Festive Mood

হোলির আগে নেড়া পোড়া, ভগবান বিষ্ণুর মাহাত্ম্যে ঘটা এক অজানা ঘটনা

রঙের উৎসবের ঠিক আগের দিন রাত থেকেই খড়, কাঠ, বাঁশ, ঘুঁটে নিয়ে তৈরি করা হয় এক কাঠামো। উল্লাসের সাথে সেই কাঠামোয় আগুন ধরিয়ে দেন মানুষজন।

Published by
Mallika Mondal

সে পুরাণ যুগের কথা। স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে পাওয়া যায় মায়াবী রাক্ষসী ‘হোলিকা’-র কথা। সম্পর্কে যিনি দানবরাজ হিরণ্যকশিপুর প্রিয় বোন। সেই রাক্ষসীর ছিল এক অদ্ভুত ক্ষমতা। প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে আগুন কোনওভাবে স্পর্শ করতে পারত না তাকে। আগুনের ভিতরে দিব্যি ঢুকে একেবারে অক্ষত অবস্থায় বাইরে বার হয়ে আসত হোলিকা। তার সেই অলৌকিক ক্ষমতাকেই নিজের স্বার্থে একবার কাজে লাগাতে চান মহর্ষি কাশ্যপ ও দিতিপুত্র রাজা হিরণ্যকশিপু। কি সেই স্বার্থ?

আসলে দানবরাজ হিরণ্যকশিপু ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। কারণ, শ্রীবিষ্ণুই বরাহ অবতারে তাঁর ভাই হিরণ্যক্ষকে হত্যা করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে তো হিরণ্যকশিপু জ্বলছিলেনই। তাছাড়া, কূটনীতিবিদ নারায়ণ নানারকম ছলনার ফাঁদে ফেলে বারবার অসুরদের বোকা বানান। এইরকম একজনকে কেউ আবার পুজো ভক্তি শ্রদ্ধা করে নাকি!

সেই রাগে তাঁর রাজত্বে এক কঠিন নির্দেশ জারি করেন হিরণ্যকশিপু। প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনওভাবে বিষ্ণুকে পুজো করা চলবে না। নাহলে মৃত্যুদণ্ড একেবারে অবধারিত। প্রাণ নিয়ে টানাটানি বলে কথা! প্রজারা তো ভয়ে বিষ্ণুর উপাসনা দিলেন বন্ধ করে। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর নিজের ঘরেই এক পরমভক্ত বিষ্ণুপ্রেমী নির্ভয়ে প্রিয় দেবতার উপাসনা চালিয়ে যেতে লাগল। আর সে হল খোদ হিরণ্যকশিপুর সন্তান প্রহ্লাদ।

বাবার নির্দেশ অমান্য করে প্রহ্লাদের বিষ্ণু পুজো করার খবর গিয়ে পৌঁছল প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী রাজার কাছে। অতএব নির্দেশমতো ছেলেকে মেরে ফেলার নানারকম পদ্ধতির প্রয়োগ করতে থাকলেন হিরণ্যকশিপু। আর প্রতিবারই বিষ্ণুর কৃপায় বেঁচে যেতে থাকল প্রহ্লাদ।

ঘর শত্রু বিভীষণকে ভীষণ শাস্তি দিতে অতএব ডাক পড়ল হোলিকার। তাকে দেওয়া হল খুদে ভাইপো প্রহ্লাদকে মারার দায়িত্ব। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য বিষ্ণুর উপর হোলিকারও রাগ কোনও অংশে কম ছিলনা। তাই দাদার কঠোর নির্দেশ পালন করতে নারায়ণ ভক্ত প্রহ্লাদকে নিয়ে হোলিকা প্রবেশ করে অগ্নিকুণ্ডে।

বালক প্রহ্লাদ তো নির্ভয়ে পিসির কোলে বসে অগ্নির লেলিহান শিখার মধ্যেই মনে মনে বিষ্ণু নাম জপ করতে লাগল। নিষ্পাপ একনিষ্ঠ ভক্তের কাতর ডাকে নারায়ণ কি আর সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন! অতএব বিষ্ণুর কৃপায় আগুনের ক্ষমতা থাকল না ভক্ত প্রহ্লাদের ত্বক স্পর্শ করার। উল্টে ক্ষমতার অপব্যবহার করায় নারায়ণের কোপে বরই শাপ হয়ে গ্রাস করল হোলিকাকে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল অশুভ আসুরিক শক্তি।

হোলিকার সেই অগ্নিদগ্ধের কাহিনি বছরের পর বছর ধরে সাড়ম্বরে উৎসবের মেজাজে পালিত হয়ে চলেছে দেশের কোণায় কোণায়। দোল বা হোলি মানে শুধু রঙের খেলা নয়। দোল মানে যা কিছু অশুভ, বিবর্ণ অথবা জীর্ণ, সেইসব কিছুকে দূরে সরিয়ে নবরূপে আগামীর সূচনা। সেই কথা মাথায় রেখেই দোলের আগের দিন আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় শুদ্ধ করে তোলা হয় প্রাণ মন আত্মা। ফাগের রাঙা আগুনের প্রাকলগ্নে অগ্নিদহনের মধ্য দিয়ে বিনাশ করা হয় রাক্ষসী হোলিকার জাদুশক্তিকে। যাতে অশুভ শক্তির কুপ্রভাবের হাত থেকে যুগে যুগে উদ্ধার পায় শুদ্ধপ্রাণ প্রহ্লাদের মত শত শত মানবাত্মা।

দেশের নানা প্রান্তে অগ্নিদহনের সেই যজ্ঞ ‘বুড়ি পোড়ানো’ বা ‘নেড়া পোড়া’ বা ‘চাঁচর পোড়ানো’ নামে পরিচিত সকলের কাছে। রঙের উৎসবের ঠিক আগের দিন রাত থেকেই খড়, কাঠ, বাঁশ, ঘুঁটে নিয়ে তৈরি করা হয় এক কাঠামো। উল্লাসের সাথে সেই কাঠামোয় আগুন ধরিয়ে দেন মানুষজন। তাতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় নোংরা ফেলে দেওয়ার মত জিনিসপত্র। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। সেই আগুনে পুড়তে থাকে হোলিকা রাক্ষসী। পুড়তে থাকে যাবতীয় অন্যায় অনাচার অশুভ শক্তির দাপুটে প্রকাশ।

Share
Published by
Mallika Mondal

Recent Posts