Let’s Go

‘ক্যালকাটা ওয়াকস’, পায়ে পায়ে কলকাতা

কলকাতার পথঘাট রহস্যে মোড়া। পথে পথে কত অজানা বিস্ময়। কত ঐতিহ্যের স্মৃতি। কলকাতায় আসা বিদেশি পর্যটকদের কলকাতার ঐতিহ্য, কলকাতার পথঘাট, মানুষজন দেখানোটাই একটা দারুণ মজা। আর সেই মজা যদি রোজগারেরও রাস্তা হয়, তাহলে তো কথাই নেই! ‘ক্যালকাটা ওয়াকস’ এই কাজটিই করছে। কলকাতায় বেড়াতে আসা বিদেশি পর্যটকদের শহর ঘুরিয়ে দেখায় এই সংস্থা। প্রতি তিনঘণ্টা ঘোরানোর বিনিময়ে পারিশ্রমিক ধার্য করা রয়েছে। তবে কলকাতা দেখানোর ক্ষেত্রে বিশেষত্ব হল, কলকাতাকে ওঁরা দেখাবেন পায়ে হেঁটে। প্রাচীন শহরের নানান স্মৃতির পরশ পাবেন পর্যটকরা। যে প্রাপ্তিটা লুকিয়ে আছে পদব্রজে কলকাতা দর্শনেই।

কলকাতা আসলে হেঁটে দেখার শহর। এমনটাই মনে করে ক্যালকাটা ওয়াকস। তিন বন্ধু মিলে ক্যালকাটা ওয়াকস চালু করেন আজ থেকে সাড়ে ১০ বছর আগে। ইফতিকার এহসান, রামানুজ ঘোষ ও ঋত্বিক ঘোষ হলেন ক্যালকাটা ওয়াকসের প্রতিষ্ঠাতা। শুরু থেকে এপর্যন্ত ওঁরা ভালো কাজ করতে পারছেন। দ্রুত তাঁদের সুনাম ছড়িয়েছে বিদেশি পর্যটকদের কাছে। রামানুজ জানালেন, মূলত আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা পর্যটকদের ওঁরা কলকাতা ঘুরিয়ে দেখান। কলকাতায় ফি-বছর এই তিন দেশ থেকে প্রচুর সংখ্যক পর্যটক আসেন। তবে শুধুমাত্র এই তিন দেশ নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও পর্যটকরা আসেন তিনশো বছরের ঐতিহ্যশালী এই মহানগরীকে একবার স্বচক্ষে দেখবার জন্যে। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত লাগাতার ভাবে ওয়াক হয়ে থাকে। দিনে অন্তত ৬ ঘণ্টা হাঁটতেই হয়। মার্চের পর কিছুটা ভাটা পড়ে ব্যবসায়। ফের পুজো নাগাদ পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

ওয়াকের সময় এক একটি টিমে অন্ততপক্ষে দু’জন পর্যটক থাকতেই হবে। সেইমত ওয়েবসাইটের ক্যালেন্ডারে ওয়াকের সময়সূচি জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই রুটের ওই ওয়াকে পরবর্তী সময়ে অন্য কোনও বিদেশি পর্যটক আগ্রহী হলে তাঁদের সেই টিমে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। তবে এক একটি দলে ২০ জনের বেশি পর্যটক নেওয়া হয় না।

সাড়ে নয় বছরের ক্যালকাটা ওয়াকসের সূত্রপাতের ইতিহাসটা একটু অন্যরকম। রামানুজ, ঋত্বিক ও ইফতিকার তিনজনই কলকাতার ছেলে। কলকাতায় জন্ম। বংশ পরম্পরায় এই শহরে বসবাস। তিন বন্ধুই শহরে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। কিন্তু কখনও ভাবেননি শহর ঘুরিয়ে দেখানোই ওঁদের পেশা হতে পারে। রামানুজ বললেন, তাঁদের তথাকথিত গাইড হিসাবে না ভাবলেই ভালো। তারা তাঁদের কাজকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে ভালবাসেন। সেটা তাঁদের নিজেদের চোখে দেখা, ভালোলাগার কলকাতা। শহরের প্রতিটি প্রান্তেই ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। বিদেশি পর্যটকদের অধিকাংশই জানতে বা বুঝতে আর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে চান ঔপনিবেশিক কলকাতার চিত্রপট। সেই স্পটগুলি দেখাতেই হয়।

সাড়ে নয় বছর আগে ইফতিকারের কয়েকজন বিদেশি বন্ধু, যাঁরা আমেরিকা ও তুরস্ক থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, গাইডের মাধ্যমে কলকাতা দেখে তাঁদের ভালোলাগেনি। সেকথা তাঁরা ইফতিকারকে জানান। সেইসময়ে তাঁদের মাথায় আসে ক্যালকাটা ওয়াকস পরিকল্পনা। প্রস্তাবটা ছিল ইফতিকারের। রামানুজ ও ঋত্বিক সঙ্গে সঙ্গেই ইফতিকারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। রামানুজ জানালেন, প্রতি মাসেই মোটা টাকার কাজ হয়ে থাকে। তার চেয়েও বেশি কাজটার সঙ্গে মিলে আছে ভালোবাসা। কলকাতার তো কোনও তুলনা নেই। এখানকার মানুষও পৃথিবীর অন্য অনেক শহরের চেয়ে সুন্দর। কলকাতা বরাবরের অতিথিবৎসল। বিদেশিরা কলকাতার বাসিন্দাদের এই আত্মীয়তার স্বভাবটা খুব উপভোগ করেন বলে জানালেন রামানুজ। পর্যটকরা ক্যালকাটা ওয়াকসের নেতৃত্বে শহর ঘুরে দেখে যাওয়ার পর সে দেশ থেকে পর্যটকদের আর একটি দল এখানে ঘুরতে এলে ক্যালকাটা ওয়াকসকে রেফার করে দিচ্ছেন। এভাবেই এগিয়ে চলেছে তাঁদের ব্যবসা।

এই কাজ করতে ‌কলকাতা নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করতে হয় তিন উদ্যোগীকেই। ওয়াকের দায়িত্ব সামলান রামানুজরা তিন বন্ধু মিলেই। এছাড়া, সংস্থায় ওয়াক করানোর জন্যে চতুর্থ কোনও কর্মী নেই। কলকাতার বাইরেও এই রাজ্যের নানান জেলায় বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে যান। তবে সেক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী নন ওঁরা। জানালেন, আসলে জেলাগুলি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান নেই। রামানুজের কথায়, আগেই বলেছি, এ কাজটা কলকাতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই করতে পারছি। শুধুমাত্র ব্যবসা করতে চাইলে হয়তো আরও অনেক কিছুই করা যেত। তবে আগামী দিনে সে ধরনের কোনও পরিকল্পনাও আমাদের নেই।

বিদেশি পর্যটকদের কলকাতা দেখানোর সময় যে তিন ঘণ্টার ওয়াক হয়, তার মধ্যে অনিবার্যভাবে একটি পর্ব আছেই। তা হল কলকাতার নাগরিকদের সঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের আলাপচারিতা। রামানুজের কথায়, কলকাতার মানুষ তো যেচে কথা বলতে ভালোবাসেন। পর্যটকরা এখানকার বাসিন্দাদের এই দিকটি বেশ পছন্দ করেন। আলাপচারিতার ভাষাটা ইংরাজিই থাকে।

ইফতিকার আর্টসের ছাত্র ছিলেন। ঋত্বিক ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন। আর রামানুজ কমার্সের ছাত্র। রামানুজ বললেন, কলকাতার ইকোসিস্টেম নিয়ে এত ভালো কাজ করা যেতে পারে সেই আইডিয়াটাই আমাদের একসময়ে ছিল না। আমাদের ওই বুদ্ধিটা যোগাযোগে খুলে গেল। বিদেশিদের একটি দলকে কলকাতা ঘুরিয়ে দিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে ভালোভাবে উতরে গেলাম। তারপরে আমাদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

রামানুজ কলকাতায় বেড়াতে আসা বিদেশিদের সম্পর্কে কিছু অন্যরকম তথ্য দিলেন। যেমন, বিদেশি পর্যটকদের ভিতর অধিকাংশই কলকাতার রাস্তা ঘেঁষা দোকানগুলির খাবার চাখতে ভালোবাসেন। খাবার নিয়ে সাহেবসুবোদের তেমন কোনও বাতিক নেই। যা পান তাই খান। কৌতূহল মেটান। আসলে কলকাতায় ঘুরতে এসে ওঁরা এই শহরের সঙ্গে একাত্ম হতে চান। ওঁদের এখানকার থাবার খেয়ে পেটের অসুখ করে বলে তো শুনিনি, দাবি করলেন রামানুজ।

এই সব সুখের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রামানুজ তাঁর একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও জানালেন। বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিদেরই কলকাতা নিয়ে নানান অনীহা রয়েছে। কখনও কখনও তা শহরটার পক্ষে ক্ষতিকারক। রামানুজ বললেন, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ঘুরতে আসা এক পর্যটক তাঁকে বলেছেন, তিনি কলকাতায় আসতে আগ্রহী শুনে তাঁর পরিচিত সেদেশের নাগরিক এক বাঙালি তাঁকে পইপই করে আসতে নিষেধ করেছিলেন। এখানকার সবই নাকি অস্বাস্থ্যকর। ব্যাপারটা যে দুর্ভাগ্যজনক, তা বলাই বাহুল্য।

দর্শনীয় জায়গাগুলি বাঙালি মাত্রেই চেনা। রাইটার্স বিল্ডিংস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, দক্ষিণেশ্বর, শোভাবাজার রাজবাড়ি ইত্যাদি। বিদেশি পর্যটকদের শহর দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি তো আর গতানুগতিকভাবে বা যান্ত্রিকভাবে করা যায় না। সেকারণেই ক্যালকাটা ওয়াকস নিছক গাইডের পাট সারে না। রামানুজ, ইফতিকার বা ঋত্বিক নিজেদের পরিচয় দেন এক্সপ্লোরার হিসাবে। রামানুজের কথায়, গাইড তো রুটিনমাফিক ঘুরিয়ে দেখিয়েই খালাস। আমরা পায়ে হেঁটে কলকাতাকে এক্সপ্লোর করি। শুধুমাত্র বিদেশিদের কাছেই নয়, নিজেদের চোখেই প্রতিদিনের কলকাতাকে নতুন ও বিচিত্র হিসাবে মনে হয়। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা ভীষণই কঠিন। আসলে কলকাতাকে ভালবাসলে কলকাতা আবরণ সরিয়ে দেখাবে নিজেকে। দেখতে পাবেন শহরটার অযথাই কত বদনাম। আসলে কলকাতাকে কখনও সখনও কলঙ্কিত করেন কলকাতার মানুষই। প্রকৃতপক্ষে কলকাতা সর্বাঙ্গসুন্দর। বিদেশিরা সেটাই দেখতে আসেন এখানে। এই শহর তাঁদের বিদেশবিভুঁই থেকে টেনে আনে যে সমস্ত কারণে তার ভিতর মস্ত কারণটি হল, এখানে এসে বিনি পয়সায় এলিয়ে থাকা যায়। অতি সস্তায় পৃথিবীর যে কোনও শহরের চেয়ে এই শহরে দিনযাপন করা যায়। আর জনজীবনের গতি অতি শান্ত। কলকাতার মানুষ আগবাড়িয়ে উপকার করতে এগিয়ে আসেন। অপকার করবার প্রবৃত্তি নেই কলকাতার। কলকাতার নাগরিকরা ভালোবাসেন বিদেশিদের। বিদেশিদের নিয়ে এক ধরনের গর্ববোধ করেন। বিদেশিরাও এটা টের পান। আর খুব উপভোগ করেন।

সারা পৃথিবী জুড়ে কলকাতার সুনাম ছড়ান কিন্তু ভিনদেশিরাই। আমেরিকা, ব্রিটেন আর অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর সংখ্যক পর্যটক কলকাতায় এসে কলকাতাকে ভালোবেসে ফিরে যান নিজেদের দেশে। তাঁদের মুখে কলকাতার ভালো ভালো খবর শুনে ফের কলকাতাকে চাক্ষুষ করতে আসে পর্যটকদের আর একটি দল! এভাবেই কলকাতা বেঁচে থাকে বিদেশিদের মনে। বেঁচে থাকে ক্যালকাটা ওয়াকসের মত সংস্থাগুলি।

(চিত্রণ – পারমিতা)

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *