Celeb Talk

দেখা হলে বলে দিও, ভাল আছি

মাঠ নিয়ে আলোচনা হবে আর অমল দত্তর মুখ থেকে কিছু ঝাঁঝালো শব্দ বের হবে না তা কি করে হয়। কোনও কালেই কাউকে তোয়াক্কা করে কথা বলেননি এই মানুষটি।

Published by
News Desk

‘ডায়মন্ড বলে সত্যিই কোনও ফর্ম হয়না। ও তো সাংবাদিকদের দেওয়া নাম। ওঁরা ওপর থেকে দেখেন তো! তা ওখান থেকে নিচের দিকে তাকালে সাজানোটা অনেকটা হিরের মত লাগে। তাই নাম দিয়ে দিলেন ডায়মন্ড।’ কথাগুলো যিনি বললেন তিনি কলকাতা ময়দানে বিতর্কিত এক অধ্যায়। যাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক চরম আকার নিয়েছিল। তবু তিনিই ভারতের প্রথম পেশাদার ফুটবল কোচ। ডায়মন্ড সিস্টেমের জনক অমল দত্ত।

‘জীবনে অনেক খেলেছি। ভারতের হয়ে খেলছি। রাশিয়া গেছি। পরে আমার সামনে দুটো রাস্তা ছিল। হয় কোচ হব। অথবা খেলোয়াড় থেকে যাব। কঠিন সিদ্ধান্ত। কোচ হতে গেলে খেলা ছাড়তে হবে। খেলা ছাড়ার কষ্টটা নেহাত কম নয়। কিন্তু সে সময়ে একটা রাস্তা বেছে নিতেই হত। তা আমি কোচ হওয়াটাই বেছে নিয়েছিলাম। বিদেশি ফুটবলের খুঁটিনাটি জানতে বিলেতে কোচিং শিখতে যাওয়ার জন্য চিঠি লিখলাম। তারপর তৎকালীন বম্বে থেকে জাহাজে চেপে বসলাম। ভাড়া ৬২৫ টাকা। খেলে যেটুকু টাকা জমিয়েছিলাম সেই টাকাই ভরসা। ইংল্যান্ডে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ইন্টার্ভিউ হল। পাসও করে গেলাম। তারপর শুরু হল কোচিং শেখার পালা। ভারত থেকে শেখার জন্য এসেছি শুনে ওরা খুব খুশি হয়েছিল। জীবনে অনেকগুলো বিশ্বকাপ দেখেছি। তবে প্রথম দেখা কোচিং শেখার সময়। সুইডেনে। তখন একটা গ্রুপ করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওখানে খেলা দেখার আগে একদফা ক্লাস হত। তারপর খেলার সময় দস্তুরমত নোট নিতে হত। সেই নোট ধরে আলোচনা হত। খেলার শেষে হত সেই ম্যাচের চুলচেরা বিশ্লেষণ। কোচিং কোর্স শেষ হওয়ার পর আমাকে ওরা কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ড কোনও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল কোচ করে দেওয়ার অফার দিয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। বলেছিলাম ভারতে গিয়ে ভাল ফুটবলার গড়ে তুলতে চাই। দেশের ফুটবলের জন্য কিছু করতে চাই। শুনে ওরা আমার পিঠ চাপড়েছিল।’ গায়ে একটা শীতের চাদর মুড়ে বেশ খোশমেজাজেই আড্ডা জুড়ে দিলেন অমলবাবু।

একান্নবর্তী পরিবারে অমলবাবুরা ছিলেন ছ’ভাই। বাবা খুব ছোট বয়সেই মারা যান। ফলে ভায়েদের মানুষ করার পুরো দায় গিয়ে পড়ে মায়ের কাঁধে। তার ওপর একান্নবর্তী পরিবার। ফলে ১৬-১৭ জনের হাঁড়ি একা মাকেই টানতে হত। এতটা লড়াই করেও যিনি ছেলেদের বড় করেছিলেন, মানসিক দিক থেকে তিনি ছিলেন অনেক এগিয়ে। ফলে অমলবাবুর খেলোয়াড় জীবনে বাড়ির দিক থেকে তেমন বড় সমস্যায় পড়তে হয়নি। বেশ হাসতে হাসতে বললেন অমলবাবু, ‘বিলেত যাওয়ার সময়ও মা বলেছিলেন, যাও। কোনও বাধা দেননি। শুধু বলেছিলেন দেখো মেম বিয়ে করে ফিরো না যেন। আমি সেকথা রেখেছিলাম। কিন্তু আমার ছোটভাই রাখেনি। সে মেম বিয়ে করে বিদেশেই থেকে গেল। দেশে ফিরল না’।

এসব কথার ফাঁকে ফের ফিরলাম মাঠে। যে মাঠ একগুচ্ছ সাফল্য, ব্যর্থতা, বিতর্ক, সবই দিয়েছে আজকের এই বৃদ্ধ মানুষটিকে। মাঠ নিয়ে আলোচনা হবে আর অমল দত্তর মুখ থেকে কিছু ঝাঁঝালো শব্দ বের হবে না তা কি করে হয়! কোনও কালেই কাউকে তোয়াক্কা করে কথা বলেননি এই মানুষটি। দেখলাম সেই রাখ ঢাক না করে নিজের কথা, নিজের ধারণা স্পষ্ট করে বলার অভ্যাসটা এখনও সমানভাবে ঠোঁটের ডগায় লেগে আছে তাঁর। ‘কলকাতা ফুটবল তো এখনও বিদেশি চামড়ার দাসত্ব থেকে রেহাই পায়নি। তাই ক্লাবগুলো ভাবে বিদেশি কোচ আনলেই বুঝি বড় বড় ট্রফি ঘরে আসবে। কিন্তু এসব বিদেশি কোচ আসলে নিজেদের দেশে ব্যর্থ। তাই ওখানে সুযোগ না পেয়ে কলকাতার ক্লাবের ডাকে সাড়া দেয়। ভাবুন তো, নিজের দেশে যদি কোচ হিসাবে সে সফল হত, তাহলে সে কি এই কলকাতার ক্লাবে কোচিং করাতে আসত? আরে বাবা, এদেশের জল হাওয়া সম্বন্ধে বিদেশি কোচেরা ভাল জানে না। ফলে এখানেও তাদের সাফল্য পাওয়া মুশকিল। যদি এত বড়ই কোচ হয় তাহলে ভারতকে এশিয়া সেরা করে দেখাক দেখি। কোরিয়া, জাপান, কাতারের মত দলগুলোকে হারিয়ে দেখাক দেখি।’ লক্ষ্য করলাম কথাগুলো বলার সময় এই বয়সেও চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেছে এই বৃদ্ধ কোচের।

বলে চললেন অমলবাবু, ‘আরে এখানে তো প্রেসও ক্লাবগুলোর হয়ে লেখে। অথচ দেখুন, আমরা যখন কোচিংয়ে আসি তখন ক্লাবগুলো মৌখিক চুক্তি করত। চুক্তি করার সময় প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিত। এই দেব, সেই দেব, রাজা করে দেব। কিন্তু দুটো খেলায় হারুন। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বের করে অন্য কোচ আনবে। চুক্তির টাকাটা পর্যন্ত দিত না। আরে পরে তো আপনার সঙ্গে দেখাই করবে না। গাড়ি করে বেরিয়ে যাবে। টাকা চাইবেন কার কাছে? ফলে ছয়ের দশকে কন্ট্রাক্টের জন্য হৈচৈ শুরু হল। যেজন্য আজকাল কন্ট্রাক্ট হওয়ায় টাকা মার‌ যায় না।  কিন্তু আসল কথা কি জানেন, এখানে কোচিং করানো মানে একেবারেই রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড জব করা। ভাল রেজাল্ট করলেন তো মাথায় চড়ে রইলেন। আর ব্যর্থতা মানেই আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে’।

একসময়ে ভাল তবলা বাজাতেন অমলবাবু। একবার তাঁকে টেবিল চাপড়াতে দেখে এক দাদা তাঁকে তবলা শেখার জন্য বলেন। রাজি হয়ে যান অমলবাবু। সরস্বতী পুজোর দিন গুরুর কাছে হাতে নাড়া বেঁধে (শিষ্য করতে গুরু হাতে যে কার বেঁধে দেন, তাকে বলে নাড়া বাঁধা) শুরু হয় মন দিয়ে তবলা শেখা। তখন ক্লাস থ্রি। সকালে বিকেলে নিয়ম করে রেওয়াজ। সকালে চার ঘণ্টা, বিকেলে চার ঘণ্টা। বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই ছিল গানবাজনার পরিবেশ। বাবা ভাল গান গাইতেন। ‘আমার স্ত্রীও ভাল গাইত। কিন্তু পরে গলায় ফ্যানিনজাইটিস হওয়ায় বাধ্য হয়ে গান ছেড়ে দিতে হয়। আমার স্ত্রী অলকনাথ দের বোন। তাই ওদের বাড়িতেও একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল।’ বললেন অমলবাবু। শুধু তবলাই নয়, অমলবাবুর গানের গলাও খাসা। কথার ফাঁকে দু’এক কলি ধ্রুপদী সঙ্গীত যেটুকু শোনালেন তা থেকে তাঁর গানের গলা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা রইল না।

বাড়ির কথা, পরিবারের কথা বলতে বলতে এসে পড়ল ছেলে মেয়ের কথা। ‘মেয়ে নূপুরকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। ওকে লেখাপড়া করিয়ে বড় করব ভেবেছিলাম। কিন্তু ও যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন একদিন আমাদের বাড়িতে আচমকাই এসে হাজির হলেন পঙ্কজ মল্লিক। এসে সরাসরি নিজের ভাগ্নের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন। পঙ্কজ মল্লিক বলছেন, না করি কি করে! বিয়ে দিয়ে দিলাম। এখন সুখে ঘর সংসার করছে। আমার নাতি নাতনিও আছে। আর ছেলে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে। ও তো নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে। সিটি কলেজে পড়ত। তখন চেনা জানা অনেকে এসে বলত তোমার ছেলেকে ওখানে একটি মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দেখলাম। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখলাম। তা আমি একদিন সোজা আমার পুত্রবধূ ডলের বাড়ি চলে গেলাম। ওর বাড়ির লোকজনকে বললাম, দেখুন আমি ছাদের ওপর ওদের একটা ঘর বানিয়ে দিচ্ছি ওদের বিয়ে দিয়ে দিন। তারপর ছাদের ঘরে বসে যত পারে কাব্য করুক।’ মন-প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন অমলবাবু। এক রসিক পিতার প্রাণখোলা হাসিতে আমিও নিজের হাসি চাপতে পারলাম না।

কথায় কথায় আর এক প্রেমিক আমল দত্তকে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন। তখন গোয়ার একটি দলের কোচ তিনি। বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী কলকাতায়। দীর্ঘদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। অমলবাবু থাকতেন আরব সাগরের ধারে একটি জায়গায়। এক ক্লান্ত দুপুরে একা বসে আছেন। কবিতার কয়েকটা লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কবি অক্ষয় বড়ালের নাতি হওয়ায় কাব্যরস রক্তের মধ্যেই ছিল। কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেললেন একটা কবিতা –

‘দেখা হলে বলে দিও, ভাল আছি,

দেখা হলে বলে দিও, ভাল আছি,

আছি সমুদ্রের কাছাকাছি,

সারাদিন ঢেউ গুনি,

জলের গর্জন শুনি,

জলেতে নামিনি এখনও,

দেখা হলে বলে দিও ভাল আছি,

কাল রাতে আহত নাবিক এক বলে গেল,

কী হবে সমুদ্রে নেমে, জল মেপে,

তার চেয়ে ডুব যাও, নিজের ভিতরে,

মুক্তো তোলো, যে মুক্তোর রঙ নেই, স্বাদ নেই,

যাকে তুমি পাওনি এখনও,

দেখা হলে বলে দিও, ভাল আছি’।

কবিতা শেষ করে হো হো করে হেসে ওঠেন এক বৃদ্ধ কবি। ‌যাঁর কবিতার প্রতিটি লাইন বিরহ রসে টইটম্বুর। এই লোকটাই কলকাতা মাঠের আপাত দুর্মুখ সেই অমল দত্ত? বিশ্বাস হচ্ছিল না। সত্যি বলছি বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে বসে রইলাম চেয়ারে।

বরাবর‌ই তিনি খামখেয়ালি। সাইকেলে করে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল অমলবাবুর। তো সেবার সাইকেল নিয়ে বেনারস যাচ্ছেন। তখন ১৭ কী ১৮ বছর বয়স। হাজারীবাগের কাছে পৌঁছতে বিকেল নেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের কোলে সূর্যটা হারিয়ে গেল। কাছেই একটা পি ডবলু ডির বাংলো ছিল। সেখানে গিয়ে বলতে একটা ঘরও পাওয়া গেল। ‌যাই হোক সন্ধেবেলা জল তেষ্টা পেয়েছে। তা জল খেতে বের হয়েছেন। দেখেন এক মোটাসোটা বৃদ্ধা হাতে একটা কলসি নিয়ে জল নিতে এসেছে। ওই গ্রামে একটাই ইঁদারা ছিল। সেখান থেকেই সকলে খাবার জল নিত। তা অমলবাবু সেই বৃদ্ধা মহিলাকে জল খাওয়ানোর জন্য অনুরোধ করতে সরাসরি না করে দিলেন তিনি। কিছুটা অবাক হয়ে সদ্য যুবক অমল জিজ্ঞেস করলেন জল না দেওয়ার কারণ কী। বৃদ্ধা জানালেন তিনি জাতে ছোট, তাই জল দিতে পারবেন না। নাহ, তিনি এসব মানেন না, সাফ জানালেন অমলবাবু। উত্তরে বৃদ্ধা জানালেন, তিনি জাতে পাড়িয়াল, অমলবাবুকে জল দিলে এ গ্রামে তাঁর থাকা মুশকিল হবে। বৃদ্ধার অসুবিধার কথা বুঝতে পেরে নিজেই ইঁদারা থেকে জল তুলে নিলেন অমলবাবু। জল পান করতে যাবেন, এমন সময় তাঁকে আটকালেন ওই বৃদ্ধা। তারপর নিজের ঝুলি থেকে দুটি বড় বাতাসা বের করে একটা ছোট্ট থালায় করে অমলবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। বললেন শুধু মুখে জল খেতে নেই। তা বৃদ্ধার দেওয়া বাতাসা দুটো মুখে পুড়ে জল খেয়ে হঠাৎ অমলবাবুর মনে হল ওই বৃদ্ধার কাছে আর কোনও খাবার আছে তো? প্রশ্নটা মনে আসতেই তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যি করে বল তো মাই, তোমার নিজের খাবার আছে তো’? বৃদ্ধা জানালেন তাঁর কাছে আর কোনও খাবার নেই। অবাক চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন অমলবাবু। বৃদ্ধা কেন তার খাবারটুকু তাঁকে দিয়ে দিল তা জানেতে চাইলেন অমলবাবু। বৃদ্ধা এবার হাসি মুখে বললেন, ‘তুমি আমায় মাই বলে ডেকেছ না? ছেলে অভুক্ত থাকলে মা কি কখনও খেতে পারে’? অমলবাবুর মনে পড়ে গেল প্রথমবার জল চাওয়ার সময় বৃদ্ধাকে মাই বলে সম্বোধন করেছিলেন তিনি। এরপর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি অমলবাবু। ওখানে দাঁড়িয়েই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন কলকাতা ফুটবলের এক সময়ের ডাকসাইটে কোচ।

Share
Published by
News Desk

Recent Posts