বারদিতে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সমাধি, নিজস্ব চিত্র
প্রসঙ্গক্রমে দক্ষিণাবাবুর আর একটি ঘটনার কথা বলি। কথাপ্রসঙ্গে একদিন মাস্টারমশাই বললেন,
– দক্ষিণাবাবু, আমরা শিলং-এ এলাম অনেক দিন হল, অথচ কামাখ্যা মাকে দর্শন করা হল না। সামনেই অম্বুবাচীর যোগ। আপনি কি বলেন?
একথা শুনে মাতৃগতপ্রাণ দক্ষিণাবাবু মাস্টারমশাইকে বললেন, মায়ের ইচ্ছে থাকলি তাঁর দর্শন করতি পারবেন।
যথানিয়মে একদিন অম্বুবাচীর যোগ শুরু হল। নিবৃত্তির দিন সকালে দক্ষিণাবাবুর ইচ্ছায় মাস্টারমশাই শিলং থেকে এলেন কামাখ্যায়। মন্দির খুলতে তখন আর সামান্য সময় বাকি। এবার মাস্টারমশাই-এর কথায়,
– ‘কামাখ্যা পাহাড়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষ আর সাধুসন্ন্যাসী প্রত্যেকেই, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসা অবস্থায় গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কারও নড়ার শক্তিটুকু নেই। গোটা পাহাড় নিস্তব্ধ, যেন প্রাণহীন। আমি আর দক্ষিণাবাবু দু’জনে মন্দিরের দরজার কাছে যেতেই পূজারি দরজা খুলে দিলেন। আমরা দু’জনে গর্ভমন্দিরে ঢুকে পুজো ও প্রণাম সেরে বাইরে আসতেই বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। দেখি, যারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল আমরা আসার সময়, এখন গোটা কামাখ্যা পাহাড় মুখরিত, প্রাণচঞ্চল। লাইনে ধাক্কাধাক্কি চলছে, চলছে চিৎকার চেঁচামেচি। খানিক বিশ্রামের পর আমরা আবার গৌহাটি হয়ে ফিরে এলাম শিলং-এ।
ফেরার পথে দক্ষিণাবাবুকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, আজ যা হল, নিজের চোখে তা দেখলাম, এটা কি ভাবে, কেমন করে সম্ভব?
দক্ষিণাবাবুর উত্তর,
– মায়ের ইচ্ছে থাকলি সবই হয়, সবই সম্ভব।
পড়ুন : আরতি কেন করা হয়, করলে তার ফলই বা কি, বুড়িমাকে জানালেন স্বয়ং গোপাল
একদিন বুড়িমা মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে এসে বসলেন। দেখলাম বেশ খুশি খুশি ভাব। ভাবটা দেখে বুঝে গেলাম একটা কিছু সুখবর আছে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনি এত হাসছেন কেন, গোপাল কিছু বলেছে নাকি?
আনন্দে ডগমগ হয়ে বুড়িমা বললেন, ‘আজ গোপাল আমারে পূজার সময় দেখাইছে,’ বলে যা বললেন, তা বুড়িমার কথা আমার ভাষায়,
– আজ পুজোর সময় ইষ্টমন্ত্র বলে মাকালীর পায়ে জবা দিতেই দেখি, জবা তুলসী হয়ে গিয়ে পড়ল আমার ইষ্ট বিষ্ণুর চরণে। একটু অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, দেখিতো, বলে একটা বেলপাতা নিয়ে ইষ্টমন্ত্র বলে শিবলিঙ্গে দিতে দেখি, বেলপাতা তুলসী হয়ে গিয়ে পড়ল আমার গোপালের চরণে। ‘এমুন অদ্ভুত কাণ্ড দেইখ্যা গোপালরে কইলাম, ও গোপাল, এটা তুমি কি দেখাও?’ গোপাল হাসতে হসতে বলল, যার যে ইষ্টদেবতা, সেই ইষ্ট ব্যতিরেকে অন্য যেকোনও দেবতাকে ইষ্টমন্ত্র বলে যেকোনও ফুল বেলপাতা তুলসী নিবেদন করলে উপাস্যের ইষ্টের প্রিয় বস্তুটি হয়ে চরণে নিবেদিত হয়। যেমন ধর বাবা, তোমার ইষ্টদেবী কালী। এখন আসনে অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহের সঙ্গে গোপালও আছে। এবার তুমি কালীর ইষ্টমন্ত্র বলে গোপালের চরণে তুলসী দিলে, সেই তুলসী জবাফুল হয়ে তোমার ইষ্টের চরণে পড়বে। এসব সত্য। চোখ খুললে (জ্ঞাননেত্র) বাবা এসব পরিস্কার দেখা যায়।
‘গোপাল আরও দেখাইছে’ বলে বললেন,
– আমরা যখন হাতের কর জপ করি, তখন করের মধ্যে, তোমাদের অলক্ষ্যে পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। ইষ্টমন্ত্র জপ করার সময় আরাধ্যদেব বা দেবী আবির্ভূত হন করে-এ ফুটে ওঠা পদ্মে। কর জপ করার সময় প্রতিটা কর-এ পদ্মের উপরে আবির্ভাব ঘটে ইষ্টের। কারণ সমস্ত দেবতার আসনই পদ্ম। কর-এ জপ করার সময় পদ্মের উপর আবির্ভাবহেতু ‘গোপাল আমারে কইছে’ হাতের চেটোকে করকমল বলে।
একদিন আমি মাস্টারমশাই আর বুড়িমা বসে গল্প করছি। হঠাৎ দেখি বুড়িমা স্থির হয়ে গেলেন। কোনও কথা নেই মুখে। মিনিট দশেক এইভাবে কাটার পর বুড়িমা একটু নড়ে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলাম,
– হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। কোথায় গেছিলেন?
বুড়িমা বললেন,
– বাবা, আজও বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের মোহনবাঁশির সুর শোনা যায়। হঠাৎ সেই বাঁশির সুর কানে আসল, তাই শুনছিলাম। পরে দেখলাম। গোপিনী আর গরুবাছুররা সব এসে কৃষ্ণকে ঘিরে ধরে বাঁশি শুনছিল, আমার বাবা বড় ভাগ্য! মাঝে মধ্যেই কৃষ্ণের পাগলকরা বাঁশির মোহিনী সুর আমার হৃদয় মন ভরিয়ে দেয়।
যেকোনও মন্দিরে, কারও বাড়িতে, যেখানে পিতলের হামাগুড়ি দেয়া গোপাল, সেখানেই গোপালের হাতে থাকে একটা জলজ্যান্ত লাড্ডু। বিভিন্ন পুজোপার্বণেও লাড্ডু কিংবা নারকেলের নাড়ু গোপালের ভোগে যেন দস্তুর। এসব দেখি কিন্তু মাথায় রাখিনা। একদিন বুড়িমা আসতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বুড়িমা, গোপালের হাতে একটা নাড়ু থাকে কেন? বিশেষ করে এমন ধরনের মূর্তির কারণই বা কি?
এমন বহুদিন গেছে, কোনও প্রশ্ন করেছি। বুড়িমা সেদিন তৎক্ষণাৎ উত্তর না দিয়ে পরের দিন এসে জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন। এ প্রশ্নের উত্তরে বুড়িমা বললেন,
– বাবা, আজ কইতে পারুম না। সকালে পূজার সময় গোপালরে জিগাইয়া কাল কমু।
পরের দিন যথা সময়ে, যথারীতি এলেন। বসলেন। এমনিতেই আমার ধৈর্য কম। সব ব্যাপারটা এই মুহুর্তে হলে ভালো। ছোটবেলা থেকে কোনও কিছুতেই আমার তর সয় না। বুড়িমা বসার সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,
– গোপালকে লাড্ডুর কথা বলেছিলেন?
বুড়িমা হাসিমাখা মুখে বললেন,
– হ্যাঁ বাবা, গোপালরে কইছিলাম। গোপাল কয়, হাতের ওটা লাড্ডু না, নারকেলের নাড়ুও না, কর্মফল। গোপাল মানুষের কর্মফল লইয়্যা বইসা আছে। যে যেমুন করে, গোপালের হাত থিকা সে সেই রকম ফলই লাভ কইর্যা থাকে। গোপাল আমারে এই কথাই কইছে।
বুড়িমা বিভিন্ন পশু পাখির ডাক বুঝতে পারতেন। বাড়িতে কখনও পাখি এসে ডাকলে কিংবা কোনও পশু ডাকলে, তার ভাষা বুঝে সেই কাজটা করতেন। যেমন, একদিন বিকেলে একটা কাক বুড়িমার উঠোনে এসে ডাকতে লাগল। বুড়িমা বলেছিলেন, ‘কাক আমাকে ডেকে বলছে সকাল থেকে এক টুকরো খাবার জোটেনি। একটু খাবার দিলে কষ্টটা কমে।’ বুড়িমা কাকের ডাক বুঝে খেতে দিয়েছিলেন।
বুড়িমার বাড়ির পাশে রাস্তায় একটা কুকুরের বাচ্চা হয়। বাচ্চাটা সামান্য বড় হতে বাড়ির সামনে এসে রোজ কুই কুই করত। কখনও বা পায়ে লুটিয়ে পড়ত। প্রতিদিন গোপালকে দেয়া পুজোর ভোগ একটু না দেয়া পর্যন্ত দরজার কাছ থেকে যেত না। এতে বুড়িমার বেশ মায়া পড়ে গেল। একদিন পুজোয় বসে বুড়িমা গোপালকে জানালেন এবং দিব্যদৃষ্টিতে গোপাল দেখালেন যা, তার মর্মার্থ হল –
বুড়িমার শ্বশুরবাড়ির কিছু সম্পত্তি পাওনা হয়েছিল। এক দেওর সেই সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে নিজের নামে লিখে নেয়। বুড়িমা বেঁচে থাকাকালীনই দেওরের মৃত্যু হয়। সম্পত্তি বঞ্চিত করার জন্য জন্ম হয় কুকুরযোনিতে। প্রতিদিন এসে বুড়িমার কাছে ক্ষমা চায় আর গোপালের ভোগ খায় উদ্ধার পেতে। বুড়িমার কুকুর বৃত্তান্ত শুরু করার তিনবছর পর একদিন এসে বলেছিলেন, ‘কুকুরটা আজ সকালে গোপালের ভোগ খাওনের পর মইর্যা গেল। অনেক কওনের পর গোপাল ক্ষমা কইর্যা আজ উদ্ধার কইর্যা দিল।’
যে সময় বুড়িমার সঙ্গে পরিচয়, তখন চরম দৈন্যময় জীবন চলছে আমার। অভাব আর কাকে বলে? এই প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনের একটা সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর জীবনীর একটা ‘প্যারা’ আজও মনে আছে আমার, ‘বছরের পর বছর ধরে, অর্ধাহারে, অনাহারে যে জীবন লিঙ্কন কাটিয়েছিলেন, যে ক্রীতদাসদের তিনি দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করেছিলেন, তারাও সে রকম দারিদ্র চোখে দেখেনি কখনও।’
আমার দুঃসহ দুঃসময় জীবনে একদিন বুড়িমাকে বললাম, আমার কথা যেন গোপাল কিংবা মাকালীকে একটু জানায়। বুড়িমা বললেন, ঠিক আছে বাবা, জিগামু।
পরের দিন যথা সময়ে বুড়িমা এলেন। বসলেন মাস্টারমশাই-এর বিছানার উপর। একটু বিশ্রামের পর বললাম,
– মা কিংবা গোপালকে কি আমার কথা কিছু বলেছিলেন?
বুড়িমা হাসিভরা মিষ্টিমুখে বললেন,
– আজ বাবা গোপাল আসে নাই, মায় আসছিল। মায়রে কইলাম, মা, শিবশংকর বড় কষ্টে আছে। ওরে তুমি দ্যাখো না ক্যান?
জানতে চাইলাম,
– মা তখন কি বললেন?
বুড়িমা বললেন,
– পদ্মের উপরে দাঁড়ানো। জ্যোতির্ময় দেহ। মাথায় সোনার মুকুট। মায়ের দু-হাত। জিজ্ঞাসার উত্তরে মায় মুখে কিছু কয় নাই। হাসিমাখা মুখে হাতটা এমুন (অভয়মুদ্রা) কইর্যা দেখাইছে।
একদিন বুড়িমা এক টুকরো আম এনে তার থেকে একটু আমাকে আর একটু মাস্টারমশাই-এর হাতে দিয়ে বললেন,
– আজ গোপালকে আম ভোগ দিয়েছিলাম। গোপাল আমাকে দেখাল, বৈকুণ্ঠে মা লক্ষ্মী আম নিয়ে নারায়ণের মুখে দিলেন, পরে নারায়ণের মুখের প্রসাদী আম লক্ষ্মী একটু খেলেন। দাদা (মাস্টারমশাইকে উদ্দেশ্য করে), লক্ষ্মী-নারায়ণের মুখের দুর্লভ প্রসাদ আপনার আর শিবশংকরের জন্য আনলাম। খেয়ে নিন।
বুড়িমার কথা শেষ হতে আমরা দু’জনে প্রসাদী আম মুখে দিতেই এক অদ্ভুত স্বাদ, সুন্দর গন্ধ দেহমনকে ভরিয়ে তুলল এক অপার্থিব আনন্দে। আজও অনুভব করি, জীবনে বহু ধরনের আম খেয়েছি তবে এমন দুর্লভ স্বাদ ও গন্ধ কোনও আমেই পাইনি। এই ধরনের স্বাদ ও গন্ধের আগে কি ‘দিব্য’ শব্দটা বসানো যায়?
একবার কালীপুজোর পরদিন। বুড়িমা এলেন মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে। নানা কথার পর বললেন,
– দাদা, কোনও মন্দির আশ্রম আর কারও বাড়িতে পুজোর প্রসাদ কেউ দিলে খাবেন না। খেলে তা ভূতপ্রেতের উচ্ছিষ্ট খাওয়া হবে। দেহমন অসুস্থ হবে। সংসারে অশান্তিও বাড়বে।
গোপাল আমাকে দেখাল, কোথাও নিয়ম নিষ্ঠা ও শুদ্ধাচারে পুজো হয় না। দেবতার উদ্দেশ্যে দেয়া ভোগ দেবদেবীরা গ্রহণ করে না। দেখলাম, ভূতপেত্নী ও পরলোকগত অতৃপ্ত আত্মা, মায়ের পার্ষদরা এসে সব ‘লুইটা পুইটা’ খায়। মায় তো দূরের কথা, কোনও দেবদেবীরাই ওসব ভোগ স্পর্শও করে না। যার জন্য তো দেখেন না দাদা, মানুষ পুজোপাঠ করে অথচ কারও কোনও কল্যাণই হয় না। ‘প্রসাদ খাইলে মানুষ অসুস্থ হয়।’
একদিন বিভিন্ন তীর্থপ্রসঙ্গে কথা হতে হতে বুড়িমা বললেন,
– ‘অখনে আর কোথাও তীর্থেই তীর্থদেবতা থাকে না।’
কেন জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানালেন,
– ভারতের প্রায় সমস্ত তীর্থ ও মন্দির ভরে গেছে অনাচারে, সেই কারণে কোনও তীর্থেই তীর্থদেবতা প্রায়ই অন্তর্হিত হয়ে থাকেন।
এই পর্যন্ত বলে একটু থেমে মাস্টারমশাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– দাদা, আমি এ দেশের একমাত্র মথুরা বৃন্দাবন নবদ্বীপ ছাড়া অন্য কোনও তীর্থে যাইনি। বৃন্দাবনে থাকার সময় রাধারানি আর গোপাল আমাকে সমস্ত তীর্থের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছে মন্দির দেবদেবী শূন্য। একমাত্র জগন্নাথক্ষেত্র, কাশী, কালীঘাট ও বৃন্দাবনে রাধারানি ও কৃষ্ণ সদা সর্বদা অবস্থান করেন। অন্য তীর্থগুলিতে ভক্তের আকুল আর্তি অনুসারে দেবদেবীরা তাৎক্ষণিক আবির্ভূত হয়ে ভক্তকে করুণা করে অন্তর্হিত হন।
কথাপ্রসঙ্গে বললেন,
– কালীঘাটে শিলায়িত বিগ্রহ এত তেজ ও জ্যোতিঃপূর্ণ যে, কোনও মানুষ ওই বিগ্রহের সামনে ইচ্ছা থাকলেও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। সুন্দর ও সুস্থভাবে অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই তাঁকে দর্শন করতে পারে তাঁরই ইচ্ছায়। মায়ের তেজ এত তীব্র যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তা নেওয়ার শক্তি অতি অল্প মানুষেরই আছে। কালীঘাটে সব সময়ই দেখবে, মায়ের বিগ্রহের সামনে গুঁতোগুঁতি ধাক্কাধাক্কি লেগেই আছে। খুব সামান্য সময়ই দাঁড়িয়ে দর্শন করতে পারে মানুষ। কেউ না কেউ মায়ের ইচ্ছাতেই আপনা থেকে ধাক্কা দিতে থাকে মূর্তির সামনে থেকে সরানোর জন্য। বাবা, কালীঘাটে বিগ্রহ দর্শনের ক্ষেত্রে এ ধারার রোধ হবে না কোনওদিনই।
এরপর বুড়িমা বলেছিলেন,
– কালীঘাটে মায়ের তিনটি ভাব কাজ করে সারা দিনে। খুব ভোরে মা থাকেন শান্ত ও প্রসন্ন অবস্থায়। ভক্তের কামনা ও প্রার্থনা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ভোরবেলাই প্রশস্ত, আর প্রশস্ত সময় সন্ধ্যারতির সময় থেকে রাতে শয়নের পূর্ব পর্যন্ত। বেলা যত বাড়তে থাকে কালীঘাটের কালী তত চঞ্চল উত্তপ্ত ও ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। ভক্তের আর্তি মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ভোর আর সন্ধ্যার পরটাই ভালো।
একদিন বুড়িমা এলেন। সারা মুখখানায় খুশি ও আনন্দলহরি বয়ে চলেছে উত্তাল বেগে। দেখামাত্র আমার আর তর সইল না। বললাম,
– বুড়িমা, আজ কি ব্যাপার, এ্যাতো খুশি খুশি ভাব!
বুড়িমারও যেন তর আর সইল না। আদি ও অকৃত্রিম হাসিমাখা মুখে বললেন মাস্টারমশাইকে,
– দাদা, আজ আমার বড় ভাগ্য। ঘুম থেকে উঠেছি খুব ভোরে, তখনও বাড়ির কেউ ওঠেনি। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখছি ‘আমাগো উঠানে মা যশোদা গরুর দুধ দোয়াইতাছে আর গোপাল গিয়া যশোদার পিঠের উপরে লাফাইয়া লাফাইয়া পড়তাছে। আমি ভাবলাম, ভুল দেখি না তো? গায়ে চিমটি কাইটা দেখলাম, দেহে সার আছে কি না? দেখলাম, সব ঠিকই আছে।’
সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,
– আপনি কি এসব জ্ঞাননেত্রে দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন?
উত্তরে বুড়িমা বললেন,
– না বাবা, আমি চর্মচক্ষুতে দেখছি। আমি তো এ্যামনে চোখে দেখি না। গোপাল আমার চক্ষু দুইটারে কি যেন কইর্যা দিল। আমি আগের দৃষ্টিতেই মা যশোদা আর গোপালরে রক্ত মাংসের দেহেই দেখলাম। মিনিটখানেক পর ধীরে ধীরে দুজনাই মিলাইয়া গেল। আগের দৃষ্টিশক্তিও গেল হারাইয়া। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। গোপাল আমারে দিনের পর দিন অনেক লীলাই দেখাইছে কিন্তু এমুনটা দেখলাম এই প্রথম।
মাস্টারমশাই-এর দীক্ষা হয়েছিল নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে। দীক্ষা নিয়েছিলেন ব্রজবিদেহী মহন্ত শ্রীশ্রীসন্তদাস বাবাজি মহারাজের সরাসরি মন্ত্রশিষ্য শ্রীশ্রীমনোহরদাস কাঠিয়া বাবাজি মহারাজের কাছ থেকে। দীক্ষাস্থান ভুবনেশ্বরে কাঠিয়াবাবার আশ্রমে। মনোহরদাসজি থাকতেন বৃন্দাবনের আশ্রমে। মাস্টারমশাই-এর আর্থিক অবস্থা ছিল করুণ তবুও প্রতিমাসে কিছু প্রণামী পাঠাতেন বৃন্দাবনে।
একদিন বুড়িমা দুটো টাকা এনে মাস্টারমশাইকে দিয়ে বললেন,
– ‘দাদা, এই প্রণামীটুকু ঠাকুরজিকে পাঠাইয়া দিবেন।’
মাস্টারমশাই বুড়িমার টাকা পাঠিয়ে দিলেন বৃন্দাবনে। প্রণামীর প্রাপ্তি স্বীকার করে মনোহরদাসজি একদিন মাস্টারমশাইকে চিঠিতে জানালেন,
– ‘জ্ঞানদাপ্রসাদ, তুমি যে দিদির প্রণামী পাঠিয়েছো তা ঠাকুরজির ভোগে নিবেদন করা হয়েছে। তুমি যে দিদির সঙ্গ করো, জেনে রেখো, অতি উচ্চমার্গের সাধিকা তিনি। সংসারজীবনে রাগাত্মিকা ভক্তির অধিকারিণী এমন মহিলা কোটিতে একটা পাওয়াও বড় মুশকিল।
‘রাগাত্নিকা ভক্তি’ শব্দের অর্থ আমার জানা নেই। অধ্যাত্মসাধনার কোন স্তরে উঠলে এমন ভক্তি লাভ হয়, তা আজও আমার বোধের বাইরে।
একদিন বুড়িমা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসলেন মাস্টারমশাই-এর ঘরে। কথাটা বলার জন্যই যেন তাঁর তাড়াতাড়ি আসা। সেদিন পুজোর সময় যে ঘটনার কথা বললেন তা শুনে আমি আর মাস্টারমশাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এবার বুড়িমার কথা আমার ভাষায়,
– আজ সকালে উঠে রোজ যেমন গোপালের পুজো করি তেমন পুজোয় বসেছি। ফুল দিয়ে গোপাল, মা কালী, লক্ষ্মীনারায়ণ, গুরুদেব সমেত আসনের অন্য সব দেবদেবীদের সাজালাম। সবার শেষে দেয়ালে টাঙানো লোকনাথ ব্রহ্মচারীবাবার ফটোর উপরে যতবার ফুল দিয়ে সাজাই, ততবারই ফুল পড়ে যায়। একবার, দুবার করে কয়েকবার ফুল পড়ে যাওয়ার পর ভাবলাম, ‘এইবার ফুল পইড়্যা গেলে তোমারে এক চড় মারুম।’ মনে মনে এই ভেবে আবার দিতেই ফুলটা পড়ে গেল। আমি আর কিছু ভাবলাম না। ঠাস করে গালে একটা চড় মেরে দিলাম।
এই পর্যন্ত বলে বুড়িমা একটু থামলেন। দেখলাম, দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে নেমে এল অশ্রুধারা। তারপর বললেন,
– ব্রহ্মচারীবাবার ছবিতে চড় মারার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত মাংসের দেহে বাবা ঘরে এসে হাজির। আমি ওই দেখে ভয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,
– বাবা, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা কর।
একথা বলতেই ব্রহ্মচারীবাবা হাসতে হাসতে বললেন,
– তুমি তো মা। ছেলে অবাধ্য হলে মা ছেলেকে মারবে না তো কে মারবে। তোমার কোনও অপরাধ হয়নি। আমি ইচ্ছে করেই ফুল ফেলে দিচ্ছিলাম। তোমার প্রতি আমি প্রসন্ন। আসলে তোমাকে দেখা দেওয়ার জন্যে ওটা আমার ছলমাত্র। এই কথা কটা বলে ব্রহ্মচারীবাবা দেয়ালে টাঙানো ছবির মধ্যে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন।
একদিন আমি, মাস্টারমশাই আর বুড়িমা বসে কথাবার্তা বলছি। এমন সময় এলেন তপন ভট্টাচার্য। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। আমাদের সকলের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল গভীর। সদগুরুর আশ্রিত। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষিত। স্বামী ভূতেশানন্দজির মন্ত্রশিষ্য। প্রথমে বেলেঘাটায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন, পরে ডানকুনিতে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছিলেন। অবসরের পর শুনেছি তিনি এখন আর দেহে নেই। তপনদা বুড়িমার দৈবী বিষয়টা জানতেন।
যাইহোক, চারজনে গল্প করার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বুড়িমার দেহটা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। খানিক পর আচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ গীতার সংস্কৃত শ্লোক সুন্দর ও স্পষ্ট উচ্চারণ করে পাঠ করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে থামছেন আবার পাঠ করছেন। এইভাবে চলল প্রায় মিনিট পনেরো। তারপর ধীরে ধীরে আত্মস্থ হলেন। এবার বুড়িমা যা বললেন তা আমার ভাষায়,
– দাদা (মাস্টারমশাইকে), আজ এখন গোপাল দেখাল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দেখলাম, শ্রীকৃষ্ণ রথে বসে গীতার শ্লোক বলে তার ব্যাখ্যা করছেন, অর্জুন একাগ্রচিত্তে হাঁটুগেড়ে করজোড়ে বসে শুনছেন। শ্রীকৃষ্ণ গীতার যে শ্লোক বলেছেন, তা মহাশূন্যে দেখলাম সোনার অক্ষরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। আমি সেগুলি দেখলাম আর গোপাল আমার কণ্ঠে বসে ওই শ্লোকগুলি পাঠ করতে লাগল।
আরও অনেক কথা বলেছিলেন বুড়িমা, এখানে লেখা হল মাত্র কয়েকটা কথা। অবাক হয়ে মাস্টারমশাই সেদিন বলেছিলেন, যে মহিলা সংস্কৃত জানেনা সে গীতার শ্লোক এমন সুন্দর ও শুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করলেন কেমন করে?
পড়ুন : মাকালী নিজে স্বর্গলোক ঘুরিয়ে দেখালেন দৃষ্টিহীন বৃদ্ধাকে
ভারতবিশ্রুত মনীষী ও সাধক, মহামহোপাধ্যায় ডক্টর গোপীনাথ কবিরাজ ‘একটি অদ্ভুত বালকের কথা’ শিরোনামে একটি বালকের কথা লিখেছেন তাঁর অমর গ্রন্থ ‘সাধুদর্শন ও সৎপ্রসঙ্গ’ (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে। তিনি কাহিনির শুরুতেই লিখেছেন –
‘১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে আমার একটি পুরাতন বন্ধু কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলিয়াছিলেন, “কাশীতে কিছুদিন হইতে একটি অদ্ভুত বালকের বিষয়ে নানাস্থানে আলোচনা হইতেছে এবং কোন কোন পত্রিকাতেও তাহার সম্বন্ধে কিছু কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। শুনিতে পাওয়া যায় বালকটি স্থূল শরীর ত্যাগ করিয়া সূক্ষ্ম শরীর অবলম্বন পূর্ব্বক দেহের বাহিরে বহুস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া থাকে এবং লোকান্তরে উপস্থিত হইয়া যেখানে যাহা কিছু অনুভব করে, দেহে প্রত্যাবর্ত্তনের পরে সকলকে সে সম্বন্ধে বর্ণনা করিয়া ব্যাখ্যা করে। ইহার প্রকৃত রহস্য কি, তাহা বুঝিতে পারি না।’…
গোপীনাথ কবিরাজের সঙ্গ করা বালকের লোকান্তরে যাওয়ার পদ্ধতিটা এক ধরনের, বুড়িমার ব্যাপারটা আর এক। কিন্তু তাঁদের দিব্যজগতে ভ্রমণ, অনুভব ও দেখা ব্যাপারটায় তেমন কোনও পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয়নি।
এখন জিজ্ঞাসা হল, দিব্যদৃষ্টিটা কেমন আর দিব্যচক্ষুটাই বা কি? যোগশাস্ত্রে দিব্যচক্ষু ও দিব্যদৃষ্টির কথা বলা আছে। যখন ভ্রু-যুগলের মাঝখানে অবস্থিত দ্বিদল আজ্ঞাচক্রে মানুষের মন স্থিতিলাভ করে, তখন দিব্যচক্ষু লাভ হয়। দিব্যচক্ষুতেই দিব্যদৃষ্টি লাভ হয়, চর্মচক্ষুতে নয়। দিব্যচক্ষুকে জ্ঞাননেত্র বা প্রজ্ঞানেত্র বলে।
এই অপ্রাকৃত চোখ দিয়ে পৃথিবীতে থেকে টেলিভিশনের মতো পরিস্কার দেখা যায় স্বর্গলোক থেকে শুরু করে সমস্ত উর্দ্ধলোকের বাইরে ও ভিতরটা। ক্রিয়াযোগের মাধ্যমে জাতিধর্ম নির্বিশেষে নারীপুরুষ প্রত্যেকেই এই চক্ষুলাভ করতে সক্ষম হন।
কুরুরাজের অমাত্য ছিলেন সঞ্জয়। তিনি দিব্যচক্ষু লাভ করেছিলেন ব্যাসদেবের করুণায়। যার জন্য ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপ্রাসাদে বসে দিব্যদৃষ্টিতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ দেখে তা নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রকে। এই প্রজ্ঞানেত্রের কথা গীতাতেও উল্লিখিত আছে।
১৯৮০ সালের জানুয়ারি। কনকনে ঠান্ডা। আগ্রা থেকে যাত্রা শুরু করেছি, চলেছি রাজস্থান হয়ে গুজরাট। সে বারের ভ্রমণ ছিল সংরক্ষিত বগিতে। সারাদিন গোটা জয়পুর ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরেছি স্টেশনে। যথানিয়মে রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়েছি। কখন ট্রেন ছেড়েছে জানি না। হঠাৎ বুড়িমার মুখখানা ঘুমন্ত অবস্থায় চোখে ভেসে উঠল ঝলকমাত্র। কানে এই শব্দকটা শুনলাম, ‘আমি চললাম বাবা’। ঘুম ভেঙে গেল। মনটা গেল খারাপ হয়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভোর সাড়ে চারটে। মাস্টারমশাই-এর ফোন নেই যে একটু খবর নেব।
ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম। গেলাম মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে। বললাম জয়পুরে চলমান ট্রেনে যা দেখেছিলাম, শুনেছিলাম কানে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ‘শিবশংকর তোমার দেখা ও শোনাটা ঠিক। বুড়িমা নেই।’