Feature

অন্ধ বৃদ্ধা কখনও গোপাল, কখনও মাকালীর হাত ধরে পৌঁছে যেতেন গন্তব্যে

আমি তো চোখে দেখি না, যেদিন গোপাল আমার সঙ্গে থাকে সেদিন আমার বড় কষ্ট হয়। হোঁচট খাইলে মায় ধইরা ফেলে, গোপাল ধরতে পারে না। বাচ্চা, ধরবো ক্যামনে।

বুড়িমার বিবাহ হয় অল্প বয়েসে। অশীতিপর বৃদ্ধার দেহরক্ষা নব্বইতে। তিনি দারুণ রসিকতা বুঝতেন, করতেনও। একদিন বললাম,

– বুড়িমা, আপনার গোপাল ভালো, না মায় ভালো?

কথাটা শুনে বুড়িমার সেকি হাসি। হাসতে হাসতে ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত দুটো বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– বাবা, তুমি মাঝে মাঝে এমুন কথা কও, না হাইসা পারি না। আসলে গোপাল চ্যাংড়া। বোঝে কম। আমি তো চোখে দেখি না, যেদিন গোপাল আমার সঙ্গে থাকে সেদিন আমার বড় কষ্ট হয়। টানতে টানতে লইয়াসে। আমি তো বুড়ি হইয়া গেছি। গোপালের মতো ছুটতে পারি নাকি? গোপাল সেটা বোঝে না। আসলে পোলাপান তো! মায় সঙ্গে থাকলে কোনও কষ্ট হয় না। আমি যেমুন চলি, মায় আমার হাত ধইরা তেমুন চলতে থাকে। হোঁচট খাইলে মায় ধইরা ফেলে, গোপাল ধরতে পারে না। ও তো বাচ্চা, ধরবো ক্যামনে। বাসে উঠলে আর গোপাল সঙ্গে থাকলে কেউ সিট ছাইড়া বসতে দেয় না। মায় সঙ্গে থাকলে কেউ না কেউ আমারে বসতে দেয়। মায় থাকলে আমার কোনও কষ্ট হয় না। মায় তো!

বুড়িমা মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে এসে গোপাল সম্পর্কে এক এক দিন এক একটা দারুণ দারুণ তাঁর দর্শনের কথা বলতেন। একদিন এসে বললেন আমাকে,

– বাবা, গোপাল আজ তোমার মায়রে দেখাইছে।

বুড়িমা মাকালীকে মা বলতেন না, মাকালীও বলতেন না। ‘মায়’ বলতেন। আমার দীক্ষা হয়েছে কুমারী ও সন্ন্যাসিনীর কাছ থেকে। বুড়িমা আমার গুরুমাকে কখনও দেখেননি। দীক্ষা হয়েছে এই পর্যন্ত জানতেন। ‘তোমার মায়’ বলতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,

– কোন মা? কালী মা, না গুরুমা?

বুড়িমা বললেন,

– গোপাল আজ তোমার গুরুমাকে দেখাইছে। লম্বা চওড়া, গায়ের রঙ দারুণ ফরসা। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। চোখে চশমা। গেরুয়া বসন। গলায় রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিকের মালা। দুই বাহুতেও রুদ্রাক্ষর মালা পরা। পায়ের পাতা দুইটা ছোট্ট ছোট্ট। তোমার মা দীর্ঘকাল কাশীতে থাকাকালীন…। গোপাল আমারে দেখাইছে আর ওইসব ঘটনার কথা মুখে কইয়া দিছে।

আমার গুরুমা কাশীতে ছিলেন টানা ৩৫ বছর। ওই সময় তাঁর সাধনজীবনের অনেক গোপন রহস্য ও কথা গোপালের মাধ্যমে বুড়িমার মুখ থেকে সেদিন জানতে পারি, যে কথা গুরুমা কাউকে কোনও দিন বলেননি। আমি বুড়িমার মুখে তা শুনে কথার সত্যতা স্বীকার করে আমাকে বলে দেন, আমি যেন সে কথা গোপন রাখি।

একদিন সকালে বুড়িমা যথারীতি মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে এলেন। কোনও কথা না বলে সমানে মিটিমিটি হাসছেন। আমি এটা লক্ষ্য করে মাস্টারমশাইকে ইশারায় বললাম, ব্যাপারটি কী? বুড়িমার আজ এত খুশি খুশি ভাব! এবার বুড়িমাকে বললাম,

– আজ এখানে আসার পর থেকে কোনও কথা বললেন না। নিজের মনেই হেসেই চলেছেন। আমরা কি কোনও অপরাধ করেছি আপনার কাছে?

সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,

– না বাবা, তোমাগো কোনও অপরাধ হয় নাই। কাল একটা কি ঘটনা ঘটেছে জানো? আমি পূজার সময় ফল ফুল তুলসী সব গুছাইয়া রাখছি। গোপাল আইয়া সব ছড়াইয়া লণ্ডভণ্ড কইরা দিল। যতবার গুছাই তত বারই ওই রকম কইরা দেয়। শেষে না পাইরা কইলাম, গোপাল অখনে আর একবার তুমি এমন করলে এমন পিটামু, সারা জীবন তোমার মনে পড়বো আমার কথা, বুঝলা? এরপর মারের ভয়েতে গোপাল আর কিছু করে নাই। সারাদিন আমার কাছে আসে নাই, কিছু দেখায়ও নাই। বুঝলাম, গোপাল আমার উপর রাগ করেছে। রাতে মনে মনে কইলাম, গোপাল সোনা, আমার উপর রাগ কইরো না। কাল তোমারে মিছরি মাখম দিমু। তুমি না আইলে আমি থাকুম ক্যামনে। আজ ভোরে গোপাল আমারে ঘুম থেকে উঠাইয়া কয়, আমার মাখন মিছরি কই? বাবা (আমাকে উদ্দেশ্য করে) এসব কথা কাউরে কইতে পারি না। তোমারে আর দাদারে (মাস্টারমশাই) কইলাম। ওসব কথা মনে হওনে আমি হাসতে ছিলাম।

একেবারেই গরিব ঘরের ছেলে আমি। বুড়িমার সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমার অবস্থাটা ছিল এই রকম, একটা জামা আর একটা প্যান্ট পরছি পাঁচ বছর ধরে। একজোড়া ফুটপাথের প্লাস্টিকের চটি পরছি তিন বছর ধরে। ছিঁড়ে গেলে তার দিয়ে সেলাই করি নিজে। অভাব আর কাকে বলে! একমাত্র মা, ছোট বোন, ছোট ভাই ছাড়া এ জগতে আত্মীয় বলতে সঙ্গে আর কেউ নেই। এখন আমাকে অনেকে আত্মীয় বলে, আমি বলি না। অভাবটা এমন পর্যায়ে এল, পরপর দুদিন হাঁড়ি চড়ল না বাড়িতে। এত কষ্টের মধ্যেও জ্যোতিষশাস্ত্রের শিক্ষা গুরুর কাছে জ্যোতিষ, শাস্ত্রীয় শিক্ষা গুরুর কাছে শাস্ত্র শিক্ষায় যাওয়া আর বুড়িমার কাছে দৈবী জগতের কথা শোনা, এর কোনওটাতেই একবিন্দু অবহেলা নেই। হাত পা সবই আছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। গর্ভধারিণী মায়ের অসহ্য কষ্ট দেখেও কিছু করতে পারছি না। চরম অভাবে অনেক সময় না খেয়ে দিন কেটেছে তবুও কারও কাছে হাত পাতিনি। হাত পাতার অভ্যাসটা কোনও কালেই ছিল না, আজও নেই। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম,

– বুড়িমা, গোপালকে আমার কথা একটু বলবেন, আমি বড়ো কষ্টে আছি। কথাটা শোনামাত্র অন্তর্যামী বুড়িমার ধবধবে সাদা ফরসা মুখখানা আষাঢ়ের মেঘে ঢেকে গেল। মনে হল কী যেন ভাবলেন মুহুর্তমাত্র। পরে বললেন,

– ঠিক আছে বাবা, সকালে পুজোর সময় তোমার কথা জিগামু।

আমি অপেক্ষায় রইলাম, সারা দিন রাত পার হয়ে সকালের অপেক্ষায়। সকাল হল। বেলা বাড়ল। যথা সময়ে আমি উপস্থিত, বুড়িমাও এলেন মাস্টারমশাই এর বাড়িতে। আমার আর তর সইল না। বললাম,

– বুড়িমা, আমার কথা কি গোপালকে বলেছিলেন?

উত্তরে বুড়িমা বললেন,

– বাবা আজ গোপাল আসে নাই, মায় আসছিল। জ্যোতির্ময় চেহারা। মায়ের দুই হাত। পদ্মের উপর দাঁড়ানো।

জানতে চাইলাম,

– আমার কথা মাকে কিছু বললেন?

বুড়িমা বললেন,

– হ্যাঁ বাবা কইছিলাম। কইলাম, মা, শিবশংকর বড় কষ্টে আছে। তুমি ওরে দেখ না ক্যান?

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– মা কী বলল?

উত্তরে বুড়িমা বললেন,

– বাবা, মায় কিছু কয় নাই, এমুন কইরা (অভয়মুদ্রা) হাত দেখাইছে।

এতক্ষণের কথা ও কাহিনি কোনও পুরাণ উপপুরাণের নয়। ভক্তের জীবনে ঘটে যাওয়া বালগোপালের লীলা কথা। গোপাল বড় হয়ে এক সময় পরিণত হলেন শ্রীকৃষ্ণে। তাঁর অনন্ত ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে থেকে মাত্র দুটি কাহিনী বহুকাল ধরেই রয়েছে আমার হৃদয় মন জুড়ে। গোপাল–শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সেই জীবন কথা প্রসাদের কণা মাত্র আজ বিতরণ করা পাঠকের পাতে।

Show More

One Comment

  1. দাদা, আমার প্রণাম নিবেন।অবশ্যই ভাল আছেন মায়ের কৃপায়।আমি আপনার প্রতিটা পোষ্ট পড়ি আর ভাবি এ ও কি সমভব?জীবনে অন্তত ১ বার আপনার দর্শনের প্রতীয় রইলাম।জয় শালার বেটি, হদেরছাড়ী॥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *