শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের মানুষজনের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। কেমন আছেন এইসব মানুষগুলো? এককথায় বলতে গেলে, তাঁদের জীবনটা এখনও আর পাঁচটা সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের জীবন নয়। বরং তাঁরা এক ধরণের ক্লেদাক্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে তা থেকে নিষ্কৃতির আশাও ক্ষীণ। ফলে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজন ক্ষুব্ধ, অপমানিত। তবে আশার কথা এই যে, তাঁরা পড়ে পড়ে মার খেতে নারাজ। তাঁরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছেন। এ দেশের আর পাঁচজন নাগরিকের মতো নিজেদের সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মানুষের জন্যে তাঁরাও নানান ন্যায্য নাগরিক অধিকারের দাবি তুলছেন।
রাজ্য সরকারের তরফে শহরের বুকে ঘুরে বেড়ানো এই বৃহন্নলাদের জীবনের সার্বিক মানোন্নয়নের বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতরের আওতায় গড়া হয়েছিল ভারতের প্রথম ও একমাত্র ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড। এই উদ্যোগে আশান্বিত বৃহন্নলারা মনে করতে শুরু করেছিলেন এবার হয়তো সত্যিই তাঁদের জীবনে ভালো সময় আসছে। ভেবেছিলেন সত্যিই এখনও কিছুক্ষেত্রে হয়তো হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো!
কিন্তু সে গুড়েবালি। বছর কয়েকের ভিতরই দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডটির আদতে ঢালও নেই, তলোয়ারও নেই। এ যেন একেবারে নিধিরাম সর্দার! এমন ভাবার বাস্তবোচিত বহুবিধ কারণ আছে। উদাহরণ স্বরূপ, ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড গঠিত হওয়ার পরে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত বোর্ডের কাজ চালানোর মতো কোনও অফিস নেই। বোর্ডের বৈঠক করার মতো জায়গাও নেই। অন্যদিকে, বোর্ড সদস্য মনোনয়ন করা নিয়ে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনের সংগঠনগুলির তরফে একাধিক অভিযোগ তোলা হয়েছে।
প্রথমত, ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করেই রাজ্য সরকার একতরফাভাবে ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন। এই প্রতিনিধিদের প্রতি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অবহেলিত মানুষের সর্বসম্মত সমর্থন নেই বলেই জানিয়েছেন তাঁরা। এর পাশাপাশি বোর্ডের কোনও কার্যালয় না থাকায় মনোনীত প্রতিনিধিরা ঠিকঠাকভাবে কাজই করতে পারছেন না। ফলে গোটা পরিকল্পনাটি এখন বিশ বাঁও জলে। এদিকে সরকারের তরফে বিষয়টি নিয়ে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। মুখ খুলতে নারাজ রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজাও। তা হলে কি হবে? সে কথাও কেউ জানেন না। ভুক্তভোগী ট্রান্সজেন্ডাররাও জানেন না তাঁদের ভবিষ্যৎ কী!
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষের সংস্থা আনন্দম। এই রাজ্যের নানা প্রান্তে আনন্দমের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। সংগঠনের সম্পাদক সিন্টু বাগুই নিজেও একজন ট্রান্সজেন্ডার। ক্ষোভ উপচে পড়ল তাঁর কথায়। সিন্টুর দাবি, এই রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডারদের একটা বড় অংশই যৌনকর্মীদের সন্তান। বাকিরা সাধারণ পরিবারেই জন্মেছেন। জন্মসূত্রে যাঁরা যৌনকর্মীর সন্তান তাঁরা সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। মা যৌনপেশায় থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই ওঁরা নানা ধরনের অমানবিকতার শিকার। বাকিদের ক্ষেত্রেও ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে জন্মগ্রহণের কারণে সামাজিক অবহেলা, নিপীড়নের ছবিটা প্রায় একই।
ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি রাজ্যের সরকার ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনকে সমাজের মূলস্রোতে আনতে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের পরে সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডারদের পেশাগত পুনর্বাসনে উদ্যোগী হয়েছে ওড়িশা সরকারও। কোথাও ট্রান্সজেন্ডারদের গাড়ি চালানোর পেশায় সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোথাও বা বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রহরীর কাজে যুক্ত করা হয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে পুনর্বাসনের প্রকল্পগুলিতে তাঁদের দক্ষতা প্রমাণ করে ট্রান্সজেন্ডাররাও বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছেন। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের পরে ওড়িশা সরকার রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে ট্রান্সজেন্ডারদের ওয়ার্ডেন হিসাবে নিয়োগ করার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আনন্দমের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এ ধরনের ভাবনাচিন্তা সামনে এনে আশা জাগিয়েছিল। ট্রান্সজেন্ডারদের সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করানোর ব্যাপারে কথাবার্তা শুরুও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসলে ছেলেবেলা থেকে নানা অত্যাচার, অবিচারের মুখোমুখি হতে হতে একটা সময় পরে অনেক ট্রান্সজেন্ডার খিদের টানে বেছে নেন যৌনপেশাই। এক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কানাকড়ি দাম নেই।
আনন্দমের আর এক কর্তা লোকনাথ ভট্টাচার্য জানালেন, ট্রান্সজেন্ডাররা বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে এখনও যৌনকর্মী হিসাবে খদ্দের ধরছেন। তাঁদের কোনও দ্বিতীয় উপায়ও নেই। যে কোনওভাবেই হোক পেটের জ্বালা তো মেটাতে হবে। এর পাশাপাশি এই রাজ্যে প্রথম গড়ে ওঠা ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড সম্পর্কে লোকনাথের অভিযোগ, বোর্ড গত কয়েক বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের মর্জিমাফিক কাজ করেছে। ট্রান্সজেন্ডারদের সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বোর্ড কোনও যোগাযোগও করেনি। কলকাতায় এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনের জন্যে কাজ করছে অন্ততপক্ষে ২০ থেকে ২২টি সংগঠন। সেই সংগঠনগুলির সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলে সকলের পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে পরিস্থিতিটা কিন্তু পাল্টাতে পারত বলে মনে করেন লোকনাথ।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিস অথরিটির দায়ের করা একটি মামলার জেরে শীর্ষ আদালত ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল। শীর্ষ আদালতের ২ বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণণ ও বিচারপতি এ কে সিরকির বেঞ্চ ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনকে নাগরিক হিসাবে আইনি স্বীকৃতি দেন। ট্রান্সজেন্ডারদের দেওয়া হয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আইনি স্বীকৃতিও। ২০১৪ সালে শীর্ষ আদালতের ওই ২ বিচারপতি এ প্রসঙ্গে তাঁদের রায়দান করতে গিয়ে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেন। এ দেশের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন যে অধিকারগুলি আদায়ের জন্যে দশকের পর দশক ধরে লড়েছেন, শীর্ষ আদালত তাঁদের সেই অধিকারের দাবিগুলিকে আইনি বৈধতা দেয় ভারতীয় সংবিধান অনুসারে। সেইমতো বিচারপতিরা জানিয়েছিলেন, সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুসারে ট্রান্সজেন্ডারদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের অধিকার একটি মৌলিক অধিকারই। পাশাপাশি, শীর্ষ আদালতের ২ বিচারপতি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, সংবিধানের ১৯(১)(এ) ধারা অনুযায়ী, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনের নিজেদের লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে গোপনীয়তার কোনও প্রয়োজন নেই। এটিও বাক স্বাধীনতার মতোই একটি মৌলিক অধিকার। এর পাশাপাশি শীর্ষ আদালত আরও জানিয়েছিল, সংবিধানের ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর ধারা অনুসারে সমানাধিকার ও আর পাঁচজন নাগরিকের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত যে অধিকারগুলি রয়েছে, সেইসব অধিকারগুলিও ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনের প্রাপ্য অধিকারের মধ্যে পড়ছে। এই রায়ের ফলে এই রাজ্যের বাসিন্দা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনের ভিতরও আগামী দিনে মানুষের মতো করে মাথা তুলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। এরপরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড গঠন করায় সিন্টু বা লোকনাথের মতো ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের বহু মানুষই আশা করেছিলেন, দিনকাল পাল্টাচ্ছে। মানুষের মতো বেঁচে থাকার সুদিন তাঁরাও ফিরে পাবেন। কিন্তু আশাই সার। বাস্তবে তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন।
প্রথমত, শিক্ষার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, কাজ নেই। আনন্দমের সম্পাদক সিন্টু বললেন, আমাদের মধ্যে সকলেই আনপড় নন। লেখাপড়া জানা বহু ট্রান্সজেন্ডার রয়েছেন। কিন্তু কোন সংস্থা ওঁদের চাকরি দেওয়ার মতো সাহসী পদক্ষেপ নেবে? এ পর্যন্ত এই রাজ্যের কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা সেই পদক্ষেপ নেয়নি! ২৬ বছরের লোকনাথ বললেন, তাও একটি আশার কথা হল, ধীরে হলেও সমাজ পাল্টাচ্ছে। ট্রান্সজেন্ডাররা তাঁদের মেয়েলি আচরণের জন্যে একসময়ে পথেঘাটেও নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতেন। রাস্তায় বেরোলেই তাঁদের দেখিয়ে কটু কথা বা আচরণ করা হত। সে ছিল আর এক যন্ত্রণা। সেই অবস্থা এখন বদলাচ্ছে। পেশাগতভাবে একজন কোরিওগ্রাফার লোকনাথের দাবি, সাধারণ নাগরিকদের ভিতর অনেকেই এখন আমাদের প্রতি তুলনায় অনেক সহানুভূতিশীল। আমরাও যে মানবগোষ্ঠীর একজন সদস্য, নাগরিক সমাজ এই সত্য উপলব্ধি করেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার পাশে দাঁড়ালে তাঁরা অনেকদূর পর্যন্ত এগোতে পারবেন বলেই আশা ব্যক্ত করলেন লোকনাথ।
কেন্দ্রীয় সরকার ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস নামে একটি বিল লোকসভায় পেশ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা এই বিলটিতে ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারকে অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ২০১৪ সালে শীর্ষ আদালত ট্রান্সজেন্ডারদের ক্ষেত্রে যে অধিকারগুলি প্রাপ্য হিসাবে জোর দিয়েছিল, সেগুলিও এই নতুন বিলে অনেকাংশে উপস্থাপন করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। যেমন, লোকসভায় গত অগাস্টে কেন্দ্রের তরফে পেশ করা ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস বিলটিতে তাঁদের আইনি অধিকার অথবা ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট বসানো, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির উল্লেখমাত্রও করা হয়নি।
একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২৩ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডারের অসুখ-বিসুখ করলে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্যই নেই। তার ওপর শতকরা ১২ জন ট্রান্সজেন্ডার কোনও না কোনওভাবে যৌন হেনস্থার শিকার। ৭৪ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডার কেবলমাত্র ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে জন্মগ্রহণের কারণেই পরিবার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বেঁচে থাকার জন্যে ৩২ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডার ভিক্ষা করেন।
সারা দেশ জুড়ে এটাই ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের করুণ চিত্র। দিন বদলের অনেক সরকারি ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও সমাজে ট্রান্সজেন্ডারদের উপযুক্ত জায়গা এখনও হয়নি। বরং এককথায় নারকীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিন গুজরান করছেন বাংলা সহ সারা দেশের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজন। — চিত্রণ – বিশ্বজিৎ