Feature

পথচলতি অপ্রীতিকর আচরণ ও তার সামাজিক প্রেক্ষিত

এক শ্রেণির মেরুদন্ডহীন মানুষের কথা, কেউ শহরের, কেউ বা শহরতলির। এদের সব্বাইকে নিয়েই কথা।

এক শ্রেণির মেরুদন্ডহীন মানুষের কথা, কেউ শহরের, কেউ বা শহরতলির। এদের সব্বাইকে নিয়েই কথা। কারণ কোলকাতাটা, এ বাংলাটা যেমন বাঙালির একার নয়, তেমনই বাংলা আর কোলকাতা এখন আর বাঙালিরও নয়। এদেরই চরিত্রগত কিছু গুণের কথা এখানে। প্রতিদিনের কোলকাতায় তাদের সারাদিন –

প্রথমেই শুরু করি ভারতীয় রেলের ‘অনুগ্রহ করে শুনবেন’ – ট্রেনের আগমন নিগমের অধিকাংশ সংবাদ ঘোষিকারা এমন কুতে কুতে ঘোষণা করেন মনে হয় যেন কোলকাতার জলই এর একমাত্র কারণ। বাড়িতেও কি এমন করে কথা বলেন? সারা বিশ্বে ‘ধন্যবাদ’ কথাটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফ্রান্সে। রেলের ঘোষিকাদের দৌলতে ফ্রান্সের পজিশনটা ভারত এই বুঝিবা ছিনিয়ে ‘ল্যায়’।


আকর্ষণীয় খবর পড়তে ডাউনলোড করুন নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

কোলকাতার শহুরে স্টেশন শিয়ালদা কিংবা হাওড়া। হাঁ করে এক মনে দেখছেন ট্রেনের সময় তালিকা। কিছু মালবাহক মালপত্তর নিয়ে ঠেলাগাড়ি দিয়ে আপনার পিছনে গদাম করে বুনো শুয়োরের মতো গুঁতো মেরে পরে ‘হটিয়ে হটিয়ে’। প্রতিবাদ করলে এরা কর্ণপাত করে না। প্রতিবাদটা জোরালো হলে সুস্থদেহে বাড়ি ফিরতে হবে না।

আগে রাস্তাঘাটে পেচ্ছাব করলে পুলিশে ধরতো। এখন আর ধরে টরে না। সময় কোথায়? তবে এখন কোলকাতা ভাসে শীত গ্রীষ্ম বরষায়। সময় নেই এক শ্রেণির যাত্রীদেরও পেচ্ছাবখানায় যাওয়ার। কুকুরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেন কামরার সংযোগস্থলে। এদের কান্ডজ্ঞানের মাত্রাটা একবার ভাবুন?

বিজ্ঞাপনের যুগ। ভাল কথা। লোকাল ট্রেনের কামরার ভিতর ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে ‘৫-৭মিনিটে সাকশান পদ্ধতিতে আরোগ্যলাভ’, কোনও ছোট ছেলে বা মেয়ে যদি বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি এমন রোগ বাপি, ৫-৭মিনিটেই আরোগ্যলাভ হয়?’

ভারতীয় রেল মানেই জাতীয় সম্পত্তি। এতে আপনার আমার যথানামের অধিকার। একশ্রেণির যাত্রীদের কাছে এটা পৈত্রিক সম্পত্তি (যেমন অধিকাংশ কুলি ট্রেনের সিট দখল করে রাখে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে)। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে সিটে ব্যাগ, রুমাল, খবরের কাগজ ফেলে দিল। ব্যাস, ‘এটা আমার জায়গা, অন্য কারও অধিকার নেই।’ এইসব যাত্রীরা কবে যে রাজভবন, ভিক্টোরিয়া কিংবা রাইটার্সে একটা রুমাল ফেলে দাঁড়িয়ে থাকবে তা ভগাই জানে!

আপনি হয়তো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে। ওমা, হঠাৎ দেখলেন মাথাটা বন করে ঘুরে গেল। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। লো প্রেসার কিংবা সুগারের খোঁচা নয়। কোনও ট্রেনযাত্রী খুশিতে গদগদ হয়ে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন থেকে আপনার চুল কিংবা জামার কলার ধরে জানিয়ে গেল ‘কভি আলবিদা না কহেনা’।

লেডিস কম্পার্টমেন্ট। ট্রেন ছাড়ার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কোনও পুরুষের টিকিটা দেখতে পাবেন না। যেই ট্রেন ছাড়ল ওমনি একদল বীর হনুমান লম্ফ দিয়ে উঠল। ভাবটা এমন, না জেনেই উঠেছি, কিছু করার নেই। আসলে এরা কামরার কাছেই ঘুরঘুর করে। ট্রেন ছাড়লেই ওঠে। রেলপুলিশ জয় জগন্নাথ।

বহু স্টেশনেই পুরনো ভাড়ার ছাপানো টিকিট দেওয়া হয়। পরিবর্তিত ভাড়ার কোনও মূল্য লেখা থাকে না। কালেভদ্রে হয়তো কোথাও যাচ্ছেন। তাই সঠিক ভাড়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন কিংবা চেহারায় ও পোশাকে কেউ গাঁইয়া হলে গচ্চা যাবে। অনেকক্ষেত্রে কাউন্টারবাবু অনেকের নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নিয়ে নেয়। পরে বুঝে লাভ নেই।

কখনও তাড়াহুড়ো করে টিকিট কাটলেন। পয়সা গোনার সময় নেই। ট্রেনটা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে ভেবে বিশ্বাসেই ফেরত পয়সা নিয়ে উঠলেন ট্রেনে। দেখবেন অনেকক্ষেত্রে যা ভাড়া তার চেয়ে বেশি পয়সা নিয়েছে। পরে অভিযোগ করে কোনও লাভ নেই। কাউন্টার ছেড়ে একটু সরে এলে কোনও ভাবেই বিষয়টা প্রমাণ করতে পারবেন না। চোর সাজতে হবে আপনাকেই। যদি ব্যাপারটা হাতেনাতে ধরে ফেলেন, ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর, ‘ওফ্ ভুল হয়ে গেছে’।

ট্রেনে উঠে স্যাট্ করে চোখদুটো বুলিয়ে দেখলেন সবাই যেভাবে বসে আছে তাতে আর একজন বসতে পারে অনায়াসে। যারা বসে আছে তাদের বসার কায়দাটা দেখলে মনে হবে যেন তাকিয়া নিয়ে বসে আছে। পুরুষেরা যেমন মেয়েদের তো কথাই নেই। ঠ্যাং ফ্যাং ছড়িয়ে যেন বিয়েবাড়ির ভিয়েনে বসেছে প্যান্ডেলে। এবার সরতে বলুন। উত্তর পাবেন, ‘কোথায় সরবো বলুন’ বলেই বেতোরুগীর মতো কোক্ কোক্ করে ফিগারটা একটু হেলাবে, সরবে না। কোনও রকমে পিছনটা একটু সাঁটিয়ে দিন। দেখবেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বডিটা গলে গিয়াছে। আরামসে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারটা কিন্তু ট্রেনে একচেটিয়া নয়, বাসেও পাবেন। আর তাস পিটানোর কথা তো ছেড়েই দিলাম।

শিয়ালদা এবং হাওড়া স্টেশন চত্বরের বাইরে ঢোকার মুখে একটা দল আছে যারা মরশুম অনুসারে জিনিস বিক্রি করে। যেমন শীতের সময় সোয়োটার। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত দাম?’ সঙ্গে সঙ্গেই জিনিসটা হাতে তুলে দিয়ে এমন একটা দর হাঁকবে যা আপনার সাধ্যের বাইরে। দামটা মোটেই ঠিক নয় বুঝে বললেন, ‘নাহ, চলবে না।’ এবার বিপদ। দলে এরা একা থাকে না। ৫-৭ জনে আপনাকে ঘিরে ধরবে। লুকিয়ে ক্ষুর দেখিয়ে মারার ভয় দেখাবে। যে কোনওভাবে ওটা আপনাকে নিতেই হবে। না নিতে চাইলে টাকা ছিনতাই করে নেবে। এটা হয় ভোরবেলায় প্রতিদিন।

শহর কোলকাতার গরমাগরম স্টেশন শিয়ালদা। অনুসন্ধান অফিস। হাতঘড়িতে যাত্রী দেখলেন রাত ৯টা। এবার কাউন্টারে কনুই ঠেকিয়ে, ‘দাদা, ৮.৩০ মিঃ বনগাঁ লোকাল কি চলে গেছে?’

অনেক সময় স্টেশন চত্বরে পা দিলেন। হঠাৎ ন্যাকাসুরে নারী কন্ঠ ভেসে এল, ‘অনুগ্রহ করে শুনবেন, ৪.৩৭-এর বনগাঁ লোকাল ৪নং প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। ধন্যবাদ।’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন তখন ৫.৩৭ মিঃ। ন্যাকামি আর কাকে বলে!

কোলকাতা থেকে কোথাও যাবেন। লোকালে ঘা-গুঁতো খেয়ে বসলেন। ট্রেন ছাড়ার সময় হল। হর্ণ বাজল পোঁ-ও-ও-ও। সমানে বেজেই চলল মিনিট খানেক। প্রশ্ন করলেন বাইরের কোনও যাত্রীকে,

– কি দাদা, হর্ণ বাজছে গাড়ি ছাড়ছে না কেন?

– ধ্যার মশাই, গার্ড কোথায়? ও তো যাত্রীরা বাজাচ্ছে।

গরমের মরশুম। শিয়ালদা আর হাওড়াসহ অধিকাংশ স্টেশনে পানীয় জলের কল ভাঙা থাকে, নইলে অজ্ঞাত কোনও কারণে জল পড়ে না। কারণটা রেল কর্তৃপক্ষ আমার চেয়ে অনেক বেশি ভাল বোঝেন। আমি বুঝি, ওটা না হলে স্টেশন চত্বরে কোল্ডড্রিংক আর হকার দাদাদের পানীয় জলের ঝাঁপে যে লাঠি পড়ে যাবে। এর পিছনে অন্য কোনও আঁতাত?

স্টেশনচত্বর ছেড়ে সবে রাস্তায় পা দিয়েছেন। কিছু রিকশা আর ঠ্যালাওয়ালার কথা। ধাক্কা দিয়ে কিংবা ফিচিক করে খইনি সমেত থুথু হয়তো আপনার গায়েই ফেলল। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কেয়া ভাই, তুম দেখতা নেহি ক্যা?’ সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর, ‘কেয়া করেগা বাবু, হাম গরিব আদমি হ্যায়।’

এবার ট্রেন ছেড়ে চলুন বাসে ট্রামে উঠি। বাস কিংবা ট্রাম ডিপো। টাইমলি কাজ। সময়েই ছাড়বে। অথচ যাত্রীদের কেউ না কেউ সমানে টিংটিং টিংটিং করে যাবে। কেউ বা দুমদুম করে চড় মারবে চালে। একজন বন্ধ করল তো আর একজনের শুরু। অষ্টম প্রহরের নাম কীর্তন। একদল গেল তো আর একদল গায়েন হাজির।

মাঝে মধ্যেই খিচুনী কন্ঠ, ‘কি হল দাদা ছাড়ুন। ড্রাইভার কি মাল খেতে গেছে।’ যাদের লক্ষ্য করে বলা, সেই ড্রাইভারও নেই, কন্ডাকটারও নেই।

বাস ছাড়ল। হঠাৎ দেখলেন পিছন থেকে মৃদু চাপ। তারপর সেটা রূপ নিল ঘোৎ ঘোৎ-এ। বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘কি মশাই অত গুতোচ্ছেন কেন?’

শ্যামবাজার নামব। তখনও চারটে স্টপেজ বাকি। প্রস্তুতি পর্ব। যেমন, মেয়ের বিয়ে হবে কোন অঘ্রাণে, বৈশাখ থেকেই সাজন গোজন।

বাস থামাবার ঘন্টা দিয়েছে কন্ডাকটার। যাত্রী নিজেও কেরামতি দেখিয়েছে দড়ি টেনে। তবুও একবার, আ-স-তে ভাই। এটা কন্ডাকটার কিংবা হেলপারের আওয়াজ নয়। বাস থামল। নামবার মুখে আর একবার রোককে ভাই।

গেট জ্যাম করবেন না। উঠে আসুন। ভিতরে যান। বামুনে মন্ত্র পড়ে, পাঁঠার কলায় শোনে। কোনও উত্তর নেই। ভিতরে ফাঁকা, উঠে আসুন। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে কন্ডাকটারের চেহারাটা মেপে আবার বাইরে চোখ। এরা উঠবেও না। বসবেও না। উঠতেও দেবে না। অদ্ভুত জীব!

বাস দাঁড়িয়ে আছে। তবু ওঠার নাম নেই। যেই ছাড়ল ওমনি বাঁদরের গাছে ওঠার কায়দায় দু-কদম দৌঁড়ে টুক করে ওঠা। যেন লায়েক হয়েছি। এবার টিকিট চাইতেই, ‘সামনে নামব।’ এক ফোয়ারা বোকা বোকা হাসি-হে হে। যেন পৈত্রিক সম্পত্তি।

বাসের সামনে লেখা, ৩৬। শিয়ালদা টু কাদাপাড়া। দেখা হল। ওঠাও হল। খান তিনেক স্টপেজ পর, ‘টিকিট?’

-এটা কি ১৪ নম্বর, মানিকতলা যাবে? কন্ডাক্টার, ‘না’। শ্যাওলাপড়া দাঁতে ফিক্ করে হেসে চোদ্দো নম্বর দাদা নেমে গেলেন।

কিছু কিছু প্রাইভেট আর মিনিদের উন্মাদের মতো চিৎকার করে যাত্রী ডাকা তো আছেই, বাসে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই টিকিটগুচ্ছে, খিচিক্ খিচিক্। ভাবটা দেখলে মনে হয় যেন বাড়িতে কেউ মারা গিয়েছে। এই পয়সা নিয়ে পোড়াতে যাবে। এমন ভাড়া।

নারকেলডাঙ্গা থেকে কোনও যাত্রী উঠলেন। কন্ডাক্টারকে বললেন, ‘দাদা বেহালা আসলে বলবেন’।‌ উত্তরে দাদা জানালেন, ‘এখনও অনেক দেরি আছে।’

খান কয়েক স্টপেজ পার। এবার পিছনের মধ্যাংশ দিয়ে ঢুশিয়ে বাইরে উঁকি। এই যেন এসে গেল! এইভাবে সমানে একটা করে স্টপেজ, একটা করে গুঁতো, একবার করে কুঁজো, একবার উঁকি। জ্বালিয়ে দিলে। বেহালা এল দেড় ঘন্টা পর।

‘কি হল দাদা, বাসটাকে এমন গরুর গাড়ির মতো চালাচ্ছেন কেন? একটু জোরে চালান।’ বাসের সামনের দিকে লেখা, ‘ড্রাইভারকে জোরে চালানোর জন্যে অনুরোধ করবেন না।’

বাড়িতে ছেলেপুলের কাঁথা ধোয়া থেকে শুরু করে অফিসের ভাত। কত কাজ! কাজের আর শেষ নেই। তাই সময় কোথায়? সামনেই শীত আসছে। দুটো কাঁটা একটা বল। ‘এটা ভাই আমি বাস জার্নি করতে করতেই শেষ করব।’

বাড়িতে পড়ার পরিবেশটা ঠিক পড়ার মতো নয়। স্কুল কলেজেরও ওই একই দশা। তেলের অভাবে গ্যাসলাইট। বিদ্যাসাগর অত কষ্ট করেছেন। অতএব যদি পড়তে হয় তো ট্রামে বাসে ট্রেনে পড়ে বিদ্যাসাগর হও। অতএব পড়ুয়া বাঙালি আর শুয়ে বসে নয়, ট্রামে বাসে উঠে ‘পড়’।

‘ম্যাডাম, ব্যাগটা একটু ধরবেন?’ পাঁচটা বাঘনখি আঙুল ধরে নিল। ধরবেনবাবুর ‘ধরবেন’টার কোনও প্রয়োজনই ছিল না তবুও ধরাবেন। ট্রামে বাসে এমনটা করতে দেখা যায় ছেলেদেরই। এতে যে কি মজা তা কে জানে?

ট্রামের গোঁফের উপর ঝুলছে ‘Ladies Only’। দেখছেও সবাই। টুক করে উঠে পড়বে কোনও যুবক, প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধ। কন্ডাক্টার জানায়, ‘এটা লেডিস অনলি।’ উত্তর আসে, ‘ওসব ঠিক আছে। নারী পুরুষ সমান সমান।’

কোনও বাসে কিংবা ট্রামে হঠাৎ দেখলেন স্যাট করে একটা হাত রেড স্যালুটের কায়দায় কপালে উঠেই নেমে গেল। বুঝতে হবে মাইল খানেকের মধ্যে কোনও মন্দির আছে। প্রীতি কিংবা ঐশ্বর্যের ফ্লাইং কিস এর মতো প্রণামটা বায়ু তরঙ্গে ছেড়ে দিল। মা কালী মন্দিরে দাঁড়িয়ে লুফে নিল। ভক্তি যেন জ্বাল দেয়া দুধ, উথলে উঠছে।

ট্রামে বাসে ইচ্ছে করে মেয়েদের গায়ে গা সাটিয়ে দাঁড়ানো, না দুললেও দুলে দুলে স্পর্শ করা। পিছনে চিমটি কাটা যাত্রীর অভাব নেই এই শহর কোলকাতায়। লেডিস সিটের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম, অনেকের আবার পরিস্কার জামা কাপড় দেখলে চোখ টাটায়। ইচ্ছে করে গুটখা কিংবা পানের পিক ফিচিক্ করে গায়ে ফেলবে। খেয়াল করিনি। আর নিজের পায়ে ট্রামে বাসে দাঁড়ানো তো অনেকে ভুলেই গিয়েছে।

ছিক ছিক করে বিড়ালের হিসি করার মতো কোলকাতায় বৃষ্টি হলে সরকারি ট্রাম বাস বন্ধ। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ইউনিয়ানবাজীয়ালাদের প্রাইভেট বাস বন্ধ করার ঘটনা আকছার। যাত্রীদের বাড়ি ফেরার চিন্তা থাকবে না যদি কোনও বুদ্ধিমান যাত্রী রান্নার সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে বেরোয় এইসব শয়তানদের হাত থেকে মুক্তি পেতে।

বাসে তেমন ভিড় নেই। তবুও গেটের কাছে কিছু কনডাকটার আছে যারা, মেয়েরা পাদানিতে পা দেওয়া মাত্রই অকারণ পাজাকোলা করে তুলে নেয়। জনসেবা, ধরলাম বলে নইলে অকালে প্রাণটা যেত চাকার তলায়।

গরমকাল। ট্রেন কিংবা বাসযাত্রীদের পকেট থেকে রুমাল বের করার সময় নেই। ঠেলাঠেলির ছলে তার ফাটা কপালটা সামনে দাঁড়ানো কোনও লোকের কাঁধে ঠেকালেই বুঝতে হবে এক চকলা ময়লা সমেত এক পোচ ঘাম গেল। একইভাবে কেউ চলমান বাস থেকে থুথু ফেলল, পড়ল হয়তো আপনার মুখে। নাকটা ঝেড়ে ব্যস্ততার ভাব নিয়ে হাতটা আপনার জামায় মুছে যাওয়ার মতো লোকের অভাব নেই তিলোত্তমা কোলকাতায়। যদি কখনও জামায় আঠা আঠা বা লেই লেই দেখলেন, দেরি না করে সাবান মেরে দিন। উপায় কি?

বাসে কনডাকটার ভাড়া চাইলে, দিচ্ছি। এই দিচ্ছি দেব না দিয়ে যে কত যাত্রী কেটে পড়ছে তার ইয়ত্তা নেই। একবারের বেশি দু’বার চাইলে যাত্রী মুখের ভাবটা এমন করে যেন কনডাকটার পাকা ধানে মই দিয়েছে। এটা অবশ্য সরকারি বাসে। আর প্রাইভেট বাসে? ও কম্মোটি হচ্ছে না। ফুটবোর্ডে পা ঠেকাতে না ঠেকাতেই -খিচিক্, খিচিক্। পড়লেন কি মরলেন দেখার দরকার নেই। ফেল কড়ি এখনই। খেলার মরশুম। একশ্রেণির ক্রীড়ামোদির কাছে বাসট্রেন ট্রামটা হয়ে দাঁড়ায় পৈত্রিক সম্পত্তি। ভাড়া না দেওয়া, যাত্রীদের উঠতে না দেওয়া, খিস্তিখেউর তো আছেই, মিটিং শেষে ফেরার পথে রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু ক্যাডারবাহিনী এমন ভদ্রতায় কিন্তু কম যায় না।

এবার চলুন ট্যাক্সিতে চড়ি। শহর কোলকাতার ট্যাক্সি। এই ট্যা-ক-সি। কোথায় যাবেন? শ্যামবাজার। না দাদা, খেতে যাচ্ছি। প্রয়োজন আপনার যত জরুরীই হোক না কেন, পছন্দসই জায়গা না হলে এদের বাধা বুলি, হয় খেতে নয় গ্যারেজে যাচ্ছি। কখনও বলে না মরতে যাচ্ছি। শয়তানি মিটারের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

কিছু কিছু প্রাইভেট বাস, মিনিবাস আর অটোরিক্সা চালকদের কাছে কোলকাতার রাস্তাটা যেন সরকারের রেজিস্ট্রি করে দেওয়া সম্পত্তি। যেভাবে খুশি চালাব, হর্ণ দেব, যেখানে খুশি যখন খুশি ওভারটেক করব। তুমি কোথাকার কোন মিঞা হে? ইউনিয়ানের নেতারা দেখছে, জানে অথচ কোনও ব্যবস্থা? দেখছি কি করা যায়? অপদার্থ! ট্রাফিক পুলিশ? তদন্ত চলছে!

ট্যাক্সি কিংবা বাসে দেখবেন, বসার সিটের নারকেল ছোবড়া অথবা স্পঞ্জগুলো দাঁত সিটকে বসে আছে। মনে হবে ক্ষিদের জ্বালায় কোনও যাত্রী খামচা মেরে এক খাবলা তুলে নিয়েছে। এটা নেই কাজ তো খইভাজদের কাজ। অনেকে ট্রেনে কিংবা ট্যাক্সিতে সিটের উপরে শ্রীচরণ দুখানি তুলে বসে। আশীর্বাদ স্বরূপ রেখে যায় পদধূলি।

এবার দমকলবাহিনীতে যোগ দেওয়া যাক। জ্যামজট আর নানান কারণে ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছালে দমকলকর্মীদের সঙ্গে নগরবাসীর সুমধুর অভ্যর্থনার কথা তো সকলেরই জানা। আসি এদের মূল্যবান সময় নষ্টের কথায়। ওই বাহিনীর এক অফিসার থাকতেন আমাদের পাড়ায়। তাঁর মুখেই এই ঘটনাগুলি শোনা।

একবার ফায়ার কল হল। পড়িমরি করে বাহিনী হাজির। বাড়ির মালিক বললেন, দেখুন তিনতলায় থাকি। স্টিলের দামড়া আলমারিটা কিছুতেই উপরে তুলতে পারছি না, তাই আপনাদের ডেকেছি। মইটা দিয়ে একটু তুলে দিন না, দেখবেন রংটা যেন না চটে।

আর একটা ঘটনা। ফায়ার কলের সঙ্গে সঙ্গেই দমকল ছুটল ঢংঢং করে। ঘটনাস্থলে হাজির। গৃহকর্তা বললেন, বউটা বড় জেদি। মন আর মতের মিল হয় না। অফিস থেকে এসে ঠায় বাইরে দাঁড়িয়ে  আছি। কিছুতেই দরজা খুলছে না। দেখলাম আপনারাই শীত গ্রীষ্মের একমাত্র ভরসা। তাই ডাকা। দয়া করে দরজাটা একটু খুলে দিতে বলুন না।

ঘটনার শেষ নেই। ফায়ার কল হল। দমকল, জি হুজুর, হাজির। সাতদিনের বাসি চুপসে যাওয়া বেগুনের মতো মুখ করে গৃহকর্তা জানালেন, আমার ওয়াইফের লেবার পেইন উঠেছে। এই রাত দুপুরে ট্যাক্সি নেই। অ্যাম্বুলেন্স-এ ফোন করলে বলবে গাড়ি নেই কিংবা খারাপ। নইলে যতক্ষণে আসবে ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যাবে। আপনারাই একমাত্র বাঁচাতে পারেন আমার বউটাকে। একটু হসপিটালে পৌঁছে দিন না!

‘কোলকাতার টেলিফোন’কে নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ওদের গুণের শেষ নেই! অন্য কথা, পাড়ার কোনও বাড়ির ফোন নম্বর যোগাড় করে যে সব ছেলেরা সময় সুযোগ বুঝে বাড়ির মেয়েদের বিরক্ত করে তাদের কথাও লিখছি না, লিখছি পাবলিক টেলিফোনে পিরিতের কথা। অন্যের মূল্যবান সময় নষ্ট করে দেওয়ার কথা। কানটা খাড়া করে রাখলেই শুনবেন, না, না। আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে – হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে।

– কাকের বাসার নীচে দাঁড়াব? আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার বাবা কি কিছু বলেছিল সেদিন ফিরতে দেরি হওয়াতে। আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে।

ফোনে না-না, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। প্রেম পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আপনার ফোন নেই। কাজের বারোটা নয়, চব্বিশটা।

ধর্ম্মের নামে যেসব ওজন করার মেসিনগুলো সিনেমা হল, হোটেল, খাবারের দোকান, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফিচিক্ ফিচিক্ করে আলো মেরে ডাকছে, এবার তাদের কথা। ‘চাকা না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন’। অপেক্ষা করেই দশবার নিয়ম মেনে পয়সা ফেলুন। দেখবেন, বডি আপনার একটা অথচ একই জায়গায় বিভিন্ন মেসিনে ওজন আপনার হরেক রকম। কোন দেশি ভদ্রতা করার জন্য এগুলো রাখা?

কোনও গলি কিংবা বাড়ির পাশ দিয়ে চলেছেন। গান গাইছেন গুনগুন করে, হু-হু, ‘ডুব দেরে মন কালী বলে।’ হুট করে মুখের উপর খপাং করে মাছের আঁশ কিংবা তরকারির খোসা এসে পড়লে ‘ঘাবড়ানে কা কোই বাত নেহি’। ওটা কোলকাতার একশ্রেণির কর্মব্যস্ত গৃহিনীদের সপ্রেম অভ্যর্থনা।

উপর থেকে জল এসে পড়লে এদিক ওদিক তাকানো স্রেফ বোকামি। কুলিকুচি করে অথবা গ্লাসের খাওয়া জলের শেষাংশকে উপরওয়ালার স্বর্গ থেকে সিঞ্চন করা শান্তি বারি হিসাবে ধরলে এ জন্মের পাপ সব কেটে যাবে।

পথ চলছেন একমনে। হঠাৎ হকারি কন্ঠ, ‘লে লে বাবু সরবত ২৫ পয়সা।’ গলা না শুকালেও ঢক্ ঢক্ করে মেরে দিলেন দু’গ্লাস। দিতে গেলেন পঞ্চাশ পয়সা। এবার ক্যাজরা বাধবে। দিতে হবে ৪.৫০ টাকা। অর্থাৎ ২ টাকা ২৫ পয়সা গ্লাস। ওদের হাঁকে টাকাটা থাকে না।

রাস্তা পারাপারের সিগনাল দেয়নি ট্রাফিক পুলিশ। কিন্তু এক ছুটে পথচারি পুলিশের তোলা হাতের তলায় গিয়ে হাজির। কিছুটা তো এগোলাম।

পাড়ার রাস্তা। নবাব পুত্তুরদের বকর বকর চলছে তো চলছেই। লরি, প্রাইভেট কিংবা ট্যাক্সি হর্ণ দেয় – পক্‌পক্। সরে দাঁড়াও। ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার পক্‌পক্। নবাবি কায়দায় তেছরা দৃষ্টি। আবার শুরু। পিতৃদত্ত জমিদারির রাস্তা।

শতকরা একদিন ট্যাক্সি চড়া বাবু। পাড়ায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বদনটা একটু বাড়িয়ে ‘আমাকে দেখ’। নামার পর ট্যাক্সির দরজা বন্ধের আওয়াজটা আরও একবার বলে দেবে, ‘আমাকে দেখ।’ আহ্, কি ট্যাক্সি চড়লুম!

রূপসী কোলকাতার সারা অঙ্গে ছোট বড় নানান সাইজের মৎস্য প্রকল্প। ‘বর্ষাকালে তার হাঁটু জল থাকে।’ প্রায় কোনও ড্রাইভারই জল না ছিটিয়ে যাবে না। ফলে জামা কাপড়েও বিউটি স্পট। মধুর কন্ঠে জনতার কাঁচাগোল্লা, ‘এই অমুকের বাচ্চা, দেখে চালাতে পারিস না’। গাড়ি ততক্ষণে এক কিলোমিটার পার।

কোলকাতার অটোরিকশা সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। তবে কথায় বলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চির নাকি তাকত্ বেশি। একশ্রেণির কঞ্চিরূপী হোমগার্ডের কথা। এরা ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় থাকলে অনেক সময় ভাবটা এমন যেন ডিসি ট্রাফিক! লরি, ট্যাক্সি, অটোরিকশা, প্রাইভেট থামিয়ে উঠে বসে। চলে যায় নিজের গন্তব্যে। তখন ভাবটা এমন, ‘না নিয়ে গেলে নম্বর লেব।’

সাজানো কাপড়ের দোকান। হাইহিল সুন্দরী হাজির। দেখে চলেছে একের পর এক। পিওর মুর্শিদাবাদ থেকে কাশী বারানসী। পাট ভাঙছে দোকানিও। বড় খদ্দের। খান পঞ্চাশেক দেখা শেষ। ‘নাহ্, আমি যেটা খুঁজছি সেটা নেই।’ ঝমঝমে বর্ষায় এমন খদ্দেরই বেশি। দাঁড়ানোর ঠাঁই নেই। ভিজতে হবে। অতএব দোকানে প্রবেশ। শাড়ি দেখা শুরু। বর্ষা শেষ। শাড়ি দেখাও শেষ। ‘চলি, লেটেস্ট কিছু রাখুন।’

‘এখানে প্রস্রাব করিও না।’ এখানেই করিব। বিখ্যাত মনীষীর প্রস্তর মূর্তির সামনেই দাঁড়াইয়া করিব। আবার জন্ম হইলেও করিব। অনন্তকাল ‘ধরিয়া করিব’। দেখি কোন ব্যাটা আছে রুখতে পারে।

এমনিতেই এক চিলতে জায়গা নেই ফুটপাথে। সহজে চলে কার বাপের সাধ্যি। হঠাৎ মাথায় খেলেন একটা জব্বর খোঁচা। উফ্ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন নির্বিবাদে খোঁচা মেরে বত্রিশ ছাতি ছত্রিশ করে এগিয়ে চলেছেন কেউ না কেউ, ছাতা খুলে। অথচ সারাটা ফুটপাথেই বাড়ির ছায়া, বৃষ্টি নেই।

স্কুল কিংবা কলেজ টাইমে ছাত্রীরা দলবদ্ধ হয়ে এমনভাবে রাস্তা জুড়ে চলবে, আপনি এগোবেন সাধ্য কি? ঢুষিয়ে চলে যায়, সংখ্যায় ছেলেরা বেশি হলে। একা হলে সাহসী হয়ে যদি বলেন, ‘একটু সরবেন?’ তাহলে দলবদ্ধরা পথ তো ছাড়বেই না, এমন অবজ্ঞাসূচক তাকাবে কিংবা ফিক্ ফিক্ করে হাসবে, তখন নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হবে। এরা আগেও না, পথও ছাড়ে না।

পথ চলছেন। হঠাৎ কোনও যুবক প্রৌঢ় কিংবা বয়স্ককে যদি দেখেন চলতে চলতে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, তবে লক্ষ্য করুন, নিশ্চয়ই কোনও মেয়েকে চোখ দিয়ে চাটছে।

আধুনিকাদের বর্তমানে হুল ফোটানো পোশাকের কথা ছেড়েই দিলাম, অধিকাংশ মোটর সাইকেল কিংবা স্কুটারের পিছনে বসা মেয়েদের একটু দেখুন। ভাবটা এই, এইভাবে না ধরলে যে পড়ে যাব। ভগবান শঙ্করেরও কৈলাস থেকে পার্বতীকে কোলকাতায় এনে একটা রাজদূত কিংবা বাজাজ কিনে চালাতে না ইচ্ছে করে!

কচি কেজিতে পড়ে বিলেত যাবে। তাই নাকের পোটাধরাদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় বাবা-মা কিংবা কাজের লোক। রাস্তায় মরা কুকুরের ঠ্যাং-এ দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার কায়দা। জয়েন্টের মায়ের প্রস্তুতি পর্ব। আবার একশ্রেণির অভিভাবকদের এক বগলে বইয়ের বান্ডিল আর এক বগলে আধদামড়া মেয়ে। যদি পাড়া কিংবা বেপাড়ার কেউ সারাজীবনের ঠিকেদারি নিয়ে ফেলে।

পরীক্ষার মরশুম। গার্জিয়ানদের কেউ না কেউ ইস্কুল কিংবা কলেজ গেটে হাজির টিফিনের এক আধ-ঘন্টা আগে। হাতে দুধ ঘোল চিনি থেকে চাউমিন, আরও কত কি? আহা, বাছার আমার গলা শুকিয়ে কিসমিস। পেটে দানাপানিও নেই।

পরীক্ষার রেজাল্ট? এঁদের স্কুল জীবনে এসব কেউ দিতে গিয়েছিল কি? বিদ্যাসাগর, আশুতোষ, শরৎ চাটুজ্জ্যের দুর্ভাগ্য!

হ্যাঁ, কুকুরকাকু। ইনি রাস্তায় কুকুর বের করে রাজ্যের কুকুর জড়ো করেন। কুকুর যতটা না ছোটে তার চেয়ে বেশি ছোটেন কুকুরকাকু। হেঁই টমি, হেঁই হেঁই। দুষ্টুমি করিস না। ভাল করে বাথরুম কর। নইলে বাপিকে বলে দেব। হাম কুকুর পোষতা হ্যায়।

ভরদুপুরে কিংবা রাত দুপুরে। ব্যালো হ্যারি, হারি বোল। আবার ব্যালো, হারি বোল। জোর সে ব্যালো – হারি বোল। দুসরা ব্যালো – হারি বোল। ঘুমন্ত শিশু চমকে উঠল, অসুস্থ রুগী মারা গেল তো বয়েই গেল। এমন শববহনকারীদের দেখলে আপনার জানতে ইচ্ছে করবে, এদের কি কোনওদিন বাপ মা মরবে না, নাকি মরেনি কারও? তখন শ্মশানযাত্রার সময় কি এইভাবে চেঁচিয়েছিল, না চেঁচাবে? শব্দদূষণে ‘ব্যালো হারিদের’ মতো প্রাইভেট বাসের একশ্রেণির কনডাকটার আর তার চামচেদের অবদান কিন্তু কোলকাতার গর্ব।

কলকাতার খোঁড়াখুড়ি লাগাতার ডিসেন্ট্রির মতো। সকালে অফিস যাওয়ার সময় যেখানে দেখলেন সুন্দর রাস্তা, বিকেলে অফিসফেরতা দেখলেন ছোটখাটো কুমির কিংবা মৎস্য প্রকল্প। এই গর্ত খোঁড়া দেখার জন্যেও লোক দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। যেন সোনা তোলা হচ্ছে, তুলছে কখনও কলকাতা কর্পোরেশান, কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই নইলে কোলকাতা টেলিফোন। এই প্রকল্প রূপায়ণে এ তিনের দোস্তিই যেন অনন্তকালের দস্তুর।

মিছিল নরকে গুলজার কলকাতা। জিন্দাবাদ সকাল থেকে সন্ধে। অধিকার চাইলেই পাওয়া যায় না। ছিনিয়ে লিতি হয়। পথের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি যাব। এ দাবী চলার দাবী। মিছিলের আগে ভাগে দুচারজন। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। নেতা নেতা ভাব, মর্নিং ফ্লাইটে দিল্লি থেকে ফিরলুম। তাকানোটা বোকা বোকা। আহ্, আমরা যাচ্ছি। পুলিশ গার্ড দিতে দিতে লিয়ে যাচ্ছে।

দুম করে একটা ফোল্ডিং চেয়ার হাজির। পকেট থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা ঝান্ডা। গামছার হাফ সাইজ। ফটাফট্ বাঁধা হল লাইট পোস্টে। তারপরই বন্ধুগণ, এইভাবে যদি শোষণ চলতে থাকে, এইভাবে বুর্জোয়ারা যদি রক্ত ল্যামেনচুষের মতো চুষে চুষে খেতে থাকে, তাহলে আমাদের একদিন অ্যানিমিয়া হবেই হবে….। রাস্তা জ্যাম। সারাদিনের কাজ লাটে।

কলকাতার হোটেল রেষ্টুরেন্টে খাওয়া চুকে গেল। তবুও চলছে গল্প। অন্যকে বসতে না দেওয়ার রেওয়াজ তো একটা আছেই। নির্দিষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও চা খেয়ে চলমান পথচারী অনেকের এখানে ওখানে খালি ভাঁড়াটা ফেলার অভ্যাস আজও যায়নি।

বইপাড়ার ফুটপাথে হঠাৎ যদি কেউ হাত টেনে ধরে তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ছিনতাই নয়। কি বই লাগবে দাদা, এম. সেনের নোট দেব? ফুটপাথে হকারদের অধিকাংশই এক গোত্রের। জিনিসের দাম চাইবে আকাশ ছোঁয়া। শুনে আপনার প্রবৃত্তিই হবে না কথা বলার। দাম কত কম বলবেন? না কিনলে ওরা যে ভাযায় বিদায় সম্বর্ধনা দেবে তাতে দু-চার পিস হজমের পিল লাগবে।

কোনও বিক্রিবাট্টা নেই। তবুও সমানে চলছে হকারের চিল চিৎকার। হঠাৎ একজনে হয়তো একটা জিনিস কিনল। ব্যস, কয়েক মুহুর্তের মধ্যে হুড়মুড় করে পড়ল সবাই। ভুসি মাল সাফ। যেন ফ্রি দিচ্ছে।

তবে মুখে বিয়ে দেবে কালীঘাটে। অবিবাহিতা বোন আর বৌদি সঙ্গে থাকলে, ‘এখানে সস্তায় শাঁখা পাওয়া যায় দিদি।’ ফেবিকলের মতো এঁটে ধরবে কয়েকজন। ‘ত্রিশ টাকায় সব কমপ্লিট করে দেব। পরে খুশি হয়ে যা দেবেন।’ কোনও বড় মন্দিরে যান। গদগদ কন্ঠের চিৎকারে মেজাজটা আপনার খিঁচড়ে যাবে, ‘মাগো মা, একটু চেয়ে দ্যাখ।’ মা যেন ঘুমোচ্ছে!

চিড়িয়াখানায় চলুন। দেখবেন পোশাকে চেখনাই কোনও মাঞ্জা দেওয়া ভদ্রলোক কিংবা জেল্লামারা মহিলা বাঘ সিংহ কিংবা হনুমানের খাঁচায় কাঠি দিয়ে খোঁচাচ্ছে। কখনও ছোটছোট ইট মারছে। নইলে বাঁদরের মতো হুপহুপ করে দাঁত সিটকিয়ে চিল্লাচ্ছে। বলতে চাইছে প্রবৃত্তি ও আচরণে তোমার চাইতে কম নই।

কলকাতার যে কোনও সরকারি অফিসে কাঁটায় কাঁটায় হাজিরা আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ হতে জ্ঞানত আমি দেখিনি। প্রয়োজনীয় কাজটা একটু তাড়াতাড়ি হলে ভাল হয় কিন্তু হবে না। ওদের অধিকাংশই দেখবেন খেলার মরশুমে সৌরভ-শচীন, পুজোর মরশুমে বোনাস ও কাটপিস, বিয়ের মরশুমে পাড়ার কোন মেয়ে কাকে নিয়ে ভাগছে, এমন মরশুমি খবর নিয়েই সারা বছর মশগুল। পাড়ার দাদা কিংবা বিশেষ পরিচিত কেউ হলে ওরা গতরটা একটু নাড়াবে, নইলে ঠ্যাং-এ কাঁচি মেরে কেষ্টঠাকুর হয়ে ঠোঁটে খইনি গুজে দাঁড়িয়ে থাকুন।

কোলকাতার কোনও সিনেমা হলের সামনে, রাস্তার মোড়ে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে স্ত্রী, বান্ধবী কিংবা কোনও আত্মীয়াকে কখনই ভুল করে অপেক্ষা করতে বলবেন না। নইলে গিয়েই শুনবেন ‘জিদ্দি’-র মেহমুদের কায়দায় কেউ চোখ মেরে ফিসফিসিয়ে জানতে চেয়েছে, ‘কি রেট’?

তবে কোলকাতা ময়দান, ইডেন উদ্যান, আউটরাম ঘাট, ভিক্টোরিয়া কিংবা বড় বড় পার্কে প্রেমিক প্রেমিকাদের অধিকাংশেরই বসার কায়দাটা চোখে বড় লাগে বটে তবে প্রেম বলে কথা!

আবার সুন্দর শালীনতা বজায় রেখে প্রকৃত ভদ্রের মতো কেউ বসলেও তার রেহাই নেই। স্থানীয় ছেলেদের একটা অংশ, সন্তোষী কিংবা স্বপ্নার মায়ের পুজো করব, চাঁদা দিন। অনেক সময় স্থানীয় থানার এক শ্রেণীর পুলিশের ছানা খাওয়ার পয়সার জন্য হয়রাণির যেন আর অন্ত নেই।

শহর কোলকাতার সবচেয়ে বেশি যেটা দেখা যায় – ‘কে আগে’, আপনি আগে না আমি? মাছের বাজার, একটা মাছ হয়তো পছন্দ হয়েছে। দর কষাকষি করছেন। ওমা, ‘কে আগে’ এসে হাজির। ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে, সে দাম যাই হোক না কেন। ট্রাম বাস ট্রেনে, ‘কে আগে’? পাঁজরে ক্যাত করে গোত্তা মেরে উঠে যাবে। নামতে যাবেন? ‘কে আগে’ ল্যাং মেরে নেমে যাবে।

রেশন দোকান, তেল কিংবা দুধের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখানেও ‘কে আগে’ লাইন ভেঙে আগে নিয়ে যাবে। সিনেমা হল, খেলার মাঠ কথাই নেই। ‘কে আগে’র ছড়াছড়ি। উৎসবের কেনাকাটায় স্বস্তি নেই। ‘কে আগে’র হুড়ো হুড়ি লেগেই আছে। কালিঘাট, চিড়িয়াখানায় ‘কে আগে’র সংখ্যা কম নয়। মোট কথা, কোলকাতায় যেখানে সুষ্ঠভাবে কাজ হতে পারে, সেখানেই দেখবেন ‘কে আগে’ হাজির। আপনি আগে, না আমি আগে? এমন কি শিয়ালদা-হাওড়া স্টেশনের বাথরুমে পর্যন্ত।

বাড়ির দেওয়াল পরিস্কার রাখবেন? সে গুড়ে বালি। রাতারাতি দখল করে নেবে কোনও দাদার দলের চ্যালারা। মন্দিরের দেওয়ালও বাদ যায় না তবে পোস্টারে নয়, ‘মা, মাধুরীকে ভালবাসি। দেখ এ ভালবাসা যেন পাখির বাসা না হয়। তোমার বাবন।’

আর স্কুল কলেজের প্রস্রাবখানা থেকে শুরু করে ট্রেনের ভিতরে, রাজু প্লাস প্রীতি। ভাগ্যিস জিন্টা লেখেনা। আর কাঁচা হাতের বিচিত্র খোদাই কোণারকের দেওয়াল চিত্রকেও যেন হার মানায়।

কোলকাতার লোডশেডিং। যেই না যাওয়া অমনি গলার স্কেল চেঞ্জ, এক রাউন্ড কাঁচা খিস্তি। খিস্তিদাতার আশপাশে পাত্র দেখার সময় নেই। যেই এল, সঙ্গে সঙ্গে পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার, হইহই।

হঠাৎ দেখলেন কিছু লোক চোঁ-চোঁ করে ছুটছে। ওই দেখে আর সবাই দে ছুট। চিনেবাদাম আর ঝালমুড়ির দোকান উল্টে, কুকুরের বুকে পা দিয়ে, এ ওকে ল্যাং মেরে ছুটছে তো ছুটছেই। ছুটন্ত প্রাণিদের কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, কি হয়েছে দাদা? উত্তর – কি জানি! আবার বলুন, তাহলে ছুটছেন কেন? উত্তর সবাই ছুটছে তাই।

উড়াল পুল। পথচারী নিষিদ্ধ। ওখান দিয়েই পথচারী চলেছে নির্বিকারে, খোস মেজাজে গল্প করতে করতে।

বিশেষ তিথি উৎসবের কথা বাদই দিলাম। যে কোনও দিনের কথা। দক্ষিণেশ্বর, বাবুঘাট, জগন্নাথ ঘাট কিংবা অন্যান্য যেকোনও স্নানের ঘাটে একদল হাড়হাভাতে বুড়ো প্রৌঢ় আর যুবকরা স্নানরতা মেয়েদের গিলছে চোখ দিয়ে। এরা দেখছে, এদেরও যে কেউ দেখছে, এরা তা দেখছে না।

চলুন মিউজিয়ামে যাই। প্রাচীন ভাস্কর্যের কিছু পাথরের উলঙ্গ মূর্তি আছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, অধিকাংশ যুবক আর কিশোরেরা উলঙ্গ নারী কিংবা পুরুষ মূর্তির একটি জায়গায় নির্লিপ্তভাবে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। পাশে কোনও মহিলা দর্শক থাকলে তো কোনও কথাই নেই, উৎসাহ যেন বেড়েই চলে। বিশ্বাস না হয় দেখে আসুন, হাত পড়ে পড়ে ময়লার একটা কালো ছোপ পড়ে গিয়েছে। পাশেই কিন্তু লেখা আছে, স্পর্শ করা নিষেধ।

কোলকাতার পুজো। ৫০১ টাকা না দিলে তোড় হবে। এটা পাড়ার দাদার কথা। অসম্ভব আওয়াজ বাড়িয়ে মাইক চালানো ছাড়াও রাত দুপুরে মাইক বাজিয়েছি তো কি হয়েছে? ১৯৫২ সাল থেকে বাজিয়ে আসছি, এ অধিকার আটকাবে কে?

আবার একশ্রেণির প্রতিবেশিও আছেন যারা, কেউ পুজোর চাঁদা তুলতে গিয়ে বাড়ির কড়া নাড়লেন। জানালেন চাঁদা তুলতে গিয়েছেন। সব জেনে বুঝে না জানার ভান করে, এখন মাফ কর বাপু, রুটি নেই।

পুজোর মরশুমে কাগজে সরকারি বিজ্ঞাপন, ‘ছুঁচোবাজি, রকেট বাজি, আলুব্যোম ইত্যাদি পোড়ানো নিষিদ্ধ।’ ভাল কথা। কিন্তু সরকার নিষিদ্ধ এই বাজিগুলিই বিক্রি হচ্ছে খোলা বাজারে। নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি হলে দোষ নেই, পোড়ালেই নন্দ ঘোষ।

বাজি পুড়ছে ফ্ল্যাটের ছাদে, জ্বলন্ত ফুলকি পড়ছে বস্তিবাসী, পথচারীদের মাথায় – ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’

পাড়া বেপাড়ার পুজোমন্ডপ। প্রসাদ বিতরণকারীদের দেখুন। জোল্লামারা বৌদি কিংবা মেয়েদের প্রসাদ দিচ্ছে প্রাণভরে। আপনাকে গৌরাঙ্গ হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ওদের কৃপা হলে এক পিস শশা কলা অথবা পানিফল, মেয়েদের হাতে ‘প্রাণহরা’।

কোলকাতায় বিসর্জনের শোভাযাত্রা। পথ জুড়ে চলা, দাদাদের মিছিলের কায়দা। সঙ্গে তাসাপার্টির ঝিংকারাক্কার সঙ্গে চল্লু খেয়ে উল্লুর নৃত্য। এ নৃত্য যেন কলকাতার বনেদীনৃত্য, বরাবরের।

এবার চলুন বছরের শেষ বড় উৎসবে। আপনি হয়তো খুশিতে গাইতে গাইতে চলেছেন, ‘প্রেম চিরদিনই কাঁদিয়ে গেছে’। হঠাৎ দেখলেন গদাম করে একটা জলভরা বেলুন এসে পড়ল আপনার মুখে। তখন আর প্রেম নয়, বেলুনই কাঁদিয়ে যাবে। শত্রুতা নয়, এমনটা হলে বুঝতে হবে কোলকাতায় ‘হোলি আয়িরে হোলি আয়ি’। টমেটো কিংবা পচা ডিম পেলেও খাবার হিসাবে খুশি হয়ে নেবেন। চলন্ত ট্রেনে লাইনের ধার থেকে ছোঁড়া পাথর তো অনেকে ইতিমধ্যেই হজম করে ফেলেছে।

দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে সিঁথিতে লাল আবির লাগিয়ে হোলির সাতদিন পরেও ‘পিয়া ঘর’ যাওয়ার শখ কোলকাতাবাসিদের নজর এড়ায় না।

কথায় আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে, ভোজনে বাড়ে পেট’। কোলকাতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। একটা মিনি রামায়ণ হয়ে যাবে। কিন্তু এসব কথা বলবেন কাকে, অভিযোগ করবেনই বা কার কাছে, কার বিরুদ্ধে?

তার চেয়ে একটা গল্প বলি শুনুন। একবার শ্রীরামচন্দ্র আর লক্ষ্মণ সরযূতটে তাঁদের তীর দুটো মাটিতে পুঁতে ধনুক পাশে রেখে স্নান সেরে উঠলেন। তারপর দুজনেই তীর দুটো তুলে দেখলেন শ্রীরামের তীরের ডগায় সামান্য রক্ত। রাম লক্ষ্মণকে বললেন, এখানে মাটির নিচে হয়তো কোনও প্রাণি আছে যার দেহের রক্ত লেগেছে এই তীরের ডগায়। তখন রামের আদেশে লক্ষ্মণ মাটি খুঁড়তে সেখানে দেখা গেল আহত একটি ব্যাঙ। রামচন্দ্র তখন ব্যাঙকে বললেন, – আমারই তীরের আঘাতে তোমার দেহ ক্ষত হয়েছে। তুমি তো একবার ডেকে বলতে পারতে আমাকে?

উত্তরে ব্যাঙ বললে, প্রভু সারা জীবন যখন যে বিপদে পড়েছি তখনই হায় রাম, হায় রাম বলে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু আজ দেখলাম স্বয়ং রামই আমার হন্তা, তাই বলব কাকে আর অভিযোগই বা করব কার কাছে?

যাই হোক, মানুষের মনের পুষ্টি আর বৃদ্ধির অগ্রগতিতে সব চেয়ে বেশি সাহায্য করে পরিবেশগত শিক্ষা, একথা বলেছেন ফ্রয়েড।

একই সঙ্গে চরিত্রের সংজ্ঞায় পরিবেশের প্রভাব যে কতখানি তা পাওয়া যায় ফ্রয়েডেরই সহকর্মী ও শিষ্য আলফ্রেড অ্যাডলারের কথায়। তিনি চরিত্রের মনোজ্ঞ সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘চরিত্র একটি মানসিক সংস্থা। কোনও ব্যক্তি যে পরিবেশের মধ্যে চলাফেরা করে সেই পরিবেশের সঙ্গে সে যে গুণ ও প্রকৃতি নিয়ে আদান প্রদান করে, তাই-ই হল তার চরিত্র।’

টমাস ভ্যান ডি ভ্যালডি বলেছেন, ‘কোনও মানুষের সেই গুণ-সমষ্টিই হল তার চরিত্র যেগুলি অন্য লোকের সঙ্গে ব্যবহারে তাদের চোখে ধরা পড়ে এবং যেগুলি অন্য লোক হতে তাকে পৃথক করে দেখায় অর্থাৎ যে গুণগুলি ব্যক্তির আচারে, আচরণে প্রতিক্রিয়ায় ও প্রতীতিতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে’।

পূর্বালোচিত অপ্রীতিকর আচরণগুলি করার পশ্চাদপটের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের পরিবেশগত শিক্ষাই মূলত দায়ী। শিশুর ক্রমান্বয়ে সাবালকত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্কের যে বৃদ্ধি ঘটে তা তারই দেখা পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি ভাবে যুক্ত। ছোটবেলায় শিশুরা অভিভাবকদের সঙ্গে চলাফেরার সময় বিভিন্ন পরিবেশে তাদের অথবা অন্যের দ্বারা কৃত আচরণ লক্ষ্য করে অথচ তার কোনও প্রতিবাদ হতে দেখে না। ক্রমান্বয়ে বিষয়গুলি দেখতে দেখতে ওই জাতীয় আচরণ অন্যায় নয়, সবাই করছে, এমন একটা ছাপ পড়ে মনে। পরবর্তীক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই মনের উপরে পড়া ছাপগুলির প্রকাশ ঘটে অপ্রীতিকর আচরণে। এ দোষ কার, যে করে তার, না পরিবেশের? যেমন, প্রস্রাবখানা থাকা সত্ত্বেও ট্রেন কামরার সংযোগস্থলে প্রস্রাব করা। মোটের উপর প্রতিনিয়ত নানান পরিবেশে দেখা প্রতিবাদহীন কাজগুলিই জ্ঞানত বা অজ্ঞাতে অপ্রীতিকর কাজে প্ররোচিত করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে।

মনোবিজ্ঞানের দর্পণে আবার দেখা যায়, কিছু কিছু মানুষ জন্ম থেকেই এক বিকৃত মানসিক গঠন নিয়ে জন্মায়। তাদের কাছে যে কোনও সুন্দর ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাই অস্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে জ্ঞান বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। তাদের দ্বারা কৃত আচরণকে এক জাতীয় রোগ বলাই ভাল, যা চিকিৎসায় ভাল হতে পারে। আবার ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিপার্শ্বিক চাপ আর জীবন ও জীবিকার সংঘাতে দিশেহারা ও বিব্রত কিছু কিছু মানুষের মস্তিষ্কের কোষ ও স্নায়ু এমন এক পর্যায় আসে, যখন তারা কোনও কিছুকেই সহজ আর ভাল ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। মানসিক গতিটা হয়ে ওঠে নিয়মের বিপরীতমুখী। এই জাতীয় মানসিক সংঘাতে জর্জরিত মানুষের মন তার অজ্ঞাতেই মাঝে মধ্যে চায় মনের ক্লান্তিজনিত ফূর্তিহীনতার মুক্তি। ফলে এইসব মানুষেরা অনেক সময় জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা বা আচরণ করে ফেলে আনন্দ পেতে। এতে অনেক সময় তারা কৃতিত্ববোধ বা আত্মপ্রসাদ লাভও করে থাকে।

আজকের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবেশগত কারণে কিছু মানুষের মানসিকতা এমনভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, যারা কোনওরকম সামাজিক শৃঙ্খলা আর সুষ্ঠ রীতিনীতিকে মানে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত বিপরীনমুখী মানসিকতার বহির্প্রকাশ ঘটে তাদের অপ্রতিকর ও অসামাজিক আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে। তবে পোশাক পরিচ্ছদে দেখতে সভ্য ভদ্র হলেও সঠিক সামাজিক শিক্ষা ব্যতিত আমাদের এই ধরণের আচরণে কোনও পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

এত কথা হল। এবার উপসংহারটা আর একটা গল্প দিয়েই শেষ করি। এক আশ্রমে এক সাধুবাবা থাকতেন। প্রতিদিন তাঁর কাছে যারা এসে যে বর প্রার্থনা করত তাকে তিনি সেই বরই দিতেন। তার তাইই হত। ওই আশ্রমেই  থাকত একটা কুকুর। একদিন পথে সেই রাজ্যের সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে তার বিয়ে করার ইচ্ছা হল। দেরি না করে সোজা এসে সাধুবাবাকে বললে, তাকে সুন্দর রাজপুত্র হওয়ার বর দেওয়া হোক। একটু হেসে বর প্রদান করলেন তিনি। কুকুর  মূহূর্তে রূপান্তরিত হল সুন্দর সজ্জিত রাজপুত্রে। কালক্রমে বিয়ে হল সেই রাজকন্যার সঙ্গে।

সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদে শুয়ে আছে দুজনে। গভীর রাত, হঠাৎ ঘুম ভাঙলো রাজকন্যার। পাশে দেখলেন রাজপুত্র নেই। চারদিকে তাকালেন। দরজা বন্ধ অথচ রাজপুত্র কোথায়? এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলেন রাজপুত্র খাটের তলায় বসে একটা চামড়ার চটি চিবাচ্ছে। অবাক হয়ে রাজকন্যা বললেন,
– এ কি রাজপুত্র, আমাদের প্রাসাদে এত সুস্বাদু খাবার থাকা সত্ত্বেও তুমি এতরাতে ওখানে বসে চটি চিবাচ্ছ কেন?

রাজকুমার খাটের তলা থেকে মুচকি হেসে উত্তর দিলেন,

– রাজকন্যা, আমি এক সাধুর আশ্রমের কুকুর ছিলাম। তার প্রদত্ত বরে আমি রাজপুত্র হয়েছি। তোমাকে পেয়ে রাজপ্রাসাদে এসেছি। চেহারায় আমি রাজপুত্র ঠিকই, কিন্তু আসল স্বভাবটা আমার যাবে কোথায়? — চিত্রণ – সংযুক্তা

Show More

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *