চিত্রণ – সংযুক্তা
লুকোনো ছেঁড়া গেঞ্জির মতো হরিহরের সময় খারাপ যাচ্ছে।
একদিন সামান্য ছুটকো একটা স্বপ্ন দেখার পর হরিহরের জীবনের বর্ণপরিচয় পলকে পালটে গেল। ঘুমের মধ্যেই সে শিশুর মতো জেগে উঠল। অবাক হয়ে দেখল, একটা লোক তার পায়ের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবছায়ার মতো, তাজ্জব ব্যাপার, মাথায় চমৎকার আলোর মুকুট।
ছন্নছাড়া হাড়-হাভাতের ঘর হরিহরের। আধভাঙা ট্যারা একটা খাট, দেয়ালের দড়িতে পুরনো নোংরা জামাকাপড়। কাউকে বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। হরিহর বলল, ‘কে ভাই?’
লোকটার মুখ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। অথচ তার চাঁদের আলোর মতো টুকরো হাসিটা হরিহর অবিকল দেখতে পেল। লোকটা দেববাণীর মতো শান্ত মধুর স্বরে বলল, ‘আমার নাম নেই। তবু তোমরা একটা নাম দিয়েছ।’
হরিহর তো হাঁ। ‘কী নাম’?
লোকটা লাজুক হেসে বলল, ‘আমার নাম সময়’।
চমকে উঠে বোবা হয়ে গেল হরিহর। তোতলানো উত্তেজনায় তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বুকে আটকে গেল। অন্তরাত্মা হু হু করে উঠল হঠাৎ। বলল, ‘তুমি বড়ো বেরসিক মশাই। কোথায় ছিলে অ্যাদ্দিন?’
‘আমি তো এতদিন এখানেই ছিলাম।’
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য মানুষের জীবন, আয়ু ভোগে চলে যাচ্ছে। আমিও তো তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি সময়দা’।
‘তোমাকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি হরিহর কডুই।’
ঢোক গিলে হরিহর বলল, ‘বলুন স্যার…।’
‘যা নেই তাকে কেন খোঁজ? তুমি যতক্ষণ আছ, সব আছে। তুমি নেই, কিছু, কিছুই নেই। এই সহজপাঠ জানো না?’
অবুঝের মতো হরিহর বলল, ‘বেশি বোঝা মানেই বোঝা। জীবন ছোটো, সময়ও ছোটো। তুমি সামান্য কদিন আলোর মুকুট পরে আমার কাছে থেকে যাও সময়দা। আমার সময় বড় খারাপ যাচ্ছে। শরীর মন ভালো না’।
‘সময় নেই’ বলে সে আস্তে আস্তে দেয়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। হরিহর সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার মতো ঘোর ঘুমঘোরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল… সময়দা… সময়দা….
।।২।।
মাধবদা আপন মনে টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করছিল। বড় ভালো লোক। মাধবদা মাঝে মাঝে তাকে চা-বিস্কুট খাওয়ায়। দু-দশ টাকা ধারও দেয়। হরিহরের মনে থাকেনা বলে, সে মাধবদার ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবেনা। হরিহর বেয়ারা হলেও বাবুর মেজাজে থাকে। কারণ ডিপার্টমেন্টের সবারই তাকে দরকার। হরি আয়, শোন হরি।
আজ হরিহরের কী যে হল, সে খুনি আসামীর মতো মাধবদার হাতের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাধবদার প্রচুর ক্ষমতা। প্রতিদিন সময় মতো অফিস করে। প্রোমোটারির বেওসাও করে। মিছিল-মিটিং করে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। আবার পুজোটুজোয় কপালে বিশাল সিঁদুরের টিপ পরে ‘মা, মাগো’ বলে কালীবাড়ির চাতালে কপাল ফেলে দেয়। পান চিবোতে চিবোতে মাধবদা হঠাৎ হরিহরের মুখের দিকে সকৌতুহলে তাকাল। পানের খয়ের ছাড়া গোপাল সুরভী জরদার ঘনরস গিলে মাধবদা বলল, ‘দেশের খবর বল’।
হরিহর বিনীতভাবে বলল, ‘একটা কথা ছিল’।
‘বল’।
‘সময়দাকে কখনো দেখেছো?’
মাধবদা হরিহরের মুখের দিকে সোজা তাকাল। মুচকি হেসে বলল, ‘বড়লোকদের জিজ্ঞেস কর গে।’
‘না না, টাকা পয়সার কথা নয়। আপনার সময়দার সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছে?’
আয়েস করে মাধবদা একটা সিগারেট ধরাল। আঙুলে তিন তুড়ি মেরে গম্ভীর গলায় বলল, হুঁ…।’
যেন হামলে পড়ল হরিহর। গলা কেঁপে গেল। ‘তোমার সঙ্গে কী কথা হয়েছে?’ তার সঙ্গে আমার সত্যিকারের দেখা হওয়া দরকার।’
হরিহর বেঁটে। লম্বা মাধবদা তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ত্রিকালদর্শীর মতো ঘন মোলায়েম গলায় বলল, ‘ওরে পাগল, ভয় কীরে? আমি তো আছি। অস্থির হলে চলে? সময়ের পিছনে যত ছুটবি সময় ততই তোকে লাগ ভেলকি লাগ খেলা দেখাবে। চুপটি করে ঘাপটি মেরে থাক। সময়, সময়তো তোর সঙ্গে দেখা করবে। হাসবে। কাঁদবে। খেলা করবে। আবার হাত-পা ছড়িয়ে গালগল্পও করবে। সময় ভারি চমৎকার বস্তু।’
একটু চুপ করে মাধবদা আবার বলল, ‘আমি বড় ব্যস্ত আছি। আর একদিন সময়-ফময় নিয়ে আলোচনা সভা করা যাবে। ঠিক আছে?’
ঝিমিয়ে পড়েছিল হরিহর। ঠিক কী যে আছে কে জানে।
বলল, ‘আমার সময় যে বড় কম।’
হঠাৎ মাধবদা চোখ কুঁচকে মিনিট খানেক আকাশ পাতাল কী ছাই চিন্তা করে বলল, ‘এক কাজ কর হরি।’
যেন স্বপ্নের মধ্যেই হরিহর জেগে উঠল। ‘কী?’
‘তুই একটা নগদ বিয়ে কর।’
‘কী!’
‘বেশি না, মাত্র একটা করলেই হবে। ওই একটার মধ্যেই শুধু সময় কেন, সময়ের চোদ্দ গুষ্টি দেখবি। পলকে পলকে ইহকাল দেখবি। পরকালও দেখবি। খণ্ড খণ্ড বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখবি। ঠিক আছে? তবে এই কথাই থাকল?’
কী কথা যে থাকলো, হরিহর একদম মনে করতে পারল না।
দিন যায়। যায় দিন। দিনের পর দিন, রাত চলে যায়। রাস্তায়, ট্রামে, বাসে অনন্ত চলন্ত মানুষের মুখের বিরামহীন স্রোতের দিকে ভিখারির মতো তাকিয়ে থাকে হরিহর। দেখতে দেখতে ভাবে, এবার এই মুহুর্তে সমূলে চমকে উঠবে। আলুর বস্তার মতো ঠাসা ভিড়ের ভেতর থেকে দুহাত তুলে ম্যান অফ দা ম্যাচের মতো সময়দা তাকে ডাকছে, ‘এই যে শ্রী হরি, আমাকে তোমার মনে আছে তো? আমি, এই যে, এখানে।’
।।৩।।
মাধবদার পরামর্শে, আদেশে এবং পরম ঘটকালিতে অঘ্রানের এক ডাঁশা সন্ধেবেলায় বাপ-মা মরা এক অসহায় অনাথ মেয়েকে কালীঘাটে প্রায় নিখরচায় বিয়ে করে ঘরে এনে তুলল হরিহর। সদ্য বিয়ে হওয়া নবদম্পতির গলায় ঝুলে আছে সস্তা গাঁদা ফুলের মালা।
ভেলকির খেলা, আশ্চর্য, নতুন আনকোরা বউটা ঘরে দাঁড়ানো মাত্রই সেই স্বপ্নের আলোয় মুকুটের মতো ঘরটা যেন ঝলমল করে উঠল। অদ্ভুত এক সুখ-দুঃখ মেশানো অব্যক্ত কাঁপুনিতে হরিহর কী যে করবে বুঝতে না পেরে ট্যারা প্রতিবন্ধী জানালাটা দড়াম করে হিন্দি ফিল্মের নায়কের মতো খুলে দিল। আর খোলা মাত্রই জানলার অদূরে সাত কিশোরীর বাঁশবনের চেরা ঝোপের মধ্যে আবছা হলুদ চাঁদ আলগোছে সুসময়ের মতো ঝুলে আছে। আহা, বড় মহার্ঘ্য দৃশ্য। দরিদ্র থ্যালাসেমিয়া জানালার কার্নিশে জন্মজন্মান্তরের স্বর্গ ফর্সা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। হরিহরের মনে হল, এই হাত বাড়ালেই বাঁশবনের সদ্যজাত নরম পাতা থেকে শান্তির মতো ঠান্ডা আলো আঙুলে উঠে আসবে।
সতীর মুখের দিকে তাকাল হরিহর। দুর্গা ঠাকুরের মতো তার মুখ থেকে যেন স্বর্গের আলো চিক চিক করছে। খাটে বসল হরিহর। সতীও বসল। একটু পরে হঠাৎ সতীর সুখের আবেগে গলা বুজে গেল। ‘তোমাকে সুখী করতে পারব তো?
অনাথ হরিহর সুখ সহ্য করতে না পেরে ঝপ করে কেঁদে ফেলল। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘তোমার মতো কেউ এভাবে বলেনি।’
সতী ফুলের মতো আলতো করে স্বামীর রোগা শুকনো হাত বুকে চেপে ধরে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল, তারপর যেন স্বপ্নের স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ গো, আমার এত সুখ সহ্য হবে তো?’
।।৪।।
অদ্ভুত এক আচ্ছন্নের মতো, সুখের মতো হরিহরের কয়েকটা দিন কেটে গেল। মাঝে মাঝে সে সন্ত্রাসবাদীর মতো লুকিয়ে তার গৃহকর্মনিপুণা স্ত্রীকে দেখে। আর মনে মনে ভাবে, ‘এই কী আমার স্বপ্নে দেখা সময়দা? সেই কী স্ত্রীর রূপ ধারণ করে এসেছে?’
একদিন ফাঁক পেয়ে মাধবদা হেসে বলল, ‘একটু দেরি করে বিয়ে করে ভালোই করেছিস। ফ্রিজের দইয়ের মতো প্রেম জমে ভালো।’
হরিহর বলল, ‘কবে সময়দার সঙ্গে দেখা হবে?’
যাত্রা পার্টির বিবেকের মতো অট্টহাসি হেসে মাধবদা বলল, ‘ওরে পাগল মাথার ওপর তোর বউ আছে। ভয় কী রে? পুরুষের জীবনে বউ হল আসল সময়।’
নিঃশ্বাস ফেলে হরিহর বলল, ‘সংসারে অনেকদিন থাকলাম। সময়দাকে একবার বড় দরকার।’
‘কী দরকার?’
‘যাওয়ার আগে জীবনটাকে একটু সুন্দর করে দেখে যেতে চাই।’
মাধবদা সান্ত্বনার ঢঙে বলল, ‘তুই এখন ঘোর সংসারী। সব সময় সতীর কথা ভাববি। সুখী হবি। ফালতু চিন্তা ছাড় হরি।’
কী যেন একটা বলতে গিয়ে হরিহর ঝপ করে চুপ করে গেল। কাউকে মনের কথা বলা যায় না। বোঝানোও যায় না। বহুকাল একা থাকার ফলে হরিহর কোনোকিছুই সেভাবে নিজের মতো করে, স্বার্থপরের মতো আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না। ফলে সারাজীবন আকাঠ বোকাই থেকে গেল সে।
ভিতরে জ্বর জ্বর মনে হচ্ছিল। পা দুর্বল লাগছিল হরিহরের। কেমন যেন অসহায় লাগছিল নিজেকে। এক সময় সে নিজের চেয়ারে, মানে বেঁটে কাঠের টুলে এসে বসল। টুকরো টাকরা ছেঁড়া চিন্তাভাবনা মনে ধাক্কা মারছিল। সতী রাতে ঘুমিয়ে পড়লে, হরিহর তার ঘুমন্ত মুখ, সহজ অথচ রহস্যময় শরীরের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে! আবিষ্কার করার চেষ্টা করে।
এই সেদিন এক ঝুপ ঠান্ডা রাতে তার মাথার মধ্যে কী যেন একটা ঘটে গেল। হরিহর বড়ো আস্তে করে সতীর ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। সতীর থুতনি ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘তুমি কী আমার সুসময়? সময়দা?’
‘কে?’ সতী ভয়ে আঁতকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল।
‘আ… মি… হরিহর কডুই।’ হরিহর যেন হাতেনাতে ধরা পড়া চোর।
সতী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে আপন মনে একটু হাসল। খোলা জানলা দিয়ে হালকা কুয়াশা মাখা ফিকে আলো মশারির গায়ে এসে পড়ছে। সেই প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও হরিহরের মনে হল, হাসিটা যেন সেই মুকুটের আলোর মতো সতীর মুখে একটু ফুটে আছে। নিশ্চিন্তে একটা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে সতী বলল, ‘ও কী করছিলে গো?’
যেন জ্ঞান ফিরে এল হরিহরের। ঢোঁক গিলে বলল, ‘কী যেন স্বপ্ন দেখছিলাম।’
ভোর হয়ে আসছে। সতী আধঘুমে হরিহরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। নিজের বুকে চেপে ধরে শান্ত গলায় বলল, ‘ভয় কী! আমি তো আছি।’ সতীর গরম নিঃশ্বাস হরিহরের ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
সতীর গোটা শরীরের মধ্যে বর্ষাভেজা কচি ঘাসের গন্ধ। সেই গন্ধ সুখে পাগল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কথা হরিহরের। কিন্তু কোথায় ঘুম! হরিহর বলল, ‘আচ্ছা সতী, সময়দাকে কখনও দেখেছ?’
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সতী। শোনা মাত্রই চমকে উঠল যেন সে। ঘুম নিমেষে উধাও। বলল, ‘আরে, তুমি চেন নাকি? আমার সঙ্গে রোজই দেখা হত।’
ধড়াস করে উঠল হরিহরের বুক। চাপা উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল সে। গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। মুহুর্তে সতীকে ছেড়ে বিছানায় উঠে বসল হরিহর। কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে?’
একটু চুপ করে থাকল সতী, তারপর ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল, ‘সে আর এমন কী? জানো, সময়দার ভাগ্য খুব খারাপ। দুর্ঘটনায় তার একটা পা নেই। কোথাও যেতে পারে না। আমার বাপের বাড়ির সামনের ফুটে বসে সারাদিন চটিজুতো সেলাই করে। খুব ভালো চটিও বানায়। তোমার পায়ের মাপ দিও, সুন্দর একটা চটি বানিয়ে দিতে বলব সময়দাকে।’
হরিহর মাথা নাড়ল কী নাড়ল না বোঝা গেল না। কোথায় ছিল তার এত ঘুম। বড়ো বেশি করে আস্তে করে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম আসছে, যেন অতল অনন্ত ঘুম। যেন মরণ ঘুম। সেই আধভোরের সর্বগ্রাসী ঘুমে হরিহর অনেক দিন পর আবার স্বপ্ন দেখল। আলোর মুকুট পরে হরিহর নিজেই সুসময়দার কাছে গেছে। তার কপালে মা দুর্গার মতো ত্রিনয়ন। সেই অবিনশ্বর মহাজাগ্রত ত্রিনয়ন থেকে টর্চের তীব্র আলো পড়ামাত্রই সময়দার কাটা পা জোড়া লেগে গেল আশ্চর্যভাবে। সময়দা দু’পায়ে সোজা দাঁড়িয়ে হরিহরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।
।।৫।।
‘আরে বিমল?’ বিমলও ডাকল, ‘অ্যায় হরি।’
দুই বন্ধুর অনেকদিন পর মুখোমুখি দেখা। কথা বলতে বলতে দুজন চৌমাথার পেট্রোল পাম্পে ঝুনুর পাতি হোটেলে ঢুকল। সন্ধে হয় হয়। ছোট ছোট ভিড় ঢুকছে বেরচ্ছে।
ঢুকতে ঢুকতে বিমল কাকে যেন চিৎকার করে বলল, ‘দেখ, কোন পাগলাকে এনেছি। এক বেহেড রিকশাওয়ালা টলতে টলতে হোটেল থেকে বেরিয়ে, আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে কাকে বলল কে জানে, ‘ভালো তো? ঠিক। সত্যি ঠিক তো? আসলে শালা কোনটা ঠিক, বেঠিক আমি তার কী জানি। আমি বউ এর খোঁয়াড়ে পোষা বাচ্চাশুয়োর।’
হরিহর কোনও কথা না বলে ব্যাপারটা দেখে মজা পেল। হোটেলের মালিক ঝুনু দিনরাত ক্যাশে ব্যাঙের মতো অমায়িকভাবে বসে থাকে। হরিহরকে দেখে খুশি হয়ে হাত নেড়ে বলল, ‘অনেকদিন পর। এনি প্রবলেম?’
হরিহর শুধু মুচকি হাসল। কোনও উত্তর দিল না।
দুই বন্ধু হাসতে হাসতে একটা কোণের টেবিলে গিয়ে নিরিবিলিতে বসল। বিমল এলাকার ‘বিমলা’ সিনেমার লাইটম্যান। হরিহর আয়েস করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর বলল, ‘এখনও কবিতা লিখিস? না ছেড়ে দিয়েছিস?’
বিমল কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘না, এখন আর আগের মতো কবিতা লিখিনা। জাবরকাটা গরুর মতো এখন মানুষের মন ক্লান্ত। এখন আমি প্রতিদিন গুনে যাই জীবনের বিচিত্র সুদ আর একটা বাচ্চাশুয়োর।’
হরিহর কবিতার ক-ও বোঝে না। তবু বন্ধুকে খুশি করার জন্য মূর্খ-জ্ঞানীর মতো বলল, ‘এই লাইন দুটোর জন্য তোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত।’
‘আমি দেশের সব থেকে সফল ভাবে ব্যর্থ কবি। একদিন আমরাই দেশ, মানুষের জীবন পালটে দেব’, বলে বিমল হাসতে লাগল। দুই বন্ধুর মধ্যে কে যে বুঝে, আর কে যে অবুঝের মতো হাসল কে জানে। হাসির ঢেউ সামলে বিমল বলল, ‘শুনলাম বিয়ে করেছিস? বউ কেমন হল?’
সবকিছু বলা যায়। বউ বর্ণনা করা যায় না। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বউ হল হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর শিলালিপি। দুর্বোধ্য। মোদ্দা কথা হল, হরিহরের সকালে যেমন লাগে বিকেলে অথবা রাতে তেমন লাগেনা। আবার রাতে যেমন, পরদিন সকালে সতীকে তেমন লাগে না। বড় রহস্য। বউ হল ইত্যাদি।
বিড়ি ধরিয়ে বিমল বলল, বউ এর সঙ্গে সবকিছু হয়, আসল জিনিস হয়না।’
ঝুঁকে হরিহর বলল, ‘কী?’
‘বউ এর সঙ্গে কখনো প্রেম হয় না।’
অবাক হয় হরিহর। বিমল বলেটা কী! একটু চুপ থেকে হরিহর বলল, ‘বিমল, তবে কার সঙ্গে প্রেম হয়?’
‘প্রেম এমন একটা কী জানি না, যা কারও সঙ্গে হয় না’ – বলে বিমল নির্বিকারভাবে হরিহরের দিকে তাকাল।
পড়ন্ত শীতের বেলা। আধ ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো সন্ধ্যে চোখের সামনে ঝুলতে ঝুলতে নামছে। হালকা কুয়াশা। ডুবন্ত মেঘের ডালে ডালে কচি তারারা জেগে উঠছে।
ইতিমধ্যে ঝুনুর বাচ্চা ছেলেটা এক পাইট বাংলা বস্তু, আর দু’প্লেট তড়কা টেবিলে রেখে গিয়েছিল। হরিহরের খিদে পেয়েছিল। হাত বাড়িয়ে খানিকটা তড়কা খেয়ে নিল সে।
বিমল ছিপি খুলে বলল, ‘তোর বিয়েতে আনন্দ করব ভেবেছিলাম, হল না। আজ যখন তোকে পেয়েছি, তোর বৌভাত হয়ে যাক এই টেবিলে।’
বোতলের দিকে তাকিয়ে হরিহর বলল, বুঝলি বিমল, আমি আজকাল স্বপ্নের নেশায় ডুবে থাকি। নতুন করে কী আর নেশা হবে?’
দু’বন্ধু চুর হয়ে ঘরপোড়া গরুর মতো বুঁদ হয়ে বসে থাকল। হঠাৎ হরিহর বলল, কেমন আছিস বি-মল?’
বিমল উত্তর দিতে যাবে এমন সময় ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে বলল, ‘এভাবেই বেঁচে আছি আমরা।’ বলে খুক খুক করে কাশতে কাশতে হাসতে লাগল। এই অন্ধকার দুই বন্ধুকে আরও কাছে এনে দিল। হরিহরের দিকে ঢুলন্ত চোখে তাকিয়ে বিমল জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের জন্য বেঁচে আছি আমরা?’
হরিহরের জিভ ভার হয়ে আসছে। এক চামচ তরকা মুখে ফেলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘সংসার যেন ঠেলাগাড়ি, তুই-আমি ঠেলাওয়ালা। শুধু ঠেলার জন্যে বেঁচে আছি।’ বলে হঠাৎ তার মনে পড়ল, সতী অপেক্ষা করে বসে আছে। হরিহর ভাবল, একটু আগে থেকে নয়। এই কুয়াশা ঢাকা অন্ধকারে সে সারাজীবন ধরেই একা এই ভাবে বসে আছে।
টেবিলে ঝুনুর অর্ধাহারের রোগা বাচ্চা ছেলেটা একটা সরু কাঠির মতো মোম দিয়ে গেল। ব্যাস, সব উল্টোপাল্টা, গণ্ডগোল হয়ে গেল। হরিহর ডবল মোম, ডবল বিমল, ডবল দুনিয়াকে দেখতে লাগল। ডবল অন্ধকারও দেখতে লাগল। শুধু নিজেকে হরিহর ডবল দেখল না। সিঙ্গলও দেখল না। মহামুশকিল। শুধু নিজের মধ্যেই নেই সে।
বিমল গ্লাস ফাঁকা করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর উপহাসের ভঙ্গিতে টলন্ত স্বরে বলল, ‘আমরা বেঁচে থেকেও মরে থাকব। মরেও বেঁচে থাকব। প্রতিদিন মরবো, আবার বাঁচার মতো বেঁচে উঠবো। এই জীবন বড় সুন্দর। বাঁচা সুন্দর, মরাও সুন্দর। একমাত্র মৃত্যু বাচ্চাশুয়োরের মতো বেঁচে থাকবে।’
হরিহরের মাথা টলছে। নেশার ভারে চোখ প্রায় বুজে আছে। শরীর গভীর অসুখের মতো দুর্বল। কোনোরকমে বলল, ‘বি-ই, বিম-লে, আমি বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। সতী ভাতের থালা নিয়ে আ-মার জন্যে ব-সে আছে’।
ফাঁকা জনহীন মধ্যরাতের শহরতলীর রাস্তা। হোটেল প্রায় ফাঁকা। ক্যাশের বাক্সে ক্লান্ত ঝুনু কপাল ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে। হালকা নাক ডাকার শব্দ আসছে। গোটা পৃথিবীটা যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, অলৌকিক মহাশূন্যে ঝুলে আছে।
বিমল যেন ঘুমঘোরে বলল, ‘আমি এই টেবিলে বাকি রাত থেকে যাব। তুই এই অবস্থায় বাড়ি যেতে পারবি তো? ও হরি বল?’
সিরসির করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। এখনও লোডশেডিং। হঠাৎ একগাল হেসে হরিহর বলল, ‘আমার বাড়ির রাস্তাটা বলবি বি-মলে?’
বিমল বলল, ‘আগে আমারটা বল? অনেকক্ষণ ধরে সত্যিকারের বাড়িটা খুঁজছি। হরি, আর দেখা হবে কিনা জানি না। নিঃশ্বাসকে বিশ্বাস নেই। গুড মর্নিং হরি…ই। বল হরি, হরিবোল…’
।।৬।।
পড়ন্ত শীতের অনন্ত অন্ধকার আর ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে প্রায় ভাসতে ভাসতে, টলতে টলতে নিস্তব্ধের মতো শেষ রাতে হরিহর এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ল। কোনোক্রমে গরীব শরীরটা ভিতরের জোরে টেনে তুলে দু পা এগিয়ে যাওয়া মাত্রই হরিহরের মাথার মধ্যে কী যেন একটা ফেটে চুরমার হয়ে গেল। অনেক দূরে, রক্তহীন এক খেজুর গাছের ডালের ডগায়, ডাঁশা চাঁদ ফুলঝুরির মতো জ্বলছে।
সমস্ত অন্তরাত্মা সমেত হরিহরের বুক ধড়াস করে উঠল। তার প্রতিবন্ধী বাড়িটা আলকাতরা অন্ধকারে বড় বেশি যেন ডুবে আছে। অথচ কাটপিস বারান্দাটা প্রচণ্ড চোখ ধাঁধানো মারকাটারি আলোয় ঝলসে যাচ্ছে। সেই স্বপ্নে দেখা স্বর্গের আলোর মতো।
টাল সামলে হরিহর শুয়োরের মতো টলতে টলতে ছুটে গিয়ে তার নরম পা দুটো নিজের বুকে সজোরে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে উঠল। ‘সময়দা, তোমাকে যখন কাছে পেয়েছি, ছাড়ছি না। আমার ঘরে থাকতেই হবে। সতীর রান্নার হাত বড় ভাল। সময়দা… আমার সময়দা…’
চমকে উঠে সতী বললে, ‘আরে করো কী?’ ‘ছিঃ.. ছিঃ…. ওঠো… ওঠো….’ — চিত্রণ – সংযুক্তা