Celeb Talk

জীবন পথের পথিক এক ‘নির্বাক কবি’

তাঁকে নিয়ে সরকার তথ্যচিত্র বানিয়েছে। ‘সাইলেন্ট আর্ট অফ যোগেশ দত্ত’। ২৪টি ভাষায় সেই তথ্যচিত্র তৈরি হয়। এই তথ্যচিত্র দেশের এক বিরল সম্পদ।

‘তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। গ্রামে দেখতাম মেয়েরা নিজেদের হাতে ছুঁচ ফুটিয়ে রক্ত বের করে তা দিয়ে দাদাদের টিকা পরিয়ে দিত। তেমনই এক স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদার কাছে প্রথম একটা বন্দুক দেখেছিলাম। একদিন গ্রামে পুলিশ এল। সবাই তো তটস্থ। কয়েকজন পালানোর উপক্রম করলে। আমি তখন ছোট। যে দাদার কাছে বন্দুক ছিল সে সঙ্গের বন্দুকটা নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেলে দিল কচুরিপানা ভরা পাশের পুকুরে। পুরো ব্যাপারটাই আমার চোখের সামনে হয়েছিল। এদিকে গ্রামে তখন পুলিশের সঙ্গে একজন কোট পরা লোক এসেছিল। এসে জিজ্ঞেস করলে, এখানে বন্দুক কার কাছে আছে। সবাই চুপ। আমি এগিয়ে এসে বললাম আমি দেখেছি বন্দুক কোথায় আছে! ওই কোট পরা লোকটা তখন আমায় বেশ আদর করে কাছে ডেকে নিয়ে জানতে চাইল কোথায় দেখেছি। দেখিয়ে দিলাম পুকুরটা। সত্যিই পুকুর থেকে সেই বন্দুকটা পাওয়া গেল। মনে আছে, ওই লোকটা চলে যাওয়ার পর গ্রামের দাদারা আমায় ওই পুকুরেরই জলে খুব করে চুবিয়েছিল। সবাই বলল, ‘বল আর কখনও এভাবে পুলিশের কাছে সত্যি বলবি না।’ আমি না বললাম। বুঝলাম সত্যি কথা বলার অনেক বিপদ আছে।’

কথাগুলো বলার সময় গলাটা মাঝে মধ্যে কেঁপে যাচ্ছিল। না, কষ্টে নয়। বয়সের ভার আর স্মৃতির অতলে ডুব দেওয়া বিভোর মন, দুয়ে মিলে ওই বৃদ্ধকে তখন নিয়ে গেছে সেই বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। নিজের জীবনের কথা এত গুছিয়ে, এত যত্ন করে, এত হৃদয় দিয়ে বলতে খুব কমই দেখেছি। নিজের শিল্পে কখনও কথা বলেননি। অথচ অঙ্গ ভঙ্গিমায় কত কথাই তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বলে বেড়িয়েছেন। তারিফ পেয়েছেন। সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু সেদিন ছোটবেলার কথা জানতে চাওয়ার পর বেশ বুঝলাম এই বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর অন্তরে এখনও লুকিয়ে আছে সেই ছোট্ট ভোলা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই চালানো সেই ভোলা। ‌যাঁকে আজ সবাই চেনেন স্বনামধন্য মূকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্ত নামে।


আকর্ষণীয় খবর পড়তে ডাউনলোড করুন নীলকণ্ঠ.in অ্যাপ

পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর সাব ডিভিশন। এখানেই বয়ে গেছে মুসলমান ফকির আরিয়াল খাঁ‍র নামে নদী। সেই নদীর পাড়েই প্রকৃতির বুকে জন্ম যোগেশ দত্তর। জন্ম দেওয়ার পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে সদ্যজাতকে ফেলে মাকে নিয়েই সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে ভুলেই গিয়েছিলেন যে এক শিশু পুত্র জন্ম নিয়েছে এই পৃথিবীর বুকে। জন্মের পর সকলে ভুলে গিয়েছিল বলে তাঁর নাম হয়ে যায় ভোলা। একরকম অবহেলায় প্রকৃতির বুকে বড় হয়ে ওঠা এই ভোলা প্রথম অ-আ-ক-খ লেখা শিখেছিল তালপাতার ওপর। তারপর পাঠশালায় ভর্তি হল। হাতে এল স্লেট। স্লেটে মোছা যায়। ফের লেখাও যায়। অবাক করত তাঁকে। কিন্তু পাঠশালা বা স্কুলে পড়া তাঁর কোনোদিনই পছন্দ ছিল না। নামতা পড়া শেষ হলে পাঠশালায় ছুটি হত। সে কি আনন্দ! ছোট্ট ভোলা তখনি ছুট লাগাত মাঠেঘাটে, আমবাগানে। প্রকৃতির কোল তাকে এক অনাবিল আনন্দ দিত। সে আনন্দ মুখে প্রকাশ করা যায় না। লিখে বোঝানো যায় না।

যেদিন ভারত স্বাধীন হল সেদিন রাতে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু তাঁদের পরিবারে আনন্দ নেই। চোখে ঘুম নেই। সকলের চোখ এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে সেদিন নৌকা ধরে ছোট্ট ভোলা পরিবারের হাত ধরে এসে হাজির হল গোয়ালনন্দপুর স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে একটা ভিড়ে ঠাসা ট্রেন ধরে কোনোক্রমে যখন শিয়ালদা স্টেশনে এসে নামল তখন সেখানে ভিড় থিকথিক করছে। বাবা একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে আনলেন। সেই গাড়িতে সার্পেনটাইন লেনের একটা ছোট্ট ঘরে এসে উঠল পুরো দত্ত পরিবার। গোয়ালঘরের চেয়েও ছোট সেই ঘরেই সংসার পাতা হল। কাছে পুরসভার একটা স্কুল ছিল। শশিভূষণ দে স্কুল। সেখানেই ভর্তি হলেন যোগেশ দত্ত।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের জন্য মন কেমন করতে শুরু করল। একাই চলে গেলেন নিজের গ্রামে। তারপর সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফের কলকাতা। যোগেশ দত্তর বাবার শিয়ালদায় আসবাবপত্রের দোকান ছিল। ততদিনে সার্পেনটাইন লেনের ছোট ঘর ছেড়ে কাছের শাস্ত্রী লেনে বড় ঘর নেওয়া হয়েছে। সেখানেই বাবা-মা ভাই বোন সকলের সঙ্গে থাকত ছোট্ট ভোলা। সুখে দুঃখে চলছিল। কিন্তু তাও বেশিদিন চলল না। মাঝে মাঝে গ্রামের কথা মনে পড়লে সেখানে চলে যেত সে। তেমনই একবার সেখানে গেছে। হঠাৎ খবর এল বাবা মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর সকলে পূর্ববঙ্গে মামার বাড়ি চলে গেল। সেখানেই বাবার শ্রাদ্ধের তিনদিন পর মায়েরও স্ট্রোক হল। মাও চলে গেলেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনেরই মৃত্যুর শোক গ্রাস করল সেদিনের ভোলাকে।

এরপর মামার বাড়িতেই থাকা। কাছের একটা স্কুলে পড়া। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি তাকে কোনও দিনই টানেনি। একদিন কি মনে হল ভোলা হাজির হল বেলুড় মঠে। সেখানে সেদিন খুব ভিড়। হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধিটা চাগাড় দিল। অনুসন্ধান অফিসে গিয়ে বলল, ‘আমি ভোলা দত্ত, আমার ভাই যোগেশ দত্ত হারিয়ে গেছে।’ অনুসন্ধান অফিস থেকে মাইকে বলা শুরু হল, ‘যোগেশ দত্ত তুমি যেখানেই থাক, তোমার ভাই ভোলা দত্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ এসব দুষ্টুমি করে বেজায় মজা পেত ছোট্ট ভোলা। তো সেদিনই একটি ছেলে নতুন কাবলি জুতো ছেড়ে বেলুড় মঠের ভেতরে ঢুকেছে। সেটা নজরে পড়ল তার। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের পুরনো জুতো রেখে সেই নতুন জুতোটা পায়ে গলিয়ে গুটিগুটি পায়ে বাড়িতে চলে এলেন যোগেশ দত্ত। কিন্তু মামাদের চোখ এড়াল না বিষয়টা। শাস্তি হিসাবে সেই জুতোই দমাদ্দম পড়ল পিঠে।

মামার বাড়িতে থাকতেন বটে কিন্তু সেখানে ছোট্ট ভোলার মন বসত না। একদিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তা দেখে মামাতো ভাই এসে খুব মারল। রাগে, অভিমানে পরদিন ভোর হওয়ার আগেই সকলের অলক্ষ্যে মামার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন তিনি। তারপর হাওড়া স্টেশনে গিয়ে একটা ট্রেনে উঠে জানলার ধারে বসে আছেন। ট্রেন ছেড়েছে। কোথায় যাবেন ঠিক নেই। সামনে বসা এক ভদ্রলোকের বোধহয় কিছু মনে হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসা হচ্ছে। ছোট্ট ভোলা বলল পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তিনি ছোট্ট ছেলেটাকে খাওয়ার জন্য একটা টাকা দিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট চেকার এসে হাজির। ভোলার কাছে টিকিট নেই। নামিয়ে দিল রামপুরহাট স্টেশনে।

পথেঘাটে ঘুরতে ঘুরতে ততদিনে বেশ কিছুটা চালু হয়ে গেছে ছোট্ট ভোলা। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বললে, তার বাবা-মাকে পূর্ব পাকিস্তানে কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সে কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছে। তার একটা কাজ চাই। চায়ের দোকানে কাজটা জুটে গেল। চায়ের কাপ-ডিশ ধোয়ার কাজ। এবার একটু হেসে আমার দিকে চেয়ে যোগেশবাবু বললেন, ‘জানেন চায়ের দোকানে যদি কেউ দুমাসও কাজ করে তো সে চালু হয়ে যাবে’।

এখানে কিছুদিন কাজ করার পর একটা হোটেলে কাজ পেল ভোলা। সেখানে এক অধ্যাপকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। সেই অধ্যাপক তাকে রাতে পড়ানো শুরু করেন। এর কিছুদিন পরে একটা মুদির দোকানে কাজ জুটে গেল। সেখানে ভোলা এক আজব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল। মুদির দোকানের মালিক তাকে শেখাল সব কিছুতে কিভাবে ভেজাল মেশাতে হয়, কিভাবে ওজনে মারতে হয়। তার চেয়েও বড়কথা, মালিক না থাকলে তার অন্য এক কর্মচারী ক্যাশ থেকে টাকা সরাত। ভোলার মনে হল এভাবে কোনদিন সেই চুরির দায়ে পড়বে। অগত্যা সেই চাকরিও ছেড়ে দিল সে। যোগ দিল এক কনট্রাক্টরের কাছে। তবে সেখানেও বেশিদিন নয়। এবার পঞ্চুবাবুর টেলারিং-এর দোকানে চাকরি। সেখানেও লোক ঠকানো তাকে হতাশ করল। সেখান থেকে বড়বাজারে পাল্লা বাঁধার একটা কাজ জুটে গেল। সেই সঙ্গে চলল মণিমালা। সঙ্গে স্কিড করা। আর জীবনে চলার পথে এমন পরতে পরতে অভিজ্ঞতার কাঁধে ভর করে ছোট্ট ভোলা নিজের অজান্তেই কৈশোর পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন যুবা বয়সে।

এমনই একদিন অবসর সময়ে লেকের ধারে বসে আছেন তিনি। দেখছেন দূরে বসা মানুষজন নিজেদের মধ্যে কত কথা বলছে। কারো আওয়াজ শোনা না গেলেও, অঙ্গভঙ্গি দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন তাঁরা কি বলছেন। এখান থেকে একটা আইডিয়া খেলে গেল তাঁর মাথায়। আচ্ছা, এভাবে কথা না বলে কেবল অঙ্গভঙ্গি দিয়ে, নির্বাক কৌতুক শুরু করলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমন কাজ। হাওড়ায় একটি অনুষ্ঠানে প্রথম এই নির্বাক কৌতুক দেখালেন যোগেশ দত্ত। একটি মেয়ে আয়নার সামনে বসে কিভাবে চুল আঁচড়ায়, সাজগোজ করে সেটাই অঙ্গভঙ্গি দিয়ে সকলের সামনে তুলে ধরলেন তিনি। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথম প্রচেষ্টাতেই বাজিমাতও করলেন যোগেশ দত্ত।

এই সময়ে তাঁর শো দেখে লন্ডন থেকে আসা অরুণ বসাক নামে এক ভদ্রলোক তাঁকে বললেন, তুমি যাকে নির্বাক কৌতুক বলছ, ইউরোপে তা নিয়ে আন্দোলন চলছে। যোগেশ দত্ত বুঝলেন তাঁর শিল্প হেলা ফেলার নয়। ‌যাইহোক, খুব অল্প সময়ে মধ্যেই যোগেশ দত্তর নির্বাক কৌতুকের বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ল। এই সময় ‌যুবসংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে টেনে নিল। ‌যুবসংঘের হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শো করতে হত তাঁকে। রোজগারও হতে শুরু করল।

একবার ইডেনে একটা বড় শো হচ্ছে। ভি বালসারা বাজানোর পর নাম ঘোষণা হল যোগেশ দত্ত’র। কিন্তু অত গুণী শিল্পীর ভিড়ে তাঁর নির্বাক কৌতুক কেউ দেখতে রাজি নন। শোর উঠল চাই না, চাই না। যোগেশ দত্তর দিকে জুতো ছুঁড়তে শুরু করলেন দর্শকরা। সেইসব জুতো এক জায়গায় করে হাত জোড় করে যোগেশ দত্ত বললেন, আমাকে একটা সুযোগ দিন। যদি খারাপ লাগে আমি নিজে গিয়ে আপনাদের জুতো আপনাদের হাতে পৌঁছে দেব। আপনারা আমায় যত ইচ্ছে জুতো পেটা করবেন। সেদিন এক বেকার যুবকের জীবন করে দেখালেন যোগেশ। সে চরিত্রে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন যে অভিনয় শেষ হওয়ার পর স্টেজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি। পরে যখন জ্ঞান ফিরল তখন দর্শকদের হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই হাততালির গুঞ্জন এখনও তাঁর কানে বাজে। সেই দিন আজও ভুলতে পারেননি এই বিশ্ববরেণ্য শিল্পী। তাঁর মতে দেশে বিদেশে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু সেদিনের সেই হাততালিটাই ছিল তাঁর কাছে আজ পর্যন্ত পাওয়া জীবনের সেরা পুরস্কার।

যুবসংঘের হয়ে শো করতেই প্রথম প্লেনে চড়া। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল সবকিছু। হাসতে হাসতে বললেন, ‘সেদিন প্লেনে‌ টয়লেটে যাইনি। কেন জানেন? যদি নিচে কারও গায়ে পড়ে! সেবার শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠান করেছিলাম। মনে আছে, অনুষ্ঠানের পর জীবনে প্রথম অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। এরপর একদিন শুনলাম বিদেশে শো করতে যেতে হবে। তো তার আগে একদিন আমার শো দেখতে জাদুকর পি সি সরকার এলেন। শোয়ের পর বললেন, ‘তুমি বিদেশে শো করতে যাবে। সেখানে তোমার মধ্যে ভারতকে খোঁজার চেষ্টা করবে সকলে। তাই সে কথা মাথায় রেখে শো কোর।’ পি সি সরকারের সঙ্গে কথা বলার পর নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে সারা ভারত ঘুরলাম। বিভিন্ন শিল্প দেখলাম। এরপর বিদেশে শো করতে যাওয়া। সোফিয়ায় শো। সেখানে করলাম ‘বার্থ অফ ডেথ।’ প্রথম হয়েছিলাম। শোয়ের শেষে ভারতের জাতীয় সংগীত বেজে উঠল। আমার কীর্তিতে সেদিন বিদেশের বুকে জাতীয় সংগীত বেজে চলেছে। তখন খুব বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছিল। কুলাঙ্গার ছেলে ছিলাম তো। এই দিনটা দেখলে হয়তো তাঁরা কিছুটা শান্তি পেতেন। কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা কান্নায় কেঁপে উঠল মূকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্ত’র। দেখলাম জলে ভিজে গেছে তাঁর দুটো চোখ। নিজেকে সামলে নিতে একটু থামলেন ‌যোগেশবাবু। আমিও কথা বললাম না।

‘এরপর চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলো দেখলাম। বার্লিনে একটা অনুষ্ঠানে সামনে অদৃশ্য কাচের দেওয়ালে হাত রাখার অভিনয় করে প্রথম হলাম। এরপর বিদেশের বহু জায়গায় শো করেছি। বাহবা পেয়েছি। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একটা জমিও পেলাম। সেখানে তৈরি করলাম একটা মাইম অ্যাকাডেমি। মূকাভিনয়ের কোনও সিলেবাস ছিল না। প্রথাগত তালিমের ব্যবস্থা ছিল না। নতুন প্রজন্মকে এই শিল্পে প্রথাগত তালিম দেওয়ার জন্য সিলেবাস বানালাম। এক সময়ে পয়সার অভাবে মার্সেল মার্সোর শো দেখতে যেতে পারিনি। কিন্তু সেই মার্সেল মার্সো এই যোগেশ দত্ত মাইম অ্যাকাডেমির স্টেজে এসে শো করে গেছেন। রবীন্দ্রভারতীতেও কিছুদিন ক্লাসও নিয়েছিলাম। কিন্তু মতের মিল না হওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে দিই।’ মনে আছে, বিশেষ প্রশ্ন করিনি। ‌যোগেশবাবু নিজেই এসব কথা একটানা বলে গেলেন আমাকে। নির্দ্বিধায়, নিরলসভাবে, এতটুকুও বিরক্ত না হয়ে।

তাঁকে নিয়ে ভারত সরকার একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছে। ‘সাইলেন্ট আর্ট অফ যোগেশ দত্ত’। ২৪টি ভাষায় সেই তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। এখনও এই তথ্যচিত্র দেশের এক বিরল সম্পদ। জীবনের এতগুলো দিন কাটিয়ে এখন এই বিশ্বখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী বৃদ্ধ হয়েছেন। প্রতিটি মুহুর্তে জীবনের সঙ্গে কঠিন লড়াই আর সাফল্য, দুটোই তিনি বড় কাছ থেকে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। তাই আজ একটু হলেও তিনি ক্লান্ত। এখন অবসর জীবনে তাই আর লড়াই নেই। খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস তাঁর। তারপর ভোর পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত শোনা। বেলা বাড়লে খবরের কাগজ পড়া। অ্যাকাডেমির কিছু টুকটাক কাজ। তবে স্বপ্ন দেখা এখনও ছাড়েননি তিনি। বোড়ালে একটা জমি কেনা আছে। সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটা মাইম অ্যাকাডেমি গড়ে তোলাই তাঁর আপাত লক্ষ। সাক্ষাৎকারের শেষ লগ্নে পৌঁছে একটা কথা বলেছিলেন এই জীবন পথের পথিক। যা বোধহয় নিজের জীবনে কখনও ভুলতে পারব না। ‘জীবনে সাফল্যের জন্য স্ট্রাগলের কোনও বিকল্প হয় না।’ নির্বাক কবি-র এই জীবনবোধ কোনও বইয়ের পাতার থেকে আহরণ করা জ্ঞান নয়। এই একটি লাইন আসলে তাঁর সারা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের অভিজ্ঞতাকে মন্থন করে তার থেকে বেরিয়ে আসা এক নিখাদ মৌলিক নির্যাস।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *