাকাডেমি।