Celeb Talk

যখন বাজিল মুরলী রবি শান্তিবনে

রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকটা পুরনো ওয়াইনের মত। ও যত পুরনো হবে তত তার কদর বাড়বে। আসলে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকেন মনোজ মুরলীদের গলায়, সুরে, গানে।

লতায় পাতায় বাংলা ভাষার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। বাবা-মা দু’জনেই কেরালিয়ান। তবু কোনও অ্যাডমিশন টেস্ট ছাড়াই ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগটা যেন ভাগ্য পাইয়ে দিয়েছিল। হয়তো যাঁদের জন্মই রবীন্দ্রনাথের জন্য তাঁদের এমনভাবেই ভাগ্যদেবতা সুযোগ পাইয়ে দেন। আর তেমন ভাবেই শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র আবহে প্রবেশ এই মুহুর্তে বাংলার প্রথম সারির রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনোজ মুরলী নায়ারের।

শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ তো পাওয়া গেল। কিন্তু ভাষা? তাকে কি করে ম্যানেজ করবে ছোট্ট ছেলেটা। শুরু হল বাংলা শেখার লড়াই। বাংলা শিখতে রীতিমত পরিশ্রম করতে হয়েছে। নিজের মুখেই স্বীকার করলেন মনোজ। তবু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে ভাষাটা ধীরে ধীরে রপ্ত হতে শুরু করল। সৌম্য চেহারা, মিষ্টি হাসি, মার্জিত কথা আর বাংলা ভাষাটা বলার ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে নৈপুণ্য। সাক্ষাৎকার নিতে বসে নিজেই কেমন যেন মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। সুন্দর স্বভাবের মানুষটি কৌতুকের হাসি হেসেই বললেন, ‘শান্তিনিকেতনে কোরিয়ান, জাপানিরা বাংলা বলে, আর আমি তো ভারতের এক প্রান্তের মানুষ। বাংলা শিখতে পারব না! বাংলাটা না জানলে যে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করা থেকেই বঞ্চিত হতে হত।’


আকর্ষণীয় খবর পড়তে ডাউনলোড করুন নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

‘শান্তিনিকেতনের শিক্ষাটাই অন্য রকম। প্রকৃতির মাঝে বসে, তাকে সামনে থেকে উপলব্ধি করে শিক্ষা। সাহিত্য তো বুঝলাম, এমনকি বিজ্ঞান, ইতিহাস যে বিষয়ের কথাই বলুন, প্রকৃতিকে সামনে রেখে সেটা নিয়ে পড়াশোনা করার একটা অন্য সুবিধা আছে। আর তা পড়াশোনার সময় আমরা অনুভব করেছি।’ বললেন মনোজ। ‘আর ছিল গান। যখন তখন যেখানে সেখানে শান্তিনিকেতনের আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথের গান। সবচেয়ে বেশি চলে ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি। বসন্ত এলে সবাই গেয়ে ওঠে ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে …’।  অথবা শীতের পরশ গায়ে মেখে, ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন…’।

‘শান্তিনিকেতনে গান শিখতে হয় না। এমনিই গান বের হয়। আবহটাই এমন। আর আছে চোখের সামনে প্রতিমুহুর্তে প্রকৃতির খেলা দেখে গান গাওয়া। আমলকির পাতা ঝরা আমরা চোখের সামনে দেখতাম, পলাশ বনে রোদ পড়ে সত্যিই মনে হত যেন পলাশ বনে আগুন লেগেছে। এসব আমরা চোখের সামনে দেখে গান শিখেছি। আজকাল কাউকে শেখাতে গেলে সেই গল্প বলি বটে। কিন্তু দেখানোর সুযোগ পাই কোথায়’!

‘ছোটবেলায় বাড়িতে একটা নাচের পরিবেশ ছিল। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন নৃত্যশিল্পী। বাবার কাছে ছোটবেলায় কিছুটা নাচও শিখেছি। মায়ের ছিল কঠোর অনুশাসন। গান শেখার ব্যাপারে মায়ের উৎসাহ ছিল। আমাদের তিন ভাইবোনকে প্রত্যেকদিন নিয়ম করে সন্ধ্যা ছ’টা বাজলে তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসতে হত। কোনও দিন বাদ যেত না।’ পড়াশোনাটা ছোটবেলা থেকেই তেমন পছন্দের ছিলনা। বরং গানের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ ছিল মনোজের। ‘তা দেখে অলোক কুমার চট্টোপাধ্যায় নিজেই এসে বাবা-মা কে বলেন তিনি আমাকে গান শেখাতে চান। প্রথাগত তালিমের সেই শুরু। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যাকে বলে তাই। গুরুজি শুধু শেখাতেনই না, এমনভাবে শেখাতেন যে দুনিয়া থেকে সেসময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু গানের জগতে বিভোর হয়ে থাকতাম।’ মনোজের মতে, ‘একজন গুরুর সেটাও একটা বড় দায়িত্ব’।

শান্তিনিকেতনের আবহ আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা, দুটো মিলেই তাঁর একজন পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হয়ে ওঠা। নিজেই বললেন মনোজ। তবে স্কুলে পড়াকালীন এমন একটা সময় এসেছিল যে মনোজ ঠিকই করতে পারছিলেন না গান শিখবেন না নাচ। বরং একসময়ে দুটোই শিখবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাবার তাতে মত ছিল না। তিনি মনোজকে বোঝান একসঙ্গে দুটো হয়না। যেকোনো একটা জিনিস ভাল করে শেখ। দুটো শিখতে গেলে কোনও কিছুই হবে না। তখন পায়ে কিছুটা সমস্যা ছিল। আর নাচে কায়িক পরিশ্রম আর পায়ের জোর দুই লাগে। তাই সবদিক ভেবে গানটাই ভাল করে শেখার সিদ্ধান্ত নেন আজকের মনোজ মুরলী নায়ার। তবে গানকে পেশা করতেই হবে। ভাল গাইতেই হবে। এমন ভাবে কোনও দিন ভেবে দেখেন নি। গান ভালবেসে গেয়েছেন। আজকালকার র‍্যাট রেসে যে তাঁর ঘোর আপত্তি আছে তা বেশ বুঝতে পারলাম।

শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন রবীন্দ্রনাথের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পড়ল। ওই বছরটাকে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে পালন করা চলছিল। তো সেই সময়ে ইংল্যান্ডে একটা অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে বাছাই কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয় শান্তিনিকেতন থেকে। ভাগ্যক্রমে সেই দলে জায়গা পান মনোজ। ইংল্যান্ডে সেই সময় ‘চণ্ডালিকা’ মঞ্চস্থ হয়। আর তাতে একজন শিল্পী হিসাবে ছিলেন মনোজ। ‌যেহেতু নৃত্যনাট্য তাই শিল্পী হিসাবে নাচ, গান দুটোই সমান পারদর্শিতায় ফুটিয়ে তুলতে হয় মনোজকে। আর তাতে বেশ সাফল্যের সঙ্গেই পাস করেন তিনি।

তবে সেই পর্যন্তই। স্কুলে পড়ার সময় যা রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা। তারপর ফের রবীন্দ্রসঙ্গীতে ফেরা ২০০০ সালে, কলকাতায় বাংলা সঙ্গীত মেলায়। তবে চোখে পড়া যাকে বলে তা সেই সময়ে রবীন্দ্র সদনে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে। চারটে রবীন্দ্রসঙ্গীত সে সময়ে ভাগ্যের চাকাটা মুহুর্তে ঘুরিয়ে দেয়। প্রচার পান। পান পরিচিতি। একজন অবাঙালী হয়ে এত সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াটা আরও বেশি করে মানুষের মনে দাগ কেটেছিল।

২০০১ সালে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ। ‘আমি দখিন পবন।’ বোন মনীষাকে সঙ্গে করে গান গাইলেন মনোজ। তবে প্রথম অ্যালবামেই যে বাজিমাত তা মানতে নারাজ মনোজ। অ্যালবামটা কিছু কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল। বেশ কিছু একক স্টেজ শো। বোনকে সঙ্গে করে সেই স্টেজ শোগুলোই ধীরে ধীরে তাঁকে নামজাদা শিল্পীর মর্যাদা দিতে শুরু করে। সেসময়ে যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া কেবল খোলা গলায় একটা তিনঘণ্টার রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান তাঁদের খ্যাতির দুনিয়ায় একটা জায়গা করে দেয়। সকলের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে নাম। এখন মনোজ-মনীষার খ্যাতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। একবাক্যে প্রথিতযশা শিল্পী। শতশত স্টেজ শো করতে হয়। তবে হাসতে হাসতে বললেন, ‌’জানেন আমার চেয়ে আমার ভাই এক সময়ে অনেক ভাল গান গাইত। স্টেজেও ভীষণ সাবলীল ছিল। ও গান গাইতে উঠলে সবাই খুশি হত। কিন্তু আমি বা বোন গাইলেও, ওই এখন গান থেকে অনেক দূরে’।

সরাসরি না বললেও ব্যান্ডের গান নিয়ে বেশ একটা অ্যালার্জি আছে মনোজের। বেশ কটাক্ষের সুরেই বললেন, ‘ব্যান্ডের গান একটা সাময়িক উত্তেজনা। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই চুমুক যাতে ঠোঁট রাখতে রাখতে একটা মানুষ জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।’ প্রশ্ন করলাম, ‌’যেসব অনুষ্ঠানে আপনার সঙ্গে ব্যান্ডের গানও থাকে সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার আগ্রহ শ্রোতাদের থাকে’? একটু নড়েচড়ে বসলেন মনোজ। তারপর হেসে বললেন, ‘দেখুন, মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন। ধরুন একজন প্রতিদিন শুকনো রুটি খান। একদিন যদি তাঁকে বিরিয়ানি দেওয়া হয় তিনি কি খাবেন না? খাবেন! এটাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রাপ্তি।’

মনোজের বিশ্বাস নতুন প্রজন্ম সব ধরণের গানের সঙ্গে ফের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে ইয়ং জেনারেশনের ভিড় নজর কাড়ছে। আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকটা পুরনো ওয়াইনের মত। ও যত পুরনো হবে তত তার কদর বাড়বে। কথা প্রসঙ্গে একটা গল্পও বলে ফেললেন মনোজ।

‘কয়েকদিন আগেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখি রাস্তার ধারে কাঁধে একটা গিটার ঝুলিয়ে একটি কমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তা আমি কাছাকাছি আসতে সেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনিই মনোজ মুরলী নায়ার না’? উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ।’ ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ ভাবেই বলল, ‘আপনার গান আমার খুব ভাল লাগে, আপনার পরের শো কবে’? এত কম বয়সী একটা ছেলের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি টান দেখে বেশ ভাল লাগল। উত্তর দিলাম, ‘কলামন্দিরে আমার একটা শো আছে, তুমি আসবে’? ছেলেটি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ দেখুন, ও পরে শো দেখতে এসেছিল কিনা তা জনি না। হয়তো এসেছিল, হয়তো বা আসেনি। কিন্তু ওর উৎসাহটা আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল’।

মনোজের মুখে একটা প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আসলে রবীন্দ্রনাথও বেঁচে থাকেন মনোজ মুরলীদের গলায়, সুরে, গানে। এঁদের মত শিল্পীদের জন্য মানুষ এই র‍্যাট রেসের জামানাতেও প্রাচ্য, পাশ্চাত্য একাকার হয়ে যাওয়া গানের বৃহত্তর জগতে আলাদা করে রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসেন। তাঁর গান শোনেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে নিজেদের ছোট ছোট অবসরগুলোকে প্রাণরসে ভরিয়ে তোলেন। মনোজ মুলরীদের মত মানুষের কাছে এতদিনের অধ্যবসায়ের এটাই বোধহয় পরম প্রাপ্তি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *