Let’s Go

এই মন্দিরে মানত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, সুস্থ হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র সেন

একসময় এই মন্দিরের দুয়ারে এসে আকুল আকুতি জানিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ওরে এই মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন’।

Published by
Sibsankar Bharati

গভীর ঘন জঙ্গল। বেত আর হোগলাপাতার বনে ভরা সুতানুটি গ্রাম। কোলাহল নেই। একেবারেই শুনশান। এরই খুব কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে পুণ্যতোয়া ভাগীরথী।

একসময় হিমালয়ের গিরি কন্দরে তপস্যারত কালীবর নামে এক সন্ন্যাসী দেবী কালিকার প্রত্যাদেশ পেলেন। হিমালয় ছেড়ে এসে সাধন আসন স্থাপন করলেন সুতানুটির বেত আর হোগলা বনে। তপস্যায় প্রীত হলেন দেবী। সন্ন্যাসীকে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে বললেন তাঁর নির্দেশিত স্থানে। যথা সময়ে সে কাজ সম্পন্ন করলেন সন্ন্যাসী। পরে এক কাপালিকের হাতে নিত্যপূজার ভার দিয়ে তিনি চলে গেলেন তাঁর পূর্ব নির্ধারিত পথে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেও সন্ন্যাসী কালীবর প্রতিষ্ঠিত দেবী কালিকার সামনে দেওয়া হত নরবলি।

এ কাহিনী ও জনশ্রুতি জড়িয়ে আছে বাগবাজারের দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালীকে নিয়ে। প্রথম প্রতিষ্ঠার সাল তারিখ আজও অন্ধকারে। কুমোরটুলির কাছাকাছি ৫১২ রবীন্দ্র সরণিতেই প্রতিষ্ঠিত দেবী সিদ্ধেশ্বরী।

এবার আর জনশ্রুতি নয়। ১৬৮৬/৮৭ সালের কথা। তখন কলকাতার জমিদার হলওয়েল। আজকের বারাকপুর তথা অতীতের চণক থেকে ভাগ্যের খোঁজে সুতানুটিতে এলেন গোবিন্দরাম মিত্র। বসতি গাড়লেন কুমোরটুলিতে। ভাগ্যের চাকা ঘুরল। পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতায় সাহেব জমিদারের সহকারী হলেন ব্ল্যাক জমিদার মিত্র মশাই। ১৭২০-১৭৫৩ সাল পর্যন্ত ওই পদে থেকে উপার্জন করলেন অগাধ ধনরত্ন ও অর্থ। বাগবাজারের মন্দিরটি তিনি নির্মাণ করলেন ১৭৩০/৩২ সালে। মন্দিরে স্থাপিত দেবী মূর্তিটি মৃন্ময়ী। আয়ত নয়ন। প্রায় সাধারণ মানুষের উচ্চতা। দেবীর বাম চরণের দিকে সম্পূর্ণ দিগম্বর শ্বেত মহাদেবের মাথা। অনাড়ম্বর দেবী বিবস্ত্রা নন, বসনে দেবী নয়নাভিরাম। বর্তমানে দুটি খাঁড়া আছে। একটি আধুনিক, আর একটি প্রাচীন। কত বছরের প্রাচীন তা কারও জানা নেই। ক্ষয়প্রাপ্ত খাঁড়াটি দেখলে অভিভূত হতে হয়।

একসময় এই মন্দিরের দুয়ারে এসে আকুল আকুতি জানিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ওরে এই মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন’।

উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাপুষ্ট। ঠাকুর একদিন বলেছিলেন, ‘উপেন যা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে মানত কর, তোর এক দরজা যেন শত দরজায় পরিণত হয়’।

ব্রাহ্ম সমাজের কেশবচন্দ্র সেন একবার বেশ অসুস্থ হলেন। এ কথা জানতে পেরে রোগমুক্তির কামনায় পরমহংসদেব বাগবাজারে সিদ্ধেশ্বরীর কাছে মানত করেছিলেন ডাব আর চিনি।

নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনিও আসতেন সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কাছে। জীবনের প্রতিটি রচনা করা নাটক তিনি দেবীর চরণে উৎসর্গ করতেন প্রথমে। আদর করে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’ বলতেন বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীকে।

একসময় দেবী মন্দিরের নাম ছিল নবরত্ন মন্দির। শোনা যায়, অক্টারলোনি মনুমেন্টের চেয়েও অনেক উঁচু ছিল এর চূড়া। সেটি ভেঙে পড়ে ১৮৪০ সালের ভূমিকম্পে। সেকালে সাহেবরা মন্দিরটিকে বলত ব্ল্যাক প্যাগোডা, কেউ বা নাম দিয়েছিল ‘মিত্রের প্যাগোডা’।

১২২৬ সনে ২৭ অগ্রহায়ণ সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ বেরিয়েছিল সেকালের ‘সমাচর দর্পণ’ পত্রিকায় –

‘‘মোং কলিকাতা বাগবাজারের রাস্তায় এক সিদ্ধেশ্বরী প্রতিমা বসে আছেন। তাঁহার নিকটে অনেক ভাগ্যবান লোকেরা পূজা দেন এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা প্রতিদিন বিশ ত্রিশজন চণ্ডীপাঠ ও স্তব কবচাদি পাঠ করেন এবং ধনবান লোকেরা স্বর্ণ-রৌপ্যাদি গঠিত অনেক অলংকার তাঁহাকে দিয়াছেন এবং তাঁহার নিকটে অনেক লোক মানত পূজা বলিদানাদি অনেক করেন। সম্প্রতি গত সপ্তাহে জ্যোৎস্না রাত্রিতে অনুমান হয় ছয় দণ্ড রাত্রির সময়ে এক চোর তাঁহার ঘরের জানালা ভাঙিয়া অনুমান পাঁচ সাত হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার চুরি করিয়াছে। পরে থানায় খবর লইলে বরকন্দাজেরা অনুসন্ধান করিতে করিতে এক বেশ্যার ঘরে সেই অলংকার কতক পাইল এবং সে বেশ্যাকে তখন কয়েদ করিল। ঐ বেশ্যার প্রমুখাৎ শুনা গেল যে এক ব্যক্তি কর্ম্মকার জাতি চুরি করিয়াছে; ঐ বেশ্যালয়ে তাহার গমনাগমন আছে কিন্তু সে কামার পলাইয়াছে, সে ধরা পড়ে নাই।’’

Share
Published by
Sibsankar Bharati

Recent Posts