Celeb Talk

বক্সিং থেকে অভিনয়ে

মুমতাজ সরকার। জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়রের সুযোগ্য কনিষ্ঠ কন্যা। ভীষণ হাসিখুশি। সব সময়ে মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেপ্টে আছে। হিরোইন সুলভ কোনও ভ্যানিটি নেই।

‘আমার অভিনয়ে আসাটা একদম ম্যাজিকের মত। তাও আবার বক্সিংয়ের হাত ধরে। আমি ভাল বক্সিং লড়ি শুনে বাংলাদেশের একটা মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের জন্য পরিচালক দেবলীনা আমাকে প্রথম অফার দেন। চরিত্রটাই ছিল একজন বক্সারের। ভাবলাম ছোট থেকে তো খেলেই কাটালাম। এবার একটু অন্য কিছু করে দেখাই যাক না। সবে তখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। হাতে অফুরান সময়। এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে যদি একটু অভিনয় করা যায় মন্দ কি! কাজটা করে ভাল লেগেছিল। আর আমার কাজ দেখে ভাল লেগেছিল দেবলীনারও। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আরও একটা মিউজিক ভিডিও করছিল দেবলীনা। ডাক পড়ল আমার। আমিও এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। এই দ্বিতীয় ভিডিওতে আমার অভিনয় দেখেই প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগটা পাই।’ আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, সিনেমার জগতে তিনি কিভাবে এলেন একথা জানতে চাইতে যিনি একটানা এই কথাগুলো বলে গেলেন তিনি হয়ত হাল ফিলের কোনও প্রথমসারির হিরো। তাই তো? যদি আপনি সত্যিই সেকথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি ডাহা ভুল ভাবছেন। যদিও একথা আমিও মানছি যে, না জানলে ওই বক্সিংয়ের কথা শোনার পর আমি নিজেও কোন হিরো তা নিয়ে মনে মনে একটা ফাটকা লড়ে ফেলতাম। কিন্তু সে কথা ভাবার কোনও সুযোগই নেই। কারণ যিনি কথাগুলো বললেন, তিনি আমার সামনে বসে আছেন। আর তাঁর দিকে একবার তাকালে তাঁর রূপের ছটায় যে কেউ, যে কোনও সময়ে সম্মোহিত হতে পারেন। একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

খুব বেশি হেঁয়ালি করে ফেলছি কি? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? নাহ, তবে আর ফুটেজ খাব না। যিনি আমায় তাঁর সিনেমার জগতে পা রাখার কাহিনি শোনালেন তিনি কোনও হিরো নন, এক অপরূপা সুন্দরী অভিনেত্রী। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমার হাত ধরে ‌যাঁকে চেনেন না এমন বাঙালি পাওয়া মুশকিল। তিনি মুমতাজ সরকার। জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়রের সুযোগ্য কনিষ্ঠ কন্যা। ভীষণ হাসিখুশি। সব সময়ে মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেপ্টে আছে। হিরোইন সুলভ কোনও ভ্যানিটি নেই। ভালবাসেন নিজের পরিবারকে। আর টুকটাক ম্যাজিক। নিজেই বললেন, স্কুল, কলেজ তো বটেই, এমনকি সিনেমার শুটিং-এর ফাঁকেও ইউনিটের আবদার রাখতে তাঁকে ম্যাজিক দেখাতে হয়। তবে হ্যাঁ, বলে রাখা ভাল আমাদের তরফ থেকে একটা ম্যাজিক দেখানোর অনুরোধ কিন্তু সুকৌশলে এড়িয়ে যান মুমতাজ।

নিজের পরিবার, নিজের বাড়ির কথা বলতে ভালবাসেন মুমতাজ। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই একথাটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। ফলে সাক্ষাৎকারটা সেই পথেই এগোলাম। বোনেদের মধ্যে ঝগড়া হয়? সাদামাটা প্রশ্ন। প্রশ্নটা শুনেই মুমতাজের মুখটা বেশ উৎফুল্লিত হয়ে উঠল।  ‘তিন বোন যখন তখন খুনসুটি তো হবেই। তবে আমি বাড়ির ছোট। ফলে আমার ওপর শাসন, ভালবাসা দুটোই বেশি। বাবা-মা তো আছেনই। উপরি পাওনা দুই দিদি। তবে দিদিরা থাকায় আমার পথ চলায় অনেক সুবিধা হয়েছে। দুই দিদি জীবনে চলতে গিয়ে যেখানে যেখানে ধাক্কা খেয়েছে সেগুলো তাদের অভিজ্ঞতার উপর ভর করেই আমি এড়িয়ে চলি। আবার অভিনয় করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে মৌবনীর সাহায্য চাই। ও আমার চেয়ে বেশি দিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাটিয়েছে। ফলে ও আমাকে অনেকটা গাইড করতে পারে। এগুলো অবশ্যই উপরি পাওনা। তার ওপর বাবা-মা তো আছেনই। বাবা-মা সবসময় সঠিক পথটা কি তা বুঝিয়ে দেন’।

‘ছোট থেকে যা করতে চেয়েছি, তাতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা-মা। আমি ছোটবেলা থেকেই ভাল নাচি। বাড়িতে ম্যাজিকের পরিবেশ থাকায় নাচেও সেই ম্যাজিক অনেক সময়ে একটা অভিনবত্বের ছোঁয়া দিতে সাহায্য করেছে। যেমন একবার চিত্রাঙ্গদা করছি। একটা জায়গায় কুরূপা থেকে সুরূপা হওয়ার দৃশ্য থাকে। তো সেটা একদম ম্যাজিকের সাহায্যে করেছিলাম। এটা সেসময়ে একটা নতুনত্ব ছিল’।

‘বাবা, দাদু দু’জনেই বিশাল মাপের মানুষ। তাঁরা নিজেদের একটা উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন। সেই পরিবারের মেয়ে হওয়ায় আমার ওপর একটা চাপ থাকেই। কারণ মানুষ যখন আমায় দেখেন তখন ধরেই নেন, আমিও নিজের কাজে সেই উচ্চতায় পৌঁছব। কিন্তু সেটা সহজ কাজ নয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, কারও সাহায্যে নয়, নিজের জোড়ে একটা জায়গায় যাওয়ার মধ্যে একটা মজা আছে। স্ট্রাগল করে ওঠাটা দরকার। কেউ হাত ধরে কোনও একটা জায়গায় পৌঁছে দিলে সহজে কিছু পাওয়া যায় ঠিকই, তবে তার মধ্যে কোনও মজা থাকে না। বরং ধীরে হলেও স্ট্রাগল করে ওঠার অভিজ্ঞতাটাও একটা বড় প্রাপ্তি।’ মুমতাজ সুন্দরীই নন, সুন্দর কথাও বলেন। বেশ ভাল লাগল।

‘আমার বাবা ভাবতেন তাঁর দুটো বাবা। একজন স্টেজে ম্যাজিক দেখান। আর অন্যজন আর একটা বাবা। যিনি বাড়িতে কড়া শাসন করেন। আমার কিন্তু সেই সমস্যা হয়নি। বাবা নিজের অদম্য ইচ্ছার জোড়ে লুকিয়ে ম্যাজিক শিখেছেন। আমায় কিন্তু তা করতে হয়নি। আমার তো জন্মই স্টেজে বলা যায়। লাইট, ঝলমলে পোশাকের মধ্যে। এমনও দিন গেছে বাবা শো করছেন। আমরা পুরো পরিবার সেখানে হাজির। পরীক্ষার পড়া সেই স্টেজের পাশে বসেই সেরেছি।’ মুমতাজ বলে চললেন।

‘আমি কিন্তু পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিলাম না। স্কুলে পড়া ছাড়া আর সব করতাম। সত্যি কথা বলতে কি, পড়ার চেয়ে বক্সিং বা রোয়িং-এ আমার অনেক বেশি উৎসাহ ছিল। বক্সিং কে তো আমি রীতিমত পেশাদার খেলোয়াড় হিসাবে নিই। ওই বক্সিং জানি শুনেই তো দেবলীনা আমায় ডেকেছিলেন। আর ভাল লাগে নাচতে। নাচ আমার ভীষণ প্রিয়’।

কিন্তু এই মুহুর্তে মুমতাজকে সকলে চেনেন অভিনেত্রী হিসাবে। তাই অভিনয় জগতে প্রবেশের কথাটায় ফিরে এলাম। ‘দ্বিতীয় মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করার সময় সেই ভিডিওতে আমার অভিনয় চোখে পড়ে মুম্বইয়ের স্ক্রিপ্ট রাইটার সৌমিক সেনের। তিনি আমায় প্রথম সিনেমা করার অফার দেন। সৌমিক সেন তখন নিজের একটা বাংলা ছবি করছিলেন। সিনেমার নামটা ছিল ‘নো প্রবলেম।’ প্রীতিশ নন্দী প্রোডাকশনের। দারুণ ছবি। তবে দুঃখের কথা সিনেমাটা শেষ হলেও তা এখনও কোনও একটা কারণে রিলিজ করেনি। কিন্তু ওই সিনেমাটায় অভিনয় করার পরপরই দ্বিতীয় ছবির অফারটা পাই চিন্ময় রায়ের কাছ থেকে। চিন্ময় আঙ্কল তখন ‘একবার বলো উত্তম কুমার’ বলে একটা সিনেমা করছিলেন। দারুণ স্ক্রিপ্ট। তবে ওই সিনেমাটাও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। সেই অর্থে হলে প্রকাশ পাওয়া আমার প্রথম ছবি ‘জিরো থ্রি থ্রি।’ সেখানে অভিনয় করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। কাজের সময়ে অনেকে আমায় সাহায্যও করেন। তাঁদের কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তারপরে চান্স পাই ‘শুধু তোমাকে চাই’ বলে আর একটা সিনেমায়। এরপর এক এক করে সিনেমায় চান্স পেতে থাকি। তবে এখনও আমি নতুন। কাজ করছি। শিখছি। তবে বাছাই করে কাজ করি। অফার অনেক আসে ঠিকই, তবে সব নিই না। বছরে চার থেকে পাঁচটা ছবি। ‘মুসলমানির গল্প’ সিনেমায় তো নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টাতে হয়েছিল। একদম একটা গ্রামের মেয়ের চরিত্র। চেষ্টা করেছিলাম তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে নিজের পুরোটা নিংড়ে চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলার’।

আচ্ছা, অনেকে বলে তোমার আর সাহেবের জুটিটা নাকি দারুণ মানায়? প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেললেন মুমতাজ। ‘হ্যাঁ, আমিও শুনছি। দেখুন কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, সব অভিনেতা অভিনেত্রীই চান একটা জুটি হোক। ফলে জুটি হলে ভালই। কিন্তু আমি এখন কতজনের সঙ্গেই বা অভিনয় করেছি, যে এত তাড়াতাড়ি বলে দেওয়া যাবে সাহেবের সঙ্গে আমার জুটিটা ভাল মানিয়েছে? আরও কয়েকজনের সঙ্গে অভিনয় করি, তবে তো মানুষ বিচার করে দেখতে পারবেন, কার সঙ্গে আমার জুটি সবচেয়ে বেশি জমে।’ কথায় কথায় একটা কথা কিন্তু সাফ করে দিলেন টলিউডের এই উঠতি নায়িকা। টেলিভিশন এখন একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ালেও, এখনই তিনি ছোট পর্দায় পা রাখার কথা ভাবছেন না।আপাতত সিনেমাটাই মন দিয়ে করতে চান। তাঁর মতে, দুটো একসঙ্গে করতে গেলে কোনটাই হবে না।

আপাত দৃষ্টিতে খোলামেলা স্বভাবের হাসিখুশি এক ট্রেন্ডি তরুণী। কিন্তু সাক্ষাৎকার শেষে তিনি যেভাবে জীবন দর্শনের কথাগুলো বললেন তাতে তাঁকে সমীহ না করে উপায় নেই। ‘আমার মনে হয় সব মানুষেরই নিজের ইচ্ছাটাকে পুরো করা উচিত। ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে লাভ নেই। নিজের ইচ্ছাকে রূপায়িত করতে প্রয়োজনে সব দরজায় কড়া নাড়ো। কোনও একটা দরজা খুলবেই। জীবনে সফল হওয়ার শর্টকাট বলে কিছু হয়না। ধৈর্যই মানুষকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে দিতে পারে।’ মুমতাজের কথা শেষ। এক সুন্দরী তরুণীর আগামী দিনের সাফল্যটা আমার মনে হল আমি চোখের সামনে এখনই দেখতে পাচ্ছি। বেস্ট অফ লাক, মুমতাজ!

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *