স্রোতস্বিনী বশিষ্ঠ গঙ্গা, নিজস্ব চিত্র
লেখাপড়া জানেন না সাধুবাবা অথচ কথাবার্তা শুনে তা মনেই হচ্ছে না। অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কোনও প্রশ্ন এখন আর করছি না। কথায় ছেদ টানলে বিরক্ত হতে পারেন এই ভেবে। এবার তিনি চোখবুঝে বললেন,
– অলৌকিক ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শবসাধন, পাদুকাসাধন, কর্ণপিশাচী সাধন, মধুমতী সাধন ইত্যাদি অনেক সাধনের কথা আছে। তাছাড়াও আছে ভূতপ্রেত পিশাচসাধনও।
একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কর্ণপিশাচী সাধনাটা কি?
চোখ খুলে তাকালেন আমার মুখের দিকে। একবার দেখে নিলেন চারপাশটা। পরে বললেন,
– কর্ণপিশাচী হল উপদেবতা। দেবতার স্তরে নয় এরা তবে তাদের মতো অনেক শক্তিই ধারণ করে। অপদেবতা নয়। ভূত প্রেত পিশাচকে বলে অপদেবতা। এই দেবীর সাধনায় আপেক্ষিক সর্বজ্ঞতা লাভ হয়। অপরের মনে কি চিন্তার উদয় হয়েছে কিংবা প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তর দেবী অন্যের অগোচরে সাধকের কানে কানে জানিয়ে দেন। যেমন ধর, প্রশ্নকর্তার কি নাম, কোথা থেকে আসছে, কি উদ্দেশ্য, কি প্রশ্ন নিয়ে, কবে কি হবে, কি করলে ভাল হবে এই সব আর কি।
সাধুবাবা একটু নড়ে চড়ে বসলেন। এতক্ষণ বসে ছিলেন একভাবে। এবার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল। বলিষ্ঠতার সুরে বললেন,
– তন্ত্রের প্রত্যক্ষ ক্রিয়া দেখেছি জীবন বহুবার বহু সাধুসঙ্গে। এতে আমার যে ধারণা দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয়েছে, তাতে এটুকু বুঝেছি তন্ত্রের মন্ত্র এবং তার নির্ভুল প্রয়োগে মানুষের অনেকরকম ক্ষতি করাটা যত সহজ, উপকার করা সবক্ষেত্রে তত সহজ নয়। যেমন ধর মারণ, উচাটন, বশীকরণ, বিদ্বেষণ, বগলামুখী, বগলা প্রত্যঙ্গিরা, শ্মশানকালীর কবচ ইত্যাদির সাহায্যে শত্রুর উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব সৃষ্টি করা যায়।
অশেষ নির্যাতনের মাধ্যমে রোগগ্রস্ত করে যেমন পাঠানো যায় মৃত্যুর হিমঅন্ধকারে, তেমনি বাবা শান্তিস্বস্ত্যয়নের দ্বারা দুর্বার বিপত্তি, গ্রহবৈগুণ্য, রাজরোষ, দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকেও রক্ষা করা যায় অনায়াসে।
এবার একটু নিচু স্বরে বললেন,
– তবে একটা কথা আছে। কোনও তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিক যদি প্রলোভনে বশীভূত হয়ে অথবা অকারণে অন্যের অনিষ্ট করতে থাকেন তবে তার সাধনলব্ধ শক্তি অতি দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেখানে সাধককে ভগবান কখনও ক্ষমা করেন না। নিঃস্বার্থভাবে লোককল্যাণে শক্তি প্রয়োগে করলে তন্ত্রার্জিত শক্তি কখনও নষ্ট হয় না।
এ কথায় প্রশ্ন মনে এল। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, বর্তমান সমাজে তান্ত্রিক যারা তাদের সম্পর্কে…
আমার কথা হাতের ইশারায় বন্ধ করতে বলে তিনি বললেন,
– বর্তমানে ধর্মকে ভাঁড়িয়ে একশ্রেণীর ভ্রষ্টতান্ত্রিক আর বৈরাগীদের অর্থোপার্জনের সোজা পথ হয়েছে এই তন্ত্র। কারণ তন্ত্রের লৌকিক অলৌকিক, সত্যমিথ্যা কিংবদন্তি দেশের অধিকাংশ নারীপুরুষের মনে বদ্ধমূল। ফলে তান্ত্রিকদের মনে করে অসীম শক্তিমান। ভয়ে ও ভক্তিতে পড়ে এদের খপ্পরে। তবে ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি, জোয়ান বয়েসের বউ আর পয়সা ধরে রাখা যতটা কঠিন ঠিক ততটাই কঠিন তান্ত্রিক হওয়া।
বাবা, খরিদ্দারের অভাব নেই, অভাব হয় না কোনওকালেই। কারণ বিভিন্ন সমস্যার কষাঘাতে আজকের মানুষ জর্জরিত বিভ্রান্ত বিপন্ন। সংসারের নানা অভাব অশান্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে ছুটে যায় এদের কাছে। কারণ এরা নাকি স্বর্গের ‘টপবেস্ট’ সুন্দরী মেনকা রম্ভা থেকে শুরু করে একতুড়িতে ইন্দ্রের সমস্ত রাজত্ব, কুবেরের পৈতৃকধন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এ কথায় হেসে ফেললাম। তিনি থামলেন না। বললেন,
– একটু খোঁজখবর করলেই দেখতে পাবি অধিকাংশ গৃহীদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আর ফ্যামিলি জ্যোতিষীর মতো বাঁধা আছে ফ্যামিলি তান্ত্রিক। ছেলের ডাইরিয়া থেকে শুরু করে প্রমোশন আটকানো পর্যন্ত কোনও কিছু হলেই শরণাপন্ন হয় তান্ত্রিকবাবার।
মন দিয়ে শুনছি কথাগুলো। এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ সাধুবাবা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন,
– বাবা, সমাজে এখন এক শ্রেণির ভগবান পাওয়া আধা মহাপুরুষের মহামারী লেগেছে। এদের অনেকেই বিক্রমাদিত্যের মতো তালবেতাল সিদ্ধ হয়ে শুক্রতারল্যের কবচ, মহাশ্মশানে ত্র্যয়স্পর্শীর অমানিশায় বামাক্ষেপার স্টাইলে বসে তন্ত্রোক্ত ক্রিয়াদ্বারা সরস্বতী কবচের মাধ্যমে বিদ্যার্থীদের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে বোর্ড বা ইউনিভারসিটি নামক এক রমণীয় খোঁয়াড়ের খাতা হারানো সত্ত্বেও পরীক্ষার বৈতরণী পার, মহামৃত্যুঞ্জয় কবচের মৃত্যুর হাত থেকে অব্যর্থ রক্ষা করে বিভীষণের অমরত্ব দান, রাস্তার অভুক্ত, অর্ধভুক্ত ভিখারিদের অলক্ষ্মীত্ব দূর করে সম্পদলাভের জন্য ধনদা বা মহালক্ষ্মী কবচ, ইলেকশন, কর্মলাভ থেকে শুরু করে সর্ব কাজে বিজয়লাভের জন্য সর্ববিজয় কবচ, নিরুদ্দিষ্টকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনা, বিচারপতিদের মতিভ্রমের কারণ ঘটিয়ে হত্যাকারীর জয় লাভের জন্য বগলামুখী কবচ, ভাড়াটে উচ্ছেদ আইনকে তন্ত্রের অমোঘ ক্রিয়া দ্বারা রোধ করে ভাড়াটে উচ্ছেদ, বাপমায়ের অবাধ্য বাঁদর সন্তানকে বাধ্য করা, পনেরো বছরের মেয়ে থেকে পঁচাত্তর বছরের বুড়িকে আকর্ষণের জন্য বশীকরণ কবচ, ফুল বা রুমাল পড়া কিংবা সিঁদুরের টিপের সাহায্যে প্রণয়সাধন থেকে শুরু করে লিঙ্গশিথিলতার জন্য কবচ দিয়ে তন্ত্রকার্য করছে কিছু কামাখ্যাফেরৎ অবতারেরা।
উত্তেজিত কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট খানেক চুপ করে থাকার পর বললেন,
– এত কথার পর তুই হয়ত প্রশ্ন করবি তন্ত্রোক্ত ক্রিয়াদিতে তাহলে কি প্রকৃতই কোনও কাজ হয় না, নাকি সব ভাঁওতা? যদি হয় তবে কেমন করে, না হলে কেন হচ্ছে না, তাই তো?
মাথাটা নেড়েও মুখে বললাম,
– হ্যাঁ বাবা, প্রথমে এই প্রশ্নই তো আপনাকে করেছিলাম। একমাত্র প্রশ্ন তো আমার এটাই।
আনন্দিত হয়ে উঠলেন সাধুবাবা। প্রসন্নতায় ভরে উঠল মুখখানা। একবার দেখে নিলেন বশিষ্ঠগঙ্গায় বয়ে যাওয়া ছোটছোট ঢেউগুলো। বললেন,
– এ কথা একেবারে সত্য জানবি, তন্ত্রের একটা বর্ণও মিথ্যা নয়, হবে না, হতে পারে না। মানুষ যা চায় পার্থিব সব কিছু থেকে পরম ব্রহ্মপদ পর্যন্ত, সবকিছুই দিতে পারে তন্ত্র। একাধারে তন্ত্র যেমন বস্তুতান্ত্রিক তেমনি তুরীয় ভূমিলাভের সহায়কও। তবে এখানে একটা কথা আছে বাবা, নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াবান সাধক ছাড়া তান্ত্রিক ক্রিয়াদিতে অন্য কারও অধিকার নেই, তন্ত্রের মন্ত্র প্রয়োগে কোনও ফল হবে না। নিয়মে তৈরি হলে পরে সুন্দর ফল আসবে হাতে।
জানতে চাইলাম,
– নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াবান সাধক কে এবং কাকে বলে?
সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
– প্রতিদিন নিষ্ঠার সঙ্গে সন্ধ্যা, আহ্নিক তর্পণ জপ ইষ্ট বা গুরুপুজোর মাধ্যমে নিত্যকর্ম এবং নৈমিত্তিক ক্রিয়াদি হল দেবপর্ব তিথিসহ অন্যান্য তিথিতে করণীয় কার্য, যেমন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে গয়ায় পিণ্ডদান সত্ত্বেও যিনি প্রতিবছর নিয়মিতভাবে পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ ও পারলৌকিক ক্রিয়াদি শাস্ত্রসম্মতভাবে নিষ্পন্ন করেন, তিনিই নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াবান সাধক।
একমাত্র তারই রয়েছে তন্ত্রোক্ত কর্মে অধিকার। সেখানে সাধকের জাতধর্মের ব্যাপার নেই। এরকম কোনও ব্যক্তি তন্ত্রের মাধ্যমে কোনও কাজ বা কবচ প্রস্তুত করলে তা জীবন্ত এবং ধারণমাত্র ফলদায়ক হয়ে ওঠে।
এইসব কথোপকথন চলছে। এমন সময় এলেন দুজন ভদ্রলোক। বসলেন আমাদের সামনে। প্রণামটুকুও করলেন না। আমি আর সাধুবাবা একবার চোখাচোখি করলাম। কথা বন্ধ হল। ওদের সঙ্গে কোনও কথা বললাম না। সাধুবাবা ভ্রূক্ষেপ করলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– বাবা আমার বিশ্বাস, এইসব ক্রিয়াগুলো যথাযথভাবে নিষ্পন্ন করে না প্রায় কেউই। ফলে যারা তাবিজ কবচ মাদুলি যন্ত্রম বা গৃহীদের কল্যাণের জন্য যে শান্তিস্বস্ত্যয়নের কাজ করেন তা ফলদায়ক হয়ে ওঠে না। তাছাড়া কবচ প্রস্তুত বা তন্ত্রের যেকোনও কর্মেই চাই মন্ত্রশুদ্ধি ও শুদ্ধমন্ত্রের সঠিক প্রক্রিয়ায় নিয়মমাফিক প্রয়োগ। তা না হলে কোনও তাবিজ কবচ না তন্ত্রকার্য, কিছুই ফলপ্রসূ হবে না।
ভদ্রলোক দুজনের একজন সিগারেট বের করে ধরালেন। একবার জিজ্ঞাসাও করলেন না সাধুবাবা ধূমপান করেন কিনা? এমন অবস্থায় একটা বিড়ি বের করে ধরিয়ে দিলাম হাতে। কয়েকটা মেজাজি টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন,
– তন্ত্রশাস্ত্রে সমস্ত মন্ত্রই লেখা আছে কিন্তু অনেক সিদ্ধ মন্ত্র সম্পূর্ণ লেখা নেই। কারণ ওই মন্ত্রগুলি অত্যন্ত গোপনীয়। এটা তন্ত্রেরই কথা, মায়ের উপপতি থাকলে সন্তান যেমন তা সযত্নে গোপন করে ঠিক তেমনই তন্ত্রোক্ত মন্ত্রগুপ্তি প্রয়োজন। সেইজন্যেই তো লেখা নেই। বই দেখে মন্ত্র প্রয়োগ করলে কিছুই হয় না। তন্ত্রের ক্রিয়াগুলো যথাযথ অনুষ্ঠিত না হলে কোনও মন্ত্রই ফলপ্রসূ হয় না, হবেও না।
এই পর্যন্ত শুনে ভদ্রলোক দুজন উঠে দাঁড়ালেন। যেতে যেতে একজন আর একজনকে বললেন, ‘যত্ত শালা দু’নম্বরি কথাবার্তা’। এরা বাঙালি বলেই মনে হল। সাধুবাবা আর আমি মুখ চাওয়া চাইয়ি করে হাসলাম। কেউ কোনও মন্তব্য করলাম না। আবার শুরু করলেন,
– বাবা তন্ত্রের প্রক্রিয়া যত সহজ ও মন্ত্রগুলো যত সরলই হোক না কেন, উপযুক্ত গুরু ব্যতিরেকে তন্ত্রের কোনও কাজই আশুফলদায়ক হয় না। কেন জানিস? শুদ্ধমন্ত্র ও তার সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োগপ্রণালী সকলের জানা নেই। এটা সব সময়েই চলে আসছে বংশ অথবা সাধুসন্ন্যাসী কিংবা গুরুপরম্পরায় মুখেমুখে। বইতে এসব পাওয়া যায় না।
এবার বললেন উদাহরণ দিয়ে,
– যেমন ধর মহামৃত্যুঞ্জয় কবচের কথা। তন্ত্রে আছে ওঁ জুং সঃ। এটা মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ প্রস্তুতের পুজোর মন্ত্র। এই মন্ত্রের আদৌ উল্লেখ নেই। কদাচিৎ কেউ পূর্বপুরুষসূত্রে অথবা সাধুসন্ন্যাসী কিংবা গুরুকৃপায় মন্ত্রটি জানেন। অথচ দেখ, জনকল্যাণার্থে নিযুক্ত তন্ত্র ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পে মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ স্থানলাভ করেছে। আমার বিশ্বাস, যে দেশে শতকরা দু একজনও জপের মন্ত্রটি জানেন কিনা সন্দেহ যেখানে, সেখানে ঢালাও এই কবচ তৈরি হচ্ছে কেমন করে?
সাধুবাবা না থেমেই বলে চললেন,
– এখানেই শেষ নয় বাবা। যেকোনও শক্তিশালী কবচ প্রস্তুত করতে হলে বাধ্যতামূলক মূলমন্ত্রের জপ করতে হবে এক লক্ষ বার। তবেই ফলদায়ী কবচ সম্ভব। যেখানে মহামৃত্যুঞ্জয় কবচের জপের মন্ত্র অধিকাংশেরই জানা নেই সেখানে লক্ষবার জপের প্রশ্নটাই তো অবান্তর।
কোনও প্রশ্ন করারই সুযোগ দিচ্ছেন না। তবে আমার ভিতরে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তরগুলো পেয়ে যাচ্ছি। ভাবিনি এমনভাবে পেয়ে যাব অমায়িক সাধুবাবাকে। বিরক্ত করলাম না কথায় ছেদ টেনে। না থেমেই তিনি বললেন,
– তাছাড়া বাবা প্রতিটা তন্ত্রকার্য বা কবচ প্রস্তুতই শ্রমসাধ্য, ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ। যেমন ধর, নিয়মকানুন বিধিসহ প্রতিদিন কয়েকঘণ্টা জপহোমাদি এবং লক্ষবার জপের কিছু কিছু করে কবচের পুরশ্চরণ করতে কমপক্ষে সময় লাগে ২/৩ মাস। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবি, আজকে যারা তন্ত্রের মাধ্যমে তাবিজ কবচ শান্তিস্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি করেন তাতে প্রকৃত কোনও কাজ হওয়া উচিত কি না?
অথচ দেখ, আজকাল কথায় কথায় পঞ্চ ‘ম’ কারে সব সিদ্ধ হয়ে লম্বা চওড়া ফতোয়া দিয়ে দাম্পত্যকলহে স্বামীস্ত্রীর মানসিক মিলন, মনমতো পাত্র বা পাত্রীকে বশীকরণ, নিরুদ্দিষ্টকে ফিরিয়ে আনা, বন্ধ্যার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাদান থেকে শুরু করে ভাড়াটে উচ্ছেদ করে এক ‘নাইট’-এ বাড়িওয়ালাকে ঘর পাইয়ে দিচ্ছে ছুঁ করে।
এইটুকু বলে সোজা হয়ে বসলেন। বাঁপাশে ঝোলার উপরে রাখা শিঙেটার উপর হাতটা রেখে কেমন যেন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বৃদ্ধ সাধুবাবা ঝড়ের বেগে বলে চললেন,
– আমি শুধু ভেবে মরি, সর্ববিজয় কবচ জানা সত্ত্বেও সব কিছু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য) জয় করতে পারছে না কেন এরা, ধনদা বা মহালক্ষ্মী কবচ জেনে নিজেরা ধনবান না হয়ে অন্যকে বড়লোক করতে চাইছে কেন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, দাম্পত্যকলহে যারা মিলন ঘটাতে চায়, তাদের সংসারে অশান্তি কেন, সরস্বতী কবচ জেনেও এরা ভারতবিখ্যাত পণ্ডিত হয় না কেন, হয় কেন এদের অনেকের ছেলে অশিক্ষিত মূর্খ চিট, মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ জানা সত্ত্বেও এরা অকালমৃত্যু রোধ করতে পারছে না কেন?
হাঁ করে কথা শুনছি। তাকিয়ে আছি মুখের দিকে। উত্তেজিত কণ্ঠেই সাধুবাবা বললেন,
– পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসার যোগ্যতা যার হয়েছে, হারানো বিশ্বাসকে তন্ত্রের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে চায়, দৈবশক্তি যার করায়ত্ত, জ্ঞাননেত্রে যিনি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান ঘটনাবলী টেলিভিশনের মতো দেখেন, যিনি তালবেতাল ও পিশাচসিদ্ধ, যিনি অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তারা তুচ্ছ স্বপ্নদোষ আর লিঙ্গশিথিলতার কবচ করতে যান কেন?
হিমালয় ছেড়ে এদের তো লোকালয়েই থাকা উচিত না কবচ বেচার জন্য। রোগ সারানোর জন্যে পাড়ার হারান কবিরাজ থেকে শুরু করে হাসপাতালে তাবড়তাবড় বিলাত ফেরত ডাক্তার আছে, এদের এ ব্যাপারে এত মাথাব্যথা কেন?
মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন। সুরটা অনেক নেমে এল। উত্তেজনাও কমে গেল। শান্তভাব এল কথায়। আনন্দের ভাব নিয়ে বললেন,
– একটা কথা জানবি বাবা, সংসারে শুধুমাত্র পারমার্থিক চিন্তা নিয়ে কেউই টিকে থাকতে পারে না। আয়ু আরোগ্য ও ঐশ্বর্যের প্রয়োজন আছে সংসারে। তাই বলে কোনও মানুষের পক্ষেই রোগ শোক দুঃখকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তন্ত্রবিধিত সঠিক প্রয়োগে সবই পেতে পারেন প্রার্থীগণ। তন্ত্রের মহিমা অতি অপূর্ব। তথাকথিত অনধিকারী তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে কেউ যদি প্রতারিত হয়ে তন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা আস্থা হারায় তাতে ভারতীয় তন্ত্রের কিছু আসে যায় না।
তন্ত্র চিরন্তন শাশ্বত সনাতন সত্য। এর মধ্যে কোনও ভ্রান্তি নেই। অথচ তন্ত্রের নামে চলছে অর্থের শোষণ। অসহায় মানুষগুলো মরছে শিয়াল কুকুরের মতো। অর্থের শ্রাদ্ধ করে নষ্ট করছে পবিত্র নির্মল মানসিকতা, ভরিয়ে তুলছে হতাশা, হচ্ছে শুধু বিভ্রান্ত।
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু হাঁপ ছাড়লেন। কেটে গেল মিনিট পাঁচেক। আমার মুখের দিলে তাকাতে বললাম,
– বাবা তাহলে মানুষ এর থেকে বাঁচবে কি করে? আপনি তো বলেই খালাস হয়ে গেলেন।
হাসিমুখে বললেন,
– আমি তো আগেই বলে গেছি তন্ত্রের নামে কি চলছে, কি হয়? বাঁচার একটাই পথ, ওসব পথে না যাওয়া, ও ব্যাপারে মাথা না ঘামানো। তাতে কষ্ট থাকলেও অনেক বেশি ভাল থাকবি। ওইসব করতে গেলে পয়সাও যাবে, শান্তিও যাবে।
এবার বললাম,
– বাবা, তন্ত্র আর তান্ত্রিক এ দুটো কথার প্রকৃত অর্থ কি?
সাধুবাবা বললেন,
– খুব সংক্ষেপেই বলি। তনুর (দেহ) ত্রাণার্থে (পার্থিব বন্ধনমুক্তি) যা যা করা প্রয়োজন তা করার নামই তন্ত্র। যিনি তনুর ত্রাণ করেন তিনিই তান্ত্রিক। অর্থাৎ পার্থিব বন্ধনমুক্তিকামী মাত্রই তান্ত্রিক।
গর্ভধানাদি দশবিধ সংস্কার, শৌচাশৌচ বিচার, দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিধি, সামাজিক ও পারিবারিক নিয়ম, লৌকিক আবশ্যকীয় বিষয় এবং নরনারীর যৌন সংযমের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও সুস্থ সমাজ জীবনযাপন থেকে শুরু করে পারত্রিক মুমুক্ষু ব্যক্তির ব্রহ্মসাধন পর্যন্ত সমস্ত নিয়মকানুনবিধি যে শাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে তার নামই তন্ত্রশাস্ত্র।
একটু থেমে বললেন,
– আবার এইভাবেও বলা যায়, তন্ত্রশাস্ত্র প্রবক্তা ভগবান শঙ্কর দেহবাদী। বিষ্ণু মনোবাদী আর ব্রহ্মা হলেন আত্মবাদী। শঙ্কর দেহকে অস্বীকার করেননি। তন্ত্রে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন দেহকে তাই সমাজে নরনারীর যৌনসংযম এবং মানসিকতার সহজ সরল ও স্বাভাবিক অক্ষুণ্ণতা বজায় রেখে ঈশ্বরতত্ত্বে পৌঁছানোর জন্য বিধিনিষেধের যে শাস্ত্র, তার নামই তন্ত্রশাস্ত্র।
কথায় বাধা দিলাম না। তিনি বলে চললেন,
– বাবা, সংসারে শিষ্নোদর সর্বস্ব মানুষের ভোগমুখী। এ কথা বুঝেছিলেন ভগবান শঙ্কর। আরও বুঝেছিলেন, সাংসারিক সর্ববিধ ভোগ থেকে বিরত করিয়ে কাউকে অধ্যাত্মবাদে পরমপথের সন্ধান দিতে চাইলে তাতে জীবের মন সায় দেবে না। প্রাকৃতিক নিয়মেই রক্তমাংসের এই দেহ সার্বিক ভোগ না করে থাকতে পারে না। তাই তো তিনি মদ্য মাংস মৎস্য মুদ্রা ও মৈথুনসহকারে অধ্যাত্মসাধনার মাধ্যমে সংযমের সঙ্গে ভোগ করিয়ে মহত্তর দিব্যজীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন তন্ত্রের মাধ্যমে।
বাবা, তন্ত্র হল ভক্তি ও অনুভূতিপ্রধান যোগ ও উপাসনাশাস্ত্র। তন্ত্রসাধনায় চরম ভোগ সুখ থাকলেও অসংযমের কোনও স্থান নেই। এক কথায় বলতে পারিস, শুধু ভোগের জন্য ভোগ ভোগ করা নয়, ভোগসাধন বস্তুনিচয়ের সঙ্গে সাধন সংমিশ্রণে ক্রমশ ক্রিয়ার অভ্যাসদ্বারা ভোগবাসনা নিবৃত্তি করার জন্যই তন্ত্র। তন্ত্রের সাধনক্ষেত্র বিশাল ব্যাপক ও বিস্তৃত। পঞ্চমুখে পঞ্চানন তন্ত্রে যা বলেছেন তা আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভই তন্ত্রের মূল ও চরমতম লক্ষ্য।