Mythology

প্রবল ঠান্ডায় বাঙালিবাবার হাঁড়িতে অফুরন্ত খাবার, এক বিস্ময়কর ঘটনা

বাঙালিবাবার অতিথি সেবায় অলৌকিকত্বের কথা। চোখে না দেখলে এসব কথা কারও বিশ্বাসই হবে না। সাধারণ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যাও চলে না।

যমুনা মন্দিরের পাশেই পাশাপাশি দুটো গরম জলের কুণ্ড। একটার জল প্রচণ্ড গরম। তাতে চালের পুঁটলি বেঁধে কিছুক্ষণ রেখে দিলে সিদ্ধ হয়ে যায়। অনেকে যমুনাদেবীর ভোগ দেয় চাল সিদ্ধ করে। প্রসাদ হিসাবে নিয়েও যায়। এই কুণ্ডের একটু নিচের কুণ্ডের জলও গরম, তবে গা সওয়া। যাত্রীদের অনেকেই স্নান করেন এখানে।

দেখতে দেখতেই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল যমুনোত্রীতে। আমার ইচ্ছা একটু সাধুসঙ্গের। এখানে তো অনেক সাধু থাকার কথা। শুনেছি হিমালয়ের বিভিন্ন তীর্থে তপস্যা করেন সাধুসন্ন্যাসীরা। কিন্তু কোথায়? ভাবতে ভাবতেই এসে দাঁড়ালাম একটা দোকানের সামনে। জিজ্ঞাসা করলাম দোকানিকে,

– হিঁয়া কোই সাধুসন্ত কা ডেরা হ্যাঁয়?

গরম কড়াইতে তেল ঢালতে ঢালতেই জবাব দিলেন দোকানি,

– হাঁ হ্যায়, গরম কুণ্ডকে্ পাস চলে যাও, বাঙালিবাবা হ্যায়।

পাশেই সেই গরম জলের কুণ্ড। কয়েক ধাপ উপরে একটা দোচালা টিনের ঘর। এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম কিছু কাঠ সংগ্রহ করা আছে। বর্ষা কিংবা তুষার পাতের সময় হয়ত কাজে লাগে। ঘরে ঢুকতেই সামনে পড়ল ছোট্ট একটা ঠাকুরের দোলার মতো। তাতে বাঁ পাশে রাধাকৃষ্ণের বাঁধানো একটা ফটোর সঙ্গে দুর্গা কালীও। এর ডান পাশে রাধাকৃষ্ণের পিতলের মূর্তি। আমার কাছে পিতলের, উপাসকের কাছে হয়ত জীবন্ত। ঘরে ডানদিকের পাহাড়ি মেঝে একটু উঁচু। তার উপরে কম্বলজাতীয় একটা কিছু, যেখানে যাত্রীরা এসে বসে। অবশ্য যাদের ইচ্ছা হয়। বাঁ দিকে খাট নয় তবে খাটের মতো। তাকের মতো একটা আছে। তাতে কোটোকাটা টিন। বাঁদিকেই কোণে জ্বলছে ধুনী। ঘরটা বড় নয় তবে একার পক্ষে যথেষ্ট। বেশি লোক হলে চাপাচাপি করে বসতে হয়।

এই ঘরেই দেখলাম একটা শান্ত সৌম্য সুদর্শন মূর্তি। ফরসা। তেজোদ্দীপ্ত তবে… দেখলে শুধু ভক্তি নয়, শ্রদ্ধাও আসে। মাথায় সাদা কাপড়ের ফেটি বাঁধা। গালে বড় বড় দাড়ি। সুন্দর মুখের গড়ন। চোখ বলতে যা, তা এঁরই আছে, ফালা ফালা। প্রশস্ত কপালে গোপীচন্দনের চওড়া তিলক। পরনে সাদা কাপড় হাঁটুর নিচে আঙুল চারেক। খালি গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়ানো। ঘরে ঢুকতেই বাংলায় বললেন,

– বসুন বসুন। কোথা থেকে আসছেন, কলকাতা?

‘হ্যাঁ’, বললাম মাথা নেড়েই। হাসিভরা মুখে তিনি বললেন,

– ক্লান্ত দেহ, আমি একটু চা করি খান। ক্লান্তি অনেকটা কমবে, কষ্টও দূর হবে।

কোনও আপত্তি করলাম না। বসলাম। পথশ্রমে আমরা প্রত্যেকেই বেশ ক্লান্ত। তার উপর আবার ঠান্ডা হাওয়া একটা আছেই। বেশ শীত শীত লাগছে। এবার ঘরের আনাচে কানাচে লক্ষ্য করতে লাগলাম। সাধুবাবা বললেন,

– আপনি কি একা, না সঙ্গে আর কেউ আছে?

– না, আমার সঙ্গীরা সব গরম কুণ্ডে স্নান করছে।

ধুনীর আগুনে চায়ের জল চাপাতে চাপাতে বললেন,

– ঠিক আছে, আপনি চা খেয়ে সকলকে পাঠিয়ে দিন। আমি ওদের জন্যেও করছি। আর একটা কথা, দুপুরে কিন্তু সকলে এখানে প্রসাদ পেয়ে যাবেন। এখানকার দোকানে ভাল খাবার পাওয়া যায় না। আপনারা ক-মূর্তি?

সঙ্গীদের কথা বলতেই বললেন,

– ঠিক আছে, আমি ওদের খাবারও চড়িয়ে দিচ্ছি। খিচুড়ি করছি কিন্তু।

যেতে হল না। সঙ্গীরা সকলে একে একে এসে হাজির। প্রত্যেককেই চা করে খাওয়ালেন। নির্লিপ্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সাধুবাবা। কখনও মশলা বাটা কখনও জিনিসপত্র গোছানো। দেখলাম ছোট্ট একটা হাঁড়িতে কিছু চাল আর ডাল দিলেন। তারপর ধুয়ে আনলেন যমুনা থেকে। ধুনীর আগুনে বসিয়ে মশলা দিয়ে ঢেকে দিলেন।

এসব লক্ষ্য করার পর জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, কি নাম আপনার?

হাসিমুখেই বললেন,

– মাধবদাস বাঙালিবাবা। এখানকার লোকেরা আমাকে বাঙালিবাবা বলেই ডাকে।

– আপনার বয়েস?

এ প্রশ্নে একটু অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল চোখেমুখে। বললেন,

– কি হবে বয়েস দিয়ে!

বলেই রান্নার কাজে যেন অকারণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খিচুড়িটা নেড়ে দিলেন। ধুনীর আগুনটাও দিলেন খুঁচিয়ে। সাধুবাবার বয়েস আনুমানিক ২৮/৩০–এর মধ্যে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি কোন সম্প্রদায়ের সাধু?

অস্বস্তির ভাবটা একটু কাটিয়ে বললেন,

– স্বামী রামদাস সম্প্রদায়।

সঙ্গে সঙ্গেই জানতে চাইলাম,

– বাড়ি কোথায় ছিল আপনার?

এবার সরাসরি তাকালেন মুখের দিকে। বললেন,

– কি হবে বাড়ি দিয়ে? থাক না ওসব কথা!

আমার প্রশ্নকে এড়ানোর জন্য আবার যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাজে। আমিও ছাড়ার পাত্র নই। প্রশ্ন করলাম,

– পূর্বাশ্রমের নাম কি ছিল আপনার?

হাসিমুখে জানালেন বাঙালিবাবা,

– সাধুসন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কথা, নামধাম কিছু বলতে নেই।

বুঝলাম চট করে কিছু বলবে না। তবুও বললাম,

– কত বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেছেন?

এ কথায় একটু বিরক্তির সুরেই সাধুবাবা বললেন,

– ছেড়ে দিন না ওসব পুরনো কথা। অতীত যা, তা অতীতই। ফেলে আসা জীবনের কথা অকারণ টেনে লাভ কি?

তবুও আমি ছাড়লাম না,

– এই যমুনোত্রীতে আছেন কতদিন?

এবার আর বিরক্তি নয়, প্রসন্নমুখে বললেন,

– আটবছর।

– ভারতের বহু তীর্থপরিক্রমা করেছেন নিশ্চয়ই?

মাথাটা নাড়িয়ে বললেন,

– না না, তেমন কোথাও যাইনি। শুধু কেদার বদ্রী গঙ্গোত্রী আর গোমুখ গেছি। এসব পায়ে হেঁটেই পরিক্রমা করেছি। হিমালয় আমার ভাল লাগে তাই এখানেই পড়ে আছি। অন্য কোথাও যেতে মন চায় না। তবে একবার বৃন্দাবন ও অযোধ্যা দর্শনের ইচ্ছা আছে।

জানতে চাইলাম,

– বছরের ছ-মাস তো এখানে তুষারপাত হয়। তখন তো কোনও যাত্রী এখানে আসে না। সেই সময় থাকেন কোথায়?

অবাক করে দিয়ে বাঙালিবাবা বললেন,

– কেন এই ঘরেই থাকি। তবে আমি আর এক মূর্তি, দুজনে।

– কি বলছেন আপনি! এঘর তো তুষারে ঢেকে যায়। কোনও অসুবিধে…

মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন,

– না না, ওসব আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হত। এখন আর হয় না। সব কিছুই তো অভ্যাসের দাস। তাছাড়া তাঁর কৃপাও তো আছে, নইলে চলছে কেমন করে?

আমাদের কথা হচ্ছে তবে এক নাগাড়ে নয়। একের পর এক তীর্থযাত্রী আসছে। মাঝেমাঝেই কেটে যাচ্ছে কথার সুতো। তার মধ্যে দিয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এবার কথার সুতো কাটলেন এক মাদ্রাজি সাধু। পরনে গেরুয়া বসন। শক্ত সমর্থ চেহারা। লম্বা। মুণ্ডিত মস্তক। কাঁধে ছোট্ট একটা ঝোলা। গায়ে ময়লা চাদর। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ না বলে কালো বলা-ই ভাল। মুখশ্রী সুন্দর নয় তবে বেশ টান একটা আছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

– থোড়া পরসাদ মিলেগা?

মাধবদাসজি জেনে নিলেন, এই সাধুবাবা পুষ্করতীর্থ সেরে এসেছেন এখানে। উত্তর দিলেন বেশ খুশি মনে,

– হাঁ হাঁ, বাবা আপ নহাকে হিঁয়া চলা আইয়ে, উসকে বাদ ভোজন কর্ লিজিয়ে।

‘ঠিক হ্যায়’ বলে চলে গেলেন স্নানে। শুরু করলাম,

– আপনি ভিক্ষা করেন না?

প্রসন্ন হাসিভরা মুখে বললেন,

– না, ভিক্ষা করি না। করিনিও কখনও।

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম,

– ভিক্ষা করেন না, তাহলে কেমন করে চলে আপনার?

ছোট্ট কুটির থেকে আঙুল দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনাকে দেখিয়ে বললেন,

– সব তাঁর ইচ্ছাতেই যোগাড় হয়ে যায়। যমুনামাঈ দেয়।

– তুষারপাতের সময় তো ঘর থেকে বেরন না। তখন এখানে থাকেন কেমন করে আর খাবারই বা পান কোথা থেকে?

নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন বাঙালিসাধু,

– তখনও কোনও অসুবিধে হয় না। তাঁর কৃপাতেই সব জুটে যায়। যমুনামাঈ দেয়। মা কি কখনও তার সন্তানকে অভুক্ত রাখে?

এবার কথার মধ্যে এলেন এক অতি বৃদ্ধ সাধুবাবা। বয়স আন্দাজ আশি হবে। কাঁধে একটা কালো কম্বল। বেশ নুয়ে পড়েছেন। চোখদুটো কোটরে ঢুকে গিয়েছে। গায়ের রং ময়লা। হাতে একটা বাঁকা লাঠি। বৃদ্ধ সাধুকে প্রশ্ন করলেন বাঙালিবাবা,

– বাবা, আপ কাঁহা সে?

ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিলেন বৃদ্ধ,

– বেটা ম্যায়নে তো নর্মদা পরিক্রমা করকে অভি যমুনামাঈ কি দর্শন করনে আয়া। হিঁয়াসে চারো ধাম দেখ্ কর বাবা বিশ্বনাথকে পাস যানা হ্যায়।

দুহাত জোড় করে বাঙালিবাবা বললেন,

– ঠিক হ্যায় বাবা, আপ কৃপা করকে হিঁয়াসে পরসাদ লেকে যাইয়ে গা। সাধুবাবা ঘরেই বসলেন আমার মুখোমুখি হয়ে তবে কোনও কথা হল না। এবার আগের কথার সুতোয় গিট দিলাম,

– এই যে একের পর এক লোক আসছে আর সমানে তাদের প্রসাদ পেতে বলছেন, কিন্তু কি করে চলে আপনার, কোথায় পান?

ওই হাসিমাখা নির্লিপ্ত মুখে বললেন,

– আমি কাউকে খাওয়াই না। যমুনামাঈ দেয়, সে-ই খাওয়ায়। মানুষের কি সাধ্য আছে মানুষকে খাওয়াতে পারে!

প্রসঙ্গের পৃষ্ঠা উল্টোলাম। সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম,

– আপনি ঘর ছাড়লেন কেন?

সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,

– কি হবে ওসব কথায়। অতীত ঘেঁটে লাভ আছে কি?

মুখ খুলবে না বুঝতে পেরে অনুরোধের সুরেই বললাম,

– তবুও বলুন না, এত অল্প বয়সে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে! কেন ঘর ছাড়লেন?

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মুখে এখন আর বিন্দুমাত্র বিরক্তির ভাব নেই। কিন্তু এমন ভাবের সৃষ্টি হল, যা দেখে মনে হল অতীতস্মৃতি ভেসে উঠেছে বাঙালিবাবার চোখে। তবে মানসিক দিক থেকে যে একটা অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে আমার কথায় তা বেশ বোঝা গেল। এবার বলতে শুরু করলেন,

– দেখুন আমিই বাড়ির বড় ছেলে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বসেছি খেতে। মা অন্য একটা কি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমার বোন আমাকে ভাত দিতে এল। থালা গুছিয়ে সামনে দিয়ে বলল, ‘তুই শুধু খেয়েই গেলি। বাবা মাকে খাওয়াতে পারিস না তো খাস কেন? তোর কি একটু লজ্জা করে না?’ আমি বললাম, ‘তুই বলার কে, তোরটা খাচ্ছি নাকি?’

ব্যস আর কোন কথা হল না বোনের সঙ্গে। সামান্য একটা কথায় হঠাৎ মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। ভাতের থালা রেখে উঠে পড়লাম। মাকে একটা প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম। কাউকে কিছু বলার বা বোঝার সময় দিলাম না। বেরনোর সময় মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আমি যেন সকলের সেবা করতে পারি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম হরিদ্বারে। আজ এ আশ্রম কাল ও আশ্রম করেই বেড়ালাম। এইভাবে কেটে গেল একটা বছর। হঠাৎ একদিন গুরু পেয়ে গেলাম। দীক্ষা হল। গুরুর আদেশেই লোকালয় ছেড়ে চলে এলাম নির্জনে। বেরিয়ে পড়ার পর আর বাড়ি যাইনি।

কথাগুলো শেষ হওয়া মাত্র জিজ্ঞাসা করলাম,

– এখন আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না? মায়ের কথা মনে পড়ে না?

কথাটাকে একটু উড়িয়ে দেবার ছলে হাসতে হাসতে বললেন,

– ইচ্ছে করলে কি আর হিমালয়ে পড়ে থাকি! আর মায়ের কথা তো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। পৃথিবীতে সকলের কথা ভোলা যায়। মায়ের কথা কি ভোলা যায়?

দেখলাম, মুখখানা মলিন হয়ে গেল বাঙালিবাবার। মিনিটখানেক কোনও কথা বললাম না। পরে জিজ্ঞাসা করলাম,

– খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ঘর ছেড়েছেন বলেই কি সেবাব্রত গ্রহণ করেছেন?

মুহুর্তে সেই হাসির ভাবটা মুখে এনে বললেন,

– বৈষ্ণবদের ধর্মই তো সেবার। আমার সাধ্য কি মানুষের সেবা করি। যমুনামাঈ যা করিয়ে নেয় তাই করি। যা জোটান তাতেই চলে যায়। কেউ কি কাউকে খাওয়াতে পারে বলুন তা? তাঁর ইচ্ছাতেই তো সব চলছে।

কথাবার্তা আপাতত শেষ। ইতিমধ্যে রান্নাও শেষ। শুধু তো খিচুড়ি। এবার বাঙালিবাবা উঠে গেলেন। পদ্মপাতার মতো কিছু পাহাড়ি কোনও গাছের পাতা আনলেন। বেশ বড় বড়। একটা ছোট হাতায় একটু খিচুড়ি তুললেন। বাঁ হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে হাতাটা রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আর দুর্গা কালীর ফটোর সমনে ধরে নিবেদন করলেন। এবার সেটা মিশিয়ে দিলেন হাঁড়ির খিচুড়িতে। এইভাবেই হল প্রসাদ। এরপর খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। একটা করে পাতা ধরিয়ে দিলেন সবাইকে। তারপর দিয়ে গেলেন প্রসাদ।

আমরা সকলে বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম। কারণ বেলাও হয়েছিল। আড়াইটে। ফলে ক্ষিদেটা সকলেরই পেয়েছিল বেশি। আমরা আকণ্ঠ খেলাম।

আমাদের কথোপকথনের সময় অনেক তীর্থযাত্রীই এসেছিলেন মাধবদাসজির কুটিরে। তাদের সকলকে বলেছিলেন প্রসাদ পেয়ে যেতে। তারা একে একে প্রায় সকলেই এসেছিলেন। তাও কমপক্ষে জনাপনেরো ষোলো হবে। সকলে প্রসাদ পেয়েছিলেন পেটভরে।

কি অদ্ভুত ব্যাপার! ছোট্ট হাঁড়ি, তাতে খুব বেশি হলে পাঁচ সাতজনের রান্না হতে পারে। হয়েছিলও তাই। অথচ যখন আমরা সমেত সকলের খাওয়া শেষ হল তখন ২২/২৪ জন তীর্থযাত্রী হবে। কৌতূহলী হয়ে বললাম,

– আপনি খাবেন না?

হেসেই বললেন বাঙালিবাবা,

– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার খাওয়ার জন্যে অত ব্যস্ত কি?

এবার কৌতূহলের সীমা একেবারে ছাড়িয়ে গেল। অধৈর্য হয়ে বললাম,

– কিন্তু আপনার প্রসাদ কোথায়?

এই মুর্হুতে একঝলক অপার্থিব হাসি ফুটে উঠল বাঙালিবাবার চোখেমুখে। ইশারায় হাঁড়িটা দেখিয়ে বললেন,

– এই তো হাঁড়িতেই আছে।

– কোথায় আছে?

বলেই একটু ঝুঁকে লক্ষ্য করলাম, তখনও দেখি হাঁড়িতে আধহাঁড়ি খিচুড়ি। মুখ থেকে একটা কথাও সরলো না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। তাকিয়ে রইলাম বাঙালিবাবার মুখের দিকে। আজ লিখতে বসে শুধু ভাবছি, ভাবছি মাধবদাসজির অতিথি সেবায় অলৌকিকত্বের কথা। চোখে না দেখলে এসব কথা কারও বিশ্বাসই হবে না। সাধারণ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যাও চলে না। এ কি কাম্যকবনে দ্রৌপদীর রন্ধনের থালি?

এবার আবার বিদায় নেবার পালা। ফিরতে হবে যমুনোত্রী থেকে। তাই কিছু প্রণামী দিতে গেলাম। শাস্ত্রে আছে সাধুসন্ন্যাসী এবং গুরুদর্শন করতে গেলে খালি হাতে যেতে নেই, প্রণামীও যথাসাধ্য দিতে হয়। নইলে তাঁদের দর্শন ও সঙ্গলাভজনিত কোনও ফললাভ হয় না। তাই দিতে গেলাম। মাধবদাসজি বাধা দিয়ে বললেন,

– দেখুন আপনারা তীর্থে বেরিয়েছেন। পথে অর্থের প্রয়োজন। অনেক খরচা। আমাকে কিছু দিতে হবে না। আমার জুটেই যাবে।

কিছুতেই নেবেন না। একেবারেই নারাজ। একরকম জোর করেই কিছু দিলাম। তারপর সঙ্গীসহ যমুনোত্রী ছেড়ে চলে আসছি আর পিছন ফিরে দেখছি বার বার, য-ত-ক্ষ-ণ দেখা যায়। ভাবছি, জীবনে আর কখনও আসা হবে না হয়ত, হতেও পারে। জানি না কি হবে, ভবিষ্যৎ যে কালের হাতে।

এবার হাঁটাপথে চড়াই উতরাই। যমুনাকে সঙ্গিনী করেই চলে এলাম জানকিচটিতে। তারপর ফুলচটি হনুমানচটি হয়ে প্রায় অন্ধকারে নেমে এলাম সানাচটিতে। বেশিরভাগ পথই উতরাই। সময়ও লাগল অনেক কম। তবুও দেহ একেবারে ক্লান্ত, অনভ্যাসের ফল।

একটা দোকানে রাতে থাকার ব্যবস্থা করলাম। ঠান্ডা তো এখানে বরাবরই। তবুও শীত যেন আজ একটু বেশি বলে মনে হল। রাতে বাসের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম। পাশেই বাসস্ট্যান্ড। কাল বাস ছাড়বে ভোরে। যাব গঙ্গোত্রী।

মাধবদাস বাঙালিবাবার এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতাকে বলা হয় বিভূতি। যার মাধ্যমে মাত্র কয়েকজনের জন্য রান্না করা খাবার তিনি বহুজনকে খাওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। যোগশাস্ত্রে আটপ্রকার বিভূতিকে বলা হয়েছে অষ্টসিদ্ধি। যেমন অণিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব ও কামাবসায়িতা। এগুলি শক্তিমান সাধু সন্ন্যাসী যোগী বা সাধকদের সাধনালব্ধ ঈশ্বরপ্রদত্ত ঐশ্বর্য বা শক্তি, বিভূতি।

অণিমা – যে বিভূতি বা শক্তিবলে এত সূক্ষ্ম হতে পারা যায় যে, অত্যন্ত ঘন বা নিরেট কঠিন যেকোনও পদার্থের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা যায় অনায়াসে।

লঘিমা – যে শক্তির সাহায্যে এত লঘু বা হাল্কা হওয়া যায় যে, জলের উপর দিয়ে বা হাওয়ায় ভেসে, এমনকি সূর্যকিরণ অবলম্বন করে যেকোনও স্থানে যাওয়া যায় ইচ্ছামতো।

প্রাপ্তি – যা পেতে চাওয়া যায় তাই-ই পাওয়া যায়। সে অভীষ্ট পার্থিব বা অপার্থিব স্থূল সূক্ষ্ম, দূরের বা কাছের, যেখানকারই হোক না কেন।

প্রাকাম্য – যে কোনও জিনিস বা যা কিছু কামনা করা যায় তা পেতে কোনও বাধা থাকে না।

মহিমা – এই শক্তির মাধ্যমে এত বৃহৎ হতে পারা যায় যে, চতুর্দশ ভুবনকেও নিজের শরীরের অন্তর্গত করা যায় এবং যেকোনও বাধা সৃষ্টি করতে ওই বৃহত্বকে কাজে লাগানো যায়।

ঈশিত্ব – এই শক্তি দ্বারা সব কিছুর উপর প্রভুত্ব করা যায়, সমুদয় ভূতের উপর আধিপত্য থাকে।

বশিত্ব – এই বিভূতিবলে দুর্দম শত্রু দুর্দান্ত হিংস্র প্রাণিকেও নিজের বশে আনা যায় সহজেই, অনায়াসে।

কামাবসায়িতা – যে শক্তিবলে সকল কামনাই পূর্ণ অথবা নিবৃত্ত করতে পারা যায়, সেই শক্তিই কামাবসায়িতা।

আলোচিত সাধনৈশ্চর্য বা শক্তিবলে মানুষ সহজেই পারে অনেক অসাধ্য সাধন করতে। অষ্টসিদ্ধির কয়েকটি সিদ্ধি আছে কিছু কিছু যোগী সাধুসন্ন্যাসীদের, যারা আশ্চর্যজনক ক্রিয়াকলাপাদি প্রদর্শন করতে সক্ষম।

বর্তমানেও আছেন এমন কিছু সাধুসন্ন্যাসী, যারা লোকপ্রিয়তার জন্য অলৌকিক কিছু দেখিয়ে সরলমনা মানুষের কাছে নিজেকে বিশেষ শক্তিমান বলে প্রতিপন্ন করে শিষ্য বা ভক্তসংখ্যা বৃদ্ধি করে থাকেন। তবে যারা প্রকৃতই ঈশ্বরানুরাগী ও মুক্তিকামী, তারা কখনও আপন সাধনালব্ধ শক্তির অপব্যবহার করেন না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *