Health

কোন সময় ও কত পরিমাণ জল পান করে কোন রোগ নিরাময় সম্ভব

কেমন করে সুস্থ রাখা যায় দেহটাকে। প্রকৃতি রোগ আরোগ্যের জন্য সমস্ত ব্যবস্থাই করে রেখেছেন, তা না জানার কারণে আমরা দেহ নিয়ে নানাভাবে কষ্ট পাই।

মহাত্মা গান্ধী একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমরা দূরের জিনিসের বিষয় যতটা জানি, নিকটের জিনিস সম্বন্ধে ততটা খবর রাখি না। ইংল্যান্ডের নদ, নদী ও পাহাড়ের নাম আমাদের কণ্ঠস্থ, কিন্তু নিজ জেলার বিষয় আমাদের কিছুই জানা নেই। আমরা চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্রদের সংবাদ রাখি, কিন্তু আমাদের যে দেহটি একান্ত কাছে, তার সম্বন্ধে আমরা কম কথাই জানি।’

আমরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চাই, দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু কেমন করে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়, তা আমরা জানি না। জানি না, কেমন করে সুস্থ রাখা যায় দেহটাকে। প্রকৃতি রোগ আরোগ্যের জন্য সমস্ত ব্যবস্থাই করে রেখেছেন, তা না জানার কারণে আমরা দেহ নিয়ে নানাভাবে কষ্ট পাই। প্রকৃতির মাধ্যমে রোগ আরোগ্য করার যে পদ্ধতি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাকে বলা হয় প্রাকৃতিক চিকিৎসা বা নেচারোপ্যাথি। জল এই চিকিৎসার প্রধান উপকরণ বলে আমাদের দেশে একে বলে জল-চিকিৎসা, ইংরাজিতে হাইড্রোপ্যাথি। এ চিকিৎসায় এক পয়সায়ও খরচ নেই। একটু নিয়ম মেনে করতে পারলে অব্যাহতি পাওয়া যায় নানারকম দুরারোগ্য রোগ থেকে।

আমাদের দেহের ৭০ ভাগই জল। দেহের এই জলীয় অংশ প্রতিনিয়ত বেরিয়ে যায় মলমূত্র ও ঘামের সঙ্গে। দেহে এই রসের সমতা রক্ষা করার জন্যই জলপান করা আবশ্যক। তা না করলে প্রকৃতি তার নিয়মে জলীয় অংশ নিতে বাধ্য হয় রক্ত মাংসপেশি ও দেহের তন্তু থেকে। ফলে দেহ কৃশ হয়, শুকিয়ে যেতে থাকে। জলীয় অংশের অভাব হেতু প্রথমে আসে কোষ্ঠবদ্ধতা, পরে রক্তশূন্যতা। আরও পরে বারো মাসে তেরো পার্বণ।

প্রতিদিন প্রচুর জল পান করলে তবে প্রকৃতি দেহের যথেষ্ট দূষিত পদার্থ মূত্রের ভিতর দিয়ে বের করে দিতে সমর্থ হয়। এ জন্য জল পানই সর্বরোগের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা। কোষ্ঠ পরিস্কার করতে জলের ক্ষমতা অসাধারণ।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শয্যাত্যাগের আধ বা একঘণ্টা পর যদি তিন বারে আধঘণ্টা অন্তর আধ গ্লাস শীতল জল পান করা যায়, তবে এ পান কোষ্ঠ পরিস্কারে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আর্য ঋষিরা একে বলতেন ঊষাপান।

Water

দেহের অবসাদ নষ্ট করতে জলের বিকল্প নেই। অনেক সময় এমন হয় যে, শরীর ভেঙে আসে, মুখের হাসি নিভে যায়, রাগ বেড়ে যায় সামান্য কারণে। এই অবস্থায় এক গ্লাস শীতল জল পান করলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অবসাদ দূর হয়ে আবার মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।

অনেক সময় মনে হয়, শরীরটা যেন কেমন কেমন করছে। কেন খারাপ লাগছে বোঝা যাচ্ছে না। তবুও অস্বস্তি, বমি বমি ভাব, অম্বল ঢেকুর ওঠে, তখন এক গ্লাস শীতল জল পানের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় দেহের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।

জ্বরের সময় জল পান অত্যন্ত উপকারী। রোগী যতটা জল বিনা কষ্টে পান করতে পারে ততটা জলই তাকে পান করতে দেওয়া উচিত। জ্বরের সময় প্রতি ঘণ্টায় আধ থেকে এক গ্লাস জল পান করতে পারলে ভালো। জ্বরের সময় শীতল জল পান করলে রোগীর নাড়ির স্পন্দন কমে যায় মিনিটে ১২ থেকে ১৪ বার হয়। তবে মনে রাখতে হবে, রোগীর শীত ও কাঁপুনি থাকলে কখনওই শীতল জল পান করাতে নেই। এ রকম অবস্থায় জ্বরের সময় সবসময় গরম জলই পান করানো কর্তব্য। ঘামের সময়ও শীতল জল পান করানো উচিত নয়। জ্বররোগীর জলে খানিকটা লেবুর রস দেয়া বিশেষভাবে আবশ্যক। তাতে অত্যন্ত উপকার হয় রোগীর।

জল পান অত্যন্ত উপকারী হয় বাতের রোগে। এ ক্ষেত্রে জল রক্তকে তরল করে এবং দেহের ভিতর সঞ্চিত ইউরিক অ্যাসিড ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। প্রচুর পরিমাণে জল পানে ঘাম বাড়ে, প্রস্রাবও বৃদ্ধি পায় বলে জল পান অত্যন্ত ফলপ্রদ বাত ব্যাধিতে।

যারা অত্যন্ত মোটা তাদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ প্রধান চিকিৎসা। কিন্তু তারা প্রচুর জল পান করলেই কেবল দেহের ভগ্ন কোষগুলি দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে সহজে।

মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগে যথেষ্ট জল পান করলে দেহে সঞ্চিত অতিরিক্ত শর্করা বেরিয়ে যায় মূত্র ও ঘামের সঙ্গে। তাতে রোগী অত্যন্ত ভালো ফল পায়। শুধু মাত্র ঊষা পানেও অব্যাহতি পাওয়া যায় দুরন্ত মধুমেহ রোগ থেকে।

কামলা রোগের (নেবা) মহৌষধ জল পান। দিনে ১০ থেকে ১২ গ্লাস শীতল জল পান করলে কামলা রোগ আরোগ্য হয়।

যাদের দীর্ঘদিনের অজীর্ণ কোষ্ঠবদ্ধতা কিংবা পেটের অন্য কোনও অসুখ আছে, তারা প্রতিদিন দুবেলা আহারের এক ঘণ্টা আগে এক গ্লাস করে শীতল জল পান করলে আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়।

খালি পেটে জল পান করতে হলে সব সময়ই লেবুর রস মিশিয়ে জল পান করা কর্তব্য। এইভাবে প্রতিদিন অন্তত তিনটে লেবুর রস পান করা আবশ্যক। (H.Valentine Knaggs – The Lemon Cruze, p.1-17)

জল পানের একটা নিয়ম আছে, এখন সে কথা। আহারের সময় জল পান না করে আহারের এক বা দেড় ঘণ্টা আগে জল পান করতে হয়। আহারের সময় অথবা অব্যবহিত পর জল সোডা লেমনেড কিংবা অন্য যে কোনও ধরনের পানীয় পান করলে পাচক রসের সমূহ শক্তি নষ্ট হয়। ফলে অধিকাংশ সময় এই অভ্যাসে উৎপন্ন হয় অজীর্ণরোগ অথবা কোষ্ঠবদ্ধতা।

আহারের সময় জল পান করাটা প্রকৃতির নিয়ম নয়। গৃহপালিত কুকুর বিড়াল থেকে শুরু করে বনের পশুদের দেখা যায় এক সময় আহার করে। জলপান করে অন্য সময়। সমস্ত প্রাণির ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যরক্ষার এটি একটি শ্রেষ্ঠ নিয়ম।

প্রকৃতির স্বাস্থ্যরক্ষার এই সহজ সরল নিয়মটি মেনে চললে অতি অল্প দিনেই মুক্তি পাওয়া যায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও অজীর্ণ রোগ থেকে। পাচকরস সম্পূর্ণরূপে ভুক্ত পদার্থের উপর কাজ করতে পারে আহারের সময় জল পান না করলে। অত্যন্ত দুর্বল রোগীরও হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এতে।

দীর্ঘদিনের অভ্যাসের জন্য প্রথম আহারের সময় অথবা আহারের পর পিপাসা পায় না। তবে নিয়মিত জল পান কোনও অবস্থাতেই বন্ধ করতে নেই। জল পানের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় সব সময়ই আহারের এক বা দেড় ঘণ্টা আগে পর্যন্ত পেট যতক্ষণ খালি থাকে ততক্ষণ এবং আহারের এক ঘণ্টা পর, যখন ভুক্তদ্রব্যের উপর পাচকরসের ক্রিয়া শেষ হয়।

পেট যখন খালি থাকে তখনই প্রচুর জল পান করা কর্তব্য। একবার এক গ্লাস জল পান করার পর সেই জল দেহ থেকে বেরিয়ে গেলেই আবার পান করা যেতে পারে। এইভাবে খুব ভোরে প্রয়োজন মতো দু তিন গ্লাস, দুপুরে আহারের আগে এক গ্লাস, আহারের এক ঘণ্টা পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক গ্লাস, রাতে আহারের এক ঘণ্টা আগে একবার শীতল জলপান করলেই একটা মানুষের ঠিক ঠিক জল পান করা হয়।

Mineral Water

এই নিয়মে জল পান করলে কোনও রকম পেটের অসুখ থাকতে পারে না। খুব অল্প দিনেই দেহ সবল সুস্থ ও পুষ্ট হয়। অজীর্ণ, পাকস্থলীর জ্বালা, পেট ফাঁপা, গ্যাস অম্বল আরোগ্য হয় অল্প কয়েকদিনে। একই সঙ্গে ক্ষুধা ও হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়, সবল হয় পাকস্থলী। মূত্রপ্রবাহ অব্যাহত হয়। প্রচুর প্রস্রাব, মূত্র পরিস্কার ও দুর্গন্ধশূন্য হয়। মূত্রাশয় বা কিডনি রক্ত থেকে যে মূত্র ছেঁকে নেয়, তার সেই কাজ অত্যন্ত লঘু হয়।

সাধারণ পানীয় জল বেশ শীতল হওয়া উচিত। জ্বর ও কোষ্ঠবদ্ধতায় একটু বেশি শীতল জল হলে ভালো হয়। জল পানের একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। একটা গ্লাসে জল ঢেলে তা অন্য আর একটা গ্লাসে বার কয়েক ঢালাঢালি করে তবে পান করা উচিত। (Yoji Ramcharaka Practical Water Cure, p.10)

জল পান অত্যন্ত হিতকারী হলেও কিছু কিছু সময় পানে বিশেষ সাবধানতা আবশ্যক। ঠান্ডা লেগে বুকে বেদনা হলে, অত্যন্ত শ্রান্তি ও ঘামের সময় জল পান করা উচিত নয়। খুব দুর্বল রোগীর বিশেষ সর্তকতার সঙ্গে জল পান করা কর্তব্য। জল পানের সর্বাপেক্ষা নিরাপদ নিয়ম হল, যতটা সহ্য হয় অর্থাৎ যতটা পান করতে কষ্ট না হয়, ততটাই পান করা উচিত। অতিরিক্ত জলপান অল্প জল পানের মতোই দূষণীয়।

যারা যথেষ্ট জল পান করতে পারে না, তাদের প্রাথমিক অবস্থায় এক গ্লাসের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র পান করা আবশ্যক। পরে ক্রমশ মাত্রা বৃদ্ধি করা কর্তব্য। পেট ভরে জল পানের অব্যবহিত পরেই কখনও খাদ্য গ্রহণ করা উচিত নয়। তাহলে সেই খাদ্য প্রকৃতপক্ষে জলেই ফেলা হয়ে থাকে।

এমন অনেক রোগী আছে যাদের দেহে জলের তাগিদ নেই। তাদের দেহে তাগিদ জলের সৃষ্টি করা একান্ত আবশ্যক। এই তাগিদ সৃষ্টি করার অর্থ প্রকৃতিকে দেহের দূষিত পদার্থ মূত্রের পথে বের করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত করে তোলা। তখন জল পান করলে সত্যকার উপকার হয়।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

আমি ডাক্তার বদ্যি নই। সুতরাং এসব কথা আমার কোনও কথা নয়। প্রায় দেড় দশক আগে ‘বৈজ্ঞানিক জল-চিকিৎসা’ গ্রন্থটি কিনেছিলাম বইমেলায় আর এন ভট্টাচার্যর স্টল থেকে। এই গ্রন্থের লেখক বৈজ্ঞানিক জল-চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকূলরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। গ্রন্থের চেহারা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ও মূল্য দেখে আমার ধারণা এটির প্রকাশ কাল আনুমানিক ১৯১০-১২ সালে। গ্রন্থে প্রকাশ কালের উল্লেখ নেই।

বিগত দেড় দশক ধরে নানা রোগে নিজের উপর জল চিকিৎসা প্রয়োগ করে চমকপ্রদ ফল পেয়েছি। গ্রন্থে আরও অনেক কথা, অন্য অনেক পদ্ধতিতে সহজে রোগ আরোগ্যের উল্লেখ আছে যা লেখা সম্ভব হল না। কিছু সহজ পদ্ধতিতে দেহ সুস্থ ও রোগ মুক্ত করার উপায় তুলে দিলাম গ্রন্থ থেকে বিষয় অবিকৃত রেখে ভাষা ও বানানের পরিবর্তন করে, আবার কখনও হু-বহু তাঁরই কথা।

এ লেখায় মানুষ সামান্যতম উপকৃত হলে তার জন্য যে প্রশংসা তা শ্রীকূলরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের প্রাপ্য। আন্তরিক শ্রদ্ধাসহ কৃতজ্ঞ রইলাম লেখক ও তাঁর পরিবার এবং প্রকাশকের কাছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *